বিশ্বকর্মার কিসসা
আরে ভাই বাঁদিকে পেটকাটা অনেকটাই বেড়ে এসেছে, ওটাকে টেনে
মার।
দাঁড়া আগে চাঁদিয়াল টা কে তো সামলাই।
হ্যাঁ রে তুই এবারে গনেশের দকান থেকে ঘুড়ি কিনিস নি, আমায়
বলছিল গনেশদা।
না রে এবারে উর্দি বাজারে একটা নতুন দোকান পেয়েছি, হেভি
স্টক আর দাম ও কম।
আরে শালা আমায় বললি না।
আরে আরে তোর ঘুড়ি সামলা, পেটকাটা তে নীচে দিয়ে টানছে, যা ভো
কাট্টা।
ধুসস গেল রে।
ছটফট করতে করতে ঘুম টা ভেঙ্গে গেল, চোখ
রগরে দেখি কোথায় পেটকাটা আর কোথায় সেই ছাদের আড্ডা, উল্টে দেওয়াল ঘড়িটা চোখ
রাঙাচ্ছে অফিসে না লেট হয়ে যায়?
কোনোমতে স্নান ছেরে, নাকে মুখে কিছু
গুঁজে, গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে, ঠিক চোখ পরে গেলো আকাশের পানে – ধুসস ফাঁকা আকাশ, ঘুড়ি
কোথায়? রাস্তায় এসে মাইকের আওয়াজ, আর বাবা বিশ্বকর্মার প্যান্ডেল মনে করিয়ে দিল
সত্যি আজ বিশ্বকর্মা পুজা। ট্রেনও আজ বেশ ফাঁকা, বসার সিট পেয়ে হারিয়ে গেলাম
ছোটবেলায়।
বিশ্বকর্মা পুজোর অন্তত একমাস আগে থাকতে আমাদের চোখে
ঘুম আসতো না উত্তেজনায়, এবারে কটা ঘুড়ি কিনব, কি মাঞ্জা দেব এসব ভাবতে আর সব জিনিস টাইমে জোগাড় করতেই দিন কাবার হয়ে যেত। বিশ্বকর্মা পুজোর এক দুদিন আগে মাঞ্জা দিতাম –
উফফ সে এক বিশাল কাজ ছিল, ভাঙ্গা টিউবলাইট জোগাড় করে হামান দিস্তায় তাকে মিহি করে
গুঁড়ো করোরে, মোটা দানার সাবু, গাব গাছের আঠা, হাল্কা নীল রঙ (যাতে আকাশে সুতোর রঙ
না বোজা যায়), তার পর টিপনি দেওয়ার জুতসই
লোক জোগাড় করা, নাওয়া খাওয়া ভুলে একটা বেলা এই নিয়ে কাটাতাম, আর বাড়িতে জুটত
বকুনি। সব ম্যানেজ করে বিশ্বকর্মা পুজোর সকালে যখন ছাদে যখন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ঘুড়ি
উড়াতে যেতাম, নিজেকে বিশ্বজয়ী মহারাজ মনে হত। একটা করে ঘুড়ি কাটা হত আর সম্মিলিত
স্বরে ভো কাট্টা, উফফ রক্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্নে যথেষ্ট। প্রতিপক্ষের ঘুড়ি তো
নয় যেন পাকিস্থানের ট্যাঙ্ক, না ওড়ালে শান্তি নেই কিছুতেই। এখন এসব ভাবলে হাসি
পায়, কিরকম ছেলেমানুষ ছিলাম আমরা? অন্তত পরের সাতটা দিন আমাদের আলোচনার টপিক থাকতো
এই ঘুড়ি ওড়ানো।
প্রত্যেক পাড়াতে একজন ঘুড়ি বিশারদ থাকতো,
আমাদের পাড়ায় ছিল হাবুল দা। হাবুল দা যখন চারমিনার ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে ছাড়তে
মাথা টা উঁচু করে বলত – শোন প্যাঁচ খেলাতা যে সে লোকের কম্ম নয়, অনেক ক্যালকুলেশন
করে খেলতে হয়। কখন ঢিল দিবি, খখন লাট দিবি ঘুড়ি কে এগুলো না জানলে ঘুড়ি তো ভো
কাট্টা হবেই। আর সন সব সুতোয় টেনে খেলা উছিত নয়, কালো গান এর সুতো হচ্ছে টেনে
খেলার জন্নে বেস্ট। আর ঘুড়ি এমন হটে হবে যে তোর হাথের ইশারায় খেলবে, তোর কথা
অনুযায়ী বাঁদিকে/ ডানদিকে লাট নেবে। আমরা সব মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনতাম, হাবুল দা
বলছে না পটলডাঙ্গার টেনিদা বলছে এটা বোঝা কঠিন ছিল। আমাদের কয়েকজন তো রীতিমতো হাবুলদার
ফাই ফরমাস খেটে তাঁর থেকে প্যাঁচ পয়জার শিখে আমাদের ঘুড়ি কেটে গর্বিত গলায় ঘোষণা
করত – এটা হাবুলদার শেখানো প্যাঁচ বাবা, এর থেকে বাঁচবি তুই ছোঃ? আমাদের মুখ গোমড়া
করা ছাড়া উপায় থাকতো নয়া। কেউ কেউ বলত হাবুল দা মাঞ্জাতে প্রসাদী মন্ত্রপূত জল দেয়
তাই ওর ঘুড়ি কেউ কাটতে পারে না। কেউ আবার বলত নারে আমি শুনেছি হাবুলদা কালো শিয়ালের
হাগু মিশিয়ে মাঞ্জা দিয়েছে। গাল গল্পের গরু গাছে উঠে যেত আর কি, এখন এসব ভাবলে
হাসি পায়।
মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় কতবার হাত কেটে ফালা
ফালা হয়ে যেত, কোনোমতে হাতে ব্যান্ডএড বা হান্সাপ্লাস্ত লাগিয়ে আবার নতুন উদ্যমে
লেগে পরতাম ঘুড়ি উড়াতে। কার হাত লাল তো কার নীল, কার বেগুনি হয়ে থাকতো মাঞ্জার
রঙ্গে। সাথে ঘুড়ি লোটা, হাত্তা মারা এগুলোর কথা আজকের প্রজন্ম জানলোই না। আজকের
দিনে টেকসাভ্যি বাবা মা রা ছেলে/ মেয়েদের হাতে ধরে পেটকাটা, চাঁদিয়াল, ময়ূরপঙ্খি
ঘুড়ি চেনান না বা দরকারে ছেলের সাথে লাতাই ধরা, মাঞ্জা দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন
না। তাই মোবাইল, ল্যাপটপেই গেম খেলে আজকের প্রজন্ম, বিশ্বকর্মা পুজোর নীল আকাশ
তাদের কাছে অধরা।
খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে হিন্দমোটরে যেতাম
বিশ্বকর্মা পুজা দেখতে, কি রমরমা অবস্থা ছিল তখন হিন্দমোটরের, প্রত্যেকটি ইউনিটে একটা
করে পুজো। এত প্রসাদ খেতে দিত যে পেট ভরে যেত, শেষে কাকুরা সব আমার সাধের রুমালে
বেঁধে দিতো, বলত পরে খাবে। আরে খাব কোন পেটে, পেট যে ভরে গেছে, কিন্তু কিছুতেই
শুনত না কথা জোর করে দিয়ে দিতো। অবশ্য পরের ইউনিটে অই প্রসাদ বাঁধা রুমাল দেখালেও
ছাড়ত না জোর করে কিছু না কিছু খাওয়াতই, আসলে তখন ভালবাসার টানটাই ছিল আলাদা। এর পর
অডিটোরিয়ামে ফ্যাংশান, খাওয়া দাওয়া, বাবার বন্ধুদের ছেলে মেয়েদের সাথে হইচই, সে
একটা দিন যেত বটে। আজ সেইসব অতীত, সেই গরিমা আর নেই, ধুঁকতে থাকা কংকালসার কারখানা
আর হতদরিদ্র, দুঃখী শ্রমিকদের শূন্য চোখের দৃষ্টি বলে দেয় সব হারানোর ব্যাথা। রিষড়া,
ব্যারাকপুর, উলুবেড়িয়া, হাওড়া সব শিল্পতালুকেই বিশ্বকর্মা আজ পিছু হটে গেছে। তাও
মাঝে মাঝে রঙ বেরঙের ঘুড়ির মেলা মনে করিয়ে দেয় জীবন একেবারে সাদা কালো হয়ে যায় নি।
No comments:
Post a Comment