Tuesday 16 May 2017

স্মরণে শ্রী উল্লাসকর দত্ত (আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস)


স্মরণে শ্রী উল্লাসকর দত্ত (আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস)

১৯০৮ সালের ১লা মে, ওয়ার্নি স্টেশন থেকে গ্রেফতার করা হয় ক্ষুদিরাম বসুকে। ভীত ব্রিটিশ প্রশাসন সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেয় ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর সাথে জড়িত সকলকে গ্রেফতার করার জন্য। ২ মে কলকাতার ব্রিটিশ প্রশাসনের পুলিশ আটটি স্থানে খানা-তল্লাশি চালায়। কলকাতার মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত ও নলিনীকান্ত গুপ্তসহ ১৪ জন বিপ্লবীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ৪৮নং গ্রে স্ট্রিট থেকে অরবিন্দ ঘোষ সহ তিনজন বিপ্লবীকে, ১৩৪নং হ্যারিসন রোড থেকে ৫ জন বিপ্লবীকে, রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে হেমচন্দ্র কানুনগোকে (হেম দাশ), গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে কানাইলাল দত্তসহ দুইজন বিপ্লবীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এছাড়া ১৩৪নং হ্যারিসন রোডের বাড়ি থেকে পুলিশ প্রচুর পরিমাণে বোমা তৈরির মাল-মশলা ও সাজসরঞ্জাম উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পুলিশ ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে মাটির তলায় পোঁতা কয়েকটি ট্রাঙ্ক উদ্ধার করে। এই সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বোমা ষড়যন্ত্র ও রাজদ্রোহের অভিযোগে মামলা। এই মামলাটিরই নামকরণ হয়েছিল 'আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা'। আলিপুর জজ আদালতে জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট এর আদালতে 'আলিপুর বোমা মামলা'র সূচনা হয়েছিল ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর। মামলায় অরবিন্দ ঘোষের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় একমাত্র চিত্তরঞ্জন দাশ বিনা টাকায় লড়েন, আসামীদের বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন, দু'শর বেশি সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সওয়াল জওয়াবের সমাপ্তি বক্তব্য দেন ৯ দিন ধরে। আলীপুর মামলার শুনানী শেষ হয় ১৯০৯ সালের ১৩ এপ্রিল এবং মামলার রায় ঘোষণা হয় ৬ মে। মামলার রায়ে ৩৬ জন আসামীর মধ্যে বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ এবং বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় (পরে অবশ্য যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেওয়া হয়)। অন্য ১৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দ্বীপান্তর ও কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

আজ সেই মহান বিপ্লবী শ্রী উল্লাসকর দত্তের প্রয়াণ দিবস, আসুন না কর্মব্যাস্ত জীবনের মাঝে একটু জেনে নিই সেসব অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কথা। না বিপ্লব করতে বলছি না, ম্যাদামরা, পলায়নপর, মেকী বাঙালীর রক্তে সেই তেজ আর কোথায়? তবু স্মরণ করতে, জানতে দোষ কোথায়?

উল্লাসকর দত্ত এর জন্মতারিখ ১৬ই এপ্রিল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ, তিনি জন্মেছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার (বর্তমানে জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ) কালীকচ্ছ গ্রামের বিখ্যাত দত্তরায় বংশের এক ব্রাহ্ম পরিবারে। বাবা স্বনামখ্যাত অধ্যক্ষ দ্বিজদাস দত্ত (১৮৫৪-১৯৩৫) আর মা মুক্তকেশী। মা মুক্তকেশী ছিলেন কালীকচ্ছ গ্রামের আরেক বিখ্যাত নন্দীরায় বংশের মেয়ে। উল্লাসকর ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। দাদা মোহিনীমোহন এর জন্ম ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে। ছোটভাই সুখসাগর এর জন্ম ১৮৯০-এ। সুখসাগর-এর পর লাবণ্যকেশী নামে তাদের একজন বোন ছিলেন।

ছোটবেলায় উল্লাসকর এর ডাকনাম ছিল পালু, তবে তিনি কোনভাবেই অভিরাম নন। অনেকে তার নাম অভিরাম বলে প্রচার করতে চান। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম (১৮৮৯-১৯০৮) এর ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে যে গান রচিত হয় (রচয়িতা বাঁকুড়ার বাউলকবি পীতাম্বর দাস। লোককবি ছন্দ মিলাতে গিয়ে ক্ষুদিরামের সাথে অভিরাম নামটি জুড়ে দেন) তাতে আছে – “হলো অভিরামের দ্বীপচালন মা, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, একবার বিদায় দে মা..”। যেহেতু উল্লাসকরেরও যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর  হয়েছিল তাই অভিরাম এর জায়গায় অনেকেই উল্লাসকরকে বসিয়ে দেন। যাক সে কথা ভ্রমে ভরা, আর কর্তাভজা ইতিহাস আমাদের, নইলে সঠিক ইতিহাস চর্চা হলে বোধহয় আমরা অন্যরকম হতাম। 

যাইহোক বিগত সেই স্বর্ণ যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মপ্রচার সর্বোপরি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অনেক বাঙালী আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখিয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লাসকর অন্যতম। বাঙালিদের মধ্যে এমনকি ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম, যিনি সফল বোমা তৈরি করেন। তার তৈরী বোমাটিই ক্ষুদিরাম-এর হাতে তুলে দেয়া হয় অত্যাচারী ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য। এহেন জাত বিপ্লবী উল্লাসকরের শৈশব সবুজে আর পুকুরে-ঘেরা গ্রাম কালীকচ্ছে কাটলেও পরবর্তীকালে তিনি এন্ট্রান্স পাশ করেন কলকাতা থেকে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে। এরপর বিজ্ঞানবিষয় নিয়ে কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। পিতা দ্বিজদাসও একই কলেজের কৃতীছাত্র ছিলেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ এম.এ পাশ করেন। কিন্তু পুত্র উল্লাসকরের নেশা ছিল রসায়নশাস্ত্রে। যা পরবর্তীকালে বোমা তৈরিতে তার কৃতিত্ব বয়ে আনে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন উল্লাসকর স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। কলকাতার বিভিন্ন হলে বিশিষ্ট বাগ্মী ও স্বদেশী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫২-১৯৩২) ও রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) এর বক্তৃতা শুনেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানে তার মূল প্রেরণা বিপিনচন্দ্র পাল। যিনি তার পিতার বন্ধু এবং মামাত ভাইয়ের শ্বশুর ছিলেন। উল্লাসকর এর মামা মহেন্দ্র নন্দীর ছেলে বীরেন্দ্রচন্দ্র নন্দী বিপিন পালের বড় মেয়ে শোভনাকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক আত্মীয়তাসূত্রে বিপিন পালের কলকাতার বাসায় উল্লাসকরের যাতায়াত ছিল। এই সময় তিনি বৌদি শুভনার ছোটবোন লীলা পালের প্রেমে পড়েন। পিতা দ্বিজদাস দত্ত তখন হাওড়ার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক, সন্তানসন্ততি সহ ওখানকার সরকারি বাসভবনে থাকেন।

বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হলেও পড়ালেখায় মন ছিল না উল্লাসের। তিনি ভাবেন পরাধীন দেশে জজ-ব্যারিস্টার হয়ে কী হবে? প্রায় সমবয়সী প্রেমিকা লীলাও বিজ্ঞানের ছাত্রী। লীলা চান তাঁর উল্লাস লেখাপড়া শিখে বড় চাকুরি করবেন। কিন্তু উল্লাস এফ.এ তে ডাহা ফেল করেন, আসলে মনে মনে সাদা চামড়ার অত্যাচার তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। এর মধ্যে একদিন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক মি. রাসেলকে প্রকাশ্যে জুতো দিয়ে পেটালেন।

ব্যস উল্লাসকরের কলকাতায় লেখাপড়ার পাট চুকল। চিন্তিত পিতা বন্ধু বিপিন পালের পরামর্শে ছেলেকে বোম্বে পাঠিয়ে দিলেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। ওখানকার ভিক্টোরিয়া জুবিলি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এ তাকে ভর্তি করে দেয়া হলো। কিন্তু স্বদেশী মন্ত্রে যে একবার দীক্ষা নিয়েছে তাঁর কি ওইসবে মন টেকে? কলকাতায় তাদের গোপন সশস্ত্র আড্ডার খবর তিনি ঠিকই বন্ধুদের চিঠিপত্র মারফত পেতে লাগলেন। বিপ্লবী ভ্রাতৃদ্বয় অরবিন্দ ও বারীন্দ্র ঘোষ দের বাগানবাড়িতে (মানিকতলা অঞ্চলের ৩২, মুরারিপুকুর রোড) তখন বোমা বানানোর তোড়জোড় চলছে। বোম্বাইয়ের লেখাপড়া আরবসাগরে জলাঞ্জলি দিয়ে উল্লাসকর আবার ভিড়ে গেলেন বিপ্লবী দলে। বিলেতি পোশাক ছেড়ে পরলেন দেশি ন হাতি ধূতি আর চাদর। শুরু করলেন একবেলা আহার আর যোগাভ্যাস, স্বেচ্ছায় বেছে নিলেন বিপ্লবীর কঠোর জীবন।

অপরদিকে পিতার কলেজের লাইব্রেরিতে রসায়ন বিষয়ক পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যবহার করতে থাকলেন কলেজ-ল্যাবরেটরি। লক্ষ্য আর স্বপ্ন একটাই- বোমা বানানো। বহু চেষ্টার পর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে উল্লাসকর ও হেমচন্দ্র দাস বোমা তৈরিতে সফল হন। ১৯০৮ এর ফেব্রুয়ারি মাসে বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ৫ জন বিপ্লবী দেওঘর এর পাহাড়ে যান। পরীক্ষার সময় এত বিকট শব্দে বোমাটি বিস্ফোরিত হয় যে, এতে যিনি বোমাটি ছুঁড়েছিলেন সেই প্রফুল্ল চক্রবর্তী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। গুরুতর আহত হন উল্লাসকর দত্ত, পরে গোপন চিকিৎসায় কলকাতায় তাকে সুস্থ করা হয়। পরের ইতিহাস অনেকেরই জানা। তবুও সংক্ষেপে বলছি - সফল বোমা পরীক্ষার প্রায় তিন মাস পর কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোডকে হত্যার জন্য বিহারের মজঃফরপুরে পাঠানো হয় ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকীকে। তারা উল্লাসকর দত্তের তৈরি করা বোমা সঙ্গে নিয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বোমা কিংসফোর্ডের গাড়ির বদলে অন্য ইংরেজের গাড়িতে পড়ে। পরের দিন ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি ধরা পড়ার আগে নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। ফাঁসি হয়ে যায় ক্ষুদিরামের (১১ই অগাস্ট ১৯০৮)। শুরু হয় ধরপাকড়। মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির কারখানা আবিস্কৃত হয়। অরবিন্দ, বারীন্দ্র, উল্লাসকর সহ ধরা পড়েন প্রায় সবাই। উল্লাসকরের ছোটবেলার দুই বন্ধু ধরণী সেনগুপ্ত ও নগেন সেনগুপ্ত, তারা থাকতেন কলকাতার ১৩৪, হ্যারিসন রোডে, আদি বাড়ি কালীকচ্ছ। ওনারা ওখানে কবিরাজী ব্যবসা করতেন, ধরা পড়লেন তারাও। অপরাধ, তাদের ঘরে বোমা তৈরির সরঞ্জাম রেখেছিলেন উল্লাসকর। আরও ধরা পড়েন উল্লাসকরের চার বছরের ছোট মামাত ভাই (মহেন্দ্র নন্দীর ছেলে) অশোক নন্দী। 

১৯০৮এর ১৯শে অক্টোবর ২৪ পরগণার জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট এর আদালতে যে মামলা উঠে ইতিহাসে তা আলীপুর বোমা মামলা নামে খ্যাত হয়। মজার বিষয় হলো ঐতিহাসিক এই মামলার বিচারক মি. বিচক্রফট ও আসামি অরবিন্দ ঘোষ কেম্ব্রিজে সহপাঠী ছিলেন এবং এক সাথে আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। অরবিন্দ সরকারি চাকুরিতে যোগদান না করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। মামলায় উল্লাসকর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। তবে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয়, নিরপরাধ প্রতিবেশী ধরণী ও নগেনকে বাচাঁনোর জন্য। ঐতিহাসিক আলীপুর বোমা মামলা র রায় বেরোয় ১৯০৯ এর ৬ই মে। ৩৬ জন আসামির মধ্যে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এর ফাঁসির আদেশ হয়। হেমচন্দ্র দাস ও অশোক নন্দীসহ ১৭ জনের বিভিন্ন মেয়াদে দ্বীপান্তর ও কারাদণ্ড হয়। অপরদিকে ১৭ জন বেকসুর খালাস পান (এর মধ্যে কালীকচ্ছের ধরণী ও নগেন ছিলেন)। কারাগারে অসুস্থতা হেতু মৃত্যুবরণ করেন ২১ বছরের টগবগে তরুণ কালীকচ্ছের অশোক নন্দী, তারিখটা ছিল ৬ই অগাস্ট ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ।

ফাঁসির আদেশ শোনার পর যে উল্লাসকর আদালতে দাঁড়িয়ে রবিঠাকুরের গান গেয়েছিলেন – “সার্থক জনম আমার জম্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে”। পরবর্তীকালে উল্লাসকর এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে অস্বীকৃতি জানান, তাঁর যুক্তি ছিল যে ইংরেজের আদালত মানি না সেই আদালতে কোন আপিল নয়। অবশেষে তার প্রিয় ঠাকুর মামা যাকে তিনি সবচে বেশি ভালোবাসতেন সেই মহেন্দ্র নন্দীর (শহীদ অশোক নন্দীর বাবা) অনুরোধে তিনি আপিলের কাগজে সই করেন। উচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসির আদেশ রদ করে উল্লাসকর ও বারীন্দ্রের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরাদেশ দেয়া হয় ১৯০৯ এর ২৩শে অগাস্ট।

শুরু হয় এক অন্যজীবন, আরও কষ্টের জীবন। কলকাতা থেকে প্রায় ছয়শ মাইল দূরে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ওখানকার সেলুলার জেলে পাঠানো হলো উল্লাসসহ দ্বীপান্তরপ্রাপ্ত অন্যদের। দশ ফুট বাই আট ফুট সেলে রাখা হলো একেক জনকে। কারাগারে থাকাকালীন ছিল কয়েদিদের খাটুনির নানা ব্যবস্থা - নারকেলের ছোবড়া থেকে দড়ি পাকানো, ঘানি চালিয়ে তেল নিষ্কাশন, বই বাধাঁই, ঝাড়ু তৈরি ইত্যাদি। একটি কলুর বলদ সারাদিন ঘানি ঘুরিয়ে যেখানে আটসের তেল বের করতে পারে সেখানে বিপ্লবী বন্দিদের বের করতে হতো এক মণ তেল। আবার আস্ত নারকেল ঘানিতে দিয়ে তেল বের করতে হতো, না পারলে কঠিন শাস্তি পেতে হতো। আর খাবার হিসেবে সকালে জুটতো দু হাতা কঞ্জি (কঞ্জি মানে গরম জলে চালগুড়ো সেদ্ধ)। দুপুরে এক বাটি ভাত, দুটো রুটি, অড়হর ডাল আর মাঝেমধ্যে কচুপাতার তরকারি।

প্রতিবাদী উল্লাসকর এহেন অন্যায় মেনে নেন নি, যথারীতি তিনি এর বিরুদ্ধে জেলে আন্দোলন শুরু করলেন এই বলে যে কোন পরিশ্রমের কাজ করবেন না। ফলে শাস্তি- অন্যত্র বদলি। আন্দামানেরই অন্য জেলে, আরও কষ্টের জায়গায়, ফলস্বরূপ তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লো। আলীপুর জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি অলীক স্বপ্ন দেখা বা হ্যালুসিনেশান নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এখানে এসে এই রোগ আরও বাড়ে। খিঁচুনিও দেখা দেয়। তাকে পাঠানো হলো মাদ্রাজের মানসিক স্বাস্থ্য নিবাসে। ওখানে চিকিৎসা চললো প্রায় ছয় বছর। প্রায় ১২ বছর কারাগারে কাটানোর পর মুক্তি মিলল উল্লাসকরের। সালটা ১৯২০। ফিরে এলেন কলকাতায়। হ্যারিসন রোডে একটি ঘি-এর দোকান খুললেন। একাই চালান, লোকসান দিয়ে কিছুদিন পর চলে এলেন জন্মগ্রাম কালীকচ্ছে। এখানে তাকে প্রতি সপ্তাহে একদিন সরাইল থানায় হাজিরা দিতে হয়। যে কারণে কলকাতা বা দূরে কোথাও যেতে পারেন না, বাড়িতেই থাকেন। নিজের তৈরি নৌকোতে ভেসে বেড়ান নদীতে। জন্মশিল্পী উল্লাসকর বাঁশি আর দোতারা বাজান, লোকে তন্ময় হয়ে শুনে। গ্রামের ছেলেরা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন তার কারাজীবনের কাহিনী শুনতে। অনুরোধ আসে কারাজীবনের ঘটনা নিয়ে বই লেখার। লিখে ফেলেন “আমার কারাজীবন” শীর্ষক বই, পরবর্তীকালে তিনিই যার ইংরেজি অনুবাদ করেন ’Twelve years of prison life’। থানায় হাজিরা দেওয়া বাতিল হওয়ায় তিনি আবার কলকাতা গেলেন। জেলে থাকাকালীন লীলার চিঠি পেতেন, অনেকদিন হয়ে গেছে লীলা লন্ডন চলে গেছেন, বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর লীলা লন্ডনে কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়ালেখা করেন। দেশে ফিরে মিরাট, লাহোরে চাকুরি করার পর এখন বোম্বেতে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরি করছেন। ছোটভাই সুখসাগর এর চিঠি থেকে এসব জেনেছেন উল্লাস। আবার ভাই সুখসাগরের চিঠি থেকেই জানলেন, লীলার বিয়ে হয়ে গেছে। স্তব্দ হয়ে গেলেন, মন থেকে তিনি এ বিয়ে কিছুতেই মেনে নিলেন না। 

এরপর বোম্বেতে লীলার সাথে দেখা করতে গেলেন, লীলার সামনে আগুন দিয়ে তার সব চিঠি পুড়িয়ে ধূতির খুঁটে ছাই বেঁধে আবার ফিরলেন কালীকচ্ছে। একাকী নিঃসঙ্গ উল্লাসকর, বাবা-মা কুমিল্লায়। দাদা মোহিনীমোহন কলকাতায়। ছোট ভাই সুখসাগর আর ছোটবোন লাবণ্যকেশী ওরফে পুঁটুরানী তিনি জেলে থাকাকালীন মারা গেছে। উল্লাসের সঙ্গী এখন দোতারা, বাঁশি আর ভিরমি খাওয়া (যে রোগে প্রচন্ড ব্যথায় তিনি অজ্ঞান হয়ে যান এবং মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়)।

আবার একটি চিঠি মনে পড়াল প্রেয়সী লীলাকে, তাঁর লীলা বিধবা হয়েছে। আর কালীকচ্ছে মন টিকল না, আবার এলেন কলকাতা, ইতিমধ্যে দেশভাগ হয়েছে।  অথচও আজন্ম বিপ্লবী তিনি, স্বভাবতই দেশভাগ তথা বাংলাভাগ মেনে নিলেন না, সেই সময়ে পশ্চিমবাংলায় শরণার্থীর স্রোত তাকে ভীষণ কষ্ট দিল। তিনি ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভাতা প্রত্যাখ্যান করলেন।
ইতিমধ্যে উল্লাসকরের জীবনে ঘটে গেছে আর এক বিরাট ঘটনা, পক্ষাঘাতগ্রস্থ বিধবা লীলাকে ব্রাহ্মমতে বিয়ে করলেন তিনি, মর্যাদা দিলেন স্ত্রীর, স্বীকৃতি পেল তাঁদের ভালোবাসা। তখন তাঁদের বয়স ছেষট্টি প্রায়, চালচুলোহীন অসুস্থ দুজনের তখন আর কোলকাতায় থাকার কোন সংস্থান নেই। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের কোন একসমযে তাঁরা পাড়ি জমালেন আসামের শিলচর এ। ওখানে তাঁরা ছিলেন প্রেমাঞ্জন (লীলার বৈমাত্রেয় ভাই) এর মেয়ে কল্যাণীর কাছে, শিলচরে চলে যাবার পর উল্লাসকর জীবিত ছিলেন আরও তের-চৌদ্দ বছর। থেকেছেন শিলচরের বিভিন্ন জায়গায়। প্রথমে পদ্মনগরে। পরে নাজিরপট্টির পপুলার হোটেলে, তারাপুরে, জেল রোডে। তাদের ঐসময়ের জীবনযাপনের কাহিনী আজও আমাদের অজানা, আসলে দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দে তদানীন্তন নেতৃবর্গ ভুলেই গেছেন এহেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের, উল্লাসকর তাঁর অন্যথা হবেন কেন? পরবর্তীকালে সহধর্মিণী লীলা পাল ইহলীলা সংবরণ করেন ১৯৬২তে। শিলচরে থাকাকালীন কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের কোন আর্থিক সাহায্য বা পুনর্বাসন ব্যবস্থা উল্লাসকর বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন - “I don’t want any help from any government”, কাঙিক্ষত স্বাধীনতা না পাওয়ায় বার বার তিনি আক্ষেপ করেছেন, স্বাধীনতার নামে দেশভাগ তার কাম্য ছিল না। দেশভাগের জন্য যারা দায়ী তাদের তিনি দেশদ্রোহী মনে করতেন। শিলচরে ১৭ই মে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ৮০ বছর বয়সে ভারতমাতার এই দামাল ছেলেটির জীবনাবসান হয়। উল্লাসকর দত্তের নামে শিলচরে একটি রাস্তার নাম থাকলেও আমাদের কল্লোলিনী কলকাতায় তাঁর নামে কোনও রাস্তা বা স্মারক নেই। বাঙালী হিসাবে যা সত্যিই আমাদের গর্বের বিষয়? সদা জাগুরুক বাঙালী বুদ্ধিজীবী সমাজ এই বিষয়ে একবার ভেবে দেখবেন কি?


তথ্য সুত্র – বিভিন্ন্য পত্র পত্রিকা, সর্বোপরি গুগুল।

No comments:

Post a Comment