Wednesday 26 October 2016

ছোটবেলায় ভুত চতুর্দশী বা নরক চতুর্দশী



ছোটবেলায় ভুত চতুর্দশী বা নরক চতুর্দশী

কালীপূজো এলে আমি যেন আমার কৈশোরে ফিরে যাই, মনে পড়ে যায় সেই সব ফেলে আসা দিনের কথা। সেই সময় হাওয়ার বদল টের পাইয়ে দিত, কালীপূজো আসছে। আমাদের বাড়িতে এই সময় আকাশ প্রদীপ দেওয়া হতো, সেই সময় তো ডিশ টিভি ছিল না, সম্বল বলতে ছিল ছাদের মাথায় অ্যান্টেনা। তার সাথেই একটুকরো বাঁশ বেঁধে তাতে একটি নীল রঙের ছোট ডুম দিয়ে আলো দেওয়া হতো। কোন এক পড়ন্ত বিকালে আমি আর বাবা ছাদে উঠে এই কাজে লেগে পড়তাম গভীর আগ্রহ নিয়ে, সন্ধ্যার আকাশে যখন সেই নীল ডুমখানি জ্বলে উঠত, অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হতো চারিদিকে। আমি চুপ করে বসে সেই নিস্তব্দতায় হারিয়ে যেতাম।

কালীপূজোর সাথে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল ভুত চতুর্দশী বা নরক চতুর্দশী নিয়ে, দুপুরে মায়ের হাতের চোদ্দশাঁক ভাজা, গরম ভাতের সাথে ঘি দিয়ে অপূর্ব লাগতো। মা বাবা কে বলে দিতো – ঠিক করে দেখে আনবে, ভুলে যাবে না কিন্তু। বাবা্ ঠিক বাজার থেকে খুঁজেপেতে নিয়ে আসতো, তবে তথাকথিত চোদ্দশাঁকের মধ্যে সব ঠিক ঠিক থাকতো কিনা দেবা ন জানন্তি। শাস্ত্রমতে এই শাকগুলি হল যথাক্রমে— ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা এবং শুষণী। আজকের প্রজন্ম হয়তো জানেই না এই চোদ্দশাঁকের কথা। তাঁরা হয়তো হেঁসে উড়িয়ে দেবে এসব গ্রাম্য প্রথা বলে। কিন্তু এর পিছনেও বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা আছে – এই সময় যেহেতু ঠাণ্ডার আমেজ এসে যায়, হাওয়ায় ভাসে হিম যা থেকে নানারকমের রোগ সৃষ্টি হয়, তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ানোর জন্যে এই চোদ্দশাঁক খাওয়ার প্রথা। তাই আমার মতে খাওয়াই ভালো, আর যাই হোক এতে ক্ষতি তো কিছু নেই। যাই হোক ফিরে আসি প্রসঙ্গে, নরক চতুর্দশীর দিন বাড়ীর আনাচে কানাচে ১৪টি প্রদীপ দেওয়া হতো। আমি খুঁজে খুঁজে বের করতাম অন্ধকার জায়গাগুলো, মা বলতো এই দিনে প্রেতলোক থেকে আত্মারা পৃথিবীতে নেমে আসে। যেসব আত্মারা প্রেতলোক প্রাপ্ত হয়, যারা স্বর্গ/নরক কোনটাতেই যেতে পারে না, তারা এই দিনে জেগে ওঠে। এই একদিন তাঁদের আলো দেখানো হয়, এতে তাঁরা খুশি হয়, এছাড়া আজকের দিনে এই চোদ্দ প্রদীপ দিয়ে মা লক্ষ্মীকেও গৃহে আসার আমন্ত্রণ দেওয়া হয়। আমিও বেশ খুশি হতাম আর যাই হোক আজ ভুতে আমার ঘাড় মটকাবে না, তাঁদের যে খুশি করা হচ্ছে আজ। আগে মাটির প্রদীপ দেওয়া হতো, তাতে রেড়ির তেল দেওয়া হতো, পরে অবশ্য প্রদীপের জায়গা নিয়েছিল মোমবাতি। পরে বাবার কাছে, বই পড়ে জেনে ছিলাম আরও অনেক অজানা তথ্য যে – এই নরক চতুর্দশীর দিনই কৃষ্ণ ভগবান নরকাসুরকে বোধ করে ছিলেন, থুড়ি তিনি তো নন বধ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী সত্যভামা। দশেরায় যেমন রাবণের মূর্তি দাহ করেন উত্তর ভারতের মানুষজন, গোয়ায় তেমনি দাহ করা হয় নরকাসুরের মূর্তি। মনে করা হয়, নরাকসুরের এই প্রতীকী দহন সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে, দূর করবে যাবতীয় অশুভ শক্তি, সমাজ পাপমুক্ত হবে। কে জানে আদৌ আমাদের সমাজ কোনদিন পাপমুক্ত, অশুভ শক্তির হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে কিনা? আবার প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, ফিরে আসি নিজের কথায়। বাড়ীর আনাচে কানাচে, কুয়োর ধারে, তুলসী মঞ্চের পিছনে মোমবাতির নরম আলো অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করতো। আমি আর আমার পোষা কুকুর লুসি চুপ করে বসে সেই মায়াবী পরিবেশের আনন্দ নিতাম যতক্ষণ না মা ডাক দিতো।

আজকের কর্মব্যাস্ত জীবনে যখন সব হারানোর পালা, তখন হয়তো স্মৃতি সবথেকে বড় পাওয়া। 

আমি মনেপ্রানে বিশ্বাস করি প্রত্যেকটি সার্বজনীন উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয়কে উদযাপন করে হয়ে থাকে। দীপাবলির এই উৎসব অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালানোর উৎসব, নিজের অন্তরের সকল অজ্ঞতা, অন্ধকারকে মুছে ফেলে আলোয় উত্তরণের উৎসব। হয়তো অঞ্চল বিশেষে দীপাবলির মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু মূল কথা এক - আত্মাকে প্রজ্বলিত করে পরিশুদ্ধ করে সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার পথই দেখায় এই উৎসব। সবার ভালো হোক, সবাই ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

No comments:

Post a Comment