Tuesday 16 August 2016

একটি ভুলে যাওয়া সময়ের গল্প









একটি ভুলে যাওয়া সময়ের গল্প
বেশ কয়েক বছর আগে বিশেষ প্রয়োজনে একবার বর্ধমান যেতে হয়েছিলো, দিনটি ছিল ১৬ই অগাস্ট। দিনটি কে বিশেষ ভাবে মনে রাখার কারণ এই যে ওই দিন একজন ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয়েছিলো যার কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না। না তিনি কোন নামী ব্যক্তিত্ব নন, লোকাল ট্রেনের একজন ভিক্ষুক মাত্র। সাদা মলিন পায়জামা, পাঞ্জাবি পরিহিত ক্ষয়াতে চেহারার একজন বেশ বৃদ্ধ ব্যক্তি, একমুখ লম্বা সাদা দাড়ি, কাঁধে একটি শান্তিপুরী ঝোলা, আর সম্বল বলতে একটি হারমোনিয়াম। এর আগেও ভদ্রলোক কে দেখেছি, চুপচাপ ট্রেনে উঠে – “চল রে চল সবে ভারতসন্তান কিংবা মুক্তির মন্দির সোপান তলে” এই ধরনের দেশভক্তিমূলক গান গাইতেই দেখেছি। কোনোদিন কার কাছে কিছু চাইতেন না, কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে দু হাত তুলে আশীর্বাদ করে এগিয়ে জেতেন অন্য কামরাতে।
    
আজকের গল্পের পটভূমিকায় অনার উল্লেখ করলাম কেন পাঠক হয়তো ভাবছেন, ধীরে রজনি ধীরে, পুরো গল্পটা মন দিয়ে পড়লেই অনুধাবন করতে পারবেন কেন ওনার কথা উল্লেখ করলাম।

যাইহোক মুল গল্পে ফেরা যাক, আমি টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে দেখি বাহ বেশ ফাঁকা ট্রেন, প্রছুর সীট খালি পরে আছে। অতএব জানালার ধারে একটি সীট দখল করে আয়েশ করে বসলাম, বর্ধমান যেতে এখন ঢের দেরি, হাথে অনেক সময়। এছাড়া গতকাল ১৫ই আগস্টের ছুটি উপভোগ করে মন বেশ ফুরফুরে, তাই নিউজ পেপার তা খুলে একটু দেখতে লাগলাম। ইতিমধ্যে ব্যান্ডেল পার হয়ে ট্রেন বর্ধমানের অভিমুখে, হথাত নজরে পড়ল সেই গায়ক ভিক্ষুক ভদ্রলোকটিকে। উল্টোদিকের রোয়ে চুপচাপ ভাবলেশহীন মুখে বসে আছেন, পাশে হারমোনিয়ামটি রাখা। একটু অবাকই হলাম, গান ছেড়ে এমনিভাবে বসে আছেন, আশেপাশে যাত্রী খুব কম সেই জন্নেই কি? দেখলাম উনিও আমায় দেখছেন, একটু বাদে উঠে এসে আমার পাশে হারমোনিয়ামটি নিয়ে বসলেন, বললেন – কতদুর যাওয়া হবে? আমি বললাম এই বর্ধমান। আচ্ছা তোমার কাছে কি পেপার? আমি বললাম – আনন্দবাজার। উনি বললেন – একটু দেবে? আমি বললাম – নিশ্চয় নিন নাউনি নিয়ে পেপার উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন, একটু বাদেই বিরক্ত মুখে পেপার দিয়ে দিলেন। আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – পেপার দেখলেন না? উনি বিরস মুখে বললেন – না দেখবো না, কিছুই নেই তো পেপারে। আমি অবাক হয়ে তাকাতে আমায় জিজ্ঞেস করলেন – আজ কত তারিখ বাবা জানো? আমি বললাম – হ্যাঁ জানি তো আজ ১৬ই আগস্ট। উনি সস্নেহে বললেন – ব্যাস এই টুকুই? আমি অবাক হয়ে গেলাম, বেশ খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। এর পর উনি নিজেই বললেন – ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট এই দিনেই হয়েছিলো কলকাতায় দাঙ্গা, যাকে তোমরা বোলো - The Great Calcutta Killing, জানো কিছু এই ব্যাপারে? হতভম্ব হয়ে গেলাম, শুদু বলতে পারলাম – হ্যাঁ কিছু বইতে পড়েছি এই সম্পর্কে, কিছু ভয়ানক, বীভৎস ছবিও দেখেছি ইন্টারনেটে। উনি বললেন – আর কিছু? আরে তোমরা তো কাল স্বাধীনতা উৎসব পালন করে এলে, একবারও মনে করলে সেই সব হতভাগ্যদের, বুজতে পারলে স্বজন হারানোর যন্ত্রণা? তারপর হারমোনিয়ামটি তুলে উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে চলে গেলেন – “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার !লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার” 

মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো, হয়তো বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি সত্যিই হারিয়েছেন তার কোন প্রিয়জনকে। কিন্তু হায়রে কপাল জানা হল না কিছুই, ভাগ করে নিতে পারলাম না ওনার যন্ত্রণার কিছু অংশ। মুখ বাড়িয়ে দেখলাম ট্রেন থেমে গেছে এক স্টেশনে, আর উনি উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে যাচ্ছেন।

চুপ করে বসে স্মৃতির কোঠর হাঁটকে মনে করার চেষ্টা করলাম অতীতে ঠিক কি হয়েছিলো আজকের দিনে।

তুষের আগুন জ্বলছে ধিকি ধিকি
১৮ই ফেব্রুয়ারি নৌবিদ্রোহ শুরু হয়েছিলো, আর ঠিক তার পরের দিনই ধূর্ত ব্রিটিশ সরকার ফেলল মোক্ষম টোপ, খুব তাড়াতাড়ি আমরা মন্ত্রিসভার তিন সদস্য কে পাঠাচ্ছি, এই তিনজনের মিশন ঠিক করবে ভারতের স্বাধীনতা কিভাবে দেওয়া যাবে।

২৪এ মার্চ মিশন এলো স্যার লরেন্সের নেতৃত্বে, অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হল ভাগাভাগি নয়, অখণ্ড ভারতকেই স্বাধীনতা দেওয়া হবে তবে কয়েকটি শর্তের ভিত্তিতে। শর্ত গুলি হল – কেন্দ্রে একটি অন্তবর্তি সরকার গঠন করা হবে আর কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ দুপক্ষই যোগ দেবে সংখ্যার ভিত্তিতে। ভারতবর্ষ কে “এ”, “বি” এবং”সি” এই তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হবে। “এ” গ্রুপে থাকবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গুলি, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গুলি থাকবে “বি” গ্রুপে আর আসাম, বাংলা থাকবে “সি” গ্রুপে। সবার উপরে থাকবে কেন্দ্রীয় সরকার – তার হাতেই থাকবে দেশরক্ষা, বৈদেশিক, যোগাযোগ ব্যাবস্থার দায়িত্ব। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মেনে নিল এই ব্যাবস্থা, দুই পক্ষই থাকব অন্তবর্তি সরকারে, সংবিধান রচিত না হওয়া অবধি আমরা যৌথভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করবো।

খুশি মনে মিশন ফিরে গেলো দেশে, যাক বাবা যত তাড়াতাড়ি পাড়া যায় পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরতে পারলে বাঁচি, না জানে কখন আবার মৃত সুভাষের আর আইএনএ-র ভুত চেপে বসে।

কিন্তু সব ভেস্তে গেলো ১০ই জুলাই নবনির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি নেহেরুজির কথায়, তিনি যা বলেছিলেন তার ভাবার্থ হচ্ছে – মিশন যাই বলুক না কেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আমরা ইচ্ছামত পরিবর্তন করে নিতে পারব অন্তবর্তি সরকারে গিয়ে। তার মানে কি মিশনের প্রস্তাব কংগ্রেস মেনে নেবে না? নিশ্চয়ই নেবে, তবে মিশন যেভাবে করেছে সেই ভাবে নয়, আমরা যেভাবে করবো সেইভাবে।

সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার পালটি খাওয়ার খেলা শুরু হল - সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কংগ্রেস আমাদের দাবিয়ে রাখতে চায়, কংগ্রেসের সাথে আর নয়, অন্তবর্তি সরকারেও নেই মুসলিম লীগ, মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রই চাই। একটা অসংযত উক্তির জন্নে কিভাবে ইতিহাস পাল্টে গেলো।

মিশন জানালো এই ধরনের কথা বলার অধিকার কংগ্রেস সভাপতির নেই, বড়লাট, এমনকি নেহেরুজিও জিন্নার বাসভবনে গিয়ে অনুরোধ জানালেন মত পরিবর্তনের। কিন্তু জিন্নার সেই এক কথা মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রই চাই।

তখন ধূর্ত ব্রিটিশ মোক্ষম চাল চালল – এতো করে বলার পরেও যখন লীগ রাজি হচ্ছে না তখন কংগ্রেস একাই গঠন করুক অন্তবর্তি সরকার, ভেদ নীতির কি ভয়ানক চাল।

জিন্না সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করলেন – অনেক হয়েছে আর নয়, আমরা অনেক আলাপ আলোচনা করেছি, আন্দোলন করেছি এবার আমরা পিস্তল সংগ্রহ করেছি, আমরা জানি কিভাবে তা ব্যাবহার করতে হয়। এবার প্রতক্ষ্য সংগ্রাম, তবে এই সংগ্রাম ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। কংগ্রেস কে তোয়াজ করতে গিয়ে মুসলিমদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা আমরা মেনে নেব না। মুসলিম লীগের প্রতক্ষ্য সংগ্রাম শুরু হল ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট।

কিন্তু কার্যত কি হল – উন্মত্ত লীগ সমর্থক দের লুটটরাজ, নরহত্যা তাও হিন্দুদের প্রতি। ১৬ই আগস্ট শহিদ মিনারের জনসভা থেকে ফেরার পথে লীগ সমর্থকরা উত্তর কলকাতার দোকানপাট বন্ধ রাখতে বাধ্য করে আর কিছু ক্ষেত্রে লুটপাট, অগ্নি সংযোগের ঘটনাও ঘটে। হিন্দুরাও এর বিরোধ করে স্বাভাবিকভাবেই, শুরু হয়ে যায় অমানবিক দাঙ্গা, লুটপাট আর ধর্ষণ। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় কত নিরীহ মানুষ খুন হন, কত মানুষ গৃহহারা হন, কত নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটে, শিশু রাও বাদ যায় না, তাদের জীবন্ত আগুনে ছুড়ে ফেলা হয়। সেই নারকীয় ঘটনার বিবরণে আর নাইবা গেলাম।

ধীরে ধীরে এই দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ল ঢাকা, নোয়াখালী, পাঞ্জাব সহ গোটা ভারতে।
এই ছিল ব্রিটিশের প্রতি প্রতক্ষ্য সংগ্রাম, কতজন ব্রিটিশ নিহত হয়েছিলো এই প্রতক্ষ্য সংগ্রামের ফলে? একজন ও না, তারাই ছিল সবথেকে বেশি নিরাপদ। কোথায় ছিলেন তখন নেহেরুজি আর জিন্না? দুজনেই ব্যাস্ত স্বাধীন ভূখণ্ডে কিভাবে ক্ষমতার ঘুঁটি সাজানো হবে তার পরিকল্পনা করতে। 

অথচও একবছর আগে ছবিটা কি ছিল? আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার, নৌ বিদ্রোহ, সেনা বিদ্রোহ, ডাক ও তার ধর্মঘট, এছাড়া ১৯৪২এর বিপ্লবেও তো কোন স্থান ছিল না এই হিন্দু – মুসলমান প্রশ্নের, কোনরকম সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পরেনি ভারতের আকাশে? এছাড়াও নেতাজীর নেতৃত্বে ভারতের বাইরেও যে বিশাল বিদ্রোহ ঘটিত হয়েছিলো সেখানেও তো হিন্দু- মুসলমান কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়েছিল। তারা প্রাণ দিয়েছিল অখণ্ড ভারতের জন্নে, কোন প্রাদেশিকতার বা ভাষা/ ধর্মের জন্নে নয়। আসলে বৃহত্তর বৈপ্লবিক উত্থানে এইসব সঙ্কীর্ণতার কোন স্থান থাকে না। 

আমরা কি দেখেছিলাম, আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল এম জেদ কিয়ানি, মেজর জেনারেল শাহনয়াজ খান, মেজর জেনারেল আজিজ মহম্মদ, কর্নেল গিলানি, কর্নেল হুসেন, কর্নেল এস এ মালিক আরও কত জন। এছাড়াও ভেবে দেখুন তো বার্লিন থেকে টোকিয় এই বিপদ সঙ্কুল পথে নেতাজীর সঙ্গী কে হয়েছিলেন? তিনিও টো একজন মুসলমান – আবিদ হোসেন। আবার তথাকথিত শেষ যাত্রা পথে সঙ্গী হয়েছিলেন সেই কর্নেল হবিবুর রহমান টো একজন মুসলমান। কই সেখানে তো কে হিন্দু, কে মুসলমান এই প্রশ্ন কোনোদিন ও ওঠেনি। সেই হিন্দু মুসলমান নিজেদের দেশে পরস্পরের প্রতি এতো মারমুখী, এতো হিংস্র হয়ে উঠল কেন?

আজকের যুগেও এই প্রসঙ্গ সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক, ভেদাভেদের বিষবাস্প আজও মেলায়নি আমাদের মধ্যে থেকে। খবরের কাগজের পাতা উল্টালেই চোখে পরে আইসিস, আল কায়দা আরও কত মৌলবাদী শক্তি সক্রিয় আমাদের দেশে, নাম বদলায়, মুখোশ বদলে যায় কিন্তু লোভ আর হিংসের কোন পরিবর্তন আসে না। তার উপর রাজনীতির কারবারিদের মধ্যে আজও আশে মীরজাফরের দল যারা সুযোগ পেলেই বিক্রি করে দেবে আমাদের মাতৃভূমি, আমাদের ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, ন্যায় নীতি সব কিছু কেই। কারণ তাঁদের কোন দেশ নেই, তাদের কোন ধর্ম নেই, তারা শুধু মুনাফাভোগী, লুণ্ঠনকারী মাত্র। আজ একটি গানের কথাই মনে পড়ছে বার বার, ওই বৃদ্ধ মানুষটি যে কষাঘাত করে গেলো মননে, বিবেকে তার গাওয়া গান টি দিয়েই শেষ হোক এই লেখা।  

“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ-
কান্ডারী, আজি দেখিব তোমার মাতৃ-মুক্তি-পণ।
হিন্দু না ওরা মুসলিম-ওই জিজ্ঞাসে কোন্‌ জন,
কান্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।।
গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গরজায় গুরু বাজ-
পশ্চাৎ পথ যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ।
কান্ডারী, তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চল টানি’-নিয়েছ যে মহাভার।।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান-
আসিঅলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান!
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ,
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার।।    

 
 

No comments:

Post a Comment