১৯শে মে ভাষা শহীদ স্মরণে
আমাদের বাঙ্গালীদের প্রানের ভাষা এই বাংলা, এই ভাষাতেই গান গাই, কবিতা লিখি, আবার তর্কের তুফান তুলি এই ভাষাতেই, অতএব এই ভাষার প্রতি দরদ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এই ভাষার টানে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা তো বাঙালীর মনে আছে, গর্বের সাথে স্মরণ করি সফিউর, রফিক, জব্বারদের, মনে মনে গেয়ে উঠি - “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”। কিন্তু সেইভাবে কি মনে আছে, বাহান্নর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের অঙ্গরাজ্য আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন অসমসাহসী বাঙালীকে। কে জানে রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, আহারে-বাহারে, হাজারো উৎসবে মেতে থাকা বাঙালীকে দেখে তো মনে হয় না। মাতৃভাষা যে কোন জাতির আবেগিক পরিচয়ের অন্যতম দিক। মাতৃভাষার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। দুঃখজনকভাবে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা সেই এগারো জন মানুষের কথা আজ বোধয় আমরা বিস্মৃত, আমরা জমি আন্দোলনের ইতিহাস কে পাঠ্য পুস্তকে ঠাই দেবার প্রয়াস করতে পারি অথচও নিজে দেশের ভাষা শহীদদের কথা ইতিহাস বইতে সম্মিলিত করার দাবি তুলতে পারি না।
যাকগে এই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করার মহান দায় আমাদের রাজনৈতিক নেতা/ নেত্রীদের সাথে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী সমাজ তো আছেই, অতএব সংক্ষেপে জেনে নিই এই মহান ভাষা আন্দোলনের কথা। কে জানে আগত সময়ে এরকমই আর এক আন্দোলনের ভাগীদার হতে হবে কিনা?
প্রতিবেশী আসাম রাজ্যর প্রধান ভাষা অহমীয়া হলে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ, কাছাড় এবং শিলচর বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা হিসাবেই আজও পরিচিত। স্বাধীনতা তথা দেশ ভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালী (বর্তমান সিলেট বিভাগ) পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বরাক ভ্যালী থেকে যায় আসামে। ১৯৬১ সালে আসাম সরকার শুধু মাত্র অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষনা দিলে, স্বভাবতই ক্ষোভ দানা বাঁধে স্থানীয় বাঙালীদের ভেতর, পরবর্তীকালে যা ক্রমশঃ রূপ নেয় আন্দোলনের - প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস আন্দোলন।
১৯৬১ সালের ১৯ মে, আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে এদিন শিলচরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করা হয়। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ভাষাবিপ্লবীরা যখন স্থানীয় রেলওয়ে ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ পালন করছিল তখন নিরাপত্তারক্ষায় নিয়োজিত আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ান তাদের বাধা দেয়। প্রতিরোধ, পাল্টা প্রতিরোধে, এক সময়ে আসাম রাইফেলস গুলি চালালে ঘটনাস্থনে প্রান হারান ১১ জন ভাষাবিপ্লবী, সাথে আহত হন অর্ধশতাধিক। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষনা করা হয়।
সেদিন মাতৃভাষার জন্য যে ১১ জন বীর শহীদ আত্মবলি দেন তাদের মধ্যে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষাশহীদ সতের বছরের তরুনী কমলা ভট্টাচার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দুজন নারী মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন- একজন শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় জন শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ, যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে শহীদ হন।
১৯ মের ১১ জন ভাষাশহীদদের তালিকা -
১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য
২. শহীদ শচীন্দ্র পাল
৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর
৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী
৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর
৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব
৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস
৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস
৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ
১০. শহীদ সুনীল সরকার
১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ
আসুন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এই সব অসমসাহসী বীর বাঙ্গালীদের, যাঁদের আত্মত্যাগ গর্বিত করেছে সমগ্র বাঙালীকে।
This comment has been removed by the author.
ReplyDelete