Monday 28 November 2016

ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন – পর্ব ৩


ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন – পর্ব ৩

কিছু বাঁকা প্রশ্নের তীর উড়ে আসছে, আমি নাকি কোনও একটি নির্দিষ্ট পার্টির হয়ে, তাঁদের সপক্ষে কলম ধরেছি। অভিযোগ গুরুতর সন্দেহ নেই, আত্মপক্ষ সমর্থনে ঢাক পেটানোর অভ্যাস কোনও কালেই ছিল না, তবু সবিনয়ে জানাই – আমি কোনও পার্টির বা ভাবনার দলদাস নই, আমি কোনও একটি ইস্যু, আর তার সপক্ষে নেওয়া কিছু পদক্ষেপের প্রশংসা বা সমর্থন করেছি মাত্র, এই আমার অপরাধ। যাক যার যা ভাবনা নিজের কাছে আমি তো কারও ভাবনার পরিবর্তন ঘটাতে পারব না, সেরকম কোনও প্রচেষ্টাও আমার নেই, অতএব একলা মাঝি বেয়ে চল আপন তরী জীবন মাঝে।
  
স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ভারতের শাসন ক্ষমতায় সব থেকে বেশি সময় কেটেছে বিশেষ একটি পরিবারের, একটি দলের হাত ধরেই, হ্যাঁ আমি নেহেরু- গান্ধী পরিবারের তথা কংগ্রেসের কথাই বলছি। আমরা অনেকেই জানি ব্যাংক ন্যাশালাইজেশন হয়েছিল ১৯৬৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরেই, অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা সেই সময় থেকেই। আর বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ শ্রী মনমোহন সিংহের পথচলাও সেই সময় থেকেই। সংক্ষেপে একটু দেখে নেওয়া যাক - Chief Economic Adviser হিসেবে ১৯৭২ সালে থেকে ১৯৭৬ সাল, এরপরে ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল অবধি Reserve Bank Governor হিসাবে কাজ করা, Planning Commission Chairman হিসাবে ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল অবধি দায়িত্বভার সামলানো, তারপর ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল অবধি Finance Minister হিসাবে কার্যভার গ্রহন, এরপরে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল অবধি Prime Ministers of India হিসাবে দায়িত্বভার সামলানো। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে Finance Minister এর পদ অলঙ্কিত করেছেন শ্রী প্রণব মুখারজি তথা শ্রী পি চিদাম্বরন মহাশয়দের মতো প্রবাদপ্রতিম অর্থনীতির কিংবদন্তীরা। তাহলে আজ এই অভিযোগ উঠছে কেন যে – গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা আজও অমিল? এতদিন কি ওনারা এই বিষয়ে অনভিজ্ঞ্য ছিলেন? দেশ কে সুগঠিত করতে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ছড়িয়ে দেননি কেন? কেনই বা আজ গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা অমিল এই ধুয়ো তুলে নোট বাতিলের বিরোধিতা করা হচ্ছে?

আমরা জানি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুজী কালোবাজারিদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, বাস্তবে একজন কালোবাজারিকেও ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাতে পারেননি তিনি। এরপরেও তো কংগ্রেস শাসনে দীর্ঘদিন ভারতবর্ষ ছিল, কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিলো কালোবাজারি, জাল নোট বন্ধে?

জাল নোট সংক্রান্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে শেষ সাড়ে তিন বছরে দেশজুড়ে এটিএম এবং ব্যাঙ্ক থেকে বের হওয়া জাল নোটের সংখ্যাটা ১৯ লক্ষ। যার মোট মূল্য ১৪৪ কোটি টাকার কাছাকাছি। অর্থাৎ, গত সাড়ে তিন বছর ধরে এই বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাঙ্ক এবং এটিএম মারফৎ বাজারে ঘোরাফেরা করছিল। শুদু এখানেই শেষ নয়, টাকার হিসেবে একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে আরবিআই। সেখানে বলা হয়েছে ওই জাল নোটের মধ্যে বাজারজুড়ে -
১০০ টাকার জাল নোটের সংখ্যা ছিল ৫.৪২ লক্ষ, যার মূল্য ৫৪.২১ কোটি টাকা, ৫০০ টাকার জাল নোটের সংখ্যা ছিল ৮.৫৬ লক্ষ, যার মূল্য ৪২.৮ কোটি টাকা, ১০০০ টাকার জাল নোটের সংখ্যা ছিল ৪.৭ লক্ষ, যার মূল্য ৪৭ কোটি টাকা। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত কি এই জাল নোট এর রমরমা বাজার কে ধাক্কা দেয় নি?

আমরা সবাই জানি সন্ত্রাসবাদ আজ ভয়ংকরতম হয়ে দেখা দিয়েছে, এর জন্য বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু আমরা কি কোন দিন ভেবেছি? এই জঙ্গিরা টাকা কোথা থেকে পায়? আসলে আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ থেকেই জাল নোটের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে থাকে। বেশ কয়েক বছর ধরে এটা হয়ে চলেছে, যেটা কোনও সরকারেরই অজানা নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কিরেন রিজিজুর বিবৃতি অনুযায়ী পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর জাল নোট এদেশে প্রবেশ করানোর যে কারবার চলছিল, তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ পত্রে মালদহের কালিয়াচক, সীমান্ত এলাকায় গাঁজা, আফিম ইত্যাদির যে চোরা চালান চলছিলো তা আজ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। এর কৃতিত্ব কি নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের নয়?

যদি একটু তলিয়ে ভাবা যায় তাহলে দেখা যাবে ৮৫ শতাংশ নোট বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী যে আঘাত হেনেছেন, তাতে কিন্তু সবচেয়ে ঘায়েল হয়েছে যে অংশ তা বিজেপি’রই প্রধান ভোটব্যাংক বলে পরিচিত, এককথায় মারোয়ারি/ অবাঙালী ব্যবসায়ীরা। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ করার কি অবকাশ আছে? প্রভুত অর্থনীতি জ্ঞ্যানের অধিকারী হয়েও দশ বছরে সামান্য সিদ্ধান্ত নিতেও হাত কেঁপেছে পূর্বতন প্রধানমন্ত্রীর সে তুলনায় এই পদক্ষেপ কি সমর্থনযোগ্য নয়? বিরোধী পক্ষ এখন বলছে কালো টাকা উদ্ধার অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করা হয়েছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। তাহলে কি সর্বভারতীয় নিউজ পেপারে বিজ্ঞ্যাপন দিয়ে, নিউজ চ্যানেলে কয়েকদিন আগে থাকতে প্রচার করে নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হত? আগে থাকতে জানানো হলে ঘর গুছিয়ে নিতে সুবিধা হতো কি? লোক খেপানোর সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জনমত নিজেদের দিকে ঘোরানো যাচ্ছে না বলে কি জনমোহিনী, চতকদারি রাজনীতির কারবারিরা এত ভীত? এই জন্যে সামান্য বিতর্ক, সমালোচনা তাঁদের সহ্য হচ্ছে না, প্রতিপক্ষ কে নানা ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলছে, এটা অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে? আমিতো কলা খাইনি’ এই গোত্রের হয়ে যাচ্ছে না?  

প্রধানমন্ত্রীর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপটির পর কত কালো টাকা উদ্ধার হবে বা জাল নোটের কারবারে কতটা টান পড়বে—তা হিসাব কষে হয়তো বলা সম্ভব নয় কিন্তু বড়সড় একটা ধাক্কা যে এই কালো টাকা এবং জাল টাকার কারবারিদের উপর পড়েছে তা তাঁদের পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিবিদদের লম্পঝম্প আর বংশবদ মিডিয়ার অবস্থা দেখলে সহজেই অনুমেয়। উপরন্তু এই পদক্ষেপের ফলে প্রধানমন্ত্রী যদি দেশের অভ্যন্তরে অন্তত ৪০ শতাংশ কালো টাকাও উদ্ধার করতে সক্ষম হন—তাহলেই দেশের অর্থনীতি অন্য মাত্রা পাবে। আমরা আম আদমি সেই দিনের অপেক্ষায় বসে আছি। জয় হিন্দ। বন্দেমাতরম।  

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে/ স্বার্থে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মতন আরও কিছু ব্যক্তির মতামতের সপক্ষে যারা দুর্নীতিমুক্ত, শক্তিশালী ভারতবর্ষ কে দেখতে চাই, তাই এই লেখায় কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত। অধমের ধৃষ্টটা মার্জনীয়, কৃপা করে দেশদ্রোহী/ পার্টি বিরোধী বা ম্যাওবাদির তকমা লাগিয়ে দেবেন না) 

Friday 25 November 2016

২৬/১১ – এক জ্বলন্ত সংগ্রামের কথা


২৬/১১ – এক জ্বলন্ত সংগ্রামের কথা

২৬/১১ নিছক কোনও সংখ্যা নয়, আপামর ভারতবাসীর মননে এই সংখ্যাটি এলে চোখ ভিজে ওঠে, সাথে সাথে চোয়াল দৃঢ় হয়ে ওঠে দুর্নিবার প্রতিরোধের ও প্রতিশোধের আশায়। ২০০৮ সালের এই দিনে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার বিবরণে আমি যাব না, আমরা সবাই অল্প বিস্তর এই বিষয়ে জ্ঞ্যাত। কিন্তু আজ সকালে বিভিন্ন সর্বভারতীয় নিউজ পেপারের পাতা উল্টে আমি হতাশ, যারা আত্মবলিদান দিয়ে গেলেন – মেজর সন্দীপ উন্নিকৃষ্ণন, হেমন্ত কারকারে, বিজয় সালাস্কার, অশোক কামটে বা তুকারাম আম্বলে এবং সর্বোপরি হামলায় নিহত বা আহতদের প্রতি কোনও শ্রদ্ধাজ্ঞ্যাপন নেই, কোনও খবরও নেই যে কেমন আছে বীর শহীদদের পরিবার পরিজন। শুদু পাতা ভরতি করে লেখা নোট বাতিল ও সেই নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির খেয়োখেয়ি! মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলি এটাই দেখাতে ব্যাস্ত যে নোট বাতিলের ফলে দেশের অর্থনীতি কিভাবে পিছিয়ে পড়ছে বা শাসকদল নিজের আখের কিভাবে গুছিয়ে নিয়েছে। সাধু উদ্যোগ সেবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলির আম আদমির প্রতি যে দায়বদ্ধতা তা সেলামের যোগ্য। তবে কেন জানিনা মনে পরে যাচ্ছে চুঁচুড়া স্টেশনে ঘুরে বেড়ানো এক শীর্ণকায়, অভাবী কিন্তু আভিজাত্যের গরিমায় ভরপুর এক জন বয়স্কা মহিলার কথা, যিনি শুদু স্টেশনে হাত বাড়িয়ে চুপ করে বসে থাকতেন, কিন্তু কোনদিনও তাঁকে কাউকে কিছু দিতে অনুরোধ করতে দেখিনি। মনে কৌতূহল জাগায় চেষ্টা করেছিলাম ওনার সাথে কথা বলে যদি কিছু তথ্য জানা যায়, কিন্তু পারিনি। উনি ওনার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে এড়িয়ে গেছেন পুরো ব্যাপারটা। আশেপাশের কয়েকজনের থেকে শোনা – বড় ঘরের গৃহবধূ ছিলেন তিনি, স্বামী মারা যাবার পর তিন ছেলে সব সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে ওনাকে, যদিও ছেলেগুলি সব নাকি শিক্ষিত এবং নিজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই মা কে জীবন থেকে বহিস্কার তাদের সাজে। যাক সে কথা, আজ আমাদের ভারতমাতার থুড়ি ভারতমাতা বললে তো আবার সেকুলার বাঙ্গালীর আঁতে লাগবে তাই দেশ মাতা এটাই ঠিক আছে, কি বলেন? যাক প্রসঙ্গে ফিরে আসি – আমাদের দেশ মাতার ও কত সুযোগ্য সন্তান (কেউ সৎ রাজনৈতিক, অবশ্য কোনও রাজনৈতিক নেতা/ নেত্রীদের নিজেকে অসৎ বলতে তো দেখলাম না, কেউ জাগরুক, নির্ভীক সাংবাদিক, সত্য তুলে ধরাই যাঁদের এক মাত্র লক্ষ্য, এছাড়া বাকিদের না হয় বাদ দিলাম। লিখতে গেলে পাতাও শেষ হয়ে যাবে) থাকতেও দেশ মায়ের একি হাল! আজও কেন দেশে এত দুঃখ, কষ্ট, এত দুর্নীতি, স্বার্থের হানাহানি? যে দেশ মাতার এত সব সুযোগ্য সন্তান সেই দেশ আজ এত সমস্যায়? না থাক প্রশ্ন করে লাভ নেই, দেশদ্রোহীর তকমা লেগে যেতে পারে। তার থেকে আমরা পিপুফিশুর দলে নাম লেখাই, কমসে কম এই প্রবাদটি সত্যি তো হবে – আপনি বাঁচলে বাপের নাম। 

(২০০৮ সালের ২৬/১১ র হামলায় নিহত সকল আত্মার শান্তি কামনা করি, সাথে আশা করি দেশ তাঁদের বলিদানকে ভুলবে না, এই হামলার পিছনে দোষীরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই লুকিয়ে থাকুক না কেন তাঁদের খুঁজে বের করে চরম শাস্তি দেওয়া হবে। জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম।) 


Thursday 24 November 2016

লাও! শেষে পর্বতের মূষিক প্রসব হবে না তো?



লাও! শেষে পর্বতের মূষিক প্রসব হবে না তো?

“কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়, ও ভাইরে ও ভাই, কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়। আমি যেই দিকেতে চাই, দেখে অবাক বনে যাই”, হীরক রাজার দেশে এই সিনেমাটি ছোটবেলায় কতবার দেখেছি, কিন্তু এর পিছনে লুকিয়ে থাকা শ্লেষ, উদ্দেশ্য একটু বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম। সে যাই হোক এই গানটি মনে আসার পিছনে কারণ একটাই – একটি বহুল প্রচলিত নামি নিউজ পেপারে (এই সময় এ) প্রকাশিত হওয়া একটি সংবাদ। 

পাঠকের সুবিধার্থে জানাই -  স্যুইস সংস্থা ক্রেডিট স্যুইস গ্রুপের করা একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে দেশের উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় বর্তমানে দেশের মোট সম্পত্তির ৫৮.৪ শতাংশের অধিকারী, ২০১৪ সালের তুলনায় দ্রুতহারে সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে দেশের ১ শতাংশ সর্বোচ্চ ধনী সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ ২০১৪ সালে যা ছিল ৪৯ শতাংশ, চলতি বছরে তা দাঁড়িয়েছে ৫৮.৪ শতাংশে। মানে দেশের শীর্ষ ধনী সম্প্রদায়ের সম্পত্তি বৃদ্ধির হার ক্রমবর্ধমান, অন্যদিকে চিত্রটি বড়ই করুন - দেশের নিম্নবিত্তরা মোট জাতীয় সম্পত্তির মাত্র ২.১ শতাংশের অধিকারী বলে জানানো হয়েছে সমীক্ষায়। 

তাহলে অতঃকিম! ঘোড়ার ডিম? কালো টাকার মালিক যে দেশের আম আদমি নয় এটা কাউকে বলে দিতে হবে না। কালো টাকা যাদের হাতে, তাঁদের এহেন শ্রীবৃদ্ধি কি কাম্য? আমরা চুনোপুঁটি থেকে রাঘববোয়াল সবার বিনাশ চাই, তবেই তো দেশের অগ্রগতি সম্ভব। তাই আজ বোধহয় কালো টাকার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পাশে থাকা আম আদমির এটাই আকুতি এত কষ্ট, এত ত্যাগ সব জলে যাবে নাতো? আমরা অধীর আগ্রহে দিন পরিবর্তনের আশায় রইলাম, আর যদি সাধারণ মানুষের আশাভঙ্গ হয় তবে ইতিহাস সাক্ষী সময়ের চাকা এক জায়গায় থেমে থাকে না, পরিবর্তন আসবেই আজ নয় কাল। জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম। 

Wednesday 23 November 2016

চোউউউউউপ গরিব রো রাহা হ্যায়



চোউউউউউপ গরিব রো রাহা হ্যায় 

যে গরিব জনগনের জন্যে বিরোধী নেতা/ নেত্রীবৃন্দের চোখে ঘুম নেই, তাঁরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বিগত ১৫দিন ধরে, শেষে দেখা যাচ্ছে রাতারাতি বড়লোক হয়ে গিয়েছে গরিব থুড়ি গরিবের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।তাও আবার ৫০০, ১০০০ টাকা বাতিলের পরে? তাহলে নোট ব্যান আখেরে গরিবের ভালো করেছে, এই প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে? না এটা কুৎসা বা প্রলাপ নয়, আজ একটি সর্বভারতীয় কাগজে (সন্দেহ থাকলে ebla.in এ গিয়ে সত্যটা যাচাই করে দেখতে পারেন) ।  সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে - জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্টে মাত্র ১৩ দিনে জমা পড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা, যেখানে সারা দেশে জন ধন প্রকল্পের অ্যাকউন্ট রয়েছে ২৫ কোটি ৫১ লক্ষ, এই সব অ্যাকাউন্টে প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিলের ঘোষণা করার আগে মোট জমা ছিল ৪৫,৬৩৬ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা, আর ৯ নভেম্বরের পরে মোট জমা টাকার পরিমাণ ৬৬ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। আর ওই সংবাদ সূত্রের খবর, গরিবের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ার পরিমাণে দেখা গিয়েছে সবার উপরে পশ্চিমবঙ্গ, আর  ঠিক এর পিছনেই রয়েছে কর্ণাটক।

তাহলে কিসের এত চেঁচামিচি, হই হট্টগোল, আন্দোলন এই নিরেট মাথায় ঢুকছে না। তাহলে কি আমরা গান্ধিজীর তিন বাঁদরের মতো কান, চোখ ও মুখ বন্ধ রাখব?

Tuesday 22 November 2016

আবার আমাদের জওয়ানদের মুণ্ডচ্ছেদ, এই হত্যামিছিল থামবে কবে?


 আবার আমাদের জওয়ানদের মুণ্ডচ্ছেদ, এই হত্যামিছিল থামবে কবে?

২০১৩ সালের জানুয়ারী মাস, কাশ্মীরের কৃষ্ণগতি সেক্টরে হামলা চালিয়েছিল পাকিস্থানের বিশেষ সীমান্ত বাহিনী ব্যাট (বর্ডার অ্যাকশন টিম), তাতে মৃত্যু হয়েছিল ল্যান্স নায়েক হেমরাজ ও ল্যান্স নায়েক সুধাকর সিংহের, দুই জওয়ানেরই দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল পাক সেনা। হেমরাজের মাথাও কেটে ফেলেছিল তারা। ২০১৬ সাল, ২৯শে সেপ্টেম্বর কাশ্মীরের মছিল সেক্টরে আবার হামলা সেই পাক (না নাপাক) সীমান্ত বাহিনী ব্যাটের সেবারেও মনদীপ সিংহ নামে এক জওয়ানের দেহ ছিন্নভিন্ন করে, মুণ্ডচ্ছেদ করে পালিয়ে গিয়েছিল পাকিস্থানি জওয়ানরা। আবার সেই মছিল সেক্টরেই পাক সীমান্ত বাহিনী ব্যাটের হামলায় মৃত্যু হয়েছে তিন সেনা জওয়ানের। যার মধ্যে রাজস্থানের বাসিন্দা প্রভু সিংহের দেহই বিকৃত করে দিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী, মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁর।

বারবার ঘটে চলা এই বর্বরতার জবাব কি? রাষ্ট্রপুঞ্জে অভিযোগ, পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলির কাছে পাকিস্থানকে বশে রাখার অনুনয়/ নিবেদন না নাপাক পাকিস্থানের মুখের উপর যোগ্য জবাব? যেটা তাঁরা ভালমতোই বোঝে। বৃহত্তর ইস্যুতে আন্দোলনরত জনদরদি নেত্রী, আম আদমির নেতা তথা সর্বহারার সাথী, প্রমুখ সকল নেতা/ নেত্রীবৃন্দের কাছে সবিনয় নিবেদন এই বিষয়ে আপনাদের অবস্থান ঘোষণা করলে দেশবাসী আশ্বস্ত হয়। প্রায় ৭০ বছর ধরে চলে আসা এই ক্যান্সারের কি কোনও নিরাময় নেই? অন্ততও এই ইস্যুতে কি আমরা একজোট হতে পারি না? জবাব পাওয়া যাবে কি?

Sunday 20 November 2016

ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন – পর্ব ২


ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন – পর্ব ২

বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বেঁচে থাকলে তিনি “কমলাকান্তের দপ্তর”- এর সংশোধিত ও পরিমার্জিত সংকলন বের করতেন এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষত ‘মনুষ্য ফল’ সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা হয়েছিলো, বর্তমানে তাহা আরও সমৃদ্ধ হতো। সত্যি বাঙ্গালীর ন্যায় পালটিবাজ, বহুরুপী জাতি দুটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। না এই ধারণা আমার একার নহে, আমার মতো কম বেশি অর্ধশিক্ষিত, আমআদমির তো বটেই, এখন প্রশ্ন হল এই দিব্য উপলব্ধি হল কিভাবে?

গত কয়েকদিন ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে, ট্রেনে বাসে, চায়ের আড্ডায়, সব জায়গায় শিক্ষিত, মহাজ্ঞ্যানি বাঙ্গালীর তর্কালাপ, তদুপরি বিবিধ খবরের কাগজ (কি সব ক্যাচ লাইন তাঁদের – জনশত্রু, ভগবান কেন শয়তানকেও ভয় করে না, পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পরতে হয় ইত্যাদি ইতাদি), সর্ব ভারতীয়, নামি দামী নিউজ চ্যানেলের অমৃত বানী শুনে সব ঘেঁটে ঘ। ধাতস্ত হতে বেশ কিছুটা টাইম লেগে গেলো, তারপরেও এই মোটা বুদ্ধিতে বেশ কিছু প্রশ্ন রয়েই গেলো। 

প্রশ্ন-১) নিউজ পেপার ও চ্যানেলে প্রকাশ দেশীয় ক্যারেন্সির (জাল ও আসল সহ) চোদ্দ আনাই হল বড় নোট, মানে ৫০০ ও ১০০০ টাকার। অথচও যোজনা কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের বেশিরভাগ লোকই দিনে ২০টাকাও খরচ করতে পারে না। তাহলে ৫০০, ১০০০ টাকার নোটের অসাধু ব্যাবহারকারী কারা? নোট বাতিলে কাদের কষ্ট হচ্ছে বেশি?   

প্রশ্ন-২) নোট বাতিলের স্বপক্ষে অর্থ সচিবের যুক্তি – গত পাঁচবছরের দেশের অর্থনীতিতে হাই ভ্যালু নোটের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে অর্থ নীতির বহর বেড়েছে ৩০ শতাংশ। দেশে চালু ৫০০ টাকার নোটের সংখ্যা ৭৬ শতাংশ ও ১০০০ টাকার নোটের সংখ্যা ১০৯ শতাংশ, অথচও রিজার্ভ ব্যাংক বাজারে ছেড়েছে ৫০০ টাকার নোট – ১৬৫০ কোটি এবং ১০০ টাকার নোট – ৬৭০ কোটি। তাহলে এবার দেখে নেওয়া যাক দেশে কত কোটি টাকার বেআইনি ও জাল টাকার সমান্তরাল অর্থনীতি, যা বৈধ অর্থনীতির সাথে সমান ভাবে চালু রয়েছে। ৫০০ টাকার নোটের সংখ্যা ১৬৫০ কোটির মানে বৈধ ৮ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা চালু রয়েছে, ১০০০ টাকার নোটের সংখ্যা ৬৭০ কোটির মানে বৈধ ৬ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা চালু রয়েছে। এবার হাজার টাকার নোটের সংখ্যা ১০৯ শতাংশ বৃদ্ধির মানে হল – বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ১০০০ টাকার ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতিতে ১৪ লক্ষ ৩০০ কোটি টাকা চালু রয়েছে। অর্থাৎ তথ্য থেকে এটা পরিস্কার যে, ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোটের বৈধ অর্থ যেখানে ৯ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকা, সেখানে এই দুই ক্যারেন্সির নোট (বৈধ ও অবৈধ) মিলিয়ে এই অর্থের পরিমান ১৯ লক্ষ কোটি টাকার ও বেশি। এই অবস্থা কি উদ্বেগের নয়? এর বিরুদ্ধে আশু লড়াই কি দরকারি ছিল না? তাহলে যারা নোট বাতিলের বিরোধিতা করছেন তাঁরা কি জেনে বুঝেই জাল টাকার কারবারিদের সুবিধা করে দিচ্ছেন? না কি আরও বৃহৎ স্বার্থে ঘা লেগেছে তাঁদের? 

প্রশ্ন-৩) বর্তমান পরিস্থিতিতে আমআদমি অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম বাঁধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, এই তথ্যটি কি প্রধানমন্ত্রীর অজানা? প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবন কি সুরক্ষিত? না কারন যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, ব্যাংকে, এটিএমে নগদ টাকার যোগান স্বাভাবিক না হবে, ততই আমআদমি প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা করবেন যার ফল আগামী নির্বাচনের ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হবে, তার সাথে যোগ দেবে ভ্রষ্ট বিরোধী নেতানেত্রী, জাল ও কালো টাকার কারবারিরা, যাদের মৌচাকে ঢিল মেরেছেন প্রধানমন্ত্রী। হয়তো এই প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ভাইপো, মেয়ে জামাই, ছেলের বা ভাইদের স্বার্থ রক্ষা করতে হচ্ছে না তাই তিনি এত বেপরোয়া? ৭০ বছরের ব্যাধি ৫০ দিনে নির্মূল করা না গেলেও কিছুটা উপশম হবে এই আশা করা যেতেই পারে। কি বলেন ব্যাস্ত জননেত্রী ও নেতাবৃন্দ তৎসহ প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী মহল?   

প্রশ্ন-৪) দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুজী কালোবাজারিদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, বাস্তবে একজন কালোবাজারিকেও ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাতে পারেননি তিনি। সেই দেশে বর্তমানে কালোবাজারি, জালনোটের কারবারি বা অন্যান্য অসাধু বাবসায়িদের কি হাল? খবরের কাগজ ও নিউজ চ্যানেলে প্রকাশ, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে গরু পাচার, সোনা পাচার সহ যাবতীয় চোরাচালান প্রায় বন্ধ, কারন হিসেবে উঠে আসছে সেই ৫০০, ১০০০ টাকার প্রসঙ্গ। তাহলে কি ধরে নিতে হবে চোরাচালান বন্ধ হওয়াতে এক শ্রেণীর নেতা/ নেত্রী ও তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গ দের অসুবিধা হয়েছে আর সেই জন্যেই এত গেলো গেলো রব? এছাড়া দেশের বিভিন্ন্য জঙ্গি সংগঠন আজ মহা বিপাকে, কারন সেই বাতিল ৫০০, ১০০০ টাকার গল্প, কয়েকদিন আগে আবার একটি সর্ব ভারতীয় নিউজ পেপারে দেখলাম ৫০০, ১০০০ টাকার নোট পুড়িয়ে চা করে খেয়েছে উত্তর পূর্বের কোনও এক জঙ্গি সংগঠন। সেই একই ভাবে তোলাবাজ নেতা নেত্রী, বহু স্বনামধন্য চিকিৎসক, উকিল, অসাধু ব্যাবসায়ি আজ বিপাকে। ইনকাম ট্যাক্সের অতর্কিত হানায় উঠে আসছে কালো টাকার খনি। এছাড়া জাল নোটের কারবারিদের মাথায় হাত কিভাবে পড়েছে সে সম্পর্কে আজ সাধারণ মানুষ অবহিত, এছাড়াও কাশ্মীরে যেভাবে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর পাথর ছোড়া, আক্রমণের ঘটনঅ্যা হ্রাস পেয়েছে তার সম্ভাব্য কারন হিসেবে উঠে আসছে সেই বাতিল ৫০০, ১০০০ টাকার প্রসঙ্গ। তাহলে এত হট্টগোল, এত প্রতিবাদ কর্মসূচী এই শ্রেণীর লোকেদের স্বার্থরক্ষার জন্যে নয়তো? আজ অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জেগেছে তার প্রতিফলন আড্ডায়, মজলিশে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। 

প্রশ্ন-৫) সাধারণ মানুষ যথেষ্ট বিপাকে এই বিষয়ে দ্বিমত নেই, কিন্তু লাইনে দাঁড়ানো ১০০ জনের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু জনের ব্যক্তিগত সমস্যাকে ইচ্ছা করে ফোকাস কেন করা হচ্ছে? কেন বেশিরভাগ মানুষ যারা এই নোট বাতিলের স্বপক্ষে তাঁদের কথা তুলে ধরা হচ্ছে না কেন? ইচ্ছাকৃত ভাবেই কি তৈরি করা হচ্ছে অসন্তোষ/ মতামত যা আম আদমির বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এতে স্বার্থ কোন শ্রেণীর সেটাও খুঁজে বের করা দরকার।

প্রশ্ন-৬) যেসব দিদিমনি, দাদাভাইরা আজ আমআদমির দুঃখে, কষ্টে সমব্যাথি তাঁদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, চিটফ্যান্দে সর্বশ্রান্ত গরীব জনগণের জন্যেও কি একইভাবে তাঁদের প্রান কাঁদে? কিংবা তোলাবাজী, জাল নোট, চোরাচালান এসব কাজের বিরুদ্ধেও সমভাবে গর্জে ওঠেন? আজ দেশের অসংগঠিত ও সংগঠিত উভয় ক্ষেত্রের শ্রমিক, কর্মচারীদের দুরাবস্থা অনেকেরই জানা, কিভাবে তাঁরা সিস্টেমের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত, শোষিত হচ্ছে তাও অজানা নয় জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু এই নিয়ে ব্যাপক অর্থে কার্যকরী আন্দোলন কতটা হয়েছে বা হচ্ছে? কে জানে অতীতের ঘটনাবলী তো সেই সাক্ষ্য দেয় না, তাহলে কি তথাকথিত জনদরদি নেতা/নেতৃবৃন্দ শুদুমাত্র বিরোধী আসনে বসার মহান দায় পালন করে চলেছেন?   

ভারতবাসী হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা জাতীয় স্বার্থেও একজোট হতে পারি না। তাই বোধহয় সারজিক্যাল স্ট্রাইকের পরে কোনও জননেতা প্রমানের ভিডিও প্রকাশের দাবি তোলেন, অতীতে ১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক দল প্রচার করেছিলো যে চীন নয় ভারতই চীন কে আক্রমণ করেছে, এরকম আরও কত কি শোনা যায়? চিটফ্যান্দ থেকে জাল নোট, চোরাচালান সব কিছু থেকেই হাত ধুয়ে ফেলেতে উদ্যোগী রাজনৈতিক দলগুলি, সবাই অপরের উপর দোষ চাপাতে ব্যাস্ত – এইসব অনৈতিক কাজকর্ম আমাদের পার্টি অনুমোদন করে না, তাহলে কি পার্টির বিনা অনুমোদনে, ছত্রছায়ায় চলে এই সব কাজকর্ম? কি অদ্ভুত দেশ আমাদের তাই না? আস্তিনের সাপেদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল বোধহয় আমাদের এই ভারতবর্ষ। অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে আরে আগে দেশের বাইরে চলে যাওয়া কালো টাকা উদ্ধার হোক পরে দেশের ভিতরে জমে থাকা কালো টাকা উদ্ধার করুক সরকার। দেশের বাইরে কালো টাকা উদ্ধারে নিশ্চয়ই আরও সক্রিয় হতে হবে রাষ্ট্রকে, কিন্তু সেই আওয়াজ/ দাবি কি বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে যে শক্তিশালী ভারতের প্রয়োজন সেটা কি আমরা বুঝতে পারছি? ভিক্ষার আবেদনে বা অনুনয়ে কালো টাকা হয়তো আসবে না তার জন্যে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী, প্রভাবশালী দেশ হয়ে উঠতে হবে আর তার জন্যে দেশের ভিতরে চলে আসা ৭০ বছরের ক্যান্সার আগে সারান দরকার। এটা ভুলে গেলে চলবে না বিদেশের মাটিতে বা আকাশে কালো টাকা জন্মায় নি, এই বিপুল পরিমান কালো টাকা সৃষ্টি হয়েছে দেশের অভ্যন্তরেই, আর সেটাই বিদেশের মাটিতে পাচার করা হয়েছে। আজ যদি কালো টাকার উৎসে আঘাত হানা যায় তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো কালো টাকা বিদেশে পাচার করার প্রবণতা হ্রাস পাবে।  আজ ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সুবাদে আমরা জানতে পারছি এলাকার স্বনামধন্য চিকিৎসক, উকিল, ব্যাবসায়িদের প্রকৃত চেহারা, আয়কর ফাঁকি দিয়ে তাঁরা কোন নতুন ভারতবর্ষ গড়ে তুলছেন? আর তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় কারা আজ বেশি তৎপর দেশবাসী সেটা বুঝতে পারছে।

আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কত রকম কথা বলি, কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি এই জঙ্গিরা টাকা কোথা থেকে পায়? আসলে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকেই জাল নোটের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে থাকে, এবং বিগত কয়েক দশক ধরে এটা হয়ে চলেছে, যারা নোট বাতিলের স্বপক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন তাঁরা কি এর আগে এই ইস্যুতেও এইভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন? গত ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতির উদ্দেশে ভাষণে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন -  শুধু কি কালোবাজারি, দুর্নীতিগ্রস্ত, কালো টাকার আড়তদার? মাথায় সেদিন আকাশ ভেঙেছিল সন্ত্রাসের নেপথ্যে থাকা মদতদারদেরও। তাই সন্ত্রাসবাদের পাশাপাশি ভারতের অর্থনীতিকে দুর্বল করার জন্যে যারা জাল নোটের কারবারি তাঁদের ও ভালো রকম ধাক্কা দিয়েছে এই নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত, যার কমবেশি খবর নিউজ পেপারে ও নিউজ চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে। তাই যেসব ভারতীয় নাগরিকরা আইনমাফিক আয়কর দেন, সমস্ত রকম দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন, সন্ত্রাসবাদ, জাল নোট প্রভৃতি বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার তাঁরা যদি কিছু কষ্ট সহ্য করে কালো টাকা, জাল নোটের আতঙ্কমুক্ত এক সমাজের ছবি দেখতে চায় তাঁতে বিরোধী পক্ষের উষ্মার কোনও কারন আছে কি? তাই সবিনয় নিবেদন মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ব্যক্তিগত অসুবিধা, মতামত কে সবার মতামত বলে চালিয়ে দেবেন না।

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে/ স্বার্থে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মতন আরও কিছু ব্যক্তির মতামতের সপক্ষে যারা দুর্নীতিমুক্ত ভারতবর্ষ কে দেখতে চাই, তাই এই লেখায় কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত। অধমের ধৃষ্টটা মার্জনীয়, কৃপা করে দেশদ্রোহী/ পার্টি বিরোধী বা ম্যাওবাদির তকমা লাগিয়ে দেবেন না) 

Sunday 13 November 2016

ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন


ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন

গতকাল আমিও ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম কয়েকটি ৫০০, ১০০০ নোট জমা দিতে, লম্বা লাইন দেখে একটু বিরক্তি হলেও পরে নিজেরই ভালো লাগলো শুনে যে আমার আগের বয়স্ক কাকুটিয়ও প্রায় দুই ঘণ্টা আগে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে। এবং তিনি অকুণ্ঠভাবেই সমর্থন জানাচ্ছেন কালো ও জাল টাকার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে। না ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়, অল্প কিছু ডাইনোসর প্রজাতির লোক (অবশ্যই হরিদাস বাঙালী) চিৎকার/ অভিযোগ, সরকারকে গাল পাড়ছিলেন, কিন্তু নিজেরাই হাস্যাস্পদ হচ্ছিলেন বাকি লোকেদের কাছে। বেশ কিছুটা সময় পরে নির্ধারিত ৪০০০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এই পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু টিভিতে অমুক দিদি, অমুক দাদার ক্ষোভ, বিপ্লবের বুলি শুনে  মনে এটাই প্রশ্ন এলো - ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিল করাতে আমাদের দাদা, দিদিদের থুড়ি নেতা/নেত্রীদের চোখে ঘুম নেই? আম আদমির হেঁশেল কিভাবে চলবে, কিভাবে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তাঁদের মুখে উঠবে এই চিন্তায় কেন তেনারা প্রানপ্রাত করে চলেছেন? আজ হঠাৎ কেন আম আদমির জন্যে এত দরদ? কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দল কেই দেখলাম না লাইনে দাঁড়ানো আম আদমির জন্যে পানীয় জল/ চা, বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যে ছায়া/ বসার বাবস্থা, গরীব অশিক্ষিত লোকে দের জমার স্লিপ লিখে দেওয়ার কোনও ক্যাম্প করতে? অবশ্য শুনলাম ব্যাঙ্কের সামনে জায়গায় জায়গায় বুথ খুলে প্রতিবাদ কর্মসূচী হবে। সাধু উদ্যোগ মানতেই হবে – কিন্তু সেই সব দিদি, দাদাদের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই, আশা করি ওনারা জবাব দেবেন নিশ্চয়ই? 

১) আম আদমি লম্বা লাইন দিয়ে সিনেমার টিকিট কাটতে পারে, জিওর সিম নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে পারে, রবিবারে খাসীর দোকানে লাইন দিতে পারে, পুজো, পার্বণে মোডের দোকান, রেস্তোরাঁতে লাইনে দাঁড়াতে পারে, ভোটের লাইনে আপনাদের মতো নেতা/ নেত্রীদের জেতাতে লাইনে দাঁড়াতে পারে আর কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা/ পরিবর্তন করাতে পারবে না? আলবাত পারবে, এই আম আদমিই কিন্তু এর আগেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে রেশন দোকানে ডিজিটাল কার্ড, আধার কার্ড করিয়েছে। তাহলে আজ ঠিক আপত্তিটা কোথায়? এই উদ্যোগ নেওয়ার সৎ সাহস আপনারা দেখাতে পারেননি না ব্যক্তিগত (দলগত) স্বার্থে ঘা পড়েছে তাই?  

২) দেশে কালো টাকা, জাল টাকার বিরুদ্ধে আপনাদের (ব্যক্তিগত/ দলগত) অবস্থান ঠিক কোথায়? এর আগে আপনাদের ঘোষিত কর্মসূচী কি ছিল বা এখনই বা কি আছে? 

৩) যে সকল নেতা/ নেত্রীরা বিদেশের কালো টাকা ফেরাতে এত তৎপর! তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন গত ৭০ বছরে কালো টাকার বিরুদ্ধে তাঁদের জিহাদের নমুনা কি ছিল? তাঁরা কি পদক্ষেপ নিয়েছেন এই উদ্দেশ্যে? যে তথাকথিত কালো টাকা সুইস ব্যাঙ্কে জমা আছে বলে এত হইচই, সেই সম্বন্ধে কি তাঁরা আজ জানলেন? এর আগে আপনারা কি শীতঘুমে ব্যাস্ত ছিলেন?

প্লীজ দোহাই আপনাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত স্বার্থের কারনে সাধারণ আম আদমি কে বলির বকরা করবেন না। যারা স্বেচ্ছায় এই কষ্ট মেনে নিতে প্রস্তুত তাঁদের দলে টানার চেষ্টা না করলেও কিছু সুবিধাবাদী, অসাধু লোকেদের নিজেদের পতাকার তলায় ঠিকই পেয়ে যাবেন। বিপ্লব তাঁদের নিয়ে করতে পারেন।

যদি রাষ্ট্র এই পদক্ষেপ না নিত তাহলে হয়তো আমরা জানতে পারতাম না –

১) কোন সুপুত্র তার অসহায় বৃদ্ধা মা বাবা কে এতদিন দেখে নি, অথচও এখন গিয়ে বলছে – এই নাও টাকা কাল সকাল সকাল ব্যাঙ্কে জমা করে দিও, বাবা কে ভালো ডাক্তার দেখিয়ো, দরকার পরলে আরও কিছু টাকা নাহয় আমি দিয়ে দেবো।

২) সমাজের হোয়াইট কালার উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা যারা এতদিন সমাজের নীচের তলার লোকেদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে এসেছে আজ তাঁদের উপকারের চেষ্টার কোনও খামতি নেই? উদ্দেশ্য একটাই যদি তাঁদের হাত ধরে কিছু কালো টাকা সাদা করে নেওয়া যায়, এরজন্যে উপঢৌকনের ডালিও প্রস্তুত।   

৩) দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কত বেহিসাবি টাকা জমা পড়েছে? আর এই অর্থ বর্ষে কত? যতদূর জানি ৬৭ হাজার কোটি টাকা, তাহলে? 

৪) অসাধু ব্যাবসায়িরা তাঁদের কর্মচারীদের আগামী ৬ এমন কি ১২ মাসের বেতনের টাকাও ক্যাশে অগ্রিম কেন দিয়ে দিচ্ছেন? অথচও পূর্বে এই কর্মচারী/ শ্রমিক ভাইটি পিতা বা মাতার চিকিৎসার জন্যে কিছু টাকা ধার/ অগ্রিম চেয়েও পায়নি।  

৫) যে ধনী আত্মীয়টি আগে অবহেলায় গরীব আত্মীয়ের মুখদর্শন করতো না সেই এখন তাঁকে মাখন লাগাচ্ছে যদি আড়াই লাখ করে কিছু টাকা সাদা করে দেয় সে। তার জন্যে অবশ্য যথাযথ মুল্য দিতে ধনী ব্যক্তিটি প্রস্তুত।

এরকম অনেক উদাহরন আশেপাশে পাওয়া যাবে একটু চেষ্টা করলেই।    

এটা ঠিকই সাধারণ মানুষের অনেক অনেক কষ্ট হচ্ছে, যেটা তাঁরা হয়তো দেশের স্বার্থের খাতিরে মুখ বুজে মেনেও নিচ্ছেন। কিন্তু অনেক বেশি কষ্ট তাঁদের হচ্ছে যারা কালো টাকা, জাল টাকার মধু এতদিন পান করে এসেছেন। এবং তাঁরা এই কথা ভেবেও আতঙ্কিত সঞ্চয় করে রাখা সেই মধুভাণ্ড রক্ষা কিভাবে করবেন? তাই এই প্রবাদ বোধ হয় আজ একদম ঠিক যে - “দেশের মধ্যে যখন চোর, দস্যু, ডাকাত, রাজদ্রোহীরা চিৎকার, চেঁচামিচি করবে, জানবে রাজা সুশাসন করছে -  মহামতি চাণক্য”।

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে/ স্বার্থে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মনের কষ্টের, দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে, তাই কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত। অধমের ধৃষ্টটা মার্জনীয়) 

Friday 11 November 2016

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সুন্দরবন - এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন আমরা


রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সুন্দরবন - এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন আমরা

“পৃথিবী খারাপ মানুষের কাজের জন্য ধ্বংস হবে না, ধ্বংস হবে তাদের জন্য যারা খারাপ মানুষের কাজ দেখে কিন্তু কিছু করে না” – আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের এই উক্তি তথাকথিত প্রতিবাদি, পরিবেশপ্রেমী, বুদ্ধিজীবী মানুষের জন্যে অবশ্যই প্রযোজ্য। 

বন্যপ্রাণ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের অনন্য এক মিলনস্থল আমাদের সুন্দরবন। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় গড়ে ওঠা এই ম্যানগ্রোভ অরন্যে যেমন পাওয়া যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার, স্বাদু/ মিষ্টি জলের ডলফিন, নোনাজলের কুমির, দুরন্ত হরিণ আরও কতশত জীবজন্তু, তেমনই সুন্দরী, গেওয়া, গরান প্রমুখ ম্যানগ্রোভ গাছ। ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা এই সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে আর বাকীটা আমাদের দেশে। অথচ এই সুন্দরবনেরই একেবারে নিকটে হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (BPDB), ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মিত হবে সুন্দরবনের থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে পশুর নদীর তীর ঘেঁষে এই প্রকল্পে ১৮৩৪ একর জমির সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে।

আমরা জানি উন্নয়নের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে বিদ্যুৎ, বাংলাদেশের উন্নতির লক্ষে বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকারি, আর প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ভারত যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা সাধুবাদের যোগ্য। কিন্তু এটা আমরা জানি যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জ্বালানী হচ্ছে কয়লা, এতে যে বিপুল পরিমাণে দূষণ ছড়াবে তার প্রতিকার হবে কিভাবে? রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে প্রয়োজন হবে আনুমানিক ৪৭ লক্ষ টন কয়লা – যা জাহাজযোগে নিয়ে আসা হবে ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। সুন্দরবনের বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলা পশুর নদীর উপর দিয়ে এই কয়লা বোঝাই জাহাজগুলো চলাচল করবে। এতে পরিবহনকালে কয়লার ভাঙ্গা টুকরা, তেল, ময়লা আবর্জনা সুন্দরবন সংলগ্ন জলে মিশবে। জাহাজ যাতায়াতের ফলে এর থেকে সৃষ্ট ঢেউয়ে পাড় ভাঙবে, উন্মুক্ত চলাচলের সুযোগে সুন্দরবনে চোরাশিকারী বাড়বে। এই বিপুল পরিমান কয়লা পোড়ানোয় তৈরী হবে বিষাক্ত ধোঁয়া, যাতে মিশে থাকবে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড। এছাড়া আর্সেনিক, পারদ, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, রেডিয়াম এগুলোর মারাত্মক দূষণ তো রয়েছেই।

অথচও দুই দেশেই মানুষের/ উন্নতির আগ্রাসনে সুন্দরবন ক্রমাগত সংকুচিত হলেও এখনও এই অঞ্চলকে, এখানকার মানুষ ও প্রাণী সমুহকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মায়ের মতো রক্ষা করছে এই সুন্দরবনই। এটা বোধহয় বেশ কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আয়লা আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। এটা আমাদের দুই দেশেরই দুর্ভাগ্য যে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা প্রদানকারী সুন্দরবনের অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত অবদানের মূল্য ঠিকমতো নির্ধারণ করতে পারি নি, নইলে সুন্দরবন না থাকলে এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে কত ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতো সেটা দুই দেশের কর্পোরেট বিজনেস মহল ও রাজনৈতিক কারবারিরা হয় করেনি নইলে নিজ স্বার্থের কারনে বিশ্লেষণ করতে দিতে চায় না।

কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের বিদ্যুতের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে ওইখানে ছোট ছোট টাইডাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করা যেতে পারে, প্রসঙ্গত ওই এলাকাটি একটি টাইডাল জোনের মধ্যে পড়ে। আমি পরিবেশ বিজ্ঞ্যানী নই, এই বিষয়ে আরও সুস্পষ্ট, সাইন্টিফিক যুক্তি/ দিশা পরিবেশ বিজ্ঞ্যানীরা দিতে পারবেন। কিন্তু আজ যখন বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মরোক্কোর মারাকেশ শহরে বৈঠকে বসেছেন পরিবেশবিদরা, আমরা আশা রাখতেই পারি এই বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ তাঁরা নিশ্চয়ই নেবেন? 

Wednesday 9 November 2016

হায়রে রেখেছ বাঙালী করে মানুষ (ভাগ্যিস নামানুষ করেনি, খামোকা অবলা জীবগুলি ছোট হতো) করো নি!


হায়রে রেখেছ বাঙালী করে মানুষ (ভাগ্যিস নামানুষ করেনি, খামোকা অবলা জীবগুলি ছোট হতো) করো নি!

সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালী যত গর্জায়, বাস্তবের মাটিতে তার কিয়দংশ বর্ষালে ভারত কবে জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পেয়ে যেত। ইউ এস, কি রাশিয়ার মুখাপেক্ষী হতে হতো না। সকাল থেকে সেই এক ক্যাঁচর ক্যাঁচর – সরকার এবার আর্থিক জরুরী অবস্থা জারি করল। দেশ ও দেশবাসী রসাতলে গেলো! কেউ পোস্ট করছে অভয়ারণ্যে প্রমোদ ভ্রমণের টিকিট কাটতে পারেনি ৫০০ টাকা থাকার জন্যে, কেউ আবার শপিং মলে শপিং করতে পারছে না শুদুই ১০০০ টাকায় পার্স ভরতি থাকায়। আবার কয়েকজনের কাছে শুনলাম ওষুধের দোকানে কনডমের প্যাকেট কিনতে পারল না পকেটে ৫০০ টাকা থাকার জন্যে। কেউ কেউ তো এই ভেবে ব্লাড প্রেশার হাই করে ফেললো – গরীবগুরব লোকগুলো দোকানপাতি, বাজারহাট করবে কিভাবে? তাঁদের উদ্দেশে বলি – ভারতের দিন আনি দিন খাই লোকগুলি আপনার মতো পকেট ভরতি ৫০০, ১০০০ এর নোট নিয়ে ঘোরে না। নিজের ক্ষুদ্র দুনিয়া থেকে বেরোতে পারলে বুঝতে পারতেন, আপনার অসুবিধাটুকু নেহাতই কোলাটোর‍্যাল ড্যামেজ। রাস্তা, ব্রিজ সারাই করতে গেলেও তো দু-একদিনের জন্যে সেই রাস্তা, ব্রিজ বন্ধ করতে হয়, তখনও আপনারা গজগজ করতে ছাড়েন না? আপনি আগামী কয়েকদিন কিভাবে শপিং মলে শপিং করবেন বা রেস্তোরাঁতে কিভাবে বিল মেটাবেন সেটা রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের না ভাবলেও চলবে, কিন্তু যারা ফলস সিলিঙের নীচে, কোমোডের সিস্তেনে টাকার তোড়া জমিয়ে রেখেছে, তাঁদের মৌরুসিপাট্টা ভাঙ্গাটা আশু প্রয়োজন। সুবিধাবাদী, পালটিবাজ বুদ্ধিজীবী সমাজ এটা বোধহয় ভুলে গেছেন যে ভারতবর্ষে হত দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই বেশি এটা যেমন চরম সত্য, তেমনি এটাও ভয়ঙ্কর আতঙ্কের দেশের ১০ শতাংশ ধনী লোকের কাছেই আছে কালো টাকা, আর সুযোগ মতো সেই কালো টাকাই খাটে ভোটের বাজারে, গয়নার বাজারে, সিনেমায়, ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির কাজে, জঙ্গি আন্দোলনের নামে দেশের সংহতি বিনষ্টের চেষ্টায় আরও কত জায়গায়? আর হঠাৎ এই ধাক্কায় জাল টাকার বাজারেও যে জোর ধাক্কা লেগেছে সেটা কি বুঝতে পারছি আমরা? তাই সাবাশ বলতে দ্বিধা কোথায়?

Tuesday 8 November 2016

বর্তমান ৫০০ ও ১০০০ টাকা অচল – এক অন্য ৮/১১ ভারতে?



বর্তমান ৫০০ ও ১০০০ টাকা অচল – এক অন্য ৮/১১ ভারতে?

কাল সন্ধ্যে থেকে বাজার সরগরম, এটিএমে লম্বা লাইন, নিউজ চ্যানেল খুলে শঙ্কিত মুখে আপামর ভারতবাসী, সবারই কি হয় কি হয় ভাব? বাঙালী তো আর এক কাঠি সরেস, সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করে ফেলছে পক্ষে/ বিপক্ষে হাজারো মতামত দিয়ে। কোথাও গেলো গেলো রব তো কোথাও সাধুবাদ। 

কি পদক্ষেপ নিলো আমাদের সরকার?

কাল মধ্যরাত থেকেই পাঁচশো এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল হয়ে যাচ্ছে। আগামী ১০ নভেম্বর থেকেই সম্পূর্ণ নতুন নকশা সম্বলিত নতুন পাঁচশো এবং দু হাজার টাকার নোট চালু করতে চলেছে রিজার্ভ ব্যাংক। নতুন ৫০০ টাকার নোটের একটি দিকে থাকবে গান্ধীজির ছবি এবং উলটোদিকে থাকবে লালকেল্লার ছবি। আর নতুন ২০০০ টাকার নোটের একদিকে থাকছে গান্ধীজি ও অন্যদিকে ভারতের পাঠানো মঙ্গলযানের ছবি। উপরন্তু ২০০০ টাকার নোট থাকবে NGC (Nano GPS Chip) সমৃদ্ধ। সংক্ষেপে একটু জেনে নি কি এই NGC?

New Rs. 2000 currency is designed in mind to eradicate the black money issue using state of the art indigenous nano technology, every Rs. 2000 currency note is embedded with NGC (nano GPS Chip)

How the embedded NGC Technology Works?

The unique feature of NGC is it doesn’t need any power source. It only acts as a signal reflector. When a Satellite sends a signal requesting location, the NGC reflects back the signal from the location, giving precise location coordinates and the serial number of the currency back to the Satellite, this way every NGC embedded currency can be easily tracked and located even if it is kept 120 meters below ground level. The NGC can’t tampered with or removed without damaging the currency note.

How will this help eradicate black money menace?

Since evry NGC embedded currency can be tracked. The Satellite can identify the exact amount of money stored at a certain location. If arelatively high concentration of currency is found a certain location for a longer period of time at suspicious locations other than banks and other financial institutions. The information will be passed on to the Income Tax Department and other Secuirity Agencies for further investigation.
 

তাহলে বন্ধুরা সহজেই অনুমান করতে পারছেন সুফল কি হতে পারে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথায় - আজ থেকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট সম্পূর্ণ কাগজের টুকরোয় পরিণত হবে। সরকারের প্রধান লক্ষ্য দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসাধু ব্যক্তি যাদের কাছে কোটি কোটি এরকম নোট গোপনে রাখা আছে। সেইসব গোপন অঘোষিত ধন আজ থেকে নিছক ছাপানো এক টুকরো কাগজে পরিণত হয়ে যাবে। পাশাপাশি সরকারের লক্ষ্য ৫০০ ও ১০০০ টাকার তাবৎ জাল নোটের কার্যকারিতা খতম করে দেওয়া। স্বাভাকিভাবেই যারা আতঙ্কিত হচ্ছেন বা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন তাঁরা নিরাপদেই থাকতে পারেন কারন সরকার সাধারণ সৎ নাগরিকদের কোনও সংকটে পড়তে দেবে না, তাই একঝাঁক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

এখন এই ব্যবস্থাগুলি জেনে নেওয়া যাক -

১) ১০ নভেম্নর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ও পোস্ট অফিসে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট জমা করতে হবে। ১০ নভেম্বর থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলবে। ২৫ নভেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কিন্তু নির্দিষ্ট সচিত্র পরিচয়পত্র কাউন্টারে দেখিয়েই ওই নোটবদল প্রক্রিয়া করতে হবে। এই সময়সীমার মধ্যেও যাঁরা নোট বদল করে উঠতে পারবেন না তাঁদের আরও একটি শেষ সুযোগ দেওয়া হবে। সেটি হল ৩০ ডিসেম্বরের পর রিজার্ভ ব্যাংকে গিয়ে একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে নোট বদল করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোনও তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। কারণ হাতে থাকছে ৫০ দিন। তবে মনে রাখতে হবে একদিনে আপাতত চার হাজার টাকার বেশি মূল্যের নোটবদল করা যাবে না। কিছুদিন পর এই ৪ হাজার টাকার উর্ধসীমা বাড়ানো হবে। অতএব সৎ ভারতবাসীর নিজেদের টাকা নিজেদেরই থাকবে, বিপদে পড়বে অসাধু কালো টাকার কারবারীরাই। কারণ যাদের বাড়িতে ও অন্যত্র অসংখ্য অঘোষিত ৫০০ ও ১০০০ টাকার পাহাড় রয়েছে, তারা ওই টাকা পোস্ট অফিস বা ব্যাংকে জমা করতে পারবে না। সেটা করতে হলে আয়কর দপ্তরের কাছে হিসাব দেখাতে হবে এই সম্পদ কোথা থেকে এল? আর ব্যাংকে এই নোটবদল প্রক্রিয়াটির ভিডিও গ্রাফি করা হবে গোপনে। 

২) হাসপাতাল, শবদাহ কেন্দ্র, ওষুধ কেনা, ট্রেন ও বিমানের টিকিট কেনা, সরকারের সমবায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিক্রয় কেন্দ্র, দুগ্ধ বিক্রয় কেন্দ্র ইত্যাদি জরুরি তথা আপৎকালীন পরিষেবার ক্ষেত্রে আজ থেকে ৭২ ঘন্টা অতিরিক্ত সময়সীমা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ আগামী ১১ নভেম্বর পর্যন্ত এইসব পরিষেবার ক্ষেত্রে পুরানো ৫০০ এবং ১০০০ টাকার .নোট গ্রহণ করতে হবে। 

২) আগামীকাল অর্থাৎ বুধবার ব্যাংক এবং এটিএম বন্ধ থাকবে। তবে কিছু এলাকায় এটিএম দুদিনও বন্ধ থাকতে পারে। আপাতত এটিএম থেকে প্রতিদিন ২ হাজার টাকা করেই তোলা যাবে। ব্যাংক এবং পোস্ট অফিসে গিয়ে যারা টাকা তুলবেন তাদের ক্ষেত্রে দিনে সর্বোচ্চ ১০০০০ টাকা এবং এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্তই তোলা যাবে। অনলাইন ব্যাংকিং, চেক, ডিমান্ড ড্রাফট ইস্যু করা কিংবা জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। একইভাবে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দিয়ে শপিং কিংবা কোনও লেনদেনের ক্ষেত্রে নয়া নিয়ম চালু হচ্ছে না।

এবার দেখে নেওয়া যাক এই ব্যবস্থায় কারা কারা অসুবিধার সম্মুখীন হবে?

এটা ঠিক যে কোনও কঠিন, কড়া পদক্ষেপে কিছু সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়ে। দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষরা কিছু সমস্যায় পড়বেন। বাজারে এখন সবচেয়ে বেশি চলে ৫০০ টাকার নোট, সেই নোট বাতিল হয়ে যাওয়ায় এবং তার বদলে যথেষ্ট ১০০ টাকার নোটের জোগান না-থাকায় গৃহস্থরা হয় তাঁদের কাজ দেবেন না, না হয় আগামী ক’দিন টাকা মেটাবেন না। চা-বাগান বা আবাসনের মতো জায়গায়, যেখানে দৈনিক মজুরিতে অনেকে কাজ করেন, সেখানে বেতন মেটানোর ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা তৈরি হল। কারণ, এই দুই ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় টাকা আগাম তুলে রাখা হয়, এবং তা মূলত ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে। চা-বাগানে শ্রমিকদের খাদ্যশস্য জোগানেও সমস্যা হবে বলে বহু বাগানের ম্যানেজারেরা যেমন আশঙ্কা করছেন, তেমনই আবাসন শিল্পে শ্রমিকদের দৈনন্দিন খাওয়ার খরচ মেটানো নিয়ে চিন্তায় প্রোমোটারেররা। নিম্ম আয়ের আম আদমিও বেশ সমস্যায় পড়বেন, যারা খুচরো বাজারে ব্যাবসা করে দিন নির্বাহ করেন তাঁরা টাকার অভাবে খুচরো বাজারের বিক্রেতারা কাঁচামাল তুলতে পারবেন না। যেটুকু তুলবেন তারও খানিকটা ধারে বেচতে বাধ্য হবেন। ফলে জিনিসপত্রের দাম চড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বিপাকে পড়বেন চাষিরাও। কারণ, সবে ধান কাটা হয়েছে। আগামী ক’দিন তা বিক্রি করা কঠিন হবে। পাশাপাশি চলছে গম ও রবি ফসল বোনার কাজ। তার জন্য সার এবং বীজ কেনাও ধাক্কা খাবে।

আমাদের মধ্যবিত্তদের সমস্যাও কিছু কম নয়, অনেকের বাড়িতেই এখন খুব বেশি ১০০ টাকার নোট থাকে না। কিন্তু আগামী দু’দিন এটিএম থেকে টাকা তোলারও আর কোনও উপায় নেই। বুধ ও বৃহস্পতিবার সব এটিএম বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করে দিয়েছে কেন্দ্র। তার পর দৈনিক দু’হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কাল থেকেই নতুন ৫০০ টাকা ও ২০০০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হবে বলে ঘোষণা করলেও তা সাধারণ মানুষের হাতে আসতে বেশ কয়েক দিন লেগে যাবে। দেশের বাজারে এখন ১৬৫০ কোটি ৫০০ টাকার নোট রয়েছে আর ১০০০ টাকার নোট রয়েছে ৬৭০ কোটি, এত নোট রাতারাতি বদলে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তা ছাড়া নিশ্চয়ই নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোটের মাপ আলাদা হবে তাই সেগুলো এটিএমে চালাতে গেলে এটিএম-গুলিতে প্রযুক্তিগত বদল আনতে হবে, সেটাও সময়সাপেক্ষও। 

কালো টাকা বা জাল টাকার রমরমা কমবে কি?

আমাদের দেশে কালো টাকা বেশি লেনদেন হয় আবাসন ক্ষেত্রে এবং জমির কেনাবেচায়, নতুন ব্যবস্থায় চিহ্নিত হবার সুযোগ বেশি, যাঁরা বিরাট পরিমাণে নগদ জমা করবেন, আয়কর দফতরের পক্ষে তাঁদের চিহ্নিত করে নজরদারি করা সহজ হয়ে যাবে। তবে রাঘব বোয়াল কটি ধরা পড়বে সেবিষয়ে সন্দেহ থেকেই গেলো, কারন বড় মাপের কালো টাকার ব্যবসায়ীদের টাকা খাটে অলংকারে, সোনায়, অথবা বিদেশে তাই বিদেশ থেকে কিভাবে কালো টাকা ফিরবে সেই চিন্তা রয়েই গেলো।

তবে এই নতুন বাবস্থায় পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই বিপাকে পড়বে, তাঁরাই যে এদেশে বিপুল পরিমানে জাল টাকা ঢুকিয়েছে, সেটা এই তথ্যটি দেখলে পরিস্কার হয়ে যাবে - গত পাঁচ বছরে অর্থনীতিতে চালু নোটের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। অর্থনীতির বহর বেড়েছে ৩০ শতাংশ। অথচ পাঁচশো টাকার নোটের সংখ্যা বেড়েছে ৭৬ শতাংশ, ১০০০ টাকার নোটের সংখ্যা ১০৯ শতাংশ। ফলে আয়-ব্যয়ের তুলনায় বড় নোটের ব্যবহার যে মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে, সেটা স্পষ্ট, সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে জাল নোটের সম্ভাবনা। জাল টাকা বড় মাপের নোটে না ছাড়লে পড়তায় পোষায় না, অথচও ২০০০ টাকার নোট থাকবে NGC (Nano GPS Chip) সমৃদ্ধ তাই বেশ বড় ধাক্কা জাল নোটের কারবারিদের।

আর কারা কারা অসুবিধায় পড়বেন?

নির্বাচনী প্রচার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির সবথেকে বড় হাতিয়ার হল কালো টাকা৷ ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের কাছ থেকে হামেশাই কালো টাকার একটা অংশ পেয়ে থাকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি৷ ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে গেল, এবার তাহলে নতুন করে অনুদান নিতে হবে৷ কিন্ত্ত সেটাও তো চেকে নিতে হবে, আর চেকে খুব বেশি ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি টাকা দেবেন না, ক্যাশে যে লেনদেন হয়, সেটা তো মূলত কালো টাকা৷ তা হলে প্রার্থী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলি খরচ সামলাবে কিভাবে? 

বিভিন্ন চিটফ্যান্দের থেকে, তোলাবাজি থেকে রাজনৈতিক নেতা, নেত্রীরা ও ভ্রষ্ট প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা এখন কি উপায়ে টাকা নেন সেটাই দেখার। 

স্যার জি আমার কিছু প্রশ্ন আছে?

মূলত পাকিস্তানেই জাল নোট ছাপা হয় ভারতের ক্ষতি করবার জন্যে, আসল টাকার সঙ্গে তার এতটাই মিল যে সাধারণ মানুষ ধোঁকা খান অনায়াসে। এই প্রয়াস কে বন্ধ করার জন্যে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অবশ্যই সাধুবাদের যোগ্য। কিন্তু নতুন ৫০০, ২০০০ টাকার নোটও যে জাল হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? সোশ্যাল মিডিয়াতে তো এখনি নতুন ৫০০, ২০০০ টাকার ছবি চলে এসেছে, তাহলে ভাবের ঘরে সিঁধ কাটছে কোন জনা? আমরা সবাই জানি কাঁটাতার ডিঙ্গিয়ে এইদেশে আসে জাল টাকা, তাহলে কি সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়ানো উচিত নয়? বন্ধ করা দরকার সব রকমের ভ্রষ্টাচার, যাতে সীমান্তেই রুখে দেওয়া যায় এই ধরনের ঘৃণ্য উদ্যোগ। পাশাপাশি চুনোপুঁটি ছেড়ে সরকার যেন ঘাঘু রাঘব বোয়াল ধরাতেও মনোনিবেশ করেন। দেশকে ভিতর থেকে ফোঁপরা এইসব রাঘব বোয়ালরাই করে যাচ্ছে দিনের পর দিন ধরে। 

পরিশেষে, অবশেষে

আমাদের দেশে মূল, অন্যতম সমস্যা হল, আমরা সমালোচনা বেশি করি কিন্তু জাতীয় স্বার্থেও ঠিক একজোট হতে পারি না, নিজ স্বার্থে বিন্দুমাত্র ঘা পড়লেই ফুঁসে উঠি। আসুন না রাষ্ট্রের ভুল ভ্রান্তি ধরার পাশাপাশি দেশের স্বার্থে নেওয়া কঠিন পদক্ষেপের পাশে দাড়াই, কালো টাকার ও জাল টাকার বিরুদ্ধে এই লড়াই সব দেশবাসীর, একা কোনও সরকারের নয়। তাই একটু কষ্ট হলেও সরকারের পাশে থেকে ভবিষ্যতের দিকে একটু তাকাই আমরা।

অন্নদাতা সুখী ভব?


অন্নদাতা সুখী ভব?

কোনোমতে ট্রেনে উঠে ঠেলে থুলে ভিতরে এসে অভ্র দেখলো না তাঁদের গ্রুপের সবাই হাজির। সুরজিত গালাগালি দিয়ে বলল – শালা তাড়াতাড়ি বাড়ী থেকে বেরোতে পারিস না? ওইভাবে দৌড়ে কেউ ট্রেনে ওঠে? খসে যাবি তো বাবা। নে বস একটু জিরিয়ে নে। অভ্র কোনও কথা না বলে একটু হেঁসে বসে পড়ল, আসলে আজ তার মন টা ভালো নেই। অফিসে বেরোনোর আগে মধুমিতা মানে বউয়ের সাথে ঝগড়া করে বেড়িয়েছে সে। মধুমিতার আবদার এবারে তাঁকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতেই হবে, নইলে একটা বড় অ্যান্ডয়েদ ফোন চাই তার। তার সব বন্ধুর আছে, এই কি প্যাড দেওয়া ফোন আর চলছে না। মেয়ের গানের স্কুল থেকে বলে দিয়েছে একটা স্কেলচেঞ্জার হারমোনিয়াম কিনে দিতে, মেয়েটা ভালই গায় অভ্রর। অভ্র হিসেব কষে দেখেছে প্রায় ১৮-২০হাজার টাকার ধাক্কা, সে বেসরকারি ফার্মের অল্প মাইনের চাকুরে, হট করে এত টাকার ব্যাবস্থা করে কিভাবে? এই কথাটাই মধুমিতা কে বোঝাতে গিয়ে ঝগড়ার সৃষ্টি, ফলস্বরূপ লেটে স্টেশনে আসা। চিন্তা সুত্র ছিঁড়ে গেলো বিকাশের খোঁচায়, বিকাশ ফিসফিস করে বলে – এই কি এত ভাবছিস রে? শোন আজও দেবুদা আমাদের সবার কাছে ১০০০ টাকা ধার চেয়েছিল, আমরা কাটিয়ে গেছি। তোর কাছে চাইলে একদম দিস না। মালটা ফেরত দিতে ভোগাবে। বলতে বলতে উল্টোদিকের সিট থেকে দেবুদা মুখ বাড়িয়ে বলল – কি আজ লেটে কেন? শরীর ঠিক আছে তো? অভ্র মনে মনে বলল – ভ্যান্তারা ছেড়ে ঝেড়ে কাশও বাবা, মুখে বলল – না এই লেট হয়ে গেলো, আপনি কেমন আছেন দেবুদা? দেবুদা মুখ টা কাঁচুমাচু করে বলল – ভাই ভালো নেই, একটু টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, টা তোমার কাছে ১০০০ টাকা হবে, এই মাইনে পেয়েই দিয়ে দেবো কিচ্ছু ভেবনা। অভ্র বলল- না দাদা এখন তো হবে না, আপনি অন্য কার কাছে একটু্ দেখে নিন। দেবুদা শুকনো মুখে বসে পড়ল। পাশ থেকে অজয় বলল – শালা আবার পেট্রলের দাম ২৮ পয়সা বাড়ল, না দেখছি বাইকে চাপাই ছেড়ে দিতে হবে, মনে হচ্ছে সাইকেলেই স্টেশনে আসতে হবে এবার। নির্মলদা ফুট কাটল – এত সবে কলির সন্ধে, শুনছি গ্যাসের দাম ও বাড়বে। প্রতাপদা ওপাশ থেকে বলল – অচ্ছে দিন অ্যা গয়ে, বুজলে ভাই সাংসদদের মাইনে বাড়ছে। শুনে অজয় কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলে উঠলো – ওই হোক, আর আমাদের যে গত ৪ বছরেও স্যালারি বাড়েনি সেটার খোঁজ কে রেখেছে? কি বল অভ্র তোমাদের বেড়েছে? অভ্র শুকনো মুখে বলল – আর মাইনে বাড়ানো? চাকরি থাকবে কিনা কে জানে? 

(না নিছক কোনও গল্প লিখতে আমি বসিনি, হয়তো আসা যাওয়ার পথে এধরনের বারোমাস্যা আমরা শুনেই থাকি। মূল্যবৃদ্ধি আজ জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু এই নিয়ে কি কোনও প্রতিবাদ, আন্দোলন হয়? আমরা সীমান্ত সমস্যা, পাকিস্থান, হরেক উৎসব-মেলা নিয়ে মেতে আছি, টিভিতে আইপিএল, সিরিয়াল বিনোদনের কত কি? কিন্তু প্রদীপের নিচের অন্ধকার নিয়ে আমরা ভাবি না। প্রতিবাদের ভাষা আজ আমরা হারিয়ে ফেলেছি, আমাদের সামান্য স্বপ্ন - দুবেলা পেট পুরে অন্ন,  সুস্বাস্থ,  সুরক্ষিত একটা ছাদ,  পরনের বস্ত্র ও শিক্ষা। কিন্ত সেটুকুও চাওয়া বা পাওয়ার আশা রাখা যেন স্বপ্নের অতীত। সাধারণ আম আদমি খবরের কাগজে গ্যাসের দাম, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার খবরে চমকে ওঠে, ভাবে এই স্বল্প আয়ে কিভাবে চালাবে সংসার? ঝাঁ চকচকে ভারতের ভিতরে অনুজ্বল, ম্যাড়ম্যাড়ে একটা ভারত আছে সেটা কজন খোঁজ রাখে? যা চকচকে শপিং মল, মাল্টি প্লেক্স, রেস্তোরাঁ এসব দিয়ে ভারত কে বিছার করতে গেলে আমরাই ঠকে যাব। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের কথা কবে বুজবে জনদরদি নেতা ও নেত্রীবৃন্দ? একটু দেখে নেওয়া যাক জনতার ভোটে জিতে আসা জনতা জনার্দনরা সব কেমন আছেন? ভারতে একজন এমপি সারাবছরে – ৬ লাখ টাকা মাইনে, প্রতিদিন ২০০০ টাকা সংসদে হাজিরার জন্যে, ৫.৪ লাখ টাকা অফিস ও তার কর্মীর খরচ খরচা বাবদ পেয়ে থাকেন। এছাড়া অন্য সুবিধা গুলি হল – বিনা খরচে বাসস্থান, জল, চিকিৎসা ও ফোনের সুবিধা। ৩৪ টি প্লেনে যাতায়াতের সুবিধা, রেলে যাতায়াতের পাস। এছাড়াও এনাদের পরিবারও এই ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকেন। আর খোদা না খাস্তা, যদি পাঁচ বছরের পরে গদি না জুটলেও, পেনশন, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তো আছেই। কেউ একবার বলেছিল রাজনৈতিক নেতারা দেহত্যাগ না করলে গদিত্যাগ করেন না, সুতরাং পাঁচ বছর পরে রিটায়ারমেন্তের গল্প দূর অস্ত। বেস কয়েক বছর আগে একবার শুনেছিলাম তৎকালীন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করে বলেছেন, গ্রামে মাথাপিছু  প্রতিদিন ১৫ টাকা ও শহরে মাথাপিছু প্রতিদিন ২০ টাকা খরচ করতে পারলে পুরোপেট পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায়। চমৎকার স্যার ঠাণ্ডা ঘরে বসে এর থেকে ভালো আইডিয়া আসতে পারে না, জানিনা আজও এই রেটই বহাল আছে কিনা? আর একটি কথা জানলে হয়তো হাসি পাবে – আমাদের দেশে সবথেকে সস্তায় পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায় সংসদ ক্যান্টিনে। হ্যাঁ এটা সত্যিই, কিছুদিন আগেও সাংসদরা যারা এত কম আয় করেন, যে তাঁরা এক প্লেট ‘ফ্রায়েড ফিশ উইথ চিপস’ কিনতেন মাত্র ২৫ টাকায়। মাটন কাটলেট পেতেন আরও কমে, মাত্র ১৮ টাকায়। মশলা দোসা ৬ টাকায়! একবার ওই ক্যান্টিনে মধ্যাহ্নভোজন সেরেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভাত, রুটি, রাজমা, সার্সো কা সাগ, আলুর তরকারি আর দই খেয়ে তাঁকে দিতে হয়েছিল ২৯ টাকা। সংসদের ক্যান্টিনে ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে ১০ কোটি ৪০ লক্ষ, ২০১০-১১-এ ১১ কোটি ৭০ লক্ষ, ২০১২-১৩ সালে ১২ কোটি ৫০ লক্ষ এবং ২০১৩-১৪ সালে ১৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে কেন্দ্র। হিসেব বলছে, ভেজিটেবল স্ট্যু তৈরির উপকরণের বাজারদর প্রায় ৪২ টাকা। আর সেই খাবার মাত্র ৪ টাকায় কিনেছেন সাংসদেরা। অর্থাৎ ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় শতকরা ৯০ শতাংশ। এরপরেও আমাদের নেতৃবৃন্দ গ্যাসের উপর ভর্তুকি ছেড়ে দিতে আবেদন করবেন? সেন্টিমেন্তে সুড়সুড়ি দেওয়া লোভনীয় বিজ্ঞ্যাপনে কেন দেখতে হবে ভর্তুকি ছাড়া কেন উচিত? যেখানে মাছ, মাংস হোক বা ভাত-রুটি-বিরিয়ানি— সংসদের ক্যান্টিনে খাবার পাওয়া যায় সুলভে/ ভর্তুকিতে। জানিনা এখন এই চিত্রের পরিবর্তন এসেছে কিনা? মূল্যবৃদ্ধি রোখার পরিবর্তে এই ধরনের ক্যান্টিন দেশের সব জায়গায় খুলে দিলে আম আদমি চারবেলা পেট পুরে খেতে পারে।
 
মাফ করবেন আমি মাননীয় সাংসদদের অবমাননা করে কিছু বলছি না, ওনারা দেশের পথ প্রদর্শক, উন্নতির, আধুনিক ভারতের রূপকার ওনারা না হয় একটু সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেন তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এই আমরা মিডল ক্লাস মধ্যবিত্ত বা সমাজের নীচের তলার মানুষের কথা যদি একটু ভাবেন তাতে ক্ষতি কি? তাহলে প্রতিদিন তিল তিল করে যে যন্ত্রণা ভোগ করছি আমরা তার কিছু সুরাহা হয়। আজকাল তো নিউজ পেপারের পাতা উল্টালেই দেখা যায় অমুক শিল্পপতি, প্রভাবশালী ব্যাবসায়ি কর ফাঁকি, পিএফের টাকা, গ্রাচুইতির টাকা মেরে দেয়, ব্যাংকের পাওনা টাকা মেরে বিদেশে চলে যায়, চাপে পড়ে সাধারণ মানুষ। যেখানে ন্যায্য মজুরি, মাহিনা মেলে না, সেসব বেসরকারি ক্ষেত্রে একটু দৃষ্টিপাত করলে ভালো হয়। ২০১৬-র মে মাসের সরকারি পাইকারি মূল্য সূচক এবং সরকার প্রকাশিত বছর ভিত্তিক মুদ্রাস্ফীতির হারে দেখা যাচ্ছে, ডালে ৩৫.৫৬ শতাংশ, সবজিতে ২২.৯২ শতাংশ ও চিনিতে ২২.৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এরই সঙ্গে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার ৮ শতাংশেরও বেশি, যদি আমার দেওয়া তথ্যে ভুল থাকে সংশোধন কাম্য। আমাদের রোজকার খাদ্যদ্রব্য ডালের দাম আজ আকাশছোঁয়া। দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, কমছে কর্মসংস্থান। এমতাবস্থায় পরিত্রাণের পথ নিশ্চয়ই আমাদের মাননীয় নেতা ও নেত্রীবৃন্দই দেখাবে? হাজার হোক আপনারাই আমাদের প্রকৃত অন্নদাতা। আশা করব আমাদের এই আর্জি সহমর্মিতার সাথে বিবেচনা করা হবে, দেখবেন রাষ্ট্রদ্রোহী বলে তকমা লাগিয়ে দেবেন না যেন? জয় হোক নতুন ভারতের ও আমাদের নেতৃবৃন্দের - অন্নদাতা সুখী ভব।

Monday 7 November 2016

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, আর কিছু কথা


চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, আর কিছু কথা

শুরু হয়ে গিয়েছে ঐতিহ্যের শহর চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো, কৃষ্ণনগর না চন্দননগর মা জগদ্ধাত্রীর আরাধনায় কে এগিয়ে এই তর্ক আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু এই দুই জায়গার সাথে আজ একাত্ম হয়ে গেছে জগদ্ধাত্রী পুজোর চিরন্তন ঐতিহ্য।

পুরাণের পাতায় উকি দিয়ে একটু দেখে নেওয়া যাক কিছু তথ্য - জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ "জগৎ+ধাত্রী। জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)"। একবার ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র – এই চার দেবতা এমন অহংকারে মত্ত হয়ে ভুলে যান যে তাঁরা দেবতা হলেও তাঁদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই – মহাশক্তি দেবী দুর্গার শক্তিতেই তাঁরা বলীয়ান। এই দেবগণের ভ্রান্তি দূর করতে দেবী জগদ্ধাত্রী কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। এরপর দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে পারলেন না। তখন দেবগণ নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। তখন দেবী তাঁর তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন। সেই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ও দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এই মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তিকে দেখে দেবগণও তাঁর স্তবে বসেন৷ মা জগদ্ধাত্রী দেবী দুর্গার অপর রূপ, উপনিষদে এঁর নাম উমা হৈমবতী। মা জগদ্ধাত্রী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সিংহবাহিনী। তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। দেবীর গাত্রবর্ণ উদিয়মান সূর্যের ন্যায়। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর। ধ্যান বা স্তবমন্ত্রে উল্লেখ না থাকলেও জগদ্ধাত্রী প্রতিমায় বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, মা জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহাহস্তী রূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারণে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী নামে পরিচিত। মা জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজার ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। কাত্যায়নীতন্ত্র-এ কার্তিকী শুক্লা নবমীতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আবির্ভূত হওয়ার কথা আছে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী - এই তিন দিন জগদ্ধাত্রীর পূজা হয়ে থাকে।। কোথাও কোথাও প্রথম বা দ্বিতীয় পূজার পর কুমারী পূজারও আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার ন্যায় জগদ্ধাত্রী পূজাতেও বিসর্জনকৃত্য বিজয়াকৃত্য নামে পরিচিত। এমনকি পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্রও দুর্গাপূজার অনুরূপ।

এবারে একটু দেখে নেওয়া যাক চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস – কথিত আছে ফরাসী সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই পুজোর প্রবর্তক। এ কথা বহুল প্রচলিত যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মধ্যে সখ্যতা এবং যোগাযোগ ছিল। এক বার কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে পরের বছর ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পুজো সূচনা করেন, এটিও চন্দননগরের আদি পুজো বলে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে এই পুজোর সংকল্প হয়। তাই অনেকেই মনে করেন ইন্দ্রনারায়ণের মাধ্যমে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো চন্দননগরে প্রবেশ করেছিল।  যদিও এ কাহিনি নিয়ে মতান্তর আছে। কেননা, ইন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয়েছিল ১৭৫৬ সালে। আর ১৭৫৬-এ কৃষ্ণনগরে পুজোর প্রচলন হয়েছিল কি না তা নিয়ে দ্বিমত আছে। অন্যমত হল – লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের তৎকালীন চালের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এই পুজোর প্রচলন করেন। ১৭৯০ সালে সার্বজনীন বা বারোয়ারী পদ্ধতিতে এই পুজোর প্রারম্ভ হয়। যদিও কাপড়ে পট্টির ব্যবসায়ীরা বলেন আনুমানিক ১৭৬৮ সাল থেকে এই পুজো হয়ে আসছে, এটা যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে চাউলপটির থেকে এখানকার পুজো প্রাচীনতর। আবার এই জনশ্রুতি আছে যে - কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান দাতারাম শূরের হাত ধরে এই অঞ্চলে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ঘটে। দাতারামের বাড়ি ছিল ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি অঞ্চলে। এখানেই আনুমানিক ১৭৬২-র কাছাকাছি সময় দাতারামের বিধবা মেয়ে তাঁর বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন। গবেষকদের মতে এ পুজোতেও কৃষ্ণচন্দ্রের অনুদান ছিল। পরে পুজোটি স্থানান্তরিত হয় শিবতলা অঞ্চলে। পরবর্তী কালে মূলত আর্থিক কারণে পুজোটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে গৌরহাটি অঞ্চলের বাসিন্দারা পুজোটির দায়িত্ব নেন, সেই পুজোটিই আজ তেঁতুলতলার পুজো বলে প্রসিদ্ধ। 

কয়েকটি ঐতিহ্যশালী জগদ্ধাত্রী পুজো - উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি যা আদি মার পুজো নামেই অধিক বিখ্যাত। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। জনশ্রুতি আছে বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া অবশ্য কাপড়েপট্টি, ভদ্রেশ্বরের গঞ্জের পুজো, গৌরহাটি তেঁতুলতলার পুজো খুবই জনপ্রিয় ও বিখ্যাত। এছাড়া বাগবাজার, ফটকগোঁড়া, বিদ্যালঙ্কা, হেলাপুকর, নাড়ুয়া, চারমন্দির তলা, হাটখোলা ইত্যাদি পুজোও দেখার মতো।

পুজোর সেকাল ও একাল – আমি একজন খুব প্রবীণ ব্যক্তির কাছে একবার তাঁদের সময়কার জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা জানতে চেয়েছিলাম। উনি আমায় বলেছিলেন – জানো বাবা আজ চন্দননগরের আলোকসজ্জা তো আন্তর্জাতিক খ্যাতিলাভ করেছে, কিন্তু আমাদের সময়ে আলো বলতে থাকত পিতলের প্রদীপ, তাও জ্বলত মণ্ডপের ভিতর। রাস্তার দুপাশে থাকতো কিছু গ্যাস বাতি আর পেল্লায় সব প্রদীপ। কোনও কোনও জায়গায় হ্যাজাকের ব্যবহার ও হতো। আর তখন বিসর্জনের শোভাযাত্রায় জ্বালানো হতো মশাল, এছাড়া জেলেদের মাছধরার চিনেমাটির হাঁড়িতে ঘুঁটে কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালানো হত। সেই হাঁড়িটি একটি বাঁশের মাথাকে চার ভাগে ভাগ করে নিয়ে তাতে বেঁধে দেওয়া হত। অনেক সময় শোভাযাত্রার সামনে থাকত সঙের দল, রামায়ণ মহাভারত, কৃষ্ণলীলা, মহাদেব, বহুরূপী সেজে শোভাযাত্রায় চলত নানা অভিনয়, ওড়ানো হত ফানুস। এমনকী  তৎকালীন ফরাসী সাহেবরাও নাকি সেই সময় মেতে উঠতেন জগদ্ধাত্রী পুজোর উৎসবে। সেই সময়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হত বাঁশের মাচায় কাঁধে চাপিয়ে। কি মনকাড়া বিবরন তাই না? আমরা অবশ্য যারা চন্দননগরে বড় হয়েছি এসব দেখতে পাইনি, তবে আমরা দেখেছি টুনি লাইটের অদ্ভুত কারুকার্য, ইলেকট্রিক পাখাকে মোটরে রুপান্তরিত করে কাঠের ছোটছোট যন্ত্র বানানো হতো, সেই মোটরের ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস আওয়াজ আর টুনি লাইটের ঝিকিমিকি আজও মনে রঙ্গিন হয়ে আছে। পরবর্তীকালে অবশ্য এলইডি লাইট এসেছে, অনেক উজ্বল আর ঝকমকে কিন্তু টুনি লাইটের ঝিকিমিকি ভুলতে পারি নি আজও। তবে নানারকম খাওয়া দাওয়ার স্টল আজও একইরকম আছে, কি সব নাম সেই সব রেস্তোরাঁগুলির – উত্তম সুচিত্রা, দাদাবউদির রেস্তোরাঁ, দিল্লি দরবার আরও কত কি? আরও দেখতে পাওয়া যায় দূর দুরান্ত থেকে আগত বিভিন্ন রকমের জিনিসের মেলা, কাঠের পুতুল, বাঁশি, একতারা আজও পাওয়া যায় হাল ফ্যাশনের ইমিতেশন গয়নার, ইলেকট্রনিক, প্লাস্টিকের খেলনার পাশাপাশি। এই কটা দিন চন্দননগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা গুলি যথার্থ অর্থেই হয়ে ওঠে হাজারো মানুষের মিলনস্থল। একবার যাবেন নাকি চন্দননগরে? কথা দিচ্ছি ভালো লাগবেই, আমন্ত্রণ রইল আমার ভালোবাসার শহরে। 


Friday 4 November 2016

আমরা বাঙালী – পর্ব ১


আমরা বাঙালী – পর্ব ১

ছোটবেলায় যখন বাজার করতে যেতাম তখন একটু ভয়ে ভয়ে থাকতাম, পাছে ভোলা ঢুশো মেরে সাইকেল সমেত ফেলে না দেয়। আসলে ভোলার তোলা না পেলে মেজাজ বিগড়ে থাকতো, আসেপাশে যাকেই দেখতে পেতো ঢুশোতে ইচ্ছে হতো তার। ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি ভোলা আদতে একটি নধরকান্তি হৃষ্টপুষ্ট কেলে ষাঁড়। যার বীরত্ব ছিল ঢুশো মারাতে, এবিষয়ে ভোলা মনে হয় পিএইচডি করেছিলো। তবে ভোলা ছিল পিওর বাঙালী ষাঁড় (ধর্মের ষাঁড় বললেও অত্যুক্তি হবে না), বেঁছে বেঁছে দুর্বল মনুষ্যগুলিকে টার্গেট করতো। আর কোনও টার্গেট ভূতলশায়ী হলে তার ব্যাগের কলাটা মুলোটা উদরস্ত করতে দেরি করতো না, কাজ মিটলে অন্য টার্গেট। ভোলার থিওরি ছিল খুব ক্লিয়ার হাম্বা বলে একটি ডাক - দিলে দাও, নইলে আমার ঢুশো তো আছেই। এই জন্যে বাজারের সবজিওয়ালারা মানে মানে আলু, পটল, মুলো যে যা পারতো দিয়ে দিতো। ভোলার পেট ঠাণ্ডা থাকলে মেজাজ ফুরফুরে, তখন সে বান্ধবীদের আই মিন অন্য গরুদের পিছনে খানিক কেষ্ট লীলা করে শনি মন্দির লাগোয়া চাতালে শুয়ে ভোঁসভসিয়ে ঘুমাত। নো জাগতিক চিন্তা নো টেনশন।

আজকের বাঙালী যুব সমাজ অনেকটা ভোলার মতো, সুপ্ত আঁতেল, স্বপ্নবিলাসী, ভাববাদী, হচ্ছে-হবে ও স্বভাব বিপ্লবী, সুখী, অলস ও পেটুক মানসিকতার। এঁরা অসম্ভব কালচার সচেতন, বুকুনি ঝাড়ায় এক্সপার্ট। কি করতে হবে এই বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপ্লব তুলে ফেলছে, কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই করছে না, কাঁকড়ার সাথে আজও অদ্ভুত মিল, এখনও লেঙ্গিতে এগিয়ে।

বিশ্বাস করুন ট্রেনে, বাসে, অফিসে, পাড়ায় চায়ের দোকানে, সেলুনে, লাইব্রেরীতে যেখানে যাচ্ছি এই বাঙালী পিছু ছাড়ছে না। দেখে শুনে হেজে গেছি ভাই, তবে কি মুক্তির উপায় নাই? মনে পড়ে গেলো অনেকদিন আগে পড়া পুরন্দর ভাট নামক এক অজেয় কবির অজেয় উক্তি –

“উড়িতেছে ডাঁস, উড়িতেছে বোলতা, উড়িতেছে ভীমরুল,
নিতম্বদেশ আঢাকা দেখিলে ফুটাইবে তারা হুল।
মহাকাশ হতে গু-খেকো শকুন হাগিতেছে তব গায়
বাঙালি শুধুই খচ্চর নয়, তদুপরি অসহায়।“

Thursday 3 November 2016



চারিদিকে স্বার্থের ঠোকাঠুকি, ভণ্ডামির কোনও সীমা পরিসীমা নেই। কেন জানি না কবি নজরুলের একটি কবিতা – মানুষ বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। যখন বকধার্মিকেরা ধর্মের রক্ষায়, রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন কবিতাটির পংক্তিগুলো আরো বেশি সত্যি হয়ে উঠেছে, তাই আজ পুরো কবিতাটি তুলে দিলাম –


মানুষ - কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান–
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি ।
‘পুজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পুজার সময় হলো !’
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা- টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয় !
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনা তো সাত দিন !’
সহসা বন্ধ হল মন্দির , ভুখারী ফিরিয়া চলে
তিমির রাত্রি পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে !
ভুখারী ফুকারি’ কয়,
‘ঐ মন্দির পুজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয় !’
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি !
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে, ‘বাবা, আমি ভুখা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন !’
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা–”ভ্যালা হলো দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গে-ভাগাড়ে গিয়ে ! নামাজ পড়িস বেটা ?”
ভুখারী কহিল, ‘না বাবা !’ মোল্লা হাঁকিল- ‘তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ !’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা !
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে–
“আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তেমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করোনি প্রভু !
তব মজসিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী !”
কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড় ;
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া- দ্বার !
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায় কে দেয় সেখানে তালা ?
সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা !
হায় রে ভজনালয়
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয় !
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে ।
পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল !–মুর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো ।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এরা পিতা পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী করে প্রতি ধমনীতে বাজে !
আমরা তাঁদেরি সন্তান , জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ ।
হেস না বন্ধু ! আমার আমি সে কত অতল অসীম
আমিই কি জানি কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।
হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদি ঈসা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা ?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি ?
হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি !
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ–দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজানালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয় !
হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে
জন্মিছে কেহ-জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে !
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখেনি–হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে !
ও কে ? চন্ডাল ? চমকাও কেন ? নহে ও ঘৃণ্য জীব !
ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।
আজ চন্ডাল, কাল হতে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী পাঠ ।
রাখাল বলিয়া কারে কর হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে !
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে !
চাষা বলে কর ঘৃণা !
দেখো চাষা রুপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না !
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারও ধরিল হাল
তারাই আনিল অমর বাণী–যা আছে র’বে চিরকাল ।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি !
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে
দ্বার দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলৈ ।
সে মোর রহিল জমা –
কে জানে তোমারে লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা !
বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ দু’চোখ স্বার্থ ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলী ।
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা মথিত সুধা
তাই লুটে তুমি খাবে পশু ? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা ?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোনখানে !
তোমারি কামনা-রাণী
যুগে যুগে পশু ফেলেছে তোমায় মৃত্যু বিবরে টানি ।

ভাবের বাঙালি অথবা লোভী কাঙালির চুপকথা – পর্ব ১



ভাবের বাঙালি অথবা লোভী কাঙালির চুপকথা – পর্ব ১

এখন বাঙালী সুযোগ পেলেই ভাব ধরে তাও আবার দিন ও রাতের, ঋতুর পরিবর্তনে এমন কি বোধ হয় জোয়ার ভাটার সাথে পরিবর্তিত/ বিবর্তিত হয়। যদি এর কারন অনুসন্ধান করা যায় তাহলে দেখা যাবে স্বার্থ লাভের আশা কিংবা স্বার্থহানীর শঙ্কায় প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে/ বিবর্তিত হচ্ছে বাঙালী। ভালো ভালো ডারউইন সাহেব তো বলেই গিয়েছেন সময়ের সাথে বিবর্তিত না হলে মুছে যেতে হয় (যেমন ডাইনোসোরাসের ক্ষেত্রে হয়েছে) তাই রূপান্তর স্বাগত। বাঙ্গালীর আর একটি গুণ চোখে পরার মতো, বাঙালী নিজে অপরের দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারঙ্গদ, কিন্তু তাঁর মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বার্থের খোঁজ যাতে কেউ না পায়, সেই বিষয়ে যাতে কেউ মুখ খুলতে না পারে সেজন্যে তাঁর চেষ্টা তদ্বিরের কোনও ঘাটতি থাকে না।

"ধান ভানতে শীবের গীত" টাইপ গল্প হয়ে যাচ্ছে! যে কারনে এই গল্পের অবতারনা তা হলো, যেকোন ভন্ডামির মতো ভন্ড সেকুলারিজম বা মানবতাবাদও বিপদজনক। সম্প্রতি নিউজ পেপারের পাতা উল্টালে হোক বা সোশ্যাল মিডিয়াতে চোখ বোলালেই হোক দেখা যায় – রাষ্ট্রের দমন/ পীড়নের প্রতি একশ্রেণীর শিক্ষিত, উদারমনস্ক মানুষ গর্জে উঠেছেন বীরদর্পে, কোথাও তথাকথিত সেকুলারিজমের পক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন কেউ। আমি আগেও বলেছি আমি কখনই রাষ্ট্রকে একশো শতাংশ ক্লিনচিত দিতে পারি না, যখন রাষ্ট্রের মেকানিজমে আমার আপনার মতো আম আদমি বর্তমান তখন ভুল ত্রুটি হতেই পারে। কিন্তু কোথাও কোনও সংঘর্ষে সন্ত্রাসবাদীরা মারা গেলে গেলো গেলো রব না তুললেই কি নয়? সব সংঘর্ষই কি ভুয়ো? নাকি বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদী সাজার চেষ্টায় হিতাহিত জ্ঞ্যানশূন্য হয়ে পরেছি আমরা? আচ্ছা একটু দেখা যাক এই ধরনের সংঘর্ষে কারা মারা যাচ্ছে? কোনও প্রান্তিক চাষি, উপজাতির লোক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া আম আদমি? নাকি কোনও দাগী অপরাধী, যাদের অতীতে অপরাধের প্রমান/ যোগ আছে, জেল ভেঙ্গে, কর্তব্যরত নিরীহ রক্ষীকে হত্যা করে আরও বড় কোনও অপরাধ কে সংগঠিত করার উদ্দেশে পালিয়ে যাওয়া অপরাধী তাঁরা? যত মানবতাবাদ, নীতিকথা তাঁদের জন্যে যারা অতীতে অপরাধমূলক কাজে জড়িত, সাধারণ আ্ম আদমি্র হত্যার চক্রান্ত করে, সেই চক্রান্তের বাস্তব রুপ দেয় তাঁদের জন্যে? ইদানীং বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদীদের রোল মডেল কারা? বিক্ষোভের নামে কাশ্মীরে নিরাপত্তাবাহিনীর উদ্দেশে পাথর, গ্রেনেড, ধারাল অস্ত্র নিয়ে হামলাকারীরা? আর যেসব নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানরা মারা যাচ্ছেন কয় তাঁদের জন্যে তো বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদীদের কুম্ভীরাশ্রু বইতে দেখি না? বুরওয়ান ওয়ানি, ইয়াকুব মেনন, আফজল গুরু মারা গেলে এঁদের রাত্রে ঘুম চলে যায়? অথচও গঙ্গাধর দলুই, বিশ্বজিৎ ঘোরুই, তুকারাম আম্বলেদের কথা কতবার স্বরন করেছেন এনারা? অথচও কে এই বুরওয়ান ওয়ানি, ইয়াকুব মেনন, আফজল গুরু প্রমুখ সন্ত্রাসবাদীরা? কোনও মহাপুরুষ না দেশপ্রেমিক? তাহলে এই মেকি কান্না কেন?ফেসবুকে এই ধরনের পোস্টে বেশি লাইক পাওয়া যাবে, না নিজেকে উদারমনস্ক, সংখ্যালঘুপ্রেমী হিসেবে তুলে ধরা যাবে?

যারা দেশের বিচার বাবস্থার ভিত টলে যাওয়ার আশঙ্কায় সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করে দিচ্ছেন, তাঁদের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জোশ কি তাঁদের সব সময় এরকমই থাকে? প্রতিনিয়ত আমাদের চারিপাশে কতশত অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, মানবাধিকার কেন মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হচ্ছে, তারবেলায় এঁরা চুপ কেন? পাছে নিজের নিরাপত্তা, পরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়? নাকি দেশ, রাষ্ট্র বাবস্থা হচ্ছে সফট টার্গেট, এর বিরুদ্ধে মুখ খুললে নিজের ক্ষতি হবে না সেই জন্যে? যারা সাম্যবাদ ধার করে আনেন প্রতিবেশী চীন থেকে, ভোগবাদ আমদানি করেন পশ্চিমের উন্নত রাষ্ট্রগুলি থেকে, তাঁরাই অবহেলায় বলতে পারেন ভারত রাষ্ট্রে তাঁরা নিরাপদ নন, এখানে পদে পদে মানবাধিকার, সংখ্যালঘুশ্রেণীর উপর নির্মম অত্যাচার হয়ে চলেছে। সত্যিই তো কেএফসির বার্গার, ম্যাগনামের আইসক্রিম চুষতে চুষতে আরও উন্নত ভারতের স্বপ্ন দেখা কত সহজ? হয়তো ভারত রাষ্ট্রে বসবাস করি বলি এই স্পর্ধা, নইলে তথাকথিত উন্নত, গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রের সমালোচনা করলে কি হতে পারে সেটা বহুল প্রচলিত নিউজপেপারে চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়। আমরা দেশের দোষ ত্রুটি ধরার আগে নিজে দেশকে কি দিতে পেরেছি সেই হিসেব করেছি কোনদিন?

আমি কখনই অস্বীকার করতে পারি না রাষ্ট্রের ভুল হয় না, এমন অনেক ঘটনা থাকে যাতে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থের শিকার হয় সাধারণ মানুষ। সেই ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত, মেনে নেওয়া যায় না, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ অবশ্যই কাম্য। রাষ্ট্র ন্যাংটা হলে তাঁকে কাপড় পরানোর দায়িত্ব আমাদের কেই নিতে হবে কারন আমরা এই রাষ্ট্রেরই বাসিন্দা। কিন্তু মানবতাবাদের ধ্বজাধারীরা একবার তো ভেবে দেখবেন মানবতাবাদ তাঁদের জন্যেই যারা মানুষ, যারা মানুষের ভেকধারী হিংস্র পশু, যারা দেশের সংহতির পক্ষে বিপদজনক, আম আদমির রক্তের পিপাসু তাঁদের হত্যা করাই মানবধর্ম, যুগধর্ম। দেশে অতীতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী হামলাগুলি সাক্ষী, তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী, জেহাদিরা জাত ধর্ম জিজ্ঞেস করে হত্যা করেনি।       

খুব জানতে ইচ্ছে করে এইসব মানবতাবাদীদের কোনও নিকট আত্মীয়, ভালোবাসার কেউ যদি তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নির্মমভাবে মারা যেত কিংবা ধর্ষিত হতো, তখনও কি এত বড় বড় বুলি আওড়াতে পারতেন তাঁরা? খুব সম্ভবত নয়। আগুনের থেকে দূরে বসে আগুনের উত্তাপ অনুভব না করে আগুন কিভাবে নেবানো যায় সেই বিষয়ে তত্ত জ্ঞ্যান দেওয়াটা সহজ, ময়দানে নেবে আগুন নেভাতে সাহায্য করাটা অন্য ব্যাপার। 

আমি এমন বুদ্ধিজীবী, মানবদরদী শিক্ষিত ব্যক্তিদের জানি, যাদের খুব সাদামাটা প্রশ্ন করা হয়েছিলো – আপনারা তো বলেন ভারতে সাম্প্রদায়িকটার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে, অথচও প্রতিবেশী দেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, ভারতে নিজ ধর্মের লোক বিপন্ন এই জিগির তুলে অন্য সম্প্রদায়ের লোকের উপর হামলা হচ্ছে কই এই বিষয়ে তো আপনাদের কোনও বক্ত্যব্য শোনা যায় না? এতে ক্ষুব্ধ হয়ে একজন বলেছিলেন এইসব সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলবেন না আমি এই বিষয়ে কোনও কথা বলব না।

আমার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুসলমান, তাঁর মধ্যে একজন বাল্যবন্ধু, আমাদের বাড়িতে যতবার সে এসেছে একসাথে, এক প্লেটে খাবার খেয়েছি আমরা, ওদের বাড়িতে নিঃসঙ্কোচে ইদে খেতে গেছি, (আমাদের বাড়িতে নানান পুজো,অনুষ্ঠানে তারাও এসেছে) কাকিমা এক সাথে কোর্মা, ফিরনী, লাচ্চা খেতে দিয়েছে কই আমাদের মনে আজও তো কোনও ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়নি। আমি ও আমাদের মুসলমান বন্ধুরা খোলা মনে কখনও জঙ্গি ইস্যুতে পাকিস্থানের মুণ্ডপাত করেছি, আবার সেই দেশের গজলের, রান্নার সুখ্যাতিও করেছি, দেশ-ধর্ম বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। আসলে আমরা সাদা কে সাদা, কালো কে কালো বলেছি নিঃসঙ্কোচে, আমাদের সেকুলারবাদি, মানবতাবাদী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি। আজমল কাসাভ, আফজল গুরু, সালাউদ্দিন, মাসুদ আজাহার এরা সন্ত্রাসবাদী আগে, এদের ধর্ম পরে। আমি মনে করি না, কোনও ধর্ম অপর ধর্মের লোককে আঘাত করতে শেখায়, কোরান, গীতা নিয়ে যেসব লোকেরা বিবাদে জড়ায় তাঁরা কয়জন কোরান, গীতা পড়ে দেখেছে সন্দেহ আছে। 

অথচও বাঙালি বুদ্ধিজীবী, মানবদরদীরা ভোগের সময় যতটা না উল্লাস প্রকাশ করে, তার চেয়েও বেশি মাত্রায় করে ত্যাগের ক্ষেত্রে। তাদের আনন্দ প্রকাশের উল্লাসের তুলনায় শোক প্রকাশের কোলাহল অনেক তীব্র। তারা স্মরণে রাখার চেয়ে ভুলে যাওয়ার মধ্যে নিজেদের সার্থকতা প্রমাণের চেষ্টা করে। খোটা দেওয়ার অভ্যাস এবং ক্ষতস্থানে নুন ছিটিয়ে আনন্দ করাটাই তাঁদের অভ্যাস। তাই বোধ হয় প্যালেস্তাইনের মুসলমান উদ্বাস্তু বা লিবিয়ার যুদ্ধে জমিহারা মুসলিমদের জন্য, কাশ্মীরী মুসলমানদের উপর অত্যাচার করছে ভারতীয় সেনা এই ইস্যুতে রাস্তায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে মোমবাতি মিছিল করে, স্লোগান দেয় কিন্তু প্রতিবেশী দেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার কেন কমে আসছে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের দাবিতে, অন্যান্য ইস্যুতে সোচ্চার হতে পারে না। ধর্মের নামে ভনিতা বাঙালী বুদ্ধিজীবী, মানবদরদীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তাই তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াতে সেকুলারবাদি হয়ে উঠতে গিয়ে আদতে দেশের, সমগ্র দেশবাসীর ক্ষতি করে ফেলছেন এই উপলব্ধি কবে হবে কে জানে? অবশ্যই রাষ্ট্র স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে স্বাধীনতার জানালা বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু মেকি সেকুলার বা মানবতাবাদী হয়ে উঠতে গিয়ে আমরা আদতে রাষ্ট্রের, দেশবাসীর ক্ষতি করে ফেলছি নাতো? তসলিমা নাসরিনের কথায় বলতে পারি - আমার এখন লজ্জা নয় ভয় হয়।

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মনের কষ্টের, দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে, তাই কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত)

Wednesday 2 November 2016

এক বিস্মৃত মহান দেশপ্রেমিকের কথা


এক বিস্মৃত মহান দেশপ্রেমিকের কথা

অনেককাল আগের কথা, বৃত্তাসুর বলে এক অসুর ছিল, সে ব্যাটা শিবঠাকুরের থেকে এক বর আদায় করল যে দেব, দানব, মানবের তৈরি প্রচলিত কোন অস্ত্রে তাঁর মৃত্যু হবে না। আপনভোলা শিব ঠাকুর তো বর দিয়ে খালাস, এদিকে বর পেয়ে বৃত্তাসুর আরও অত্যাচারী হয়ে উঠলো, ক্রমে সে দেবলোক অবধি অধিকার করে নিলো। তখন দেবতারা বিচারের আশায় ভগবান বিষ্ণুর কাছে গেলেন, সব শুনে ভগবান বিষ্ণু বললেন – তোমরা নৈমিষারণ্যে ঋষি দধীচির কাছে যাও, তাঁর অস্থি দিয়ে প্রস্তুত এক নতুন অস্ত্র বজ্র দ্বারাই বৃত্তাসুরের নিধন সম্ভব। দেবরাজ ইন্দ্র খুশীতে ডগমগ হয়ে ঋষি দধীচির কাছে ছুটলেন, দয়ালু ঋষি দধীচি সব শুনে তৎক্ষণাৎ যোগবলে দেহত্যাগ করলেন। এদিকে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা সেই অস্থি দিয়ে বজ্র তৈরি করলেন, যা দিয়ে অধর্মী, অত্যাচারী বৃত্তাসুরের বধ সম্ভব হল, আর দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর স্বর্গের সিংহাসন ফিরে পেলেন।

না ধান ভাঙ্গতে শিবের গীত গাইছি না, এটা উদাহরণ রুপে ভাবতে পারেন সবাই। আসলে আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, চারিপাশে শুদুই লোভী, সংকীর্ণমনা মানুষের ভিড়। তা স্বত্তেও দেশের ভিতরে, বাইরে এমন কিছু বিরল দেশপ্রেমিকের নিদর্শন পাওয়া যায় যাদের দেখলে শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। মন নিজেকেই প্রশ্ন করে বসে এও কি সম্ভব? একজন ভারতবাসী হিসেবে সেইসব দেশপ্রেমিকের ঋণ পরিশোধ অসম্ভব, তেমনই একজন হলেন রবিন্দর কৌশিক। নামটা খুব অচেনা তাই না, হবেই কারন রাষ্ট্র এঁদের ভুলিয়ে দেয় নিজ প্রয়োজনেই।

রাজস্থানের এক অখ্যাত শহর শ্রীগঙ্গানগরে ১৯৫২ সালের ১১ই এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন রবিন্দর কৌশিক, প্রথম জীবনে তিনি একজন সফল থিয়েটার অভিনেতা ছিলেন। সেই সুত্রে মাত্র ২১ বছর বয়সে অংশ নেন লখনউতে আয়োজিত এক জাতীয় নাটক কর্মশালায়, এই কর্মশালা থেকেই অন্যদিকে মোড় নেয় তাঁর জীবন। কারন এই নাট্য সম্মেলনেই তিনি চোখে পড়ে যান রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইঙ্গের (RAW) কিছু পদস্ত্র অফিসারের, তাঁর অভিনয় কুশলতা দেখে ঠিক করা হয় তাঁকে আন্ডারকভার এজেন্ট হিসাবে পাকিস্থানে পাঠানো হবে। এর পর তাঁকে দিল্লীতে পাঠানো হয় দুবছরের জন্যে RAW এর অধীনে কঠোর এবং নানাপ্রকার গোপন প্রশিক্ষণের জন্যে। কেমন ছিল সেইসব প্রশিক্ষণ? শারীরিক, অস্ত্র প্রশিক্ষণ ছাড়াও তাঁকে শিখতে হয় উর্দু, এবং কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষা। সৌভাগ্যক্রমে শ্রীগঙ্গানগরে বড় হয়ে ওঠার সুবাদে কৌশিক কয়েকটি ভাষা জানতেন যা পাকিস্থানের পাঞ্জাব প্রদেশের কথ্য ভাষা। এরপর তাঁকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব তথ্য সম্বন্ধে অবহিত করানো হয়, পড়ানো হয় কোরান। যখন তিনি আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবে পুরোপুরি তৈরি, ১৯৭৫ সালে কোনও এক ঝড়জলের রাতে পাকিস্থানের বর্ডার গার্ডদের চোখে ধুলো দিয়ে শত্রু দেশের মাটিতে পা রাখেন তিনি, নতুন নাম নেন নবি আহমেদ শাকির।

এর পরের অনেকটাই আমাদের অজানা, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সিভিলিয়ান ক্লার্ক হিসেবে যোগদান  করেন পাকিস্থান আর্মিতে, বিশ্বাস যোগ্যটা বাড়াতে বিয়েও করেন ‘আমানত’ নামে একজন মুসলিম মেয়ে কে, যার বাবা পাকিস্থান আর্মির অন্য একটি ইউনিটে দর্জি ছিল।

পরবর্তীকালে তিনি নিজ প্রতিভায় পাকিস্থান আর্মির উচ্চপদে উঠে আসেন, পাশাপাশি অত্যন্ত গোপনে এবং নিঃশব্দে চলতে থাকে একজন আন্ডারকভার এজেন্টের সব কাজ। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে পাক সরকারের ও সেনাবাহিনীর বহু গোপন তথ্য ভারতে পাচার করেন তিনি। বহুবার তাঁর পাঠানো তথ্যের জন্যেই পাক সেনা ও জঙ্গিদের বিভিন্ন হামলা ও পরিকল্পনা বানচাল করতে সমর্থ হয় আমাদের দেশ। এই কাজে তাঁর কোড নেম ছিল ‘ব্ল্যাক টাইগার’। কিন্তু ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে নেমে আসে বিপর্যয়, তাঁকে সাহায্য করার জন্যে পাকিস্থান পাড়ি দেয় আর একজন আন্ডারকভার এজেন্ট, যার কোড নেম ছিল ইনায়ত মসিহা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, কিছু ভুলের জন্যে তথ্য আদানপ্রদানের সময় ইনায়ত মসিহা ধরা পড়ে যায় পাকিস্থানি গোয়েন্দা বিভাগের হাতে। ইনায়ত মসিহা কে জেরা, টর্চার করে ‘ব্ল্যাক টাইগার’ এর আসল পরিচয় জানতে পারে পাকিস্থানের গোয়েন্দা বিভাগ। এরপরেই ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হন কৌশিক, এরপর শুরু হয় অকথ্য অত্যাচারের এক নির্মম কাহিনী। ১৯৮৫ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেই তদানীন্তন পাক সরকার, পরবর্তীকালে পাক সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে যা বদলে যায় যাবজ্জিবন কারাদণ্ডে। কিন্তু কোনভাবেই কোনও তথ্য ফাঁস করেননি এই দেশপ্রেমিক মানুষটি। একটিও কথা, তথ্য না বের করতে না পারার রোষে একবছর, দু বছর নয় টানা ১৬ বছর ধরে পাকিস্থানের বিভিন্ন যেমন শিয়ালকোট, লাখপত, মিলানওয়ালি প্রমুখ জায়গার কারাগারে অকথ্য, নির্মম অত্যাচার চালানো হয় তাঁর উপর। অবশেষে ১৯৯৯ সালের ২৬শে জুলাই মুলতানের নিউ সেন্ট্রাল জেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই অসমসাহসী বীরযোদ্ধা। পাক সরকারী নথিতে কারন হিসাবে অ্যাজমা, যক্ষ্মা, হৃদরোগের কথা উল্লেখ আছে, যার সত্যটা আমরা কোনদিনও জানতে পারব না, শোনা যায় জেলের পিছনেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়।

দেশের এই প্রকৃত বীরকে আমরা ভুলে গেছি, হয়তো সেটাই জাগতিক নিয়ম। নিশ্চয়ই এস্পিয়নেজ বা স্পাই জগতের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্র কোনদিনও এইধরনের এজেন্টদের স্বীকৃতি দেয় না, স্বাভাবিক নিয়ম কিন্তু যখন মেকি নায়কদের, সুবিধাবাদী নেতাদের নিয়ে মাতামাতির অন্ত নেই, চারিদিকে যখন সুবিধাবাদী, স্বার্থপর মানুষের এত ভিড় তখন কি আমরা একবারের জন্যে হলেও স্বরন করতে পারি না এই সব বীর দের? ২০১২ সালে ‘এক থা টাইগার’ সিনেমাটি তাঁর জীবনের অনুকরনেই বানানো। যদিও বাস্তবের কৌশিকদের কথা আমরা কতটুকুই বা জানি?

আজ দেশের পশ্চিমাংশে যখন আমাদের দেশের বীর সেনানীরা প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে পাকিস্থানের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে, তখন প্রণাম জানাই এই বীর শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিককে, সাথে অভিনন্দন জানাই সেই সব অগুনতি বীর সেনানী ভাইদের, গোয়েন্দা ভাইদের যারা আমাদের সুরক্ষায় প্রাণপাত করে লড়াই করে চলেছেন। জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম, ভারত মাতা কি জয়।

Tuesday 1 November 2016

বিপ্লব এসেছে হীরক রাজার দেশে


বিপ্লব এসেছে হীরক রাজার দেশে

‘‘এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে!’’, কি পাঠক সত্যজিত রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাটি মনে পড়ে গেলো তো। গপ্পের হীরক রাজা ছিলেন বড়ই দুষ্ট প্রকৃতির লোক, যেকোন মূল্যে মসনদ টিকিয়ে রাখতে সে ছিল বদ্ধ পরিকর। তিনি জানতেন জ্ঞ্যানলাভ বড় বাজে, প্রজারা তাঁর স্বরূপ জেনে গেলে মসনদটি উল্টে যাবে, তাই তাকে বলতে দেখা যায়, ‘এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে’। এ তো গেল চলচ্চিত্রের এক স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক রাজার কথা। কিন্তু এ যুগের বাস্তবের রাজারা থুড়ি নেতারা কি হীরক রাজার চেয়ে কোন অংশে কম! না একেবারেই না, তা না হলে কাশ্মীর উপত্যকায় একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগানো কেন হচ্ছে? গত চারমাস ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় স্কুল বন্ধ, ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই। এ কেমন স্বাধীনতার আন্দোলন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ কর্মসূচি? এতদিন বিভিন্ন বিক্ষোভ, প্রতিবাদ কর্মসূচিতে মিছিলের সামনে রাখা হচ্ছিলো, শিশু ও কিশোরদের। নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে পাথর ছুঁড়তে বাধ্য করা হচ্ছিলো তাঁদের, উদ্দেশ্য একটাই মিডিয়াকে, বহিঃবিশ্বকে দেখানো যে এই সংঘর্ষের শিকার শিশু এবং কিশোররাও, ভারতীয় বাহিনীর কি অমানবিক আর দমনমূলক আচরণ? কি সুন্দর চক্রান্ত্র? একদিকে মগজ ধোলাই করে শিশু ও কিশোরদের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ঠেলে দাও, অন্যদিকে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে শিক্ষার পথই বন্ধ করে দাও। না সাধু উদ্যোগ মানতেই হবে, একটা প্রজন্ম কে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে রেখে দিয়ে তাঁদের শিক্ষিত না হতে দিলে ভবিষ্যতে তাঁদের জন্যে কর্ম সংস্থানের বাবস্থা করা কঠিন, কিন্তু হাতে বন্দুক তুলে দেওয়া যাবে অনায়সেই। স্বাধীনতার লড়াইয়ে সিপাহীর যে বড় প্রয়োজন।  

তবে এখন কি প্রতিকার? না, হীরকরাজের শিক্ষামন্ত্রী তো বলেইছিলেন, ‘‘হিতাহিতের বিচার করেন কে? করেন হীরকরাজ’, কাশ্মীরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারা এই ষড়যন্ত্র বুজতে পারছেন কি?