আমার উপলব্ধি স্মৃতি বড় বেদনার, অনেকে একমত হতে পারবেন না জানি। সময়ের কোন
চোরাগলিতে ফেলে আসা ছোটবেলার দিনগুলি আর কখনই ফিরে পাবো না এটা ভাবলে বুকের একটা
চাপ লাগে। একটা জমাট বাঁধা কষ্ট গলার কাছে ডলা পাকিয়ে থাকে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট
হয়।
ছোটবেলায় গরমের ছুটি মানে ছিল অফুরন্ত মজা, আর যা ইচ্ছে তাই করার পাসপোর্ট
হাতে পাওয়া। আমাদের সময়ে টিভি থাকলেও, এখনকার মতো অফুরুন্ত চ্যানেল ছিল না,
সর্বসাকুল্যে ২-৩ টি চ্যানেল পাওয়া যেত। আমরা টিভি দেখতে পেতাম কম, তবে সব অভিমান
ভুলে যেতাম রবিবার এলে। অইদিন সকাল সকাল পড়া শেষ করে বসে যেতাম টিভির সামনে, একটা
প্রোগ্রাম হতো – “ছুটিছুটি“। সে এক অসাধারন অনুভুতি, কত মজার সব অনুষ্ঠান হতো, গোগ্রাসে গিলতাম সব। ছোটদের
সিনেমা, কমিকস কত কিছু। কিছু প্রোগ্রাম আবার ধারাবাহিক হতো, লোডশেদিং এর জন্নে কোন
এপিসোড মিস হয়ে গেলে কি কষ্ট হতো তখন। এখন তো ছোটদের জন্নে হাজার একটা চ্যানেল,
হাজার রকমের অনুষ্ঠান। কিন্তু আমাদের সময়ে ওই “ছুটিছুটি“ ছিল তপ্ত মরুভুমির মাঝে
একটুকরো মরূদ্যান। এছাড়া রেডিওর প্রোগ্রাম ও আমার খুব প্রিয় ছিল। তাড়াতাড়ি করে
স্নান সেরে নিয়ে রেডিওর সামনে বসে যাওয়া টা ছিল একটা বড় কাজ। এছাড়া কত গল্পের বই
যে এই গরমের ছুটিতে শেষ করেছি তার ইয়ত্তা নেই।
গরমে ঘামতে ঘামতে মুখ তুলে আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম আর মা কে জিজ্ঞেস
করতাম – মা কালবৈশাখী কবে হবে? মা হেঁসে বলত দাঁড়া ঠিক হবে। হয়তো ২-৩দিন পর
বিকালের দিকে আকাশ কালো করে, মেঘ মামা বিস্তর হাঁকডাক করে একপ্রস্ত জল ঢেলে ঠাণ্ডা
করে দিয়ে যেত, আর আমার বিকাল টা কি সুন্দর হয়ে যেত – ঠাণ্ডা হাওয়া, মাটির সেই
সোঁদা সোঁদা গন্ধ, বাড়ীর পাশের বেল গাছের পাতা থেকে চুইয়ে জল পড়ছে, সন্ধে বেলায়
বেল ফুলের গন্ধে পুরো জায়গা টা ভরে যেত। আমি পোষা কুকুর টা কে কোলে নিয়ে অবাক হয়ে
দেখতাম সব।
গরমের ছুটি মানে আর একটা মজা ছিল – ব্যাগটাগ গুছিয়ে মামার বাড়ী যাওয়া। ওই যেতে
যা একটু কষ্ট, কিন্তু একবার গিয়ে পড়তে পারলে, বাবার বকা নেই, দিদার আদর আর এন্তার
মজা। পড়ার বই সাথে থাকত, কিন্তু ওই নামেই, মাঝে সাঝে একটু পড়া আর বাকীটা শুধু মজা
আর মজা। মামার বাড়ীর পাশে একটা ছোট পুকুর ছিল, সেখানে মাঝে মাঝে ছিপ ফেলে মাছ
ধরতাম। দুপুরে কাঁঠাল, আম গাছের ছায়ায় বসে মামাদের সাথে মাছ ধরার মজা ছিল আলাদা। আর
বাড়ীর পিছন দিকে একটা বেশ জঙ্গল ছিল, কত দুপুরে ওখানে ভাম, গোসাপ, বেঁজি আর কত
রকমের সাপ দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। এছাড়া ঢিল মেরে কাঁচা আম পেড়ে খাওয়া, দিদার সাথে
শিকার শিকার খেলা, ছোট মাসীর সাথে লুডো খেলা, আমের আঁচার চুরি করে খাওয়া সব এই
গরমের ছুটিতেই করা।
আজ মনে হয় বড় না হলেই বোধ হয় ভালো হতো, কমসে কম এই স্মৃতিগুলো তো হারিয়ে যেত
না। আজ বড় হওয়ার সাথে সাথে স্মৃতিগুলো ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেলো। হয়তো বাকী জীবন
টা এই জমানো স্মৃতিগুলো পুজি করেই কাটিয়ে দিতে হবে। এটাই বোধহয় জীবন?
No comments:
Post a Comment