Tuesday 3 January 2017

বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ২



বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ২

হাঁসের প্রিয় গুগলি, পর্তুগিজদের হুগলি। গুণের প্রিয় তানপুরা, ওলন্দাজদের চিনসুরা। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় ইতিহাসের শহর চুঁচুড়া নিয়ে এক সময় লিখেছিলেন এই বিখ্যাত ছড়াটি। পর্তুগিজ, ওলন্দাজদের সময়কার নানা ইতিহাস যেমন এই শহরে রয়েছে তেমনিই রয়েছে ব্রিটিশ শাসনকালের নানা স্মারক। গঙ্গাপাড়ের এই শহরের আনাচে কানাচে আজও ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে, শুদু একটু অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে খুঁজে দেখতে হবে। অবশ্য চুঁচুড়ার থেকে বেশী চুঁচড়ো নামটিই কথ্য ভাষায় চলে। চুঁচুড়া নিয়ে কোন কথা বলতে গেলে হুগলী শহরের কথাও চলে আসে। তাই বোধহয় এই দুটি শহরের পৌরসভাও এক। ইতিহাস অনুসারে হুগলী শহরটি ছিল পর্তুগিজদের অধিকারে এবং চুঁচুড়া ছিল ওলন্দাজদের দখলে। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এই দুই শহর দখল করে এবং পরে ১৮৬৫ সালে এই দুই প্রশাসনিক অঞ্চলকে একত্রিত করা হয়। চুঁচড়া আর হুগলী শহরের ইতিহাসের গল্প অন্য একদিন বলব। আজ শোনাবো এই অঞ্চলের কিছু বিখ্যাত কালী মন্দিরের কথা, যা আজও নিজ গৌরবে সমুজ্বল। 

শীতকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে একদিন সকালে আমার মতন বেরিয়ে পরতে পারেন এই মন্দিরগুলি দর্শনে। আমার প্রথম গন্তব্য ছিল মা দয়াময়ী কালীমন্দির, আসুন শোনাই দয়াময়ী কালীমন্দিরের কথা। এই মন্দিরটি চুঁচুড়া শহরের খড়োবাজার অঞ্চলে নেতাজি সুভাষ রোডের পাশে অবস্থিত। ইতিহাস অনুসারে মুঘল সম্রাট আকবরের রাজস্বসচিব টোডরমল্ল জিতেন রায় নামক এক ব্যক্তিকে চুঁচুড়া অঞ্চলের জায়গীরদার হিসেবে নিযুক্ত করেন, আর উক্ত জিতেন রায় দয়াময়ী কালীমন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের পরে অনেকটা জায়গা জুড়ে মন্দিরপ্রাঙ্গণ। গম্বুজাকৃতি চূড়াবিশিষ্ট নাটমন্দিরবিহীন দেবীমন্দিরের বাইরে একটি ঢাকা বারান্দা অবস্থিত। গর্ভগৃহে প্রায় সাড়ে তিন ফুট উচ্চ কষ্টিপাথরে নির্মিত দেবী মূর্তি, মায়ের পদতলে মহাদেব শিব শায়িত আছেন। এই কালীমন্দির প্রাঙ্গনে চারটি শিবমন্দির অবস্থিত, এছাড়াও মন্দির প্রাঙ্গন সুন্দরভাবে সুসজ্জিত যা দর্শনার্থীদের ভালো লাগবে। মন্দির চত্বরে ছবি তোলায় কোন নিষেধ নেই, তবে হ্যাঁ কেউ পূজারী ঠাকুরের ছবি তোলার দুঃসাহস করিবেন না এতে মা রুষ্ট না হলেও তাঁর সেবকের রুষ্ট হওয়ার যথেষ্টই কারন আছে। মন্দিরের মা কে দর্শনের সময় চোখে পড়ল একজন অবাঙালী পুজারি ঠাকুর মায়ের পায়ে জবা ফুল অর্পণ করছেন এক ভক্তের অনুরোধে, মুহূর্তটি সুন্দর হওয়াতে ভাবলাম যদি ছবি তোলা যায়? ক্যামেরা তুলতেই পূজারি ঠাকুর রেগে গিয়ে হাঁইহাঁই করে বললেন – আরে বেটা তুমাকে হামি ফটো লিতে বারন করেছি? তুমি হামার ফটো কেন লিচ্চ, হামার মালিক জানতে পারলে হামায় নোকরি থেকে হাথিয়ে দিবে। 

সাত সকালে কারোর চাকরি খাবার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র ছিল না, তাই ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে আসছি, ডাক শুনে ফিরে দেখি তিনজন দুঃস্থ মহিলা (ওনারা হয়তো ওই মন্দির প্রাঙ্গনেই থাকেন, ভক্ত/ দর্শনার্থীদের দেওয়া দানে জীবন নির্বাহ করেন) আমায় বলছেন তুমি এত ছবি তুললে আর আমাদের ছবি তুলবে না বাবা? মনে হোল সত্যিই তো ঈশ্বর কি শুধু মন্দির বা মূর্তিতেই আছেন, না তিনি আছেন আমাদের মাঝেই। আমারই ভুল, ভুল স্বীকার করে ওনাদের ছবি তুলে আর অল্প কিছু সাহায্য করে বেরিয়ে আসার সময়ে আবারও মনে পড়ল সেই অমোঘ উক্তি “করিতে ঈশ্বর সেবা সাধ যদি মনে, প্রথমে মানব সেবা করহ যতনে”। এর পরের গন্তব্য করুণাময়ী কালী মন্দির।

করুণাময়ী কালী মন্দির শ্যামবাবুর ঘাটের কাছেই অবস্থিত। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে লেখা আছে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে (বাংলার ১২১৮ বঙ্গাব্দে) এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল, দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মন্দির প্রাঙ্গনে ঢুকে মন ভরে গেলো, সামনেই মন্দির। মন্দিরের সামনে বড় দালান, বাম পাশে একটি দালান, ওখান থেকে মন্দিরের ভোগ বিতরণ করা হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে নয়নাভিরাম কষ্টি পাথরের মাতৃ মূর্তি বিরাজমান, পদতলে সাদা রঙের মহাদেব শায়িত। মন্দিরে আলাপ হল একজন বয়স্কা মাসীমার সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম যে এই মন্দির একজন বয়স্কা সাধিকার হা্তেই প্রতিষ্ঠিত, পরে সময়ের সাথে এই মন্দির তাঁর বর্তমান রুপ পেয়েছে। মন্দির দালানে আগের মন্দিরের ছবির সাথে ওনার ছবিও আছে। আর জানতে পারলাম যে প্রতি অমাবস্যায় মাকে ভোগ নিবেদন করা হয়, আতপ চালের ভোগ সাথে পায়েস। ইচ্ছা রইলো পরে কোনোদিন এই ভোগ গ্রহন করার। আবার বেরিয়ে পরলাম ক্যামেরা কাঁধে, এর পরের গন্তব্য ষণ্ডেশ্বর তলার মন্দির গুলি।

ষণ্ডেশ্বরতলায় এলে প্রথমেই চোখে পড়বে বাবা ষণ্ডেশ্বর মহাদেবের ভব্য মার্বেল পাথরের মন্দিরটি। মন্দির চত্বরে প্রবেশের মুখে একটি সুন্দর তোরণদ্বার আছে যা দেখে মুগ্ধ হতে হবে। মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত শ্রী আশিস ব্যানারজী, ওনার অনুমতি নিয়ে ভিতরে গিয়ে বাবা ষণ্ডেশ্বর মহাদেবের লিঙ্গরুপ দর্শন আর মনভরে ছবি তুলে বাইরে এলাম। মন্দিরের সামনে বাম পাশে বাবা ভৈরব নাথের ছোট্ট একটি মন্দির আছে। আর ঠিক মন্দিরের সামনে আছে মা সিদ্ধেশ্বরি মায়ের মন্দির। মায়ের মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, ডান পাশে কৃষ্ণ রাই মন্দির ওর যোগদ্যা দুর্গা মাতার মন্দির। এই মন্দিরের ইতিহাস মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি ফ্রেমে লেখা আছে, যতটুকু অনুধাবন করতে পারলাম তাঁর মর্মার্থ এই যে – আনুমানিক ১৭৪৬ সাল (ইং) নাগাদ জনৈক শ্যামরাম সোম, মতান্তরে দুর্লভ সোম এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দেখে অবাক হয়ে যেতে হয় তাই না? কি প্রাচীন ঐতিহ্যময় ইতিহাস এই মন্দিরের? ষণ্ডেশ্বরতলায় গঙ্গার ঘাটের দিকে আরও দুইটি মন্দির আছে, হনুমানজির আর রাম, সীতার মন্দির। বর্তমানে গঙ্গার ঘাটের সংস্কার হয়েছে, বসার জায়গা, লাইটের বন্দোবস্ত আছে। দেখলাম অনেকেই বসে আছেন, আমিও একটা গাছের তলায় বসে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। বড় ভালো লাগছিলো, আজকের এই স্বার্থপরতার যুগে, হানাহানির সময়ে যেখানে মানুষ উদভ্রান্ত হয়ে পরে প্রকৃত দিক নির্দেশনার অভাবে সেখানে আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন আছে বইকি।

আমাদের দুর্ভাগ্য চারিদিকে আজ শুদু একটি ধর্মের মানুষের অপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার অভাব, এর থেকে আজ যত হিংসা, হানাহানি। এর থেকে মুক্তির উপায় কোনও রাজনৈতিক নেতা বা ধর্মীয় গুরু/ গুরুমাতারা ভেবেছেন কি? স্বামীজি কিন্তু তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তা থেকে ভবিষ্যৎ ভারতের এই চিত্রটি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি শুধু হলেই হবেনা, সংগে তাদের জানতে হবে ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতির ইতিহাস, তা না হলে সাংস্কৃতিক দিকটির অবক্ষয় ঘটবে। তিনি তাই চেয়েছিলেন ভারতের সাধারণ জনগণ শিক্ষার আলোয় সর্ব চেতনাসম্পন্ন হবার সাথে সাথে ভারতের আধ্যাত্মিক সাধনার ধারাটিকেও জানুক। তাই ডাক দিয়েছিলেন তিনি, 'Deluge the country with spiritual ideas'। সত্য, ন্যায়নিষ্ঠতা, ভালোবাসা, শান্তি ও ঐক্য ভারতীয় সনাতন আদর্শের পরিচায়ক। তিনি বলেছেন - ধর্ম শুধুমাত্র বক্তৃতা বা দর্শনতত্ত্বে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি ধর্মকে আত্ম-উপলব্ধি বলেছেন। তাঁর ভাষায়, "এটি হওয়া বা হতে থাকা, তবে শোনা বা জানা নয়। সমগ্র আত্মার রূপান্তরে বিশ্বাসে রূপান্তরিত হওয়াকেই ধর্ম বলে।" তাঁর মতে সব পূজা যদি পবিত্র হয় ও অপরের হিতের জন্য করা হয়, তবে তার সমষ্টিকেই ধর্ম বলা চলে। স্বামীজি বলেছেন, ধর্ম হল মানুষকে পশু থেকে মানুষে এবং তারপর মানুষ থেকে দেবতায় রূপান্তরিত করার শিক্ষা। আসলে স্বামীজি  ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব শিখেছিলেন, "জীবই শিব"। তাই তিনি "শিবজ্ঞানে জীবসেবা"র উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন - মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর থাকেন। তাই মানুষের সেবা করাই ঈশ্বরের সেবা। স্বামীজি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে যদি কোনো দেশকে পুণ্যভূমি বলতে হয়, যদি কোনো দেশে মানবিকতা, পবিত্রতা, শান্তি সর্বোচ্চ স্থান নেয় এবং সর্বোপরি কোনো দেশ যদি আধ্যাত্মিক ধারণায় পূর্ণ থাকে, তবে সেই দেশটি হল ভারত। অনেক কথা হয়তো বলে ফেললাম, যা বলার উপযুক্ত আমি নই, তাই প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার। আগের পর্বে আমি চেষ্টা করে ছিলাম অষ্টধা মা কালীর এক একটি রুপের বর্ণনার, আজ মা সিদ্ধকালীর কথা বলব -   
সিদ্ধকালী মাকালীর একটি অখ্যাত রূপ। কোনও গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পূজা হয় না, এই মাতৃ রুপ কেবলমাত্র সিদ্ধ সাধকদের ধ্যান আরাধ্যা। কালীতন্ত্রতে তাঁকে দ্বিভূজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। অন্যত্র তিনি ব্রহ্মরূপা ভুবনেশ্বরী। সিদ্ধকালী আদপেই রক্তপান করেন না, তিনি খড়্গ দিযে আঘাত হানেন চাঁদে, সেই চাঁদ থেকে নিঃসৃত অমৃত পানে তুষ্ট হন এই দেবী। মা সিদ্ধকালী সদা সালংকারা। তাঁর বামপদ ভোলানাথ শিবের বুকে ও ডানপদ ভোলানাথের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত।

আজ এই পর্যন্তই, আবার ফিরে আসব বাংলার কোনও কালীমন্দিরের ছবি ও লেখা নিয়ে। সবাই ভালো থাকবেন, সবার মঙ্গল হউক। 

No comments:

Post a Comment