Wednesday 21 December 2016

বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ১


বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ১

ব্রহ্মযামল তন্ত্র অনুসারে মা কালী আমাদের এই বঙ্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, ষোলোআনা খাঁটি সত্য, এই বঙ্গে যত কালী মন্দির আছে, তত সারা ভারতেও দেখা যায় না। মা দুর্গার পূজা হয় বছরে একবার, কিন্তু কালীপূজা নিত্য দিনের। বঙ্গে কালী পূজার ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু আমি জানি না, তবে পড়েছি যে সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। তাঁর পূর্বে মায়ের উপাসকগণ তাম্রটাটে ইষ্টদেবীর অর্থাৎ মা কালীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পূজা করতেন। পরবর্তী কালী সাধক কমলাকান্ত, সাধক রামপ্রসাদ, সাধক ভবা পাগলা, শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে মায়ের পূজায়, ভক্তিতে সারা দেশ প্লাবিত করেছেন। শ্রী শ্রী ঠাকুর তো কালীময়, তাঁর জীবনে মা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে, পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ মাকে বীরভাবে সাধনা করেছিলেন, তিনি বলতেন - “যাঁরা প্রকৃত মায়ের ভক্ত, তাঁরা পাথরের মত শক্ত, সিংহের মত নির্ভীক। মাকে তোমার কথা শুনতে বাধ্য কর। তাঁর কাছে খোসামোদ কি? জবরদস্তি, তিনি সব করতে পারেন”। বাংলার এই বীরভাবের সাধনার রূপটি স্বামী বিবেকানন্দের কবিতায় সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে – 

সত্য তুমি মৃত্যরূপা কালী, সুখবনমালী তোমার মায়ার ছায়া।
করালিনি, কর মর্মচ্ছেদ, হোক মায়াভেদ, সুখস্বপ্ন দেহে দয়া ।।
মুণ্ডমালা পরায়ে তোমায়, ভয়ে ফিরে চায়, নাম দেয় দয়াময়ী।
প্রাণ কাঁপে, ভীম অট্টহাস, নগ্ন দিক‍বাস, বলে মা দানবজয়ী ।।
মুখে বলে দেখিবে তোমায়, আসিলে সময় কোথা যায় কেবা জানে।
মৃত্যু তুমি, রোগ মহামারী বিষকুম্ভ ভরি, বিতরিছ জনে জনে ।।
রে উন্মাদ, আপনা ভুলাও, ফিরে নাহি চাও, পাছে দেখ ভয়ঙ্করা।
দুখ চাও, সুখ হবে ব'লে, ভক্তিপূজাছলে স্বার্থ-সিদ্ধি মনে ভরা ।।
ছাগকণ্ঠ রুধিরের ধার, ভয়ের সঞ্চার, দেখে তোর হিয়া কাঁপে।
কাপুরুষ! দয়ার আধার! ধন্য ব্যবহার! মর্মকথা বলি কাকে ?
ভাঙ্গ বীণা-প্রেমসুধাপান, মহা আকর্ষণ-দূর কর নারীমায়া ।
আগুয়ান, সিন্ধুরোলে গান, অশ্রুজলপান, প্রাণপণ, যাক্ কায়া ।।
জাগো বীর, ঘুচায়ে স্বপন, শিয়রে শমন, ভয় কি তোমার সাজে?
দুঃখভার, এ ভব-ঈশ্বর, মন্দির তাহার প্রেতভূমি চিতামাঝে ।।
পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা।
চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা ।।

পরবর্তীকালে এই বীর ভাবনায় উদ্দিপ্ত হয়ে বাংলার অসংখ্য বীর বিপ্লবী তরুণের মনে মা কালী প্রলয়ঙ্করী মহাকালী রূপে আবির্ভূতা হলেন। বিবেকানন্দের বাণীতে তাঁরা উদ্দীপ্ত “মাকে বুকের রক্ত দিয়ে পুজো করতে হয়, তবে যদি তিনি প্রসন্না হন। মার ছেলে বীর হবে, মহাবীর হবে। নিরানন্দে দুঃখে মহালয়ে মায়ের ছেলে নির্ভীক হয়ে থাকবে। কি অদ্ভুত প্লাবন এসেছিল স্বামিজির বানীতে তরুণ হৃদয়ে সাধনার ধারা অবধি পালটে গেল? বাংলায় মহা কালীশক্তি জাগ্রত হল, কিন্তু কী সেই শক্তির প্রকৃতি? পরবর্তীকালে আর এক মহাকালী সাধক শ্রীঅরবিন্দের ভাষায় এর বর্ণনা পাই - “ক্ষিপ্র, ঋজু, অকপট যে সকল প্রেরণা, অকুণ্ঠ অব্যভিচারী যেসব গতিধারা, অগ্নিশিখায় ঊর্ধ্বগামী যে অভীপ্সাতাই মহাকালীর পদক্ষেপ। অদম্য তাঁর প্রবৃত্তি, তাঁর দৃষ্টি, তাঁক সংকল্প শ্যেনপক্ষীর ব্যোমবিহারের মত উত্তুঙ্গ দূরপ্রসারী, ঊর্ধ্বপ্রসারিত পথে ক্ষিপ্র তাঁর গতি, হস্ত তাঁর প্রসারিত দণ্ডবিধানের জন্যঅভয়প্রদানের জন্য। কারণ তিনিও মাতাঁর স্নেহ তাঁর ক্রোধেরই মত তীব্র, তাঁর কারুণ্য সুগভীর, আবেগ-আপ্লুত। আপন শক্তিতে তিনি যদি নেমে আসতে পারেন, তবে যেসব বাধা আমাদের চলৎশক্তিহীন করে রাখে, দস্যু যারা অন্বেষুকে আক্রমণ করে, তারা সংহতি-বিহীন বস্তুর মত এক মূহুর্তে চূর্ণ হয়ে যায়। বাংলার রক্তক্ষরা বিপ্লব ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হয়ে উঠলেন মহাকালী। তাই বোধহয় "অনুশীলন" ও "যুগান্তর" এর মতন ব্রিটিশবিরোধী গুপ্ত সংগঠনে মা কালীর আরাধনা হতো, সেই মহান বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের অফুরন্ত উৎস ও প্রেরণা ছিলেন মা কালী, আর সেটা অবশ্যই জাতধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করেই। তাঁরা এক হাতে গীতা, অন্যহাতে মাকে প্রণাম করে অগ্রসর হতেন দেশ সেবার কাজে। দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, তবে কি মাতৃ আরাধনার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে? না বরং আজকের সময়ে মাতৃ আরাধনা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এই ক্লীবত্ব, এই পলায়নপরতা, স্বার্থের হানাহানি যখন এত বেশি স্পষ্ট, বিপ্লবের বীজ বুনতে আজও সমান দরকার এই মাতৃ আরাধনা। 

অনেকে হয়তো একমত নাও হতে পারেন, দৃষ্টিভঙ্গি একান্ত আপন মাত্র। অনেকে বলেন কালী সাধনা হিংসার, বীভৎস তাঁদের বলব মার এই রুপ সাধ করে নয়গো, মা কালীও এককালে হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছিলেন বলেই তাঁর অমন বীভৎস রুপ, নচেৎ আমার মায়ের রুপ খুবই শান্ত, ঠিক আমার তোমার মায়ের মতো। আসলে মা কালীর সংহার রূপিণী রুপ নিয়ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা যেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিয়ত সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় ব্রতী থাকি। তবেই মানব জীবনের সার্থকতা, আর দেশ ও সমাজের মঙ্গল।  

শাস্ত্র মতে 'কালী' শব্দটি 'কাল' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার অর্থ "কৃষ্ণ, ঘোর বর্ণ"। তন্ত্র ও বিবিধ পুরাণে মা কালীর একাধিক রূপভেদের কথা পাওয়া যায়। যেমন  তোড়ল তন্ত্র মতে কালী অষ্টধা বা অষ্টবিধ, যথা - দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী ও শ্রীকালী।

দক্ষিণাকালী

দক্ষিণাকালীর কালীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মূর্তি। ইনি প্রচলিত ভাষায় শ্যামাকালী নামে আখ্যাতা। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুলে বর ও অভয় মুদ্রা। তাঁর গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তাঁর গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তাঁর দন্ত ভয়ানক; তাঁর স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তাঁর দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। সাধকেরা তাঁর এই নামের যে ব্যাখ্যা দেন তা হল - দক্ষিণদিকের অধিপতি যম যে কালীর ভয়ে পলায়ন করেন, তাঁর নাম দক্ষিণাকালী। তাঁর পূজা করলে ত্রিবর্ণা তো বটেই সর্বোপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ফলও দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়। 

কোনও একটি দেবালয়ে একটি চমৎকার উক্তি চোখে পরেছিল – “করিতে ঈশ্বর সেবা সাধ যদি মনে, প্রথমে মানব সেবা করহ যতনে”। অতএব সাধু পথ চল আপন তালে।

আর তত্ত্ব কথায় কাজ নেই, আমি পাপীতাপী, অজ্ঞ্যানি আমার সাধ্য কোথায় মায়ের রুপ বর্ণনা করি? সামান্য কিছু বইপড়া বিদ্যে উগরে দিলাম মাত্র। তাঁর থেকে চলুন যাই মাতৃ সন্দর্শনে, আগেই বলেছি এই বাংলায় মা কালীর মন্দির অসংখ্য, কিছু আপন গরিমায় উজ্বল। মাহাত্ম্য, ইতিহাসেও ছোঁয়ায় সেগুলিও আজ এক দ্রষ্টব্য স্থান। এরকমই কিছু জায়গার ছবি ও তথ্য দিলাম –

বোড়াই চণ্ডীতলা কালী মন্দির

চন্দননগরের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান এটি, বহু প্রাচীন অথচও নিজ মহিমায় আজও অসংখ্য ভক্তের সমাবেশ ঘটে এই সুপ্রাছিন মন্দিরে। বর্তমানে এই মন্দিরের সংস্কার হয়েছে, নব কলেবরে নতুন ভাবে সেজে উঠেছে মাতৃ মন্দির। মন্দির দালানের একটি ফলক থেকে  জানা যায় জনৈক শ্রীমন্ত সউদাগর এই মন্দিরের স্থাপনা করেছিলেন। স্থাপনকাল আমার অজানা, মন্দিরের গর্ভগৃহ তিন খিলান বিশিষ্ট। ভিতরে অষ্টধাতুর মনমুগ্ধকর মাতৃ মূর্তি বিরাজমান। নিত্য পূজা হয় এখানে, পূজায় বাহুল্যের থেকে আন্তরিকতা, ভক্তি বেশি দেখা যায়।  

পথ নির্দেশ – হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল বা মেইন বর্ধমানগামী যে কোনও লোকালে আসা যায় চন্দননগর, স্টেশনে নেবে টোটো বা রিক্সায় ঘুরে নিতে পারেন এই মন্দিরটি। কাছেই স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মতিলাল রায় কতৃক প্রবর্তক সংঘ, আশ্রম ঘুরে নিতে পারেন। সাথে চন্দননগরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান গুলিতো রয়েছেই।

শেষ করি মাতৃ পূজার সেই মন্ত্রখানি দিয়ে “জয়ন্তী মঙ্গলাকালী ভদ্রাকালী কপালিনী দূর্গা শিবা সমাধ্যার্তী সাহাসুধা নমস্তুতে”। সবার মঙ্গল হউক।




No comments:

Post a Comment