India Unrevealed
Wednesday, 20 June 2018
Saturday, 4 November 2017
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা |
# কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা
উৎসবের দিনে ঘরে বসে থাকা দায়, অষ্টমীর রাতেই ভাবছিলাম ঘুরে এলেই হয় কাল যখন ছুটি আছে। আর কালই তো মহা নবমী, আর তার পরেই তো সেই বিষাদের দিন দশমী, আর আমার ছুটিও নেই যে বিসর্জন দেখা যাবে। অতএব এই সবেধন নীলমণি একদিন ছুটিতেই ঘুরে আসতে হবে, যাবার প্ল্যান করতে গিয়ে মনের কোণে উঁকি দিয়ে গেলো আর এক ঐতিহ্যের শহরের কথা, যেখানে এই জগদ্ধাত্রী পূজা হয় একদিনই, নবমীর পুন্য তিথিতে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন আমি কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যমণ্ডিত জগদ্ধাত্রী পুজার কথাই বলছি। চন্দননগরের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই এখানকার জগদ্ধাত্রী পুজার সাথে পরিচিত, কিন্তু কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যমণ্ডিত জগদ্ধাত্রী পুজার কথা শুনেছি মাত্র, যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে নাই।
এবারে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় মোবাইল নিয়ে বসে গেলাম প্ল্যান-প্রগ্রাম বানাতে, রাতে উত্তেজনায় ঠিক ঘুম এলো না, বারবার যেন চোখের সামনে ভাসছিল ইন্টারনেটে দেখা কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ী, বুড়ি মা, আদি মায়ের নয়নাভিরাম প্রতিমাগুলি।
ধুসস ঘুম ঠিক না হওয়ায় ভোর ভোর উঠে ফ্রেশ হয়ে ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম, চুঁচুড়া থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার সহজ রাস্তা হচ্ছে ফেরী পার করে উল্টোদিকে নৈহাটি ঘাট গিয়ে, ওখান থেকে নৈহাটি ষ্টেশন থেকে কৃষ্ণনগরের জন্যে লোকাল ট্রেন ধরা। আমিও যথারীতি ফেরী ঘাটে গিয়ে টিকিট কেটে অপেক্ষা করতে লাগলাম ফেরী সার্ভিসের জন্যে, যথা সময়ে ফেরী এলো আর আমিও টুক করে উঠে পড়লাম, ভোরবেলা হওয়ায় বেশ ফাঁকাই ছিল, ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া মেখে গঙ্গার বুক চিরে এই জার্নি বেশ ভালই লাগলো। ওপারে এসে একটা রিকশাও ঠিক পেয়ে গেলাম, ট্রেনের টিকিট কেটে যখন প্ল্যাটফর্মে এলাম দেখি – ও হরি বেশ ভালই ভিড়, যাচ্চলে সবাই কি কৃষ্ণনগরের যাত্রী? কে জানে ট্রেনে বসার জায়গা পাবো বলে তো মনে হচ্ছে না। ভারতীয় রেল, সুতরাং নির্ধারিত টাইমের একটু পরেই হেলতে দুলতে এলো বহুকাঙ্খিত লোকাল ট্রেনটি, ধাক্কাধাক্কি খেয়ে ট্রেনে উঠে কোনোরকমে একটা সীট বাগালাম। মোটামুটি সওয়া এক ঘণ্টার জার্নি, আর এই লাইনে যেহেতু বেশী যাতায়াত নেই তাই চারপাশের দৃশ্য দেখতে ভালই লাগছে। ভিড় ভালই হয়েছে, কিন্তু কিভাবে জানিনা না সহযাত্রী দুজন নেমে যাওয়ায় জানালার পাশে সীট পেলাম, আর আমায় দেখে কে? কানে হেড ফোন, জানালায় মাথা আর সাথে ছুটে চলা আকাশ, কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে মানা কোথায়? সম্বিৎ ফিরল একজনের ডাকার আওয়াজে – বলি কোথায় যাওয়া হবে? তাকিয়ে দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, সাধারণ প্যান্ট শার্ট পরা, কিন্তু চেহারাতে আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। হেঁসে বললাম – এই কৃষ্ণনগর যাবো। ভদ্রলোক হেঁসে বললেন – জগদ্ধাত্রী ঠাকুর দেখতে?আমি বললাম – হ্যাঁ। উনি বললেন একাই যাচ্ছ? বাহ বেশ। তো বাড়ি কোথায়? চুঁচুড়াতে বাড়ি শুনে বললেন সেকি তোমাদের ওখানেই তো মেলা ধূমধাম, সেসব ছেড়ে হঠাৎ এদিক পানে? কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ীর পূজা দেখতে আগ্রহী শুনে খুশী হলেন বেশ, বললেন হম তো এই রাজবাড়ীর পুজার ইতিহাস কিছু জানা আছে? নাকি এমনিই যাচ্ছ? আমি বললাম – না কিছুটা বিভিন্ন্য পত্র পত্রিকা, নিউজ পেপারে পড়েছি। উনি হেঁসে বললেন তাই তো শোনাও দেখি আমায় সেই গল্প দেখি কেমন জেনেছ তুমি? আমি বললাম- আমি সবটা জানি না তবে যেটুকু জানি বলছি, দেখুন আপনাকে তৃপ্ত করতে পারি কিনা? যতদূর জানি পুজোর প্রচলন নিয়েও রয়েছে একাধিক কাহিনি, প্রচলিত কাহিনি অনুসারে নবাব আলিবর্দি খানকে একবার রাজকর দিতে না পারায় কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র, সালটা বোধহয় ১৭৫৪।
শোনা যায়, সময়টা ছিল দুর্গোৎসবের কাছাকাছি। নবাবের কারাগার থেকে অবশেষে তিনি যখন মুক্ত হয়েছিলেন তখন দুর্গোৎসব প্রায় শেষ। নৌকায় কৃষ্ণনগর ফেরার পথে রাজা বুঝলেন, সে দিন বিজয়া দশমী। সে বার পুজোয় উপস্থিত থাকতে না পারায় ক্লান্ত বিষণ্ণ রাজা নৌকার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। জনশ্রুতি সেখানেই কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেছিলেন যে এক রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কুমারী দেবী তাঁকে বলছেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে।” সেই থেকেই নবমী তিথিতে হয় এই জগদ্ধাত্রী পূজা।
তবে অন্য এক কাহিনিও আছে - ইংরেজদের বন্ধু এই সন্দেহে ১৭৬৪ সালে মীরকাশিম মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রকে। শোনা যায়, মীরকাশিম নাকি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর দূত মারফত এই সংবাদ মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রাণ রক্ষার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। কারাগারেই কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীর স্বপ্নাদেশ লাভ করেন এবং কারাগার থেকে মুক্তিলাভের প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন। জনশ্রুতি, কিছু দিনের মধ্যেই তিনি সত্যি কারামুক্ত হয়েছিলেন।
এর পরেই কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে নিয়ে উপস্থিত হন মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে। কৃষ্ণচন্দ্র এই স্বপ্নের কথা জানান এবং জানতে চান কে এই দেবী? কালীশঙ্কর তাঁকে জানান, এই দেবী স্বয়ং চণ্ডী, প্রাচীন কালে এই দেবীর পুজোর প্রচলন ছিল। রাজা তখন জানালেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি এই দেবীর পুজোর আয়োজন করতে চান। এর উত্তরে কালীশঙ্কর জানান, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবীর পুজোর বিধান আছে। হাতে সময় কম থাকলেও কৃষ্ণচন্দ্র পুজোর সমস্ত আয়োজন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন পুজোয় পৌরোহিত্যের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। শোনা যায় কালীশঙ্কর রাজাকে যথাযথ সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
তবে, একটা সমস্যার কথা অনুমান করে কৃষ্ণনগরে না ফিরে সেখান থেকেই কৃষ্ণচন্দ্র সরাসরি গিয়েছিলেন চন্দননগরে তাঁর বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে। যাওয়ার আগে পুজোর সব দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে। তাঁরাই জগদ্ধাত্রী পুজোর সব আয়োজন করেছিলেন। আর বলেছিলেন, পুজোর আগের দিন রাত্রে তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরে আসবেন।
রাজপরিবারের কূলগুরু ছিলেন বৈষ্ণবাচার্য। তিনি নতুন এই শাক্ত দেবীর পুজোয় অনুমতি না দিলে পুজো করা সম্ভব হত না। তাই রাজা ঠিক করেছিলেন, পুজোর আগের দিন মধ্যরাত্রে কৃষ্ণনগরে ফিরবেন। আর পরের দিন সকালে অঞ্জলি দেবেন। তখন কূলগুরুর কোনও বাধাই কার্য্যকর হবে না।
ইতিমধ্যেই শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড় পুজোর সব আয়োজন করে রেখেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুজোর আগের দিন গভীর রাতে গোপনে কৃষ্ণনগরের প্রাসাদে ফিরে এসেছিলেন। এবং পর দিন সারা দিন উপবাসী থেকে পুজোয় অঞ্জলিও দিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হল রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো। গবেষকদের মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক। অনেকেই মনে করেন, পরের বছর থেকে চন্দননগরে পুজোর প্রচলন হয়েছিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে।
মোটামুটি এই হল আমার জানা কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজা শুরুর কথা, এর বাইরে আমার কিছু জানা নেই। ভদ্রলোক হেঁসে বললেন – না হে তুমি অনেকটাই জানো, আচ্ছা বল তো ইতিহাসের পাতায় কি উল্লেখ আছে এই জগদ্ধাত্রী পুজার? মাথা নেড়ে জানালাম না আমার ঠিক জানা নেই, আপনি যদি একটু বলে দেন ভাল হয়। শুনে উনি বললেন আমারও বিশেষ কিছু জানানেই, তবে এটুকু পড়েছি যে বাংলার পাল-সেন যুগের বিভিন্ন তন্ত্র গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রীর পুজোর। যেমন ‘মায়াতন্ত্র’-এ দেখা যায় - ‘প্রপূজয়েজগদ্ধাত্রীং কার্তিকে শুক্লপক্ষকে দিনোদয়ে চ মধ্যাহ্নে সায়াহ্নে নবমেহহন।’ এর অর্থ কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দিনের শুরুতে মধ্যাহ্নে এবং সায়াহ্নে জগদ্ধাত্রী পুজো করা যায়। বাহ কত সুন্দর তথ্য জানা গেলো ওনার দৌলতে, ওনার কাছেই শুনলাম জয়রামবাটিতে সারদা মা চালু করেন দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো, ছেলেবেলায় মা সারদা ছিলেন দেবীর ভক্ত। পরবর্তীকালে শ্রী শ্রী ঠাকুর একবার বলেছিলেন, ‘জগদ্ধাত্রীর মানে কী জানো? যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন। তিনি না ধরলে জগৎ পড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। মন্দকারীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে দেবী জগদ্ধাত্রীর উদয় হয়।’ তাই দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনায় তিন গুণের পুজো হয়। সপ্তমীতে স্বাত্ত্বিকী, অষ্টমীতে রাজষ্ট, নবমীতে তামষ্ট পুজো, আর যেখানে শুধু নবমীর দিনে পুজো হয় সেখানে সকালে, বিকেলে, সন্ধ্যায় ওই তিন গুণের উপাসনা হয়। ওনার কাছে আরও জানলাম দেবী জগদ্ধাত্রীর রুপ সম্বন্ধে - দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সিংহবাহিনী। তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। দেবীর গাত্রবর্ণ উদিয়মান সূর্যের ন্যায়। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর। ধ্যান বা স্তবমন্ত্রে উল্লেখ না থাকলেও জগদ্ধাত্রী প্রতিমায় বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, জগদ্ধাত্রী দেবী করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহাহস্তী রূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারণে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী নামে পরিচিত।
সত্যি কত কিছুই অজানা আছে, মানুষের সাথে মিশলে, আলাপ – আলোচনায় কত কিছু জানা যায়। একথা সেকথা বলতে বলতে বাইরে ষ্টেশনের দিকে তাকিয়ে বললেন – এইরে এবার গাড়ি তো রাণাঘাট ঢুকছে, আমায় নামতে হবে ভাই। তুমি যাও দেখে ঘুরে এসো, মা জগদ্ধাত্রী তোমার মঙ্গল করুন। বলে ভদ্রলোক রাণাঘাট ষ্টেশনে নেমে গেলেন, এতো গল্প হল, অথচও ওনার নাম, ফোন নাম্বার কিছুই নেওয়া হল না, অথচও বেশ গুণী লোক, ওনার সান্নিধ্য বেশ উপভোগ করছিলাম, এখন আবার সেই একলা। হেড ফোনে গান শুনতে শুনতে আর চারপাশের মানুষ দেখতে দেখতে কখন যে কৃষ্ণনগর ষ্টেশন এসে গেলো বুঝতেই পারলাম না, সত্যি মানুষ দেখার, আলাপ করার এই কুঅভ্যাস গেলো না দেখছি।
ষ্টেশনে বেশ ভিড়, কে জানে সবাই আমার মতন মাতৃ মূর্তি দর্শনের অভিলাষী কিনা? টোটো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে কিন্তু আমার পছন্দ হল সেই পুরাতন রিকশা কেই, ষ্টেশনের বাইরে এসে একটা রিকশাকে জিজ্ঞেস করাতে বলল – সব ঠাকুর টো দেখাতে পারবুনি তবে তোমায় নামকরা বেশ কিছু ঠাকুর দেক্ষে দেবো, এখুন চলতো বাপু, রাস্তায় যা জাম লেগেছে আর বলুনি।
রিকশা এগিয়ে চলেছে আপন তালে, আর আমি গ্যাঁট হয়ে বসে দেখে চলেছি চারপাশের দৃশ্য, কথায় কথায় জানতে পারলাম কাকার নাম নব কুমার বিশ্বাস, বাপ রে বাপ বঙ্কিম চন্দ্রের নব কুমার শেষে কৃষ্ণনগরে ভাবা যায় না? একটু বাদে রিকশা এসে দাঁড়ালো রাজবাড়ীর সিংহ দুয়ারের সামনে। কাকা বলল – যাও বাপু দেখে এসো, তবে বেশি সময় থেকুনি, এখনও বুড়ি মা যেতে হবে কিন্তু। ঘাড় কাট করে হ্যাঁ বলে মাথা তুলে মুগ্ধ হয়ে দেখি সামনের ভগ্নপ্রায় সিংহ দুয়ার, কিন্তু ইতিহাসের আভিজাত্যে ভরপুর। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সিংহ দুয়ার হয়ে,রাজবাড়ির তোরণ পেরিয়ে পঙ্খঅলঙ্কৃত নাটমন্দিরের দিকে পা বাড়াতেই পুরনো স্থাপত্য যেন ফিসফিস করে বলে ওঠে ইতিহাসের অজানা কথা। এক দিন এই পুজোকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল বাঙালির জগদ্ধাত্রী আরাধনা। আর কালের স্রোতে কিংবদন্তি, জনশ্রুতি আর ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে ‘বাংলার বিক্রমাদিত্য’ কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর প্রবর্তিত জগদ্ধাত্রী পুজো। ঘুরে ঘুরে দেখলাম সব কি দেখলাম জিজ্ঞাসা করবেন না, কারন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। ইতিহাসকে প্রাঞ্জল ভাবে উপস্থাপনা করা কি মুখের কথা। রাজবাড়ীর মনোমুগ্ধকর সানাইএর সুর, মনে যেন দোলা দিয়ে গেলো। সানাই বাদকদের ছবি নেব কিনা জিজ্ঞেস করতে ওনারা হেঁসে বললেন – হ্যাঁ তোল না, আমাদের আপত্তি নেই। রাজবাড়ী চত্বরে সেই সময় কার পালকি, রাজ সিংহাসন এসব দেখে মন ভরে গেলো, বেরিয়ে আসার সময়ে বার বার মনে হচ্ছিল পরের বার আবার আসবো। নিজের মনেই হেঁসে উঠলাম কাল কে দেখেছে পাগলা? কাল যদি আমিই না থাকি, তাহলে আসার প্রশ্ন আসছে কিভাবে?
বাইরে এসে দেখি কাকা বসে আছে, আমায় দেখে বলল- নাও চল বাপু বড্ড তেইম লাগগে দিলে, চল ছোট মা দেখিয়ে আনি। যাওয়ার পথে আর যা যা পড়বে দেক্ষে নিও। ছোট মা দেখে আরও কিছু ঠাকুর দেখে যখন বুড়ি মা দেখতে যাচ্ছি, পোস্ট অফিস তলায় পুলিশে আটকে দিল, কারন ওদিকে নো এন্ট্রি, কাকা বলল – যা ভিড় লেগেছে দেখতে পাবে? আমি বললাম – দাঁড়াও দেখে আসি, যদি বুঝি অনেক সময় লাগবে তাহলে ফিরে আসবো, আমায় বাড়িও যে ফিরতে হবে। একটু এগিয়ে দেখি ও বাবা সামনে জন সমুদ্র, কমসে কম আট-নশো লোকের লাইন, প্রায় দু কিমি লম্বা লাইন হবে মনে হচ্ছে। মনটা ভার হয়ে গেলো এতো দূরে এসে বুড়ি মা না দেখেই ফিরতে হবে? কিন্তু ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। বুড়ি মার উদ্দেশে প্রনাম ঠুকে এগিয়ে চললাম অন্যান্য ঠাকুর সন্দর্শনে। যেতে যেতে আর একটি দুঃসংবাদ দিল কাকা, বলল – বাপু মেজো মার কাছেও এরকমই ভিড়, যাবে কি? মনটা কেমন উদাস হয়ে গেলো, ধুসস এবারে দেখছি বাঁধাই বাঁধা। কাকা বোধহয় বুঝতে পারল মনের অবস্থা, বলল – মন খারাপ করো না, আমি তোমায় বেশ কিছু ঠাকুর দেখিয়ে দিচ্ছি, মেজো মা, বড় মা সবই তো মনে গো, এই মন থেইকে ডেকতে পারলে দেখবে সব ঠাকুরই তোমার কাছে বড় মা, মেজো মা হয়ে ধরা দিচ্ছে গো, মনই হল আসল। সত্যি কাকার কথাটা যেন আমার বিবেকের গালে সপাতে একটা চপেটাঘাত। এক গাল হেঁসে বললাম- ঠিক বলেছ কাকা, যা তুমি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছ, দেখ আমিই বুঝতে পারি নি। কাকা বলল – সে ঠিক আছে সকালে বেরিয়েছ মনে হচ্ছে কিছু খাবে? আমি বললাম – ভাল চায়ের দোকানে নিয়ে চল, একটু চা, বিস্কুট খেয়ে আবার ঠাকুর দেখা যাবে। সামনের একটা চায়ের দোকান থেকে দুজনে দুকাপ চা আর বিস্কুট খেয়ে যাত্রা শুরু হল। একে একে নেদিয়ার পাড়া, বেঁজি খালি, পল্লীশ্রী এসব মাতৃপ্রতিমা দর্শন করলাম।
কাকা বলল- বাপু এবারে তো ষ্টেশনে ফিরে যাবো, এখানে কেউ বেড়াতে এলে মিষ্টি না কিনে কেউ ফেরে না, তুমি কিনবেনা? আমি বললাম হ্যাঁ নিশ্চয়ই কিনবো, এখানে কথায় সবথেকে ভালো সরপুরিয়া পাওয়া যায় বলত? কাকা বলল- তুমি বাপু অধর দাসের দুকান ত্থিকেই নাও, দুপইসা বেশী হলেও খাঁটি জিনিস দেয়, চল যাওয়ার পথে ঘুরে যাবো দুকানে। কাকা নিয়ে গেলো অধর দাসের দোকানে, দেখে মালুম হয় বহু পুরানো দোকান। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এখনও, দোকানের সাজসজ্জা বেশ পুরানো। আমি চুঁচুড়া থেকে আসছি শুনে জিজ্ঞ্যাসা করলেন – ফিরে যাবেন? আর একটা দিন থেকে একেবারে ভাসান দেখেই যান। কিন্তু অফিস আছে শুনে বললেন বেশ পরের বার চেষ্টা করবেন কিন্তু, দেখবেন ভালো লাগবে। বেশ খানিকটা সর পুরিয়া কিনে, ফিরে চললাম ষ্টেশন অভিমুখে, পিছনে পড়ে রইলো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের এক উজ্জ্বল গাঁথা, যার শুরু হয়েছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে।
ষ্টেশনে এসে কাকার পাওনা আড়াইশো টাকা মিটিয়ে যখন ষ্টেশনে ফিরছি, কাকা বলল – বাপু সাবধানে যেও, আর পরের বার এলে আমার খোঁজ করো, আমি ওই রাজবাড়ী চত্বরেই থাকি গো। আমি বললাম – নিশ্চয়ই কাকা পরের বার এলেও তোমার রিকশা করেই ঘুরবো গো।
ষ্টেশনে এসে শুনলাম আপ কৃষ্ণ নগর লোকাল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে আর ওটাই ফেরার ট্রেন হবে, ষ্টেশন তখন ভিড়ে ভিড়ে ছয়লাপ। ভিড় থেকে কোনওমতে গেলাম তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে, নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরেই এলো ট্রেন, ভিড় ঠেলে উঠেও একটা বসার জায়গা মা জগদ্ধাত্রী ঠিকই পাইয়ে দিল। ট্রেন যখন ছেড়ে যাচ্ছিল, অদ্ভুত একটা ফিলিংস হচ্ছিলো, আপনজন কে ছেড়ে যাওয়ার ফিলিংস, বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছিল, মনে হচ্ছিলো, সত্যি দুদিন কাটিয়ে গেলে ক্ষতি কি? প্রান ভরে দেখা তো হবে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা। একটু বোকা বোকা ফিলিংস তাই না? আসলে আমি এরকমই বোকার হদ্দ অল্পেই আপন করে নিতে যাই আর আঘাত পেয়ে মুখ চুন করে বসে থাকি, হয়তো বোকার হদ্দগুলো সব এরকমই হয়। যাক গে বাদ দিন আমার কথা, আপনারা সবাই ভালো থাকুন, মা জগদ্ধাত্রী আপানাদের সবার মঙ্গল করুন, পারলে একবার ঘুরে আসবেন কৃষ্ণনগর, দেখবেন ভালো লাগতে বাধ্য। এই শহর পারে আপন করে নিতে, যাবেন নাকি একবার কৃষ্ণনগর? কে জানে কোনও নবকুমার বিশ্বাস বা বসে আছে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে! আজ এইটুকুই, ভালো থাকবেন।
Saturday, 8 July 2017
একটি বৃষ্টির দিনের ডায়েরি
একটি বৃষ্টির দিনের ডায়েরি
‘স্বপ্ন’ তোর কথা আজ অনেক বেশি করে মনে পড়ছে, হ্যাঁ অন্যান্য দিনের থেকে অনেক অনেক বেশি। ভোর থেকেই আঝরে ঝরছে বর্ষা, আধো ঘুমের মধ্যেই যেন টের পাচ্ছিলাম ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দ। উঠতে ইচ্ছে করছিলো না, কিন্তু মা-র জোরাজুরিতে বিছানা ছাড়তে হল, আড়মোড়া ভেঙ্গে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সাদা হয়ে বৃষ্টি পরে যাচ্ছে। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে এসে জানালার পাশে বসলাম, ভেবেছিলাম আজ তো বেরোবার কোনও উপায় নেই, তাই গান শুনে, তোর কথা লিখে কাটিয়ে দেবো আজকের দিনটা। কিন্তু বিধি বাম বসের ফোনের গুঁতোয় সব ছেড়ে এই বৃষ্টির মাঝে বেরোতেই হল, আর পৌঁছেও গেলাম কর্মস্থলে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি - ও হরি কেউ তো আসেনি, শুধু পিওন আর ক্লিনিং স্টাফ ছাড়া।
কি আর করি ল্যাপটপ খুলে বসে গেলাম আমার ব্লগ নিয়ে, কিন্তু কি অদ্ভুত ধুসস গত এক ঘণ্টা ধরে এক লাইনও লিখতে পারলাম না। বসে আছি অনেক কিছুই লিখব ভাবছি, কিন্তু লেখা বেরিয়ে আসছে কই? তার থেকে বরং তোর কথা ভাবতেই বেশি ভালো লাগছে। সামনের কাঁচ দিয়ে ওপারে তাকিয়ে রইলাম, রাস্তা শুনশান, সত্যিই এরকম বৃষ্টি তে কে আর বেরোবে? কিন্তু দেখলাম দূরে রাস্তা দিয়ে বাস, গাড়ি, মোটরবাইক সবই যাচ্ছে, কয়েকজন যেন ছাতা নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে, হয়তো আমারই মতন কেউ পাগল হবে। নিজের মনেই হেসে ফেললাম। আকাশ এমন কালো মেঘে ছেয়ে রয়েছে যেন মনে হচ্ছে এখন সন্ধ্যা। সামনের কবরস্থানের আমগাছ, লিচুগাছ, বাকি সব গাছগুলো কে দেখে মনে হচ্ছে একদল ছেলে মেয়ে হুল্লোড় করে ভিজেই চলেছে। রোজই তো দেখি কিন্তু আজ যেন সব নতুন লাগছে, রোজকার চেনা জায়গা যেন এক নতুন আবেশে ধরা দিলো আজ। না কবিগুরু ঠিকই বলেছেন - ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশির বিন্দু।’ আজ নিজের এই নতুন আবিষ্কারে খুব আনন্দ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি - ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে।’
আজ মনের ক্যানভাসে বারবার ভেসে উঠছে তোর ছবি, সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ছে, সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল, তবে এতটা জোরে নয়। আমি যথারীতি কলেজ কেটে স্ত্রান্দের ঘাটে গিয়ে বসেছিলাম রেলিঙে উঠে, মাথায় ছাতা আর সঙ্গী বলতে সিগারেট আর তোর ভাবনা। বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছি আর ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছি সামনের রাস্তার পানে, দেখছি কতো মানুষ এই বৃষ্টি মাথায় করেই ছাতা মাথায় হাঁটাহাঁটি করছে, কেউ কেউ আবার পলিথিন মোড়ানো রিকশায় বাবু হয়ে বসে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে।
জানিস ‘স্বপ্ন’ রিকশাওয়ালাগুলো কাকভেজা হয়ে রিকশা চালাচ্ছে, অবশ্য গরীব মানুষের আর বৃষ্টিতে ভিজলেই কি? খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে হলে তো বৃষ্টিতে ভিজেই রিকশা চালাতে হবে। ঠান্ডা-জ্বর ঝারি ওসব তো গরীবদের হয়না, ওসব রোগ বড়লোকদের, না রে? আমি, তুই বড়োলোক না হলেও ওদের মতো দিন আনি দিন খাঁই গোত্রের নয়, তাই আমি বৃষ্টির দিনে বসে বসে তোকে নিয়ে চিঠি লিখি, নষ্টালজিয়ার আক্রান্ত হই, বৃষ্টি বিলাসের নাম করে কফির কাপে চুমুক দিই, পায়ের উপর পা তুলে বাদলা দিনে প্রেমের গল্পের বই পড়ি, গান শুনি। যাক ছাড় সেদিনকার কথায় ফিরে আসি, সেদিন দেখেছিলাম রিকশায় বসে থাকা কয়েক জোড়া কপোত-কপোতীকে যারা বৃষ্টি সিক্ত না হয়েও বৃষ্টির রোমান্টিকতা কে অনুভব করছে দেহে আর মনে। আর আমি শালা বসে তোর চিন্তায় সিগারেট ফুঁকে চলেছি, সত্যিই তুই বড় বাজে ঠিক সময়ে কোনদিনও আসতে পারলি না! অলওয়েজ ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পরে স্টেশনে আসা হ্যাবিট তোর। বৃষ্টিতে মন ভাল হয়ে যাবে, হয়তো যাচ্ছিলও এমন সময় এক-ই ছাতার নীচে গল্প করতে করতে হেঁটে যাওয়া এক জোড়া ছেলে-মেয়েকে দেখে আবার তোর কথা মনে পড়ে গেল। ইসস, আজ যদি তুই আমার পাশে থাকতি? আমরা একসাথে হাঁটতাম, কতো গল্প করতাম। আমি জানি সেদিনটা সব থেকে ভালো আর সুখের দিনই হতো, কিন্তু হল না ভাগ্যের পরিহাসে তুই অন্যের হাত ধরে চলে গেলি সংসার করতে। আর আমি অন্যপথে!
আজ যখন আবার সেই ভাগ্যের খেলায় দেখা হল আমাদের, আমি জানলাম সুখী বিবাহিত জীবনের মুখোশের আড়ালে কি নিদারুন যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে, তুইও জানলি আমার সুখী জীবনের কথা, সেদিনকার কথা আবারও মনে পরে গেলো রে। জানি আজও তুই আমারই আছিস মনে মনে, বারবার বলেও ফেলিস, তাই আজ বৃষ্টির এই সুন্দর দিনে তোকেই আমি বারবার কাছে চাই। এই যে ‘স্বপ্ন’ তুই কি দেখতে পাচ্ছিস আমি আমার হাত এখনো তোর জন্য বাড়িয়ে রেখেছি? তুই আবার সেই আগের মত আমার পাশে এসে দাঁড়া, আমার হাতটা ধর। তোর স্পর্শে আমিও পরিপূর্ণ হই রে।
এটা একটা অসম্পূর্ণ চিঠি, যা বহুদিন আগেই জলে ভিজে হয়তো ছিঁড়েই গেছে, কোন এক পাগল ছেলে তার জীবনের আবেগঘন মুহূর্তে লিখেছিল তার প্রেমিকাকে, এখন অফিসের চার দেওয়ালের মাঝে, বাস্তবের তীব্র কশাঘাতে সে এখন শুদুই দায়িত্ব পালনে ব্যাস্ত। কেউ কিন্তু জানবেনা, মনে রাখবেনা এই ছেলেটা কোন এক অতীতে তার ‘স্বপ্ন’ কে ছুঁতে চেয়েছিল, প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চেয়েছিল, ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল।
(এটা ‘আঁখি’ আর ‘স্বপ্ন’ কে নিয়ে লেখা, যদি বাস্তবের চেনা কারোর সাথে মিল খুঁজে পান, সেটা নিতান্তই কাকতালিয় বলেই ধরে নেবেন, অনুগ্রহ করে অধমকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।)
Thursday, 6 July 2017
ঢিল পড়েছে ঠিক জায়গামতো, তাই কি ব্যাথায় কাতরে উঠেছে ড্রাগন?
ঢিল পড়েছে ঠিক জায়গামতো, তাই কি ব্যাথায় কাতরে উঠেছে ড্রাগন?
কূটনৈতিক সূত্রের খবর, সিকিম সীমান্তে গোপন ঘাঁটি তৈরি করছিল বেজিং। ভুটানের সাহায্যে তাকে আঘাত করে গোটা বিষয়টিকে ভারত প্রকাশ্যে নিয়ে আসার পরেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে লাল চিন, তাই থেকে থেকে দেওয়া হচ্ছে চাইনিজ হুমকি।
একটু সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক এই ডোকা লা বিবাদের গল্প
ভুটান, চিন এবং ভারত (সিকিম)— এই তিনটি রাষ্ট্রের সীমান্ত যেখানে মিশেছে, সেখানেই বিতর্কিত ডোকা লা মালভূমি। যে ৭৬৪ বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ডের দখল নিয়ে ভুটানের সঙ্গে চিনের দীর্ঘকালীন চাপানউতোর চলছে, ডোকা লা অবস্থিত সেখানেই। কি ঘটেছিল সেইদিন - মাস দু’য়েক আগে চিনা ফৌজ এসে ডোকা লা-র লালটেন এলাকার বাঙ্কারগুলি ভেঙে দিতে বলে, সংগত কারনেই ভারত তাতে পাত্তা দেয়নি। শেষে চিনা সেনা সীমান্ত লঙ্ঘন করে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে বুলডোজার দিয়ে দু’টি বাঙ্কার ভেঙে দিয়েছে বলে অভিযোগ। ওই অঞ্চলে সীমান্ত পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশের (আইটিবিপি) ক্যাম্প সীমান্ত থেকে বেশ কিছুটা ভিতরে। ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ (এলএসি) বরাবর টহল দেওয়ার সময় ভারতীয় জওয়ানরা সীমান্ত লাগোয়া বাঙ্কারগুলিতে বিশ্রাম নিতেন। তাই বাঙ্কার ভাঙার খবর পেয়েই ক্যাম্প থেকে বাহিনী পৌঁছে যায় এলএসি-তে, ফলে বাড়তে থাকে উত্তেজনা।
অথচও সাম্যবাদের মক্কা বলে পরিচিত চীন কি করছিলো ডোকা লা তে? ডোকা লা চিনের এলাকা না হওয়া সত্ত্বেও, চিন ওই অঞ্চলে রাস্তা তৈরির চেষ্টা করছিল। কৌশলগত ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি অঞ্চলে চিন সামরিক ঘাঁটি তৈরির করার চেষ্টা করছিল, যাতে ভারতের স্বার্থ অরক্ষিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। রাস্তা তৈরির চেষ্টা ভারতীয় বাহিনী একাই আটকে দেয়। আর ভুটানকে সঙ্গে নিয়ে ভেস্তে দেওয়া হয় সামরিক ঘাঁটি তৈরির চেষ্টাও। সীমান্ত এলাকায় চিনের স্বেচ্ছাচারিতার চেষ্টা ভারত এই ভাবে আটকে দেবে, বেজিং তা একেবারেই আশা করেনি। তাই বাধা পেয়ে এখন সীমান্তে আস্ফালন শুরু করেছে চিনা বাহিনী।
ডোকা লা-য় চিন সামরিক পরিকাঠামো গড়লে ভারতের অস্বস্তির কারণ কী?
এই ডোকা লা মালভূমি উপত্যকা থেকে ‘শিলিগুড়ি করিডর’-এর দূরত্ব বেশি নয়। এখান থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে সহজেই পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। চিনের প্রবণতা এবং অতীতের রেকর্ড থেকে স্পষ্ট যে সড়ক গড়ার নাম করে সামরিক পরিকাঠামো তৈরি করতে চায় বেজিং। আর তা ভারতকে নিশানায় রেখেই। এছাড়া দক্ষিন চীন সাগরে চীনা আগ্রাসনের কথা আমরা সবাই জানি, এমতাবস্তায় চীন নামক শত্রু কে বিশ্বাস করা যায় কি?
ভারত বন্ধু ভুটানের ঘোষিত অবস্থান কি এই বিষয়ে?
এই বিবাদের মধ্যে ভুটান কিন্তু প্রত্যাশিত ভাবেই ভারতের পাশেই দাঁড়িয়েছে। দিল্লিতে ভুটানের রাষ্ট্রদূত ভেটসপ নামগিয়েল বলেছেন, ‘‘ডোকলাম অঞ্চলটি নিয়ে বিবাদ রয়েছে। তার চূড়ান্ত মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হবে বলে ভুটান ও চিনের মধ্যে চুক্তি সই হয়েছিল। কিন্তু চিন সেই চুক্তির খেলাপ করে ওই এলাকায় রাস্তা নির্মাণ করছে।’’ ডোকলামে চিনের কার্যকলাপের প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের একটি ডিমার্শেও পাঠিয়েছে ভুটান।
অতঃকিম, চীন নামক মহাশক্তিধর দেশের কি বক্তব্য?
তাদের সরকারি মুখপত্র ‘গ্লোবাল টাইমস’-এ ক্রমাগত হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে আমাদের। সে দেশের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র লু কাং মন্তব্য করেছেন, ‘‘চিনের ভূখণ্ডে অন্য দেশের নাক গলানো বরদাস্ত করা হবে না।’’ বা কখনও ১৯৬২ সালের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচও ১৯৬৭ সালের তাঁদের সন্মানজনক পশ্চাৎঅপসারনের কথা বলা হচ্ছে না। এছাড়াও উক্ত গ্লোবাল টাইমসে লেখা হয়েছে - ‘‘ভারতের সঙ্গে চলতে থাকা সীমান্ত সঙ্ঘাতে চিন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে, তার জন্য যুদ্ধ করতেও চিন প্রস্তুত।’’ মাঝে মাঝে ভারত মহাসাগরে ডেস্ট্রয়ার, ডুবোজাহাজ পাঠিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টাও চলছে। শেষে আবার সিকিম অন্তভুক্তি, উত্তর পূর্বরাজ্যে ঘটে চলা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দেওয়ার ভয়ও দেখানো হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন এটাই – “স্বাধীনতার পর থেকেই তো উত্তরপূর্বের জঙ্গি সংগঠন গুলিকে চীন সামরিক, আর্থিক ইত্যাদি সাহায্য প্রদান করে আসছে, তাহলে নতুন করে আর কি শুরু করবে তাঁরা?”
ভারতের প্রতিক্রিয়া
এই জায়গায় অধমের কিছু বক্তব্য আছে, সব পেয়েছির এই মহান দেশে মীরজাফরের, উমিচাঁদ এর মতো লোকের অভাব তো নেই, বিভিন্ন্য দেশজ পত্র পত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধ বা যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় ভারতের কি করুন অবস্থা হবে সেই বিষয়ে প্রভুত জ্ঞ্যান দেওয়া হচ্ছে। অথচও মাতৃভূমির অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্যে যুদ্ধ যদি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পরে তাতে সক্রিয় যোগদান বা সাপোর্টের কথা বলতে শুনছি না। ইতিহাস সাক্ষী ভারত আগ বাড়িয়ে কোনও দেশ আক্রমণ কিন্তু করেনি, অথচও ভারতকেই বারবার পড়শি দেশগুলির আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমতাবস্থায় তামাম মিডিয়াকুল, তথা রাজনৈতিক ব্যাপারী দের কাছে অনুরোধ যে দয়া করে জাতীয় সমস্যার সময়ে পাশে দাঁড়ান, নইলে আমও যাবে আর ছালাও থাকবে না, তখন বুড়ো আঙুল চোষা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।
এবিষয়ে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন কুমার চামলিং অগ্রগণ্য, তিনি সম্প্রতি বলেছেন - ‘‘চিন এবং বাংলার মাঝে স্যান্ডউইচ হওয়ার জন্য সিকিমের মানুষ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হননি।’ বা কি চমৎকার রাজনৈতিক প্রজ্ঞ্যা? চিন এবং বাংলার মাঝে সিকিম স্যান্ডউইচ হয়ে যাচ্ছে বলে যে মন্তব্য চামলিং করেছেন, তা কি চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞ্যানহীনতার প্রকাশ নয়? সিকিম যেমন ভারতের অঙ্গরাজ্য, পশ্চিমবঙ্গও তেমনই, দুই রাজ্যের মধ্যে যদি কোনও সমস্যা থেকেও থাকে, তা হলেও সেই সমস্যাকে কি ভারত-চিন দ্বন্দ্বের সঙ্গে এক পংক্তিতে ফেলে দেওয়া যায়?
কি বলেন প্রাজ্ঞ্য সেকু/মাকু বিদ্দজনের দল? তাঁরা কি এখনও নীরবতা পালন করবেন না জাতীয় স্বার্থের খাতিরে প্রতিবাদ জানাবেন সেটা তাঁরাই ঠিক করুন।
বাদুড়িয়া, স্বরূপনগর, বসিরহাট প্রসঙ্গে
বাদুড়িয়া, স্বরূপনগর, বসিরহাট প্রসঙ্গে
“ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায়ে বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।
বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে,
নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে।“
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই কবিতাটি আজও কত প্রাসঙ্গিক, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে তাকালে বোঝা যায়।
বাদুড়িয়ায় কোন এক ১৭ বছরের গবেট কিছু একটা ফটোশপড ইমেজ পোস্ট করায় তার বাড়িতে হামলা চালালো শতাধিক সংখ্যালঘু দুস্কৃতি। হ্যাঁ তাঁদেরকে দুস্কৃতি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না, কারণ তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে ধর্ম তাঁদের বেসাতি, কিছু কামিয়ে/ লুটে পুটে নেওয়ার মাধ্যম মাত্র।
এবার ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যাক, প্রথমেই আসি ছেলেটির কথায়। ছেলেটি যা করেছে তা অবশ্যই অপরাধ, এবং তার জন্যে আইন ব্যাবস্থাকেই উদ্যোগী হয়ে শাস্তির বাবস্থা করতে হবে। কিন্তু দেখতে হবে এই ধরনের ছেলেগুলি যা করছে সেটা কি একপ্রকার ব্রেন ওয়াশের খেলার শিকার কিনা? আমার তো মনে হয় এঁরা বার খেয়ে, দেখ কেমন লাগে এই মানসিকতায় এসব পোস্ট পাবলিকলি শেয়ার করছে নাতো? আদৌ এঁদের সেই ম্যাচিওরিটি আছে তো? কারণ এধরণের পোস্টে যে আদৌ সমাজের কোনও ভালো হয়না এটা তাঁরা হয় বোঝে না, নয় বুঝতে চায়ও না। জাস্ট একটা গন হিষ্টিরিয়ার শিকার এঁরা, অমুকে এরকম কিছু করেছে আমাকেও এর পাল্টা কিছু করতে হবে। তাই এই প্রবণতাটিকেই অঙ্কুরে বিনাশ করতে হবে যাতে কারোর সাজানো খেলার স্বীকার না হয় কেউ।
ভারতের বেশিরভাগ ধর্মোন্মাদ জনতার সাথেই ক্ষ্যাপা কুকুরের তুলনা করা যায়। তারা লজিক বোঝেনা, আইন বোঝেনা, এমনকি ধর্ম কি তাও ভালো করে বোঝে কিনা সন্দেহ আছে? গীতা আর কোরান এর নামে যারা লড়াই করে, কজনে এই ধর্মগ্রন্থের পাতা উল্টে দেখেছে সন্দেহ আছে। ইদানীং সংখ্যালঘু জনতার মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে দিনের পর দিন যেন আরও বাড়ছে। কেউ দূর থেকে একটা মিউ মিউ করলেই ক্ষ্যাপা কুকুরের দলের মত তারা ছুটে যাচ্ছে কামড় বসাতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ নেমে আসছে অপর পক্ষের উপর, এটা কি পূর্ব পরিকল্পিত কোনও প্ররোচনা বা ষড়যন্ত্রের ফল এটাও ভেবে দেখতে হবে প্রশাসন কে।
আপাতত এই ঘটনাটার পর দুরকম রি-অ্যাকশন দেখছি – কিছু সংখ্যক আকাট গবেটদের যারা ওই ছেলেটির ফাঁসি চাইছে, কেউবা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে ছেলেটিকেও মেরে ফেলার পক্ষে। আর একদল হচ্ছে সেকু/মাকু শিক্ষিত পাবলিক, যাঁদের বক্তব্য হ্যাঁ মুসলিমরা যা করছে ভুল কিন্তু ওই ছেলেটি আরো বড় অপরাধী কারণ সে এই শান্ত সমাজে এতো বড় বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে, ছেলেটি ইচ্ছাকৃত ভাবে শান্তিপ্রিয় জনতাকে উসকেছে, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে। একটু ভেবে দেখবেন কি? যারা একটা ১৭ বছরের ছেলের একটা পোস্টে অস্ত্র নিয়ে ছোটে, দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধায়, তার আর যাই হোক শান্তিপ্রিয় জনতা নয়, সবকটা ব্রেনওয়াশড ধর্মোন্মাদ কিংবা নিছকই দুস্কৃতি। আর একটা ফটোশপড ইমেজে যদি আমার আপনার ধর্মের অসম্মান হয় তাহলে সেই ধর্মকে ইয়েতে গুঁজে রাখাই ভালো নয় কি?
আমি আবারও বলছি এধরণের গহিত কাজে যেকোন ধর্ম, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দোষী ঠাওরানো যায়, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা আইনি পদক্ষেপ কাম্য কিন্তু সবার আগে দায়িত্ববোধ আসাটা জরুরী। দেখুন না কুজাত, মন্দে আক্রান্তা কবিদের দল বা তথাকথিত সেকুলারবাদি/ মানবতাবাদীরা কি এই ধরনের ঘটনার/ দাঙ্গার নিন্দা করেছেন? মনে হয় না, অথচও এনারাই সুযোগ বুঝে নিজের আখের গোছানোর ধান্দায় রাম, রহিম কে উস্কে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না।
ভারতের মতো বহু ধর্ম, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি, বহু জাতি-উপজাতি-জনজাতির দেশে না হিন্দু মৌলবাদ কাম্য না ইসলামী মৌলবাদ কাম্য। তাই প্রতিবাদ করতে হলে সব ক্ষেত্রেই করা উচিত যাতে কোনও একটি পক্ষ তোষণের সুবিধা না পেয়ে বসে, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহল ও রাজনীতির ব্যাপারীরা সেটাই করে চলেছেন দিনের পর দিন ধরে।
এটা কি আমরা এখনও বুঝতে পারছি না যে এই অনৈতিক তোষণের ফলে কেবল হাত শক্ত হবে হিন্দু, মুসলিম উভয় মৌলবাদীদের। অপরদিকে সবথকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ শান্তিপ্রিয় হিন্দু-মুসলমানরা, যারা কোনভাবেই এই মৌলবাদীদের সমর্থন করেন না। আজকে এই সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কারা হচ্ছে? সেই আম আদমি খেটে খাওয়া জনগণই তো?
আমাদের প্রশাসন কে নিরপেক্ষ হতে হবে, ভোট ব্যাংকের রাজনীতি ছেড়ে দাঙ্গার সম্ভাবনা তৈরি হলেই, স্থানীয় গুণ্ডাদের ফাটকে পুরতে হবে, তা তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন। আসলে গুণ্ডারাই করে এসব, আর প্রতক্ষ বা পরোক্ষে মদত থাকে কিছু ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতা/ নেত্রী তথা ধর্মীয় নেতা দের, অথচও মরে সাধারণ গরীব, খেটে খাওয়া মানুষ। অদ্ভুত দেশ আমাদের এখানে এক দল হিন্দুত্বের হিড়িক তুলছে তো অন্য দল মুসলিমদের খেপাচ্ছে।
সাধারণ গরীব মানুষকেই বুঝতে হবে কারোর কোনও এক কথা বা সোস্যাল মিডিয়ায় কোনও একটা পোস্ট দেখেই খেপে উঠলে, মরতে হবে তাদেরই, বাড়ীঘর জ্বলবে তাদেরই, স্বজনহারা হবে তাঁদের পরিবারই। পথে নিশ্চয়ই নামুন কিন্তু তা খাদ্যের দাবীতে, জীবিকার দাবিতে, সম অধিকারের দাবীতে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করতে নয়।
আমরা, যারা বাঁদরবাহিনীর বাঁদরামি আর লাদেন, কাসভ বাহিনীর গুণ্ডামি দুটোকেই ঘেন্না করি, তাদের কিন্তু এবার ঐক্যবদ্ধ ও আক্রমণাত্মক হবার সময় এসেছে, আর দেরী করাটা ঠিক হবে না। আসুন আমরাও সমস্বরে গর্জে উঠি, প্রতিবাদ করি পিপুফিশুর দল ভারী না করেই।
কিন্তু আমরা কি করতে পারি? কিছু পথ আমি বলি, আর আপনারাও ভাবুন।
এই দাঙ্গা, হাঙ্গামায় এক বড় রসদ হচ্ছে গুজব আর সোশ্যাল মিডিয়া এখন সবচাইতে বড় রসদে পরিনত হয়েছে গুজব ও ঘৃণা ছড়াবার জন্য। আমাদের করনীয় এই ক্ষেত্রেই -
1. যদি ফেসবুক ওয়ালে এ কোন বিদ্বেষ মূলক পোস্ট আসে, তাতে Like, Comment বা Share তো করবেন ই না, পারলে comment এ জোরালো প্রতিবাদ করুন। কেউ ট্যাগ করলে তাঁকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করবেন না।
2. ওই রকম বিদ্বেষমূলক পোস্ট, ছবি, ভিডিওগুলিকে নিজের পেজ থেকে মুছে দিন, যিনি এই ধরনের পোস্ট দিচ্ছেন, তিনি আপনার পরিচিত বা অপরিচিত যাই হোক না কেন স্পষ্ট ও কড়া ভাবে বলুন যে ঐ পোস্ট মুছে দিতে, অন্যথায় আপনি প্রশাসন এর দ্বারস্থ হতে পারেন বলে জানিয়ে দিন। হাঁ ওই ব্যাক্তি আপনার যতই নিকট জন হোন না কেন, এক্ষেত্রে কড়া হোন, সম্পর্ক নষ্ট করার সাহস রাখুন।
৩. আপনি সরাসরি ফেসবুকেও রিপোর্ট করতে পারেন, সেক্ষেত্রে ফেসবুক ওরকম বিদ্বেষ মূলক পোস্ট মুছে দেয়। এমন কি ওই পোস্ট যিনি করেছেন তাঁর একাউন্ত ব্লক করে।
৪. অনেক সময় গ্রুপে যদি কেউ বিদ্বেষমূলক পোস্ট, ছবি, ভিডিও দিয়ে থাকে তাহলে এডমিন কে অবহিত করুন, যাতে ওই ধরনের নচ্ছার ব্যক্তিটিকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া যায়।
আপাততঃ এটুকু দিয়ে শুরু করা যাক, পথে তো নামি আগে, পরে নাহয় পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক করা যাবে।
কবিগুরুর একটি কবিতা দিয়েই লেখাটি শেষ করছি – “আজি এ ভারত লজ্জিত হে, হীনতাপঙ্কে মজ্জিত হে। নাহি পৌরুষ, নাহি বিচারণা, কঠিন তপস্যা, সত্যসাধনা। অন্তরে বাহিরে ধর্মে কর্মে সকলই ব্রহ্মবিবর্জিত হে।“
শুভ বুদ্ধির উদয় হউক, অশান্তির এই কালো মেঘ কেটে গিয়ে শান্তির, সদ্ভাবনার সূর্য উঠুক। সকলে ভালো থাকবেন আর ভালো রাখবেন।
Sunday, 2 July 2017
চন্দননগরের রথের ইতিকথা
চন্দননগরের রথের ইতিকথা
“রথ টানা সেই রঙ্গিন বিকেল আসবেনা আর ফিরে, শৈশবটাই হারিয়ে গেল দায়িত্ব বোধের ভিড়ে...।।” না আমার লেখা নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া এই দুই লাইন বোধ হয় মনে গেঁথে বসে গেছিলো আজ লেখার সময়ে মনে পড়ে গেল। আজ রাত্রি পোহালেই কাল উল্টো রথের টান, সপ্তাহভর যে উৎসবের সূচনা হয়েছিলো কাল তার পরিসমাপ্তি, আবার এক বৎসরের প্রতীক্ষা।
আজ চন্দননগরের রথের কথা বলব, ঐতিহ্যে ও প্রাচীনতার দিক থেকে মাহেশ আর গুপ্তিপাড়ার পরেই এই রথের স্থান। কথিত আছে ১৭৭৪ শ্রী যাদবেন্দু ঘোষ নামে এক আড়তদার (চাল ব্যবসায়ী) নিজ বাড়ীর নিমগাছের কাঠ দিয়ে এই রথ প্রস্তুত করান। এই রথের পিছনে যে জনশ্রুতি আছে যে রথযাত্রার সময়ে একবার শ্রী যাদবেন্দু ঘোষ মহাশয়ের শ্রীক্ষেত্র যাওয়ার ইচ্ছে হয়, সেইমতো লোকজন, পরিবার পরিজন সাথে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু অসুস্থতার কারনে তাঁর শ্রীক্ষেত্র দর্শন হয়ে ওঠেনি। বিফল, ভগ্নমনোরথ শ্রী যাদবেন্দু ঘোষ দুঃখে ভেঙ্গে পড়েন, তখন প্রভু জগন্নাথ দেবের সপ্নাদেশ পেয়ে ১৭৬৩ সালে পুণ্যতোয়া গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের নিকট জগন্নাথ দেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরের রথ প্রতিষ্ঠার কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি, যাই হোক উক্ত রথটি নির্মাণের প্রায় ১৮০ বৎসর পড়ে কালের নিয়মে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে, চন্দননগর রথ পরিচালনা সমিতির নিরলস কর্মী শ্রী মদনমোহন দাস ও তৎকালীন গোন্দলপাড়া জুট মিলের সাধারন সম্পাদক শ্রী প্রাণকৃষ্ণ মুখার্জী মহাশয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আর চন্দননগরের জনসাধারণের অনুদানে এবং M/S BRAITHWET & CO.LTD এর সহযোগিতায় আগের রথটির অনুকরণে আজকের এই লোহার, প্রায় ৬০ টন ওজনের রথটি নির্মিত হয়। শোনা যায় সেই ১৯৬২ সালেই আনুষ্ঠানিক ভাবে কাঠের রথটি বিসর্জন দেওয়া হয়, আর রথের গায়ে কারুকার্য করা কাঠের প্যানেলের কিছু অংশ এখনও চন্দননগর যাদুঘরে রাখা আছে।
কি ভাবছেন আসবেন নাকি ঐতিহ্যের শহর চন্দননগরে? আমন্ত্রণ রইল কিন্তু, আজ এই পর্যন্তই, আবার ফিরে আসবো এরকমই কোনও গল্প সাথে নিয়ে। সাথে থাকুন, সঙ্গে থাকুন। ভাল থাকবেন সবাই, শুভ রথযাত্রা। প্রভু জগন্নাথ দেব সবার মঙ্গল করুন।
তথ্যসূত্র – গুগুল, ছবিটি আমার এক বন্ধুর তোলা
রথযাত্রার ইতিহাসের সন্ধানে
রথযাত্রার ইতিহাসের সন্ধানে
আজ রাত্রি পোহালেই কাল উল্টো রথের টান, সপ্তাহভর যে উৎসবের সূচনা হয়েছিলো কাল তার পরিসমাপ্তি, আবার এক বৎসরের প্রতীক্ষা। রথযাত্রা নিয়ে আমরা সবাই আনন্দে, পরম উৎসাহে মেতে উঠি, আসুন আরও একবার জেনে নিই এই রথযাত্রার পিছনে লুকিয়ে থাকা সেইসব পৌরাণিক গল্পগাথা।
দ্বাপর যুগের কথা, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর অনেকদিন কেটে গেছে, যদু বংশও ধ্বংস হয়েছে নিজ দোষে বা বলতে পারেন মা গান্ধারীর অভিশাপে, শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকায়। ভগবান তো অন্তযামী, তিনি জানতেন ধরাধামে তাঁর লীলার পরিসমাপ্তি ঘটানোর সময় আগত। তাঁর ইচ্ছায় একদিন শবর জাতির এক ব্যাধ বাণ মেরে বসলো শ্রীকৃষ্ণের রাঙ্গা চরণে। আর সেই বাণ নির্মিত হয়েছিলো সেই মুষল এর অংশ দিয়ে, অতএব শ্রী কৃষ্ণ ত্যাগ করলেন এই পার্থিব দেহ, যাত্রা করলেন তাঁর আপন বিষ্ণু লোকে। সখা অর্জুন এই দুঃসংবাদ পেয়ে বিলাপ করতে করতে ছুটে এলেন দ্বারকায়, নিজ হাতে সমুদ্র তীরে প্রস্তুত করলেন এক চন্দন কাঠের চিতা, অগ্নি সহযোগ করলেন সেই চিতায়, দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন, গোটা দেহটা পুড়ে ভস্মে রূপান্তরিত হলেও, শ্রীকৃষ্ণের নাভিদেশ তো পুড়ছে না! তখনই হল দৈববাণী, ‘ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই যে ওঁর অনন্তশয়ন।’ অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম জ্যোতি স্বরুপ সেই নাভি। আর তাকে লক্ষ করে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলল অনার্য সেই শবর, তাঁর মনে যে পরম কষ্ট, তাঁর তার বাণেই মৃত্যু হল ভগবানের। এই দুঃখ সে রাখবে কোথায়? দ্বারকা থেকে পুরী পর্যন্ত ছুটে চলল সেই জ্যোতি স্বরুপ সেই নাভি, পিছনে সাঁতরে চলা সেই শবর ব্যাধ, অবশেষে এখানেই ঠাকুরকে স্বপ্ন দেখল সে, ‘কাল ভোরে আমাকে তুলে নে। এখন থেকে তোর বংশধর, শবরদের হাতেই পুজো নেব আমি’।
তখন থেকে নীলমাধবরূপে তিনি পূজিত হতে থাকলেন শবরদের কাছে, সময়ট তখন দ্বাপর যুগ। এরপর এলো কলি যুগ। কলিঙ্গের রাজা তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব, তিনি ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত। সেই উদ্দেশ্যে তিনি গড়ে তুললেন একটি মন্দির, শ্রীক্ষেত্রে, এখন আমরা যাকে চিনি জগন্নাথধাম বা পুরী রূপে। কিন্তু মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা গেল না কিছুতেই, দুঃখে কাতর রাজা মুহ্যমান হয়ে বসে আছেন রাজসভায়, রাজকার্যে আর তাঁর কোনও আগ্রহ নেই। এমতাবস্থায় রাজসভায় একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারলেন নীলমাধবের কথা - ইনি নাকি বিষ্ণুরই এক রূপ। অমনি চারদিকে ধার্মিক ব্রাহ্মণদের প্রেরন করলেন রাজা।
বাকিরা খালি হাতে ফিরে এলেও, ফিরলেন না একজন – বিদ্যাপতি। তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন সুন্দরী শবররাজ কন্যা ললিতা, নিয়ে এলেন তাদের বাড়ি। ললিতা শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা। প্রভু জগন্নাথের লীলায় ললিতার প্রেমে পড়লেন বিদ্যাপতি, বিয়ে হল দুজনের। বিয়ের পর বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন রোজ সকালেই শ্বশুর শবররাজ কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও উধাও হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। কোথায় যান শবররাজ বিশ্ববসু! কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করতে বিদ্যাপতি জানতে পারলেন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীলমাধবের পূজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু। আনন্দে নেচে উঠলো বিদ্যাপতির মন, রাজকার্য সমাধা করার দিন তাহলে আগত? নীলমাধবের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, তখন তো আর ছাড়ার নয়। অমনি বিদ্যাপতি বায়না ধরলেন, তিনিও দর্শন করবেন নীলমাধবকে।
শবররাজ বিশ্ববসু প্রথমে রাজি না হলেও, অবশেষে মত দিলেন, তবে শর্তসাপেক্ষে। বিগ্রহ পর্যন্ত চোখ বেঁধে যেতে হবে বিদ্যাপতিকে। জামাতা হলেও বিদ্যাপতিকে কোনভাবে নীলমাধবের সন্ধান দিতে রাজি ছিলেন না বিশ্ববসু। বিদ্যাপতিও ছাড়ার পাত্র নন, চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় তিনি গোটা পথটায় সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। যথাস্থানে পৌঁছে যখন তিনি দর্শন পেলেন নীলমাধবের, তখন তাঁর প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল। বনের মধ্যে পূজোর ফুল কুড়িয়ে এনে শবররাজ বিশ্ববসু যখন পূজোয় বসলেন, তখন দৈববাণী হল, ‘এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহাউপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই। তুমি সেই ব্যাবস্থাই কর শবররাজ।’ ভীষণ রেগে গেলেন শবররাজ। ইষ্টদেবতাকে হারাবার দুঃখে বন্দী করলেন বিদ্যাপতিকে। কিন্তু কন্যা ললিতার বারবার কাকুতি মিনতিতে বাধ্য হলেন জামাতাকে মুক্ত করতে।
চতুর বিদ্যাপতিও সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দিলেন রাজার কাছে। ইন্দ্রদ্যুম্ন মহানন্দে জঙ্গলের মধ্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, উদ্দেশ্য ঠাকুরকে সাড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে আনতে। কিন্তু একি, নীলমাধব কোথায়! কোথাও তো নেই তাঁর বিগ্রহ, অতএব আটক হলেন শবররাজ। তখন আবার দৈববাণী হল - যে সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে কাঠ। সেই থেকেই বানাতে হবে বিগ্রহ। যথা সময়ে ভেসে এল সেই দৈব কাঠ। কিন্তু হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া, সেপাইসাস্ত্রী, লোকলস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই কাঠ। শেষে কাঠের একদিক ধরলেন শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণপুত্র বিদ্যাপতি। অনায়সে উঠে এল সেই কাঠ, আসলে প্রভু জগন্নাথের কাছে ব্রাহ্মণ-শবর কোনও ভেদাভেদ নেই যে!
মহারাজ তাঁর কারিগরদের নির্দেশ দিলেন মূর্তি গড়তে। কিন্তু সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই যায় ভেঙে। তা হলে উপায়! মূর্তি গড়বে কে! মহারাজের আকুলতা দেখে বৃদ্ধের বেশে এবার হাজির হলেন স্বয়ং জগন্নাথ। তিনিই গড়বেন মূর্তি, তবে শর্ত একটাই। একুশদিন পরে তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে।
রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মেনে নিলেন তাঁর শর্ত, শুরু হল কাজ। ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণি গুন্ডিচা রোজই রুদ্ধ দুয়ারে কান পেতে শোনেন কাঠ কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ। চোদ্দদিন পর হঠাৎ রাণি শুনতে পেলেন সেই রুদ্ধদ্বার কক্ষ নিস্তব্ধ। একি হল, কী হল! কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে রাণি মহারাজকে জানাতেই চিন্তিত ইন্দ্রদ্যুম্ন খুলে ফেললেন কক্ষের দরজা। ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন বৃদ্ধ কারিগর উধাও, পড়ে আছে তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি, তাঁদের হাত, পা কিছুই গড়া হয় নি। গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন ভেবে দুঃখে ভেঙে পড়লেন রাজা। অন্নজল ত্যাগ করলেন রাজা, ইচ্ছা এইভাবেই প্রাণত্যাগ করবেন তিনি, রাত্রে তাঁকে স্বপ্ন দিয়ে প্রভু জগন্নাথ বললেন - যে এমনটা আগে থেকেই পুনর্নির্ধারিত ছিল, তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই শ্রী জগন্নাথদেবের মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
এবার জেনে নিই আরও কিছু কথা - জগন্নাথের প্রধান উৎসব হল রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেব বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরাম বা বলভদ্রকে নিয়ে রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি যান। সেখান থেকে সাতদিন পরে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। এই যাওয়াটাকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে।
রথের দিন তিনটি রথ পর পর যাত্রা করে মাসির বাড়ি, প্রথমে যাবেন বলরামের রথ, তারপর সুভদ্রা এবং সবশেষে মহাপ্রভু জগন্নাথের রথ। রথে চড়ে এই গমন ও প্রত্যাগমনকে সোজারথ এবং উল্টোরথ বলে।
জগন্নাথ ধামে, অর্থাৎ পুরীতে তিনজনের রথ তিন রকমের হয়, যথা – শ্রী জগন্নাথের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। উচ্চতা ৪৫ফুট, রথের গায়ে হলুদ এবং সোনালি রং। চলার জন্য এই রথে রয়েছে সাত ফুট ব্যাসের ১৬টি চাকা। রথের সারথির নাম মিতালি। এরপরে লাল ও সবুজ রঙের শ্রী বলরামের রথ নাম ‘তালধ্বজ’। উচ্চতায় শ্রী জগন্নাথের তুলনায় এক ফুট ছোট। রথে ছ’ফুট ব্যাসের চোদ্দটি চাকা থাকে, রথের সারথি সাত্যকি। এর পর আসি দেবী সুভদ্রার রথ প্রসঙ্গে, এনার রথের নাম ‘দর্পদলন’। উচ্চতা প্রায় ৪৩ফুট, রথের রঙ লাল এবং কালো। চাকা বারোটি, প্রত্যেকটির ব্যাস পাঁচ ফুট। এই রথের সারথি স্বয়ং অর্জুন। প্রতিটি রথেই সাতজন করে পার্শ্বদেবী অধিষ্ঠিত, সেই সঙ্গে দু’জন করে দ্বারপাল, একজন করে সারথি এবং একজন করে ধ্বজাদেবতা।
রথের কথা তো জানা হল এবারে জেনে নিই আমাদের ধর্ম গ্রন্থ, পৌরাণিক মত অনুযায়ী রথযাত্রার অন্তর্নিহিত অর্থ, কঠোপনিষদে বলা হয়েছে- আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু। বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মন: প্রগ্রহমেব চ।। অর্থাৎ - “এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী, আর ঈশ্বর থাকেন অন্তরে।“
শ্রী জগন্নাথ, শ্রী বলরাম আর দেবী সুভদ্রার এই রুপ সম্বন্ধে আর একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে টা হল এইরুপ যে - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করেন, তারপর তিনি আর বৃন্দাবনে আসেননি। কিন্তু একবার রথে করে পার্শ্ববর্তী গ্রামে এসেছিলেন বৃন্দাবনবাসীদের সাথে দেখা করতে। বৃন্দাবনবাসিরা শ্রীকৃষ্ণকে প্রাণাধিক ভালবাসত তাই তাঁর বিরহে তাঁদের করুন অবস্থা দেখে কিছুক্ষণের জন্যে কৃষ্ণ বলরাম সুভদ্রা তিন জন নির্বাক হয়ে যান, তখন তাঁদের এই অমূর্ত রুপ ফুটে ওঠে। কথিত আছে এই রূপই বর্তমান শ্রী জগন্নাথ, শ্রী বলরাম আর দেবী সুভদ্রার রূপ।
সময়, স্থান বিশেষে কত জনশ্রুতি, পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে তাঁর খোঁজ রাখা সম্ভব নয়। তবে এই রথযাত্রা এবং সামাজিক ঐক্যকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। আসলে এই রথ যাত্রার দিন কোন ভেদাভেদ থাকে না। ধনী,দরিদ্র, উচু, নিচু, স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য সবাই ভক্তি, শ্রদ্ধা আর ভালবাসার টানে একযোগে রাস্তায় নামে, আর আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভগবান সবার এবং এই মিলন মেলায় সবাইকে একত্রিত হতে।
আগামী উল্টোরথের শুভেচ্ছা রইলো, আজ এই পর্যন্তই, আবার ফিরে আসবো এরকমই কোনও গল্প সাথে নিয়ে। সাথে থাকুন, সঙ্গে থাকুন। ভাল থাকবেন সবাই, শুভ রথযাত্রা। প্রভু জগন্নাথ দেব সবার মঙ্গল করুন।
তথ্যসূত্র – গুগুল ও বিবিধ পত্র পত্রিকা, ছবিও গুগুল থেকেই নেওয়া।
Subscribe to:
Posts (Atom)