Thursday 6 July 2017

বাদুড়িয়া, স্বরূপনগর, বসিরহাট প্রসঙ্গে



বাদুড়িয়া, স্বরূপনগর, বসিরহাট প্রসঙ্গে

“ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায়ে বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।
বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে,
নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে।“

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই কবিতাটি আজও কত প্রাসঙ্গিক, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে তাকালে বোঝা যায়।

বাদুড়িয়ায় কোন এক ১৭ বছরের গবেট কিছু একটা ফটোশপড ইমেজ পোস্ট করায় তার বাড়িতে হামলা চালালো শতাধিক সংখ্যালঘু দুস্কৃতি। হ্যাঁ তাঁদেরকে দুস্কৃতি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না, কারণ তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে ধর্ম তাঁদের বেসাতি, কিছু কামিয়ে/ লুটে পুটে নেওয়ার মাধ্যম মাত্র। 

এবার ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যাক, প্রথমেই আসি ছেলেটির কথায়। ছেলেটি যা করেছে তা অবশ্যই অপরাধ, এবং তার জন্যে আইন ব্যাবস্থাকেই উদ্যোগী হয়ে শাস্তির বাবস্থা করতে হবে। কিন্তু দেখতে হবে এই ধরনের ছেলেগুলি যা করছে সেটা কি একপ্রকার ব্রেন ওয়াশের খেলার শিকার কিনা? আমার তো মনে হয় এঁরা বার খেয়ে, দেখ কেমন লাগে এই মানসিকতায় এসব পোস্ট পাবলিকলি শেয়ার করছে নাতো? আদৌ এঁদের সেই ম্যাচিওরিটি আছে তো? কারণ এধরণের পোস্টে যে আদৌ সমাজের কোনও ভালো হয়না এটা তাঁরা হয় বোঝে না, নয় বুঝতে চায়ও না। জাস্ট একটা গন হিষ্টিরিয়ার শিকার এঁরা, অমুকে এরকম কিছু করেছে আমাকেও এর পাল্টা কিছু করতে হবে। তাই এই প্রবণতাটিকেই অঙ্কুরে বিনাশ করতে হবে যাতে কারোর সাজানো খেলার স্বীকার না হয় কেউ।

ভারতের বেশিরভাগ ধর্মোন্মাদ জনতার সাথেই ক্ষ্যাপা কুকুরের তুলনা করা যায়। তারা লজিক বোঝেনা, আইন বোঝেনা, এমনকি ধর্ম কি তাও ভালো করে বোঝে কিনা সন্দেহ আছে? গীতা আর কোরান এর নামে যারা লড়াই করে, কজনে এই ধর্মগ্রন্থের পাতা উল্টে দেখেছে সন্দেহ আছে। ইদানীং সংখ্যালঘু জনতার মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে দিনের পর দিন যেন আরও বাড়ছে। কেউ দূর থেকে একটা মিউ মিউ করলেই ক্ষ্যাপা কুকুরের দলের মত তারা ছুটে যাচ্ছে কামড় বসাতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ নেমে আসছে অপর পক্ষের উপর, এটা কি পূর্ব পরিকল্পিত কোনও প্ররোচনা বা ষড়যন্ত্রের ফল এটাও ভেবে দেখতে হবে প্রশাসন কে।  

আপাতত এই ঘটনাটার পর দুরকম রি-অ্যাকশন দেখছি – কিছু সংখ্যক আকাট গবেটদের যারা ওই ছেলেটির ফাঁসি চাইছে, কেউবা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে ছেলেটিকেও মেরে ফেলার পক্ষে। আর একদল হচ্ছে সেকু/মাকু শিক্ষিত পাবলিক, যাঁদের বক্তব্য হ্যাঁ মুসলিমরা যা করছে ভুল কিন্তু ওই ছেলেটি আরো বড় অপরাধী কারণ সে এই শান্ত সমাজে এতো বড় বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে,  ছেলেটি ইচ্ছাকৃত ভাবে শান্তিপ্রিয় জনতাকে উসকেছে, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে। একটু ভেবে দেখবেন কি? যারা একটা ১৭ বছরের ছেলের একটা পোস্টে অস্ত্র নিয়ে ছোটে, দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধায়, তার আর যাই হোক শান্তিপ্রিয় জনতা নয়, সবকটা ব্রেনওয়াশড ধর্মোন্মাদ কিংবা নিছকই দুস্কৃতি। আর একটা ফটোশপড ইমেজে যদি আমার আপনার ধর্মের অসম্মান হয় তাহলে সেই ধর্মকে ইয়েতে গুঁজে রাখাই ভালো নয় কি? 

আমি আবারও বলছি এধরণের গহিত কাজে যেকোন ধর্ম, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দোষী ঠাওরানো যায়, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা আইনি পদক্ষেপ কাম্য কিন্তু সবার আগে দায়িত্ববোধ আসাটা জরুরী। দেখুন না কুজাত, মন্দে আক্রান্তা কবিদের দল বা তথাকথিত সেকুলারবাদি/ মানবতাবাদীরা কি এই ধরনের ঘটনার/ দাঙ্গার নিন্দা করেছেন? মনে হয় না, অথচও এনারাই সুযোগ বুঝে নিজের আখের গোছানোর ধান্দায় রাম, রহিম কে উস্কে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। 
  
ভারতের মতো বহু ধর্ম, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি, বহু জাতি-উপজাতি-জনজাতির দেশে না হিন্দু মৌলবাদ কাম্য না ইসলামী মৌলবাদ কাম্য। তাই প্রতিবাদ করতে হলে সব ক্ষেত্রেই করা উচিত যাতে কোনও একটি পক্ষ তোষণের সুবিধা না পেয়ে বসে, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহল ও রাজনীতির ব্যাপারীরা সেটাই করে চলেছেন দিনের পর দিন ধরে। 

এটা কি আমরা এখনও বুঝতে পারছি না যে এই অনৈতিক তোষণের ফলে কেবল হাত শক্ত হবে হিন্দু, মুসলিম উভয় মৌলবাদীদের। অপরদিকে সবথকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ শান্তিপ্রিয় হিন্দু-মুসলমানরা, যারা কোনভাবেই এই মৌলবাদীদের সমর্থন করেন না। আজকে এই সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কারা হচ্ছে? সেই আম আদমি খেটে খাওয়া জনগণই তো?

আমাদের প্রশাসন কে নিরপেক্ষ হতে হবে, ভোট ব্যাংকের রাজনীতি ছেড়ে দাঙ্গার সম্ভাবনা তৈরি হলেই, স্থানীয় গুণ্ডাদের ফাটকে পুরতে হবে, তা তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন। আসলে গুণ্ডারাই করে এসব, আর প্রতক্ষ বা পরোক্ষে মদত থাকে কিছু ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতা/ নেত্রী তথা ধর্মীয় নেতা দের, অথচও মরে সাধারণ গরীব, খেটে খাওয়া মানুষ। অদ্ভুত দেশ আমাদের এখানে এক দল হিন্দুত্বের হিড়িক তুলছে তো অন্য দল মুসলিমদের খেপাচ্ছে।

সাধারণ গরীব মানুষকেই বুঝতে হবে কারোর কোনও এক কথা বা সোস্যাল মিডিয়ায় কোনও একটা পোস্ট দেখেই খেপে উঠলে, মরতে হবে তাদেরই, বাড়ীঘর জ্বলবে তাদেরই, স্বজনহারা হবে তাঁদের পরিবারই। পথে নিশ্চয়ই নামুন কিন্তু তা খাদ্যের দাবীতে, জীবিকার দাবিতে, সম অধিকারের দাবীতে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করতে নয়।

আমরা, যারা বাঁদরবাহিনীর বাঁদরামি আর লাদেন, কাসভ বাহিনীর গুণ্ডামি দুটোকেই ঘেন্না করি, তাদের কিন্তু এবার ঐক্যবদ্ধ ও আক্রমণাত্মক হবার সময় এসেছে, আর দেরী করাটা ঠিক হবে না। আসুন আমরাও সমস্বরে গর্জে উঠি, প্রতিবাদ করি পিপুফিশুর দল ভারী না করেই।  

কিন্তু আমরা কি করতে পারি? কিছু পথ আমি বলি, আর আপনারাও ভাবুন।

এই দাঙ্গা, হাঙ্গামায় এক বড় রসদ হচ্ছে গুজব আর সোশ্যাল মিডিয়া এখন সবচাইতে বড় রসদে পরিনত হয়েছে গুজব ও ঘৃণা ছড়াবার জন্য। আমাদের করনীয় এই ক্ষেত্রেই -

1. যদি ফেসবুক ওয়ালে এ কোন বিদ্বেষ মূলক পোস্ট আসে, তাতে Like, Comment বা Share তো করবেন ই না, পারলে comment এ জোরালো প্রতিবাদ করুন। কেউ ট্যাগ করলে তাঁকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করবেন না।   

2. ওই রকম বিদ্বেষমূলক পোস্ট, ছবি, ভিডিওগুলিকে নিজের পেজ থেকে মুছে দিন, যিনি এই ধরনের পোস্ট দিচ্ছেন, তিনি আপনার পরিচিত বা অপরিচিত যাই হোক না কেন স্পষ্ট ও কড়া ভাবে বলুন যে ঐ পোস্ট মুছে দিতে, অন্যথায় আপনি প্রশাসন এর দ্বারস্থ হতে পারেন বলে জানিয়ে দিন। হাঁ ওই ব্যাক্তি আপনার যতই নিকট জন হোন না কেন, এক্ষেত্রে কড়া হোন, সম্পর্ক নষ্ট করার সাহস রাখুন।

৩. আপনি সরাসরি ফেসবুকেও রিপোর্ট করতে পারেন, সেক্ষেত্রে ফেসবুক ওরকম বিদ্বেষ মূলক পোস্ট মুছে দেয়। এমন কি ওই পোস্ট যিনি করেছেন তাঁর একাউন্ত ব্লক করে।

৪. অনেক সময় গ্রুপে যদি কেউ বিদ্বেষমূলক পোস্ট, ছবি, ভিডিও দিয়ে থাকে তাহলে এডমিন কে অবহিত করুন, যাতে ওই ধরনের নচ্ছার ব্যক্তিটিকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া যায়। 

আপাততঃ এটুকু দিয়ে শুরু করা যাক, পথে তো নামি আগে, পরে নাহয় পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক করা যাবে।
কবিগুরুর একটি কবিতা দিয়েই লেখাটি শেষ করছি – “আজি এ ভারত লজ্জিত হে, হীনতাপঙ্কে মজ্জিত হে। নাহি পৌরুষ, নাহি বিচারণা, কঠিন তপস্যা, সত্যসাধনা। অন্তরে বাহিরে ধর্মে কর্মে সকলই ব্রহ্মবিবর্জিত হে।“

শুভ বুদ্ধির উদয় হউক, অশান্তির এই কালো মেঘ কেটে গিয়ে শান্তির, সদ্ভাবনার সূর্য উঠুক। সকলে ভালো থাকবেন আর ভালো রাখবেন। 

No comments:

Post a Comment