Tuesday 16 May 2017

আজ ১৭ই মে, এক অসাধারণ গণিতবিদ এবং সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের আবিস্কারক ও উচ্চতা নিরূপক শ্রী রাধানাথ শিকদার মহাশয়ের প্রয়ান দিবস


আজ ১৭ই মে, এক অসাধারণ গণিতবিদ এবং সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের আবিস্কারক ও উচ্চতা নিরূপক শ্রী রাধানাথ শিকদার মহাশয়ের প্রয়ান দিবস

মাউন্ত এভারেস্টের নাম আজ সবাই জানে, হিমালয় পর্বতমালায় পৃথিবীর সবথেকে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ, আর একজন অসাধারণ মেধাবী বাঙালী গণিতবিদ পরিমাপ করে বের করেন এর উচ্চতা। আসুন আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে একবার স্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ভারত মায়ের এই সুযোগ্য সন্তানটিকে।

স্বর্গীয় শ্রী রাধানাথ শিকদারের জন্ম ১৮১৩ সালে, কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রী তিতুরাম শিকদার। শৈশবে রাধানাথ “ফিরিঙ্গি” কমল বসুর বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন, পরে ১৮২৪ সালে তিনি ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। এই হিন্দু কলেজেই রাধানাথ শিকদার শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন ইংরেজির শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, গণিতের শিক্ষক ড. জন টাইটলার প্রমুখ প্রথিতযশা বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তিদের। হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায়, বিশেষ করে গণিত বিষয়ে তাঁর অসীম জ্ঞান সবাইকে মুগ্ধ করে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ছাত্র থাকাকালীন তিনি নিজেই জ্যামিতির একটি সম্পাদ্য সমাধানের পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন, যা Gleanings in Science (১৮৩১) পত্রিকায় “To draw a Tangent to two Circles” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিলো।

এবার আসি তাঁর কর্মজীবনের কিছু কথায়, ১৮৩১ সালে ভারতে সার্ভেয়র জেনারেল ছিলেন স্যার জর্জ এভারেস্ট, তিনি একজন দক্ষ, তরুণ গণিতবিদকে খুঁজছিলেন। ওইসময়ে তাঁর বন্ধু ড. জন টাইটলার তাঁর প্রিয় ছাত্র রাধানাথের নাম সুপারিশ করে ছিলেন স্যার এভারেস্টের কাছে। ঐ সময়ে আইজ্যাক নিউটনের প্রিন্সিপিয়া সমগ্র ভারতে প্রথম চর্চা করেছিলেন রাধানাথ শিকদার ও রাজনারায়ণ বসাক, যা সম্ভব হয়েছিলো তাঁদের শিক্ষক ড. টাইটলারের জন্যই। স্যার এভারেস্ট রাধানাথ শিকদার কে চিনতে ভুল করলেন না, চাকরি দিলেন নিজ দপ্তরে। শুরু হল এক বরনময় জীবন, সেই সময়ে শ্রী রাধানাথ শিকদারের বেতন ছিল মাসে ত্রিশ টাকার মতো। পরবর্তীকালে শ্রী রাধানাথ গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্ভেয়র হন। দেরাদুনের সিরোন্‌জ অঞ্চলে জরিপের কাজে যুক্ত হয়ে যান তিনি। এ জরিপের কাজের জন্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানী জর্জ এভারেস্ট বেশ কিছু নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই, রাধানাথ এরকম কিছু পদ্ধতির পরিমার্জন করে দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে একটির শিরোনাম ছিলো A Set of Tables for Facilitating the Computation of Trigonometrical Survey and the Projection of Maps for India।

এরপর স্যার জর্জ এভারেস্ট অবসর নিলেন ১৮৪৩ সালে। তাঁর আগে তিনি The Great Trigonometrical Survey কাজটি সম্পূর্ণ করেন। এটি ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ও ভয়ঙ্কর সমস্যাসঙ্কুল জরিপের কাজ। তাঁর জায়গায় অভিষিক্ত হলেন স্যার অ্যান্ড্রু ওয়াহ, তিনি ১৮৪৫ সালের ৩১ মার্চ তারিখে তিনি ভারতের প্রধান কম্পিউটার (Chief Computer) হিসাবে পদোন্নতি পান। আর  সেই সময় শ্রী রাধানাথ শিকদার দেরাদুনের সার্ভে অফিস থেকে কলকাতার সার্ভে অফিসে বদলি হয়ে আসেন, শুরু হয় আর এক কর্মযজ্ঞ। ১৮৪৭ সালে  স্যার অ্যান্ড্রু ওয়াহ হিমালয় পর্বতমালার পূর্বপ্রান্তে একটি নতুন শৃঙ্গ আবিষ্কার করেন। তিনি ধারণা করেন যে এর উচ্চতা তখন পর্যন্ত জানা পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকে বেশি হতে পারে। এর নাম রাখা হলো “শৃঙ্গ-১৫” (Peak-XV)। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে হিমালয় পর্বতের ৭৯টি শিখরের উচ্চতা নির্ণয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। এগুলোর মধ্যে ৩১টির স্থানীয় নাম ছিলো আর বাকিগুলোকে রোমান অক্ষরের সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো। সে অনুযায়ী ভবিষ্যতের এভারেস্ট শৃঙ্গকে ডাকা হতো শৃঙ্গ-১৫ (Peak-XV) নামে।

সেই সময়ে হিমালয় পর্বতমালার সব শৃঙ্গের উচ্চতার মাপ জমা পড়েছিলো কলকাতার গণনা বিভাগে। রাধানাথ শিকদার মন দিলেন এতে, ফল স্বরূপ ১৮৫২ সালের একদিন তিনি আবিষ্কার করে বসলেন শৃঙ্গ-১৫ (Peak-XV) পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। তাঁর হিসাবে এর উচ্চতা ২৯,০০২ ফুট। দেরাদুনে অ্যান্ড্রু ওয়াহকে বিষয়টা জানান তিনি। এ ছিলো এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ওয়াহ সাহেব কাউকে না জানিয়ে দেরাদুনে “কম্পিউটার” পদে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হেনেসি সাহেব ও তাঁর সহযোগীদের দিয়ে বিষয়টা ক্রসচেক করান। অবশেষে ১৮৫৬ সালে শ্রী রাধানাথের পরিশ্রম স্বীকৃতি পায়। সে বছর রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি পিক ফিফটিনকে ঘোষণা দেয় বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ হিসাবে। জর্জ এভারেস্টের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট। স্যার ওয়াহ কোন প্রচলিত আঞ্চলিক নাম প্রস্তাব করতে পারেননি। এর কারণ হলো সে সময় নেপাল ও তিব্বত বিদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো, যদিও তিব্বতিরা একে কয়েকশো বছর ধরে চোমোলুংমা বলে আসছিলো। এর নাম প্রথমে মন্ট এভারেস্ট রাখলে চাইলেও পরে মাউন্ট এভারেস্ট নামটি চূড়ান্ত হয়।

দুঃখের বিষয় একটাই, ১৮৫২ সালে এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করলেও শ্রী রাধানাথের কৃতিত্ব গোপন করে ইংরেজরা, একজন নেটিভ ভারতীয়ের এতো বুদ্ধি সম্ভবত মেনে নিতে পারেনি সেদিঙ্কার সুসভ্য ইংরেজ সমাজ। যাই হোক সত্য কোনদিন চিরকাল গোপন থাকে না, একদিন না একদিন টা সর্ব সমক্ষে আসেই। 

কালের নিয়মে ১৮৫১ সালে সার্ভে বিভাগের এক ম্যানুয়াল প্রকাশিত হয়। A Manual of Surveying for India ছিলো এর নাম। এর লেখক ছিলেন আর. স্মিথ ও এইচ. এল. থুইলিয়ার। এ ম্যানুয়াল প্রকাশে রাধানাথের সহযোগিতা ও অবদানের কথা তাঁরা উল্লেখ করেন। কিন্তু ১৮৭৫ সালে রাধানাথের নাম রাখা হয় নি বইটির তৃতীয় সংস্করণে। ১৮৭৬ সালে Friend of India নামক সংবাদপত্র এ ঘটনাকে “মৃতের উপর ডাকাতি” বলে উল্লেখ করে। রাধানাথের আবিষ্কারের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ভারতের প্রাক্তন সার্ভেয়ার জেনারেল কর্নেল সিডনি জেরাল্ড বুরার্ড। ১৯০৪ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা নেচারের (Nature) ১০ নভেম্বর সংখ্যায় “Mount Everest:The Story of a Long Controversy” শিরোনামে এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করে। সারা বিশ্ব জানতে পারে রাধানাথ শিকদার নামের এ অসাধারণ গণিতবিদ সম্পর্কে।

আচ্ছা গণিতবিদ শ্রী রাধানাথ শিকদারের সম্পর্কে তো অনেক কিছু জানা হল, এবার আসি ব্যাক্তি  রাধানাথ শিকদারের কথায়। ইংরেজ সাহেবদের অধীনে কাজ করলেও তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, স্বাধীনচেতা ও সাহিত্য অনুরাগী। একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। 

১৮৪৩ সালের ১৫ মে, দেরাদুন শহর। সে সময় সাধারণ মানুষকে উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসাররা জোর করে পয়সা না দিয়ে খা‍‌টি‍‌য়ে নিতো। শ্রী রাধানাথ শিকদার সেসময় দেরাদুনের গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অফিসের কম্পিউটার পদে ছিলেন। ঘটনার দিন রাধানাথের পরিচারককে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এইচ. ভ্যানসিটার্ট সাহেব বিনা পয়সায় তাঁর নিজের মালপত্র বহন করিয়ে নিচ্ছিলেন। এমন কাণ্ড দেখে রাধানাথ সে মালপত্র আটকে রাখেন ও ম্যাজিস্ট্রেটকে সশরীরে তাঁর কাছে আসতে বাধ্য করেন এবং যার ফলস্বরূপ তাঁদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ঘটে। শেষে মালপত্র ফেরত পেলেও ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। মামলায় রাধানাথ হেরে যান আর দুশ টাকা জরিমানা হয়ে যায় তাঁর। সে সময় এটা কিন্তু অনেক বেশি অর্থ, তবু শ্রী রাধানাথ কোনরকম গ্রাহ্য না করে জরিমানা দিয়ে দেন। পরবর্তীকালে তাঁর এহেন প্রতিরোধ/ প্রতিবাদের ফলে এরকম বেগার খা‍টিয়ে নেবার মতো অমানবিক কাজ অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। ১৮৫৪ সালে তাঁর বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্রের সাথে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে মাসিক পত্রিকা নামে পত্রিকা বের করেন। ১৮৬২ সালের ১৫ মার্চ তিনি অবসর গ্রহণ করেন ও তৎকালীন জেনারেল এসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশনে (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৮৬৪ সালে তিনি জার্মানির ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি অফ ব্যাভারিয়ার (Natural History Society of Bavaria) সম্মানজক সদস্যপদ পান।

এই মহান গনিতবিদ সাহিত্য অনুরাগী মানুষটির জীবনাবসান ঘটে ১৮৭০ সালে ১৭ মে চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার গঙ্গার ধারে তাঁর নিজস্ব বাড়িতে। তাঁর মৃত্যুর পর নেচার পত্রিকা লিখলো, “Baboo Radhanauth Sickdar for many years chief computer to the Trigonometrical Survey of India, at one time in charge of Calcutta Observatory, and a mathematician of some attainments, died in May last at Calcutta.” তাঁর উপরওয়ালা স্যার জর্জ একবার তাঁর সুযোগ্য শিস্য শ্রী রাধানাথ শিকদার সম্পর্কে বলেন - “Hardy, energetic young man, ready to undergo any fatigue, and acquire a practical knowledge of all parts of his profession.”

আসুন এই মহান বাঙালী মনীষীর প্রয়াণ দিবসে তাঁকে স্মরণ করি, আর প্রার্থনা করি হে ভারতমাতা আরও একবার ফিরিয়ে দাও সেই স্বর্ণযুগের সন্তানদের, দেশের যে আজ আশু প্রয়োজন তাঁদের।

তথ্য সুত্র – বিভিন্ন্য পত্র পত্রিকা, সর্বোপরি গুগুল।

No comments:

Post a Comment