অলস দুপুরের ইতিকথা
গ্রীষ্মকাল কোনদিনই আমার প্রিয় ছিল না, তবে প্রখর রোদে
ঝাঁঝাঁ করা দুপুরের একটা অদ্ভুত মাদকতা ছিল। আজ যখন অফিসে বসে কাঁচের ওপারে একাকী
কবরস্থান (প্রঙ্গত আমার অফিস পার্ক স্ট্রিট কবরস্থানের পাশেই) কে দেখি, মন চলে যায়
ফ্ল্যাশব্যাকে।
আজকাল দুপুরে চোখ জুড়ে ঘুম নামে নীরবে, বসের শাসন কিংবা
নিয়মের বেড়াজাল টপকেই। অথচও শৈশবে এরকমটা ছিল না – গ্রীষ্মের দুপুরে আমি হয়ে উঠতাম
কলম্বাস। মা হয়তো আমাকে জোর করে পাশে শুইয়ে ঘুম পারানর নিষ্ফল চেষ্টা করতো আর আমি
চোখ বুজে অপেক্ষায় থাকতাম কখন মা ঘুমিয়ে পড়বে আর আমি দৌড়ে চলে যাবো সিঁড়ির উপর
ছোট্ট বারান্দা তে, যেখানে আমি হয়ে যেতাম সিন্দাবাদ বা কলম্বাস। আমাদের বাড়ী ছিল
একটু ফাঁকা জায়গায়, আমবাগান কেটে সবে বসতি হচ্ছে, কাজেই কাছেই আমগাছ ইট, খোয়া পাতা
রাস্তা ছিল আমার সাথী। আর সঙ্গী ছিল একটা পোষা ময়না আর একটা টিয়াপাখি। আমি
বারান্দা থেকে দেখতাম ফেরিওয়ালা মাথায় পসরা নিয়ে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে চলেছে, আর
মাঝে মাঝে হেঁকে উঠছে “বাসন নেবে গো, ভালো ভালো স্টিলের বাসন আছে”, কিংবা “ ছাতা
সারাবে ছাতা “ বা “ শিল কাটাও”। কত বিচিত্র সব সুর এক একজনের গলায়, মাঝে মাঝে আমিও
ভেঙিয়ে উঠতাম তাঁদের নকল করে, আর যখন তারা অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাতো, আমি লুকিয়ে
বসে পড়তাম যাতে দেখতে না পায়। আমাদের বাড়িতে কুয়ার পাশে একটা বকফুল গাছ হয়েছিলো,
যেটা বেশ ভালোই বড় হয়ে উঠেছিল। তার ডালে দোলনা তৈরি করে একা একাই ঝুলতাম, আর দূরে
আম গাছের দিকে নজর রাখতাম যে কোন আম পড়ল কিনা? আর আম যদি পড়ত পা টিপে টিপে উঠানের
দরজা খুলে এক ছুটে বেড়িয়ে যেতাম। যেদিন আম পড়ত না, সেদিন তাক খুঁজতাম কখন
আমবাগানের কাকা অন্য দিকে যাবে বা ঘুমিয়ে পড়বে। কাকা অন্যদিকে গেলেই আমি হয়ে উঠতাম
অর্জুন, গুলতি দিয়ে আম ফেলা ছিল আমার অন্যতম খেলা। তারপর সেই কাঁচা আম নিয়ে এসে
বাড়ীর দেওয়ালে ছুড়ে মেরে ফাটিয়ে, একটু জলে ধুয়ে নুন মাখিয়ে খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা।
কোথা্য ঠেকে ম্যাগনামের আইসক্রিম?
কত বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী
এই গরমের দুপুর, আজ সেসব কথা মনে পড়লে হাসিও পায়, মন উদাস ও হয়ে যায়। একবার খুব শখ
হয়েছিলো একটা কাঠবেরালি পুষবো, যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমাদের টিয়াপাখির খাঁচার কাছে
প্রায়শই অনেক কাঠবেরালি আসতো, একটু বড় হয়ার জন্নে সেগুলো ঠিক বাগে পেতাম না। একদিন
পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখি একটা বেশ ছোট কাঠবেরালি জানালার পাশে আমার দিকে
পিছন করে বসে আছে, লেজ টা ঝুলছে বেশ। অতএব এক হাতে প্লাস্টিকের বড় জার নিয়ে, যেই
না অন্য হাতে লেজটা খপ করে ধরে টেনেছি। নিমেষের মধ্যে কাঠবেরালি তার ধারাল দাঁত
দিয়ে আমার হাত ফালাফালা করে দিলো, ব্যাথা আর জলুনির চোটে আমি তখন চোখে সরষেফুল
দেখছি। আর ভাবছি মা কে কি করে বলব? না ভালোমানুষির কোন দাম নেই দেখছি, ভেবেছিলাম
বেশ আদর যত্নে ব্যাটাকে রাখব ওর দেখছি কপালে সে সুখ নেই? অঝোরে রক্ত পড়ছে, সেই
অবস্থায় মা কে গিয়ে ডাকলাম। মা উঠে আমায় মারবে কি? দেখেই চোখ ছানাবড়া, কেঁদেই
ফেলেছিল মা। অথচও যন্তনা হচ্ছে আমার, মায়েরা বোধহয় এরকমই হয়, সন্তানের কষ্টে দুকুল
ছাপিয়ে জল আসে তাঁদের চোখে, অথচও সংসারের হাজার কষ্টেও তাঁদের মুখে রা ফোটে না। অনেকদিন
লেগেছিল হাত সারতে, লাল ওষুধ আর টিটেনাস এর দৌলতে বেঁচে গেছিলাম সেবার। পরে অবশ্য
শোধ তুলে ছিলাম, ওটা কে গুলতি দিয়ে কসে একটা ঢিল মেরে।
কখনও বা আইসক্রিমওয়ালা কে দেখে দৌড়ে গিয়ে ঘুমন্ত মাকে ঠেলে
তুলতাম – মা মা দুটো টাকা দাও আইসক্রিম কিনি। মা ঘুম চোখে বলত – বড্ড জ্বালাস তুই,
এই গরমে আইসক্রিম খেয়ে ঠাণ্ডা লাগালে কি হবে শুনি? অনেক বুজিয়ে যখন টাকা নিয়ে
আসতাম দেখতাম আইসক্রিমওয়ালা ওই দূরে চলে গেছে। চেঁচাতে চেঁচাতে তার পিছনে গিয়ে দু
হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে যখন ফিরতাম, তখন নিজেকে নেপোলিয়নের থেকে কম মনে হতো না।
ভালোই ডানপিটে ছিলাম আমি, গরমের দুপুরে ঝরা পাতা একজায়গায়
জড়ো করে আগুন লাগিয়ে দিতে আমি ছিলাম ওস্তাদ। মা, পাশের বাড়ীর কাকিমা যতই বকুক মাঝে
মাঝে এই অপকর্ম টি করতে ভালোই লাগতো।
আর শনি, রবিবারে রেডিও শোনা ছিল আমার অন্যতম কাজ, তার জন্নে
রোদে ব্যাটারি দেওয়া, সেটা তুলে যত্ন করে রেডিও তে লাগান এই সব কাজে আমি ভুল করতাম
না। আর আমি গল্পের বই পড়তে খুব ভালোবাসতাম (বাসতাম কেন এখনও তো বাসি), এক একটা
দুপুর ছিল আমার এক একটা গল্পের বই এর জন্নে নিবেদিত। পথের দাবী, রাজসিংহ,
কপালকুণ্ডলা, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, আরোগ্য নিকেতন, কালের মন্দিরা, তুঙ্গভদ্রার
তীরে, ব্যোমকেশের গল্প, কিরীটী, ফেলুদা, চরিত্রহীন সব পড়েছি এই নীরব নিভৃত দুপুর
বেলায়।
আর দেখেছি এই দুপুরে ক্লান্ত ফেরীওয়ালা কে গামছা পেতে গাছের
ছায়ায় একটু জিরোতে, দেখেছি পোষা ভুলো কুকুর কে এত্তবড় জিব বার করে হা হা করে
হাঁপাতে। দুপুরে ঘুঘুর ডাক, কাকের আওয়াজ সব কেমন এলোমেলো করে দিত আমার। নিঃসঙ্গ
আমি খুঁজেছি কি তোমায়? কে জানে কৈশোর কি প্রেমের আহ্বান শুনেছিল? গ্রীষ্মের তপ্ত
রোদের দুপুর আজও আছে, কিন্তু শৈশবের সেই মধুর দিন গুলো আর নেই। মায়ের বকুনি, পোষা
পাখি, কুকুর কেউ নেই, ইচ্ছে হলেও গল্পের বই পড়তে পারি না আজ। যান্ত্রিকতার
জাঁতাকলে সময়ের আবর্তে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে আমার সাথে শৈশবের দুপুরের। তাই অলস
দুপুরকে আজ আর আমি খুঁজে পাই না।
"পূর্ণিমার চাঁদের
কবিতা তো সবাই লিখেছে,
আমি লিখব ঝলসানো
দুপুর কে নিয়ে,
হোকনা সে ঘামে
ভেজা, বিরক্তির বোঝা।
জীবন কে যতই করুক
অতিষ্ঠ,
ঝলসানো দুপুর
সেতো আমার কাছে জীবন্ত।
নিজেকে যে
হারিয়েছি বারে বারে,
চৈত্র, বৈশাখের
তপ্ত রোদের নিঃসঙ্গতায়,
হারিয়ে খুঁজেছি
তাঁকে, উপন্যাসের পাতায় পাতায়।
ভেবেছিলাম
আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে
কাটাব কত অলস
দুপুর,
তোর কোলে মাথা
দিয়ে, চোখে চোখ রেখে,
দেখবো শৈশবের
নিঃসঙ্গ দুপুর।
ক্লান্ত
ফেরীওয়ালা একটু খোঁজে ছায়া,
একটু জিরিয়ে নিয়ে
পারি দিতে হবে কতদুর?
বাঁচার তাগিদে
অবিরাম এই ছুটে চলা,
হয়তো পথে হোঁচট
খায়, মুখ থুবরে পথে পরে রয়,
বাসে- ট্রামে
চাকায় পিষ্ট হয় আশা নিরাশা।
তবু কত নির্বিকার
এই দুপুর?
মোড়ের মাথায় কল
খুলে জল খায় গরু,
জিব বার করে
হাপায় ভুলো কুকুর
ঘুঘু ডাকা দুপুর
হাতছানি দেয় আজও,
খুঁজে ফিরি আমি
শৈশবের দুপুর।
দুপুর গড়িয়ে
বিকাল হয়,
বিকাল গড়িয়ে
সন্ধে হয়।
রাতের শেষে ভোর
হয়।
আর আমি খুঁজি
ঝলসানো দুপুর,
হারানো কবিতা,
শৈশবের দুপুর
নিঃসঙ্গতায় ভরা
আমার দুপুর।"
No comments:
Post a Comment