Monday 3 October 2016

পুজোর চিঠি


পুজোর চিঠি

শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা,
কেয়ার অফ বাবা মহাদেব
কৈলাশ ভিলা
কৈলাশ নগর, গঞ্জিকা সরণী।

প্রিয় মা,

অপরাধ নিয়ো না মা, অত উপরে নেটওয়ার্ক ঠিক মত কাজ করবে কিনা জানি না তাই আর whatsapp/ email এর ঝামেলায় গেলাম না চিঠি লিখে বসলাম। আর তো পাঁচদিন মা, এর পরেই তুমি এসে পড়বে, জানি এবারে ঘোটকে আগমন তোমার তাই লেট হবে না তবু প্রতিবারের মত এবারেও অধমের কিছু আরজি আছে তাই জানাতে সাধ হল। একটু ক্ষমা ঘেন্না করে দিয়ো জানোই তো ছিঁচকাঁদুনী নেকু পেশু বাঙালি আমরা মুখে যতটা বড় কাজে ততটা দড় নই। যাক গে যে কথা বলছিলাম মা – জানো আজকালকার ছেলেপুলেগুলো মহিষাসুরমর্দিণী শুনে শিহরিত হয়না। অথচও দেখো আজও “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা…” শুনলেই যেন শিহরণ হয়, সেই এক অনুভূতি কোন চেঞ্জ নেই? সেই ভাবগম্ভির স্ত্রোত্র, আগমনীর সুরে যেন মনের ভেতরটায় বেজে ওঠে কিসের সুর…মনে হয় আবার শরত এলো, আবার পুজো এসে গেল। জানো মা আজ আর রেডিও কেউ শোনে না, রেডিওর, আকাশবাণীর জায়গা নিয়েছে এফ এম, মহিষাসুরমর্দিণীর এমপিথ্রি এখন সবার মোবাইলে, তবু কজন শোনে কে জানে? জানো মা অফিসের কাঁচের জানলা দিয়ে আজও খুঁজি পেঁজা তুলোর মত মেঘ, দেখতে পেলে আজও হাততালি দিয়ে নেচে উঠতে ইচ্ছে করে। আগে তো মা এই সেপ্টেম্বর/ অক্টোবর মাসে বেশ ঠাণ্ডা পড়ত, ভোঁরে শিউলি ফুল কোড়াতে গেলে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগতো, আর এখন ভাদ্রের ভরা গুমোট? ওয়েদারের গুমোট যদিও বা কখনও কাটে, মনের গুমোট কেন কাটে না মা? জানো মা ভট্টাচার্যবাবু দের বাগানে শিউলি গাছ টা কেটে দিয়েছে, বড্ড নাকি শুঁয়াপোকার উৎপাত হয়? শুনেছি বাড়িটাও নাকি কোন প্রমোটার কে দিয়ে দিয়েছে, সুন্দর ফ্ল্যাট তৈরি হবে ভাঙ্গাচোরা আদ্দিকালের প্রকাণ্ড বাড়ীটা ভেঙ্গে! মাগো  মনে হচ্ছে পরের প্রজন্ম প্লাস্টিকের শিউলি ফুলেই তোমার পূজা দেবে? জানো মা আগে ট্রেনে চেপে অফিসে বা যেখানেই জেতাম না কেন, কাশফুলের বন দেখতে পেতাম, এখন বোধহয় কয়েকশো মাইল পারি দিলেও কাশফুলের বন চোখে পড়বে না। 

আজও নিউজ পেপারের স্টলে থরে থরে সাজানো পূজাবার্ষিকী, দেখলে ছোটবেলার কথা মনে পরে যায়, নতুন পূজাবার্ষিকীর গন্ধ খুঁজে বেড়ায় ফেলে আসা মন। মাগো আর একবার আমায় ছোটবেলায় ফেরত পাঠাবে? জানো মা, এখন পাড়ায় পাড়ায় চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল, তবু মা, দিদার হাতের নাড়ু, নিমকি, গজার জন্যে প্রানটা হা হুতাশ করে। জানো মা, আগে পাড়ায় পুজোর মধ্যে আন্তরিকটা ছিল, এখন আড়ম্বর আছে, থিম আছে, চোখ ধাঁধানো এলএডি লাইট আছে, তবু মা কেন টুনি লাইট, একচালার তোমার মূর্তি খোঁজে মন?

জানো মা এখন চারিদিকে কত মল, শপিং কমপ্লেক্স, কিন্তু সেই বয়োজ্যেষ্ঠ কাকুর দোকান আজও মনের মাঝে অমলিন হয়ে আছে। বারবার নতুন জামাকাপড়ের প্যাকেট খুলে গন্ধ নিতাম, আজ সেসব শুদুই স্মৃতি। জানি মা অনেকে আমায় ব্যাকডেটেড বলবে, ক্ষতি নেই। তবু তোমার একরাশ কালো চুল দেখতে চাই, মেমসাহেবের মত সোনালি চুল চাই না। চাইনা কর্পোরেট ঢঙের পূজা, তাতে যদি বাজেট কমে ক্ষতি নেই, না হয় এবার ভাসানে ডিস্ক লাইট হবে না, ডিজে হবে না, কিন্তু মা ঢাক তো আছে। ওই দিয়েই জীবনের বাকি কটা দিন ঠিক চালিয়ে নেব।

জানো মা আজও স্মৃতি কোঠায় পূজার দিন গুলো অমলিন। ষষ্ঠীর দিন ভোরেই মা কে দেখতাম স্নান করে বাড়ির প্রতিটি দরজায় চন্দন আর সিঁদুরের ফোঁটা দিতে, এটি নাকি মাঙ্গলিক কাজ। আমার কাছে পুজোর শুভ সূচনা আর কি। তারপর দুর্গাষষ্ঠীর ব্রতকথা পড়ে মা জল, সন্দেশ খেতেন। মা বলতেন, তিনি যখন ব্রতকথা পাঠ করবেন, তখন যেন তাঁর পাশে বসে আমি শুনি। সেই একই গল্প প্রতিবার… মাদুর্গার গায়ের ময়লা থেকে তাঁর নিজের হাতে গড়া একরত্তি গণেশের জন্ম, তারপর গণেশের কি করে হাতির মুখ হল …কতবার শোনা তবুও ঐ বিশেষদিনে তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। দুপুরে নিরামিষ অতএব লুচির কড়ায় পোষ্টম্যান বা ডালডা ঢেলে জলখাবারে লুচি, দুপুরে লুচি আবার রাতেও লুচি, সঙ্গে বেগুণ ভাজা, নারকোল দেওয়া ছোলারডাল, মাখামাখা আলুর দম অথবা ছোলা দেওয়া কুমড়োর ছক্কা আর শেষ পাতে সিমুইয়ের পায়েস। মনে মনে বলতাম ইসস এরকম দিন কেন রোজ আসেনা মা? সপ্তমীর ভোর জানান দিত ঢাক ঢোল পিটিয়ে কলাবৌ স্নান করাতে যাওয়ায়। সেদিন দুপুরে মাস্ট মাছ হত এটা আমাদের বাড়ীর অলিখিত নিয়ম – রুই মাছের কালিয়া আর চিংড়ির মালাইকারী হবেই সেদিন। সপ্তমীর সন্ধ্যেয় সেজেগুজে ঠাকুর দেখার পালা। পরদিন সকালে উপোস করে, স্নান সেরে, নতুন জামা পরে মহাষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া। দুপুরে আবারো লুচি। সেদিন হয়তো ছানার ডানলা কিম্বা ধোঁকার ডানলা বা নিরামিষ ফুলকপির তরকারি, এই ছিল তখনকার স্পেশাল মেনু। রাতে সবচেয়ে দামী পোষাক। রিক্সা ভাড়া করে ঠাকুর দেখতে বেরুনো। নবমীর সকাল হলেই মনখারাপ একটু একটু করে গ্রাস করতে শুরু করত, পরেরদিন দশমীর কথা ভেবে। সেদিন বাড়ীতে আমিষের আয়োজন – হয় মুরগির মাংস নয়ত খাসীর মাংস। সন্ধ্যেয় ধুনুচিনাচ দেখতে যাওয়া। আরও ঠাকুর দেখা ঘুরে ঘুরে। নবমী নিশি পোহালেই পুজো শেষ যেন …সেই অমোঘ সত্যিটা মেনে নিতে কষ্ট হত। আমার সব মনখারাপ আছড়ে পড়ত মায়ের আঁচলে। মনে পড়ে, দশমীর বিকেলে বাবা আমাদের নতুন খাতার মধ্যে লালকালির দোয়াতে খাগের কলম ডুবিয়ে লেখাতেন “শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’, আজ  আর কেউ লেখেনা  বোধহয়। পরদিন থেকেই শুরু হত সব আত্মীয়/ বন্ধুদের বিজয়ার চিঠি লেখা। মধ্যবিত্ত বাড়িতে বেড়ে ওঠার দরুন সেই আটপৌরে আভিজাত্য কোথায় হারিয়ে গেলো মা? আজ ডিজিটাল যুগে নতুন ধরনের সামাজিকতায় ভুলেই গেছি সেই সব চিঠির বয়ান, আজ যে শুদুই ই মেল, এসএমএস, হোয়াটস্যাপ। তাতে হয়ত দায় মেটে, কিন্তু ভালোবাসার বাঁধন অনুভব হয়না।  

দশমীর দিন মা, দিদার করা এলোঝেলো নিমকি, কুচো নিমকি, ঝাল নিমকি, নারকেল নাড়ু আর চন্দ্রপুলি, নানা রকম গজা, সুজির নাড়ু, বেসমের নাড়ু সব যে হারিয়ে যাচ্ছে মা? জানো মা আগে রান্না ঘরে একটা বড় হাঁড়ি করে ঘুগনি করতো মা, আমি খালি নানান ছুতো করে ঘুর ঘুর করতাম যে কখন মা আমায় একটু টেস্ট করে দেখতে বলবে। সন্ধ্যে হলেই পাড়ায় বিজয়া দশমী করতে বেরোতাম আমরা, উফফ সে কি মজা পাড়ার এক এক কাকিমা/ জেঠিমা যেন রান্নায় সেদিন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা, কেউ বানাত কাটলেট, কেউ দই বড়া তো কেউ অন্য কিছু। এখন ফাস্ট ফুডের জমানা সেই মা, কাকিমাদের হাতের স্বাদ, ভালবাসা খুঁজে পাই না। হাই হ্যালো তে বিজয়া সারা আজকে। বড় মেকি হয়ে গেছে আজকের সমাজ, আমরা বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেছি। আজকের গ্লোবাল দুনিয়ায় সম্পর্ক, ভালবাসা সব মিথ্যে, সবই বোধহয় বাস্তবের ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড।  

তুমি এসো মা, প্রতিবারের মতো এবারেও এসো, খালি দিনগুলো সব আগের মতন করে দাও মা। এটাই অধমের আর্জি। জানি মা নস্টালজিয়া ধুয়ে জল খাবো না, আবেগ নিয়ে এই দুনিয়ায় বাঁচা সম্ভব নয়, কিন্তু কি করব মা? তুমি যে আমায় এইভাবে গড়েছ, তাই এবারে আমার আর্জি একটু শুনবে? আমার রুপ, যশ কিছুই চাইনা, এমন কি কোটিপতিও হতে চাইনা। কি হবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে, তাঁর থেকে মা আমায় সারল্য দাও, মনুসত্ত্য বোধ দাও, প্রকৃত শিক্ষা দাও, শিক্ষার অহঙ্কার দিয়ো না, সর্বোপরি যে শিক্ষা মানুষে মানুষে বিভেদ শেখায় সেই শিক্ষা চাই না মা। আশীর্বাদ করো যাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুদ্র তেজে রুখে দাঁড়াতে পারি, ভয় পেয়ে পিছিয়ে না আসি। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই মা, কার দয়া দাক্ষিনে নয়। একটু ভেবে দেখো মা খুব বেশি কিছু কি চাইলাম? জানিনা। 

প্রণাম নিয়ো।


No comments:

Post a Comment