Saturday 4 November 2017

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা
# কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা 

উৎসবের দিনে ঘরে বসে থাকা দায়, অষ্টমীর রাতেই ভাবছিলাম ঘুরে এলেই হয় কাল যখন ছুটি আছে। আর কালই তো মহা নবমী, আর তার পরেই তো সেই বিষাদের দিন দশমী, আর আমার ছুটিও নেই যে বিসর্জন দেখা যাবে। অতএব এই সবেধন নীলমণি একদিন ছুটিতেই ঘুরে আসতে হবে, যাবার প্ল্যান করতে গিয়ে মনের কোণে উঁকি দিয়ে গেলো আর এক ঐতিহ্যের শহরের কথা, যেখানে এই জগদ্ধাত্রী পূজা হয় একদিনই, নবমীর পুন্য তিথিতে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন আমি কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যমণ্ডিত জগদ্ধাত্রী পুজার কথাই বলছি। চন্দননগরের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই এখানকার জগদ্ধাত্রী পুজার সাথে পরিচিত, কিন্তু কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যমণ্ডিত জগদ্ধাত্রী পুজার কথা শুনেছি মাত্র, যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে নাই।

এবারে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় মোবাইল নিয়ে বসে গেলাম প্ল্যান-প্রগ্রাম বানাতে, রাতে উত্তেজনায় ঠিক ঘুম এলো না, বারবার যেন চোখের সামনে ভাসছিল ইন্টারনেটে দেখা কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ী, বুড়ি মা, আদি মায়ের নয়নাভিরাম প্রতিমাগুলি।

ধুসস ঘুম ঠিক না হওয়ায় ভোর ভোর উঠে ফ্রেশ হয়ে ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম, চুঁচুড়া থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার সহজ রাস্তা হচ্ছে ফেরী পার করে উল্টোদিকে নৈহাটি ঘাট গিয়ে, ওখান থেকে নৈহাটি ষ্টেশন থেকে কৃষ্ণনগরের জন্যে লোকাল ট্রেন ধরা। আমিও যথারীতি ফেরী ঘাটে গিয়ে টিকিট কেটে অপেক্ষা করতে লাগলাম ফেরী সার্ভিসের জন্যে, যথা সময়ে ফেরী এলো আর আমিও টুক করে উঠে পড়লাম, ভোরবেলা হওয়ায় বেশ ফাঁকাই ছিল, ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া মেখে গঙ্গার বুক চিরে এই জার্নি বেশ ভালই লাগলো। ওপারে এসে একটা রিকশাও ঠিক পেয়ে গেলাম, ট্রেনের টিকিট কেটে যখন প্ল্যাটফর্মে এলাম দেখি – ও হরি বেশ ভালই ভিড়, যাচ্চলে সবাই কি কৃষ্ণনগরের যাত্রী? কে জানে ট্রেনে বসার জায়গা পাবো বলে তো মনে হচ্ছে না। ভারতীয় রেল, সুতরাং নির্ধারিত টাইমের একটু পরেই হেলতে দুলতে এলো বহুকাঙ্খিত লোকাল ট্রেনটি, ধাক্কাধাক্কি খেয়ে ট্রেনে উঠে কোনোরকমে একটা সীট বাগালাম। মোটামুটি সওয়া এক ঘণ্টার জার্নি, আর এই লাইনে যেহেতু বেশী যাতায়াত নেই তাই চারপাশের দৃশ্য দেখতে ভালই লাগছে। ভিড় ভালই হয়েছে, কিন্তু কিভাবে জানিনা না সহযাত্রী দুজন নেমে যাওয়ায় জানালার পাশে সীট পেলাম, আর আমায় দেখে কে? কানে হেড ফোন, জানালায় মাথা আর সাথে ছুটে চলা আকাশ, কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে মানা কোথায়? সম্বিৎ ফিরল একজনের ডাকার আওয়াজে – বলি কোথায় যাওয়া হবে? তাকিয়ে দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, সাধারণ প্যান্ট শার্ট পরা, কিন্তু চেহারাতে আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। হেঁসে বললাম – এই কৃষ্ণনগর যাবো। ভদ্রলোক হেঁসে বললেন – জগদ্ধাত্রী ঠাকুর দেখতে?আমি বললাম – হ্যাঁ। উনি বললেন একাই যাচ্ছ? বাহ বেশ। তো বাড়ি কোথায়? চুঁচুড়াতে বাড়ি শুনে বললেন সেকি তোমাদের ওখানেই তো মেলা ধূমধাম, সেসব ছেড়ে হঠাৎ এদিক পানে? কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ীর পূজা দেখতে আগ্রহী শুনে খুশী হলেন বেশ, বললেন হম তো এই রাজবাড়ীর পুজার ইতিহাস কিছু জানা আছে? নাকি এমনিই যাচ্ছ? আমি বললাম – না কিছুটা বিভিন্ন্য পত্র পত্রিকা, নিউজ পেপারে পড়েছি। উনি হেঁসে বললেন তাই তো শোনাও দেখি আমায় সেই গল্প দেখি কেমন জেনেছ তুমি? আমি বললাম- আমি সবটা জানি না তবে যেটুকু জানি বলছি, দেখুন আপনাকে তৃপ্ত করতে পারি কিনা? যতদূর জানি পুজোর প্রচলন নিয়েও রয়েছে একাধিক কাহিনি, প্রচলিত কাহিনি অনুসারে নবাব আলিবর্দি খানকে একবার রাজকর দিতে না পারায় কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র, সালটা বোধহয় ১৭৫৪।

শোনা যায়, সময়টা ছিল দুর্গোৎসবের কাছাকাছি। নবাবের কারাগার থেকে অবশেষে তিনি যখন মুক্ত হয়েছিলেন তখন দুর্গোৎসব প্রায় শেষ। নৌকায় কৃষ্ণনগর ফেরার পথে রাজা বুঝলেন, সে দিন বিজয়া দশমী। সে বার পুজোয় উপস্থিত থাকতে না পারায় ক্লান্ত বিষণ্ণ রাজা নৌকার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। জনশ্রুতি সেখানেই কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেছিলেন যে এক রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কুমারী দেবী তাঁকে বলছেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে।” সেই থেকেই নবমী তিথিতে হয় এই জগদ্ধাত্রী পূজা। 

তবে অন্য এক কাহিনিও আছে - ইংরেজদের বন্ধু এই সন্দেহে ১৭৬৪ সালে মীরকাশিম মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রকে। শোনা যায়, মীরকাশিম নাকি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর দূত মারফত এই সংবাদ মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রাণ রক্ষার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। কারাগারেই কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীর স্বপ্নাদেশ লাভ করেন এবং কারাগার থেকে মুক্তিলাভের প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন। জনশ্রুতি, কিছু দিনের মধ্যেই তিনি সত্যি কারামুক্ত হয়েছিলেন।

এর পরেই কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে নিয়ে উপস্থিত হন মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে। কৃষ্ণচন্দ্র এই স্বপ্নের কথা জানান এবং জানতে চান কে এই দেবী? কালীশঙ্কর তাঁকে জানান, এই দেবী স্বয়ং চণ্ডী, প্রাচীন কালে এই দেবীর পুজোর প্রচলন ছিল। রাজা তখন জানালেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি এই দেবীর পুজোর আয়োজন করতে চান। এর উত্তরে কালীশঙ্কর জানান, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবীর পুজোর বিধান আছে। হাতে সময় কম থাকলেও কৃষ্ণচন্দ্র পুজোর সমস্ত আয়োজন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন পুজোয় পৌরোহিত্যের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। শোনা যায় কালীশঙ্কর রাজাকে যথাযথ সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

তবে, একটা সমস্যার কথা অনুমান করে কৃষ্ণনগরে না ফিরে সেখান থেকেই কৃষ্ণচন্দ্র সরাসরি গিয়েছিলেন চন্দননগরে তাঁর বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে। যাওয়ার আগে পুজোর সব দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে। তাঁরাই জগদ্ধাত্রী পুজোর সব আয়োজন করেছিলেন। আর বলেছিলেন, পুজোর আগের দিন রাত্রে তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরে আসবেন।

রাজপরিবারের কূলগুরু ছিলেন বৈষ্ণবাচার্য। তিনি নতুন এই শাক্ত দেবীর পুজোয় অনুমতি না দিলে পুজো করা সম্ভব হত না। তাই রাজা ঠিক করেছিলেন, পুজোর আগের দিন মধ্যরাত্রে কৃষ্ণনগরে ফিরবেন। আর পরের দিন সকালে অঞ্জলি দেবেন। তখন কূলগুরুর কোনও বাধাই কার্য্যকর হবে না।
ইতিমধ্যেই শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড় পুজোর সব আয়োজন করে রেখেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুজোর আগের দিন গভীর রাতে গোপনে কৃষ্ণনগরের প্রাসাদে ফিরে এসেছিলেন। এবং পর দিন সারা দিন উপবাসী থেকে পুজোয় অঞ্জলিও দিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হল রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো। গবেষকদের মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক। অনেকেই মনে করেন, পরের বছর থেকে চন্দননগরে পুজোর প্রচলন হয়েছিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে।

মোটামুটি এই হল আমার জানা কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজা শুরুর কথা, এর বাইরে আমার কিছু জানা নেই। ভদ্রলোক হেঁসে বললেন – না হে তুমি অনেকটাই জানো, আচ্ছা বল তো ইতিহাসের পাতায় কি উল্লেখ আছে এই জগদ্ধাত্রী পুজার? মাথা নেড়ে জানালাম না আমার ঠিক জানা নেই, আপনি যদি একটু বলে দেন ভাল হয়। শুনে উনি বললেন আমারও বিশেষ কিছু জানানেই, তবে এটুকু পড়েছি যে বাংলার পাল-সেন যুগের বিভিন্ন তন্ত্র গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রীর পুজোর। যেমন ‘মায়াতন্ত্র’-এ দেখা যায় - ‘প্রপূজয়েজগদ্ধাত্রীং কার্তিকে শুক্লপক্ষকে দিনোদয়ে চ মধ্যাহ্নে সায়াহ্নে নবমেহহন।’ এর অর্থ কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দিনের শুরুতে মধ্যাহ্নে এবং সায়াহ্নে জগদ্ধাত্রী পুজো করা যায়। বাহ কত সুন্দর তথ্য জানা গেলো ওনার দৌলতে, ওনার কাছেই শুনলাম জয়রামবাটিতে সারদা মা চালু করেন দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো, ছেলেবেলায় মা সারদা ছিলেন দেবীর ভক্ত। পরবর্তীকালে শ্রী শ্রী ঠাকুর একবার বলেছিলেন, ‘জগদ্ধাত্রীর মানে কী জানো? যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন। তিনি না ধরলে জগৎ পড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। মন্দকারীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে দেবী জগদ্ধাত্রীর উদয় হয়।’ তাই দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনায় তিন গুণের পুজো হয়। সপ্তমীতে স্বাত্ত্বিকী, অষ্টমীতে রাজষ্ট, নবমীতে তামষ্ট পুজো, আর যেখানে শুধু নবমীর দিনে পুজো হয় সেখানে সকালে, বিকেলে, সন্ধ্যায় ওই তিন গুণের উপাসনা হয়। ওনার কাছে আরও জানলাম দেবী জগদ্ধাত্রীর রুপ সম্বন্ধে - দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সিংহবাহিনী। তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। দেবীর গাত্রবর্ণ উদিয়মান সূর্যের ন্যায়। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর। ধ্যান বা স্তবমন্ত্রে উল্লেখ না থাকলেও জগদ্ধাত্রী প্রতিমায় বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, জগদ্ধাত্রী দেবী করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহাহস্তী রূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারণে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী নামে পরিচিত।

সত্যি কত কিছুই অজানা আছে, মানুষের সাথে মিশলে, আলাপ – আলোচনায় কত কিছু জানা যায়। একথা সেকথা বলতে বলতে বাইরে ষ্টেশনের দিকে তাকিয়ে বললেন – এইরে এবার গাড়ি তো রাণাঘাট ঢুকছে, আমায় নামতে হবে ভাই। তুমি যাও দেখে ঘুরে এসো, মা জগদ্ধাত্রী তোমার মঙ্গল করুন। বলে ভদ্রলোক রাণাঘাট ষ্টেশনে নেমে গেলেন, এতো গল্প হল, অথচও ওনার নাম, ফোন নাম্বার কিছুই নেওয়া হল না, অথচও বেশ গুণী লোক, ওনার সান্নিধ্য বেশ উপভোগ করছিলাম, এখন আবার সেই একলা। হেড ফোনে গান শুনতে শুনতে আর চারপাশের মানুষ দেখতে দেখতে কখন যে কৃষ্ণনগর ষ্টেশন এসে গেলো বুঝতেই পারলাম না, সত্যি মানুষ দেখার, আলাপ করার এই কুঅভ্যাস গেলো না দেখছি।

ষ্টেশনে বেশ ভিড়, কে জানে সবাই আমার মতন মাতৃ মূর্তি দর্শনের অভিলাষী কিনা? টোটো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে কিন্তু আমার পছন্দ হল সেই পুরাতন রিকশা কেই, ষ্টেশনের বাইরে এসে একটা রিকশাকে জিজ্ঞেস করাতে বলল – সব ঠাকুর টো দেখাতে পারবুনি তবে তোমায় নামকরা বেশ কিছু ঠাকুর দেক্ষে দেবো, এখুন চলতো বাপু, রাস্তায় যা জাম লেগেছে আর বলুনি।

রিকশা এগিয়ে চলেছে আপন তালে, আর আমি গ্যাঁট হয়ে বসে দেখে চলেছি চারপাশের দৃশ্য, কথায় কথায় জানতে পারলাম কাকার নাম নব কুমার বিশ্বাস, বাপ রে বাপ বঙ্কিম চন্দ্রের নব কুমার শেষে কৃষ্ণনগরে ভাবা যায় না? একটু বাদে রিকশা এসে দাঁড়ালো রাজবাড়ীর সিংহ দুয়ারের সামনে। কাকা বলল – যাও বাপু দেখে এসো, তবে বেশি সময় থেকুনি, এখনও বুড়ি মা যেতে হবে কিন্তু। ঘাড় কাট করে হ্যাঁ বলে মাথা তুলে মুগ্ধ হয়ে দেখি সামনের ভগ্নপ্রায় সিংহ দুয়ার, কিন্তু ইতিহাসের আভিজাত্যে ভরপুর। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সিংহ দুয়ার হয়ে,রাজবাড়ির তোরণ পেরিয়ে পঙ্খঅলঙ্কৃত নাটমন্দিরের দিকে পা বাড়াতেই পুরনো স্থাপত্য যেন ফিসফিস করে বলে ওঠে ইতিহাসের অজানা কথা। এক দিন এই পুজোকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল বাঙালির জগদ্ধাত্রী আরাধনা। আর কালের স্রোতে কিংবদন্তি, জনশ্রুতি আর ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে ‘বাংলার বিক্রমাদিত্য’ কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর প্রবর্তিত জগদ্ধাত্রী পুজো। ঘুরে ঘুরে দেখলাম সব কি দেখলাম জিজ্ঞাসা করবেন না, কারন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। ইতিহাসকে প্রাঞ্জল ভাবে উপস্থাপনা করা কি মুখের কথা। রাজবাড়ীর মনোমুগ্ধকর সানাইএর সুর, মনে যেন দোলা দিয়ে গেলো। সানাই বাদকদের ছবি নেব কিনা জিজ্ঞেস করতে ওনারা হেঁসে বললেন – হ্যাঁ তোল না, আমাদের আপত্তি নেই। রাজবাড়ী চত্বরে সেই সময় কার পালকি, রাজ সিংহাসন এসব দেখে মন ভরে গেলো, বেরিয়ে আসার সময়ে বার বার মনে হচ্ছিল পরের বার আবার আসবো। নিজের মনেই হেঁসে উঠলাম কাল কে দেখেছে পাগলা? কাল যদি আমিই না থাকি, তাহলে আসার প্রশ্ন আসছে কিভাবে?

বাইরে এসে দেখি কাকা বসে আছে, আমায় দেখে বলল- নাও চল বাপু বড্ড তেইম লাগগে দিলে, চল ছোট মা দেখিয়ে আনি। যাওয়ার পথে আর যা যা পড়বে দেক্ষে নিও। ছোট মা দেখে আরও কিছু ঠাকুর দেখে যখন বুড়ি মা দেখতে যাচ্ছি, পোস্ট অফিস তলায় পুলিশে আটকে দিল, কারন ওদিকে নো এন্ট্রি, কাকা বলল – যা ভিড় লেগেছে দেখতে পাবে? আমি বললাম – দাঁড়াও দেখে আসি, যদি বুঝি অনেক সময় লাগবে তাহলে ফিরে আসবো, আমায় বাড়িও যে ফিরতে হবে। একটু এগিয়ে দেখি ও বাবা সামনে জন সমুদ্র, কমসে কম আট-নশো লোকের লাইন, প্রায় দু কিমি লম্বা লাইন হবে মনে হচ্ছে। মনটা ভার হয়ে গেলো এতো দূরে এসে বুড়ি মা না দেখেই ফিরতে হবে? কিন্তু ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। বুড়ি মার উদ্দেশে প্রনাম ঠুকে এগিয়ে চললাম অন্যান্য ঠাকুর সন্দর্শনে। যেতে যেতে আর একটি দুঃসংবাদ দিল কাকা, বলল – বাপু মেজো মার কাছেও এরকমই ভিড়, যাবে কি? মনটা কেমন উদাস হয়ে গেলো, ধুসস এবারে দেখছি বাঁধাই বাঁধা। কাকা বোধহয় বুঝতে পারল মনের অবস্থা, বলল – মন খারাপ করো না, আমি তোমায় বেশ কিছু ঠাকুর দেখিয়ে দিচ্ছি, মেজো মা, বড় মা সবই তো মনে গো, এই মন থেইকে ডেকতে পারলে দেখবে সব ঠাকুরই তোমার কাছে বড় মা, মেজো মা হয়ে ধরা দিচ্ছে গো, মনই হল আসল। সত্যি কাকার কথাটা যেন আমার বিবেকের গালে সপাতে একটা চপেটাঘাত। এক গাল হেঁসে বললাম- ঠিক বলেছ কাকা, যা তুমি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছ, দেখ আমিই বুঝতে পারি নি। কাকা বলল – সে ঠিক আছে সকালে বেরিয়েছ মনে হচ্ছে কিছু খাবে? আমি বললাম – ভাল চায়ের দোকানে নিয়ে চল, একটু চা, বিস্কুট খেয়ে আবার ঠাকুর দেখা যাবে। সামনের একটা চায়ের দোকান থেকে দুজনে দুকাপ চা আর বিস্কুট খেয়ে যাত্রা শুরু হল। একে একে নেদিয়ার পাড়া, বেঁজি খালি, পল্লীশ্রী এসব মাতৃপ্রতিমা দর্শন করলাম।   

কাকা বলল- বাপু এবারে তো ষ্টেশনে ফিরে যাবো, এখানে কেউ বেড়াতে এলে মিষ্টি না কিনে কেউ ফেরে না, তুমি কিনবেনা? আমি বললাম হ্যাঁ নিশ্চয়ই কিনবো, এখানে কথায় সবথেকে ভালো সরপুরিয়া পাওয়া যায় বলত? কাকা বলল- তুমি বাপু অধর দাসের দুকান ত্থিকেই নাও, দুপইসা বেশী হলেও খাঁটি জিনিস দেয়, চল যাওয়ার পথে ঘুরে যাবো দুকানে। কাকা নিয়ে গেলো অধর দাসের দোকানে, দেখে মালুম হয় বহু পুরানো দোকান। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এখনও, দোকানের সাজসজ্জা বেশ পুরানো। আমি চুঁচুড়া থেকে আসছি শুনে জিজ্ঞ্যাসা করলেন – ফিরে যাবেন? আর একটা দিন থেকে একেবারে ভাসান দেখেই যান। কিন্তু অফিস আছে শুনে বললেন বেশ পরের বার চেষ্টা করবেন কিন্তু, দেখবেন ভালো লাগবে। বেশ খানিকটা সর পুরিয়া কিনে, ফিরে চললাম ষ্টেশন অভিমুখে, পিছনে পড়ে রইলো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের এক উজ্জ্বল গাঁথা, যার শুরু হয়েছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে।

ষ্টেশনে এসে কাকার পাওনা আড়াইশো টাকা মিটিয়ে যখন ষ্টেশনে ফিরছি, কাকা বলল – বাপু সাবধানে যেও, আর পরের বার এলে আমার খোঁজ করো, আমি ওই রাজবাড়ী চত্বরেই থাকি গো। আমি বললাম – নিশ্চয়ই কাকা পরের বার এলেও তোমার রিকশা করেই ঘুরবো গো।

ষ্টেশনে এসে শুনলাম আপ কৃষ্ণ নগর লোকাল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে আর ওটাই ফেরার ট্রেন হবে, ষ্টেশন তখন ভিড়ে ভিড়ে ছয়লাপ। ভিড় থেকে কোনওমতে গেলাম তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে, নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরেই এলো ট্রেন, ভিড় ঠেলে উঠেও একটা বসার জায়গা মা জগদ্ধাত্রী ঠিকই পাইয়ে দিল। ট্রেন যখন ছেড়ে যাচ্ছিল, অদ্ভুত একটা ফিলিংস হচ্ছিলো, আপনজন কে ছেড়ে যাওয়ার ফিলিংস, বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছিল, মনে হচ্ছিলো, সত্যি দুদিন কাটিয়ে গেলে ক্ষতি কি? প্রান ভরে দেখা তো হবে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা। একটু বোকা বোকা ফিলিংস তাই না? আসলে আমি এরকমই বোকার হদ্দ অল্পেই আপন করে নিতে যাই আর আঘাত পেয়ে মুখ চুন করে বসে থাকি, হয়তো বোকার হদ্দগুলো সব এরকমই হয়। যাক গে বাদ দিন আমার কথা, আপনারা সবাই ভালো থাকুন, মা জগদ্ধাত্রী আপানাদের সবার মঙ্গল করুন, পারলে একবার ঘুরে আসবেন কৃষ্ণনগর, দেখবেন ভালো লাগতে বাধ্য। এই শহর পারে আপন করে নিতে, যাবেন নাকি একবার কৃষ্ণনগর? কে জানে কোনও নবকুমার বিশ্বাস বা বসে আছে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে! আজ এইটুকুই, ভালো থাকবেন।