Monday 7 November 2016

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, আর কিছু কথা


চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, আর কিছু কথা

শুরু হয়ে গিয়েছে ঐতিহ্যের শহর চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো, কৃষ্ণনগর না চন্দননগর মা জগদ্ধাত্রীর আরাধনায় কে এগিয়ে এই তর্ক আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু এই দুই জায়গার সাথে আজ একাত্ম হয়ে গেছে জগদ্ধাত্রী পুজোর চিরন্তন ঐতিহ্য।

পুরাণের পাতায় উকি দিয়ে একটু দেখে নেওয়া যাক কিছু তথ্য - জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ "জগৎ+ধাত্রী। জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)"। একবার ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র – এই চার দেবতা এমন অহংকারে মত্ত হয়ে ভুলে যান যে তাঁরা দেবতা হলেও তাঁদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই – মহাশক্তি দেবী দুর্গার শক্তিতেই তাঁরা বলীয়ান। এই দেবগণের ভ্রান্তি দূর করতে দেবী জগদ্ধাত্রী কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। এরপর দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে পারলেন না। তখন দেবগণ নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। তখন দেবী তাঁর তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন। সেই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ও দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এই মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তিকে দেখে দেবগণও তাঁর স্তবে বসেন৷ মা জগদ্ধাত্রী দেবী দুর্গার অপর রূপ, উপনিষদে এঁর নাম উমা হৈমবতী। মা জগদ্ধাত্রী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সিংহবাহিনী। তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। দেবীর গাত্রবর্ণ উদিয়মান সূর্যের ন্যায়। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর। ধ্যান বা স্তবমন্ত্রে উল্লেখ না থাকলেও জগদ্ধাত্রী প্রতিমায় বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, মা জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহাহস্তী রূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারণে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী নামে পরিচিত। মা জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজার ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। কাত্যায়নীতন্ত্র-এ কার্তিকী শুক্লা নবমীতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আবির্ভূত হওয়ার কথা আছে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী - এই তিন দিন জগদ্ধাত্রীর পূজা হয়ে থাকে।। কোথাও কোথাও প্রথম বা দ্বিতীয় পূজার পর কুমারী পূজারও আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার ন্যায় জগদ্ধাত্রী পূজাতেও বিসর্জনকৃত্য বিজয়াকৃত্য নামে পরিচিত। এমনকি পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্রও দুর্গাপূজার অনুরূপ।

এবারে একটু দেখে নেওয়া যাক চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস – কথিত আছে ফরাসী সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই পুজোর প্রবর্তক। এ কথা বহুল প্রচলিত যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মধ্যে সখ্যতা এবং যোগাযোগ ছিল। এক বার কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে পরের বছর ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পুজো সূচনা করেন, এটিও চন্দননগরের আদি পুজো বলে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে এই পুজোর সংকল্প হয়। তাই অনেকেই মনে করেন ইন্দ্রনারায়ণের মাধ্যমে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো চন্দননগরে প্রবেশ করেছিল।  যদিও এ কাহিনি নিয়ে মতান্তর আছে। কেননা, ইন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয়েছিল ১৭৫৬ সালে। আর ১৭৫৬-এ কৃষ্ণনগরে পুজোর প্রচলন হয়েছিল কি না তা নিয়ে দ্বিমত আছে। অন্যমত হল – লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের তৎকালীন চালের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এই পুজোর প্রচলন করেন। ১৭৯০ সালে সার্বজনীন বা বারোয়ারী পদ্ধতিতে এই পুজোর প্রারম্ভ হয়। যদিও কাপড়ে পট্টির ব্যবসায়ীরা বলেন আনুমানিক ১৭৬৮ সাল থেকে এই পুজো হয়ে আসছে, এটা যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে চাউলপটির থেকে এখানকার পুজো প্রাচীনতর। আবার এই জনশ্রুতি আছে যে - কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান দাতারাম শূরের হাত ধরে এই অঞ্চলে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ঘটে। দাতারামের বাড়ি ছিল ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি অঞ্চলে। এখানেই আনুমানিক ১৭৬২-র কাছাকাছি সময় দাতারামের বিধবা মেয়ে তাঁর বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন। গবেষকদের মতে এ পুজোতেও কৃষ্ণচন্দ্রের অনুদান ছিল। পরে পুজোটি স্থানান্তরিত হয় শিবতলা অঞ্চলে। পরবর্তী কালে মূলত আর্থিক কারণে পুজোটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে গৌরহাটি অঞ্চলের বাসিন্দারা পুজোটির দায়িত্ব নেন, সেই পুজোটিই আজ তেঁতুলতলার পুজো বলে প্রসিদ্ধ। 

কয়েকটি ঐতিহ্যশালী জগদ্ধাত্রী পুজো - উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি যা আদি মার পুজো নামেই অধিক বিখ্যাত। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। জনশ্রুতি আছে বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া অবশ্য কাপড়েপট্টি, ভদ্রেশ্বরের গঞ্জের পুজো, গৌরহাটি তেঁতুলতলার পুজো খুবই জনপ্রিয় ও বিখ্যাত। এছাড়া বাগবাজার, ফটকগোঁড়া, বিদ্যালঙ্কা, হেলাপুকর, নাড়ুয়া, চারমন্দির তলা, হাটখোলা ইত্যাদি পুজোও দেখার মতো।

পুজোর সেকাল ও একাল – আমি একজন খুব প্রবীণ ব্যক্তির কাছে একবার তাঁদের সময়কার জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা জানতে চেয়েছিলাম। উনি আমায় বলেছিলেন – জানো বাবা আজ চন্দননগরের আলোকসজ্জা তো আন্তর্জাতিক খ্যাতিলাভ করেছে, কিন্তু আমাদের সময়ে আলো বলতে থাকত পিতলের প্রদীপ, তাও জ্বলত মণ্ডপের ভিতর। রাস্তার দুপাশে থাকতো কিছু গ্যাস বাতি আর পেল্লায় সব প্রদীপ। কোনও কোনও জায়গায় হ্যাজাকের ব্যবহার ও হতো। আর তখন বিসর্জনের শোভাযাত্রায় জ্বালানো হতো মশাল, এছাড়া জেলেদের মাছধরার চিনেমাটির হাঁড়িতে ঘুঁটে কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালানো হত। সেই হাঁড়িটি একটি বাঁশের মাথাকে চার ভাগে ভাগ করে নিয়ে তাতে বেঁধে দেওয়া হত। অনেক সময় শোভাযাত্রার সামনে থাকত সঙের দল, রামায়ণ মহাভারত, কৃষ্ণলীলা, মহাদেব, বহুরূপী সেজে শোভাযাত্রায় চলত নানা অভিনয়, ওড়ানো হত ফানুস। এমনকী  তৎকালীন ফরাসী সাহেবরাও নাকি সেই সময় মেতে উঠতেন জগদ্ধাত্রী পুজোর উৎসবে। সেই সময়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হত বাঁশের মাচায় কাঁধে চাপিয়ে। কি মনকাড়া বিবরন তাই না? আমরা অবশ্য যারা চন্দননগরে বড় হয়েছি এসব দেখতে পাইনি, তবে আমরা দেখেছি টুনি লাইটের অদ্ভুত কারুকার্য, ইলেকট্রিক পাখাকে মোটরে রুপান্তরিত করে কাঠের ছোটছোট যন্ত্র বানানো হতো, সেই মোটরের ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস আওয়াজ আর টুনি লাইটের ঝিকিমিকি আজও মনে রঙ্গিন হয়ে আছে। পরবর্তীকালে অবশ্য এলইডি লাইট এসেছে, অনেক উজ্বল আর ঝকমকে কিন্তু টুনি লাইটের ঝিকিমিকি ভুলতে পারি নি আজও। তবে নানারকম খাওয়া দাওয়ার স্টল আজও একইরকম আছে, কি সব নাম সেই সব রেস্তোরাঁগুলির – উত্তম সুচিত্রা, দাদাবউদির রেস্তোরাঁ, দিল্লি দরবার আরও কত কি? আরও দেখতে পাওয়া যায় দূর দুরান্ত থেকে আগত বিভিন্ন রকমের জিনিসের মেলা, কাঠের পুতুল, বাঁশি, একতারা আজও পাওয়া যায় হাল ফ্যাশনের ইমিতেশন গয়নার, ইলেকট্রনিক, প্লাস্টিকের খেলনার পাশাপাশি। এই কটা দিন চন্দননগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা গুলি যথার্থ অর্থেই হয়ে ওঠে হাজারো মানুষের মিলনস্থল। একবার যাবেন নাকি চন্দননগরে? কথা দিচ্ছি ভালো লাগবেই, আমন্ত্রণ রইল আমার ভালোবাসার শহরে। 


No comments:

Post a Comment