Friday 24 March 2017

ভাবের বাঙালি অথবা লোভী কাঙালির চুপকথা – পর্ব ২


ভাবের বাঙালি অথবা লোভী কাঙালির চুপকথা – পর্ব ২

হাঁস ছিল সজারু ব্যাকরণ মানিনা, হয়ে গেল "হাঁসজারু" কেমনে তা জানিনা। উঁহু এই হাঁসজারু জীবটির দেখা শুধু সুকুমার রায়ের কবিতায় মিলবে এমন ভুলেও ভাববেন না, চোখকান খোলা রাখিলে মদীয় শিক্ষিত ভদ্দরলোকেদের মাঝে থুড়ি এই বঙ্গ সমাজেও এদের যত্র তত্র দেখিতে পাইবেন। দেখিবেন ইহারা জনগনের মাঝে সমাজ শোধরানোর বুলি থুড়ি মানবতার ঝুলি হাতে জ্ঞ্যান বিতরনের জন্যে উপস্থিত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে কেউ শ্রীযুক্ত কবি, কেউ কালো কোটধারি আইনের রক্ষক, কেউ বা শিক্ষক, শিক্ষিকা নামক মহান কুলোদ্ভবজাত, কেউ ইঞ্জিনিয়ার - ডাক্তার, মানে সব হোয়াইট কালার প্রফেশনাল, আর কেউবা নিতান্তই স্বতন্ত্র অর্থাৎ আঁতেল গোষ্ঠীভুক্ত। তবে এনাদের উদ্দেশ্য মহৎ অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের মুণ্ডপাত। বেশ কিছুদিন আগে মুক্তমনা বলে একটি ওয়েবসাইটে কিছু লেখা দেখলাম স্বামীজি কে নিয়ে, মনে ঘৃণা হল এঁরা মুক্তমনা না হীনমনা? নইলে এইভাবে ঘৃণা, অবিশ্বাসের বিষ ছড়াতে পারতেন না। নিজেরা এই দেশ সমাজ কে কি দিতে পেরেছেন তাঁর বিশ্লেষণ না করে স্বামীজির মূল্যায়ন করতে বসেছেন!

স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে এই “হাঁসজারু” দের মত প্রকাশের অধিকার অবশ্যই আছে, আমি এটাকে সন্মান জানাই। কিন্তু মনে খুব প্রশ্ন জাগে যে শ্রী যুক্ত বাবু/ বিবিদের প্রতি প্রতিবাদ যদি করতেই হয় তাহলে সব ক্ষেত্রে করেন না কেন? যখন দেগঙ্গা, কালিয়াচক, তেহত্ত বা ধুলাগরের মতো ঘটনাগুলি ঘটে তখন কি আপনাদের কলমগুলি কনডম পড়ে থাকে? যখন ভারতে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে হিন্দু নিগ্রহের ঘটনা ঘটে কোথায় থাকেন এঁরা আর এঁদের লেখনী? যদি প্রকৃত মানবতাবাদী হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে চান তাহলে সব ধর্মের উগ্রতা, গোঁড়ামি নিয়ে লিখুন নইলে শুদু হিন্দু ধর্মকে সফট টার্গেট করবেন না। কিন্তু জানি আপনারা পারবেন না, আপনাদের মস্তিস্ক, বিচার বিবেচনা সবই বিক্রিত এবং বিকৃত। ভারতের মতো বহু ধর্ম, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি, বহু জাতি-উপজাতি-জনজাতির দেশে না হিন্দু মৌলবাদ কাম্য না ইসলামী মৌলবাদ কাম্য। তাই প্রতিবাদ করতে হলে সব ক্ষেত্রেই করা উচিত যাতে কোনও একটি পক্ষ তোষণের সুবিধা না পেয়ে বসে, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহল ও রাজনীতির ব্যাপারীরা সেটাই করে চলেছেন দিনের পর দিন ধরে। 

এটা কি আমরা বুঝতে পারছি যে এই অনৈতিক তোষণের ফলে কেবল হাত শক্ত হবে হিন্দু, মুসলিম উভয় মৌলবাদীদের। অপরদিকে সবথকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ শান্তিপ্রিয় হিন্দু-মুসলমানরা, যারা কোনভাবেই এই মৌলবাদীদের সমর্থন করেন না। একটু ভেবে দেখুন না আইএস, আল-কায়দা প্রভৃতি জঙ্গি সংগঠনগুলির সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য সকল মুসলমানরা দায়ী নয়, তবু তো সারা বিশ্বই আজ তাদেরই সন্দেহের চোখে দেখছে! তাহলে এই পারস্পরিক সন্দেহের বাতাবরণে যেখানে সমাজের সব স্তরের বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী ও কলাকুশলীদেরই প্রত্যেকটি ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো সেখানে তাঁরা তা না করে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মকেই টার্গেট বানিয়ে নিলেন কিসের আশায়? 

আর রাজনৈতিক ছাতার তলায় মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা বুলি আওড়ে যাতে নিজেদের ব্যক্তিগত আখের গুছিয়ে নেওয়া যায় এই আশায় তো? না কবিতার ঘায়ে ধর্ম মুচ্ছ যায় না, অত ঠুনকো নয় ধর্মের ভিত, কিন্তু হ্যাঁ এতে মৌলবাদীদের হাত শক্ত হয়, আর অবশ্যই নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া যায়। আর এই ছল চাতুরী কেউ ধরে ফেললেই তাঁর উপর তকমা লাগিয়ে দাও সাম্প্রদায়িক, তারপর বাকি কাজ তো সহযোগী মৌলবাদী, রাজনৈতিক নেতা/ নেত্রী, তাঁদের চ্যালা চামুণ্ডারাই করে দেবে। 

বাহরে বুদ্ধিজীবী সমাজ কি সুন্দর তোমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার মাপকাঠি? আসলে মেকি বুদ্ধিজীবী মহল ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের শিকড়, অন্তরাত্মা থেকে আহরণ না করে পাশ্চাত্য দেশগুলি থেকে টুকে মেরে দিয়েছে তাই আজ আমরা উপহারে পেয়েছি আজকের এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা।
আজকের ভারতে এই বুদ্ধিজীবী মহল দুর্যোধনের প্রকৃত উত্তরসূরি কারণ দুর্যোধন অন্ততও মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন "জানামি ধর্মম্ ন চ মে প্রবৃত্তি, জানামি অধর্মম্ ন চ মে নিবৃত্তি"। অর্থাৎ ধর্ম কি, তা আমি জানি। কিন্তু আমার তাতে প্রবৃত্তি নেই। আর অধর্ম কি, তাও আমি জানি কিন্তু তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করার ক্ষমতা আমার নেই। আর এই বুদ্ধিজীবীরা তো সেটুকু স্বীকার করার মতো সৎসাহস দেখাতে পারছেন না।

তাহলে উপায়? মহান বিপ্লবী চে গুয়েভারার একটি উক্তি মনে পড়ে গেলো – “অন্যায় যখন নিয়ম হয়ে উঠে, তখন প্রতিরোধ কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়“। একটা গানের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে – “পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা, জনস্রোতে নানান মতে মনোরথের ঠিকানা, হবে চেনা, হবে জানা”। সমাজের সর্বস্তরে আজ এই মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চাই, নইলে আগামী দিনে ক্ষতিগ্রস্ত আমরাই হবো, আর এই ধূর্ত বুদ্ধিজীবী মহল আর রাজনীতির কারবারিরা আখের গুছিয়ে বিদেশে গিয়ে ভারত দহনের দৃশ্য দেখে বেহালা বাজাবে। 

তাই আকুতি একটাই চিনে নিন এই ভণ্ড ধর্ম নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী দের ও তাঁদের প্রভু রাজনীতির ব্যাপারীদের, ভুলে যাবেন না কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের সেই কবিতার লাইন – অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে। অন্যাযের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শিক্ষা আমাদের ভাগবত গীতাও দিয়ে গেছে (অবশ্য যদি ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী মহল গীতাকে হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থ হিসাবে চিহ্নিত করেন তাহলে আলাদা কথা), তাহলে আমরা আজ বিস্মৃত কেন? 

কিন্তু আমি স্মরনাপন্ন আজ ভাগবত গীতার, কানে যেন বাজছে সেই অমোঘ শাশ্বত বরাভয় ধ্বনি - “यदा यदा हि धर्मस्य ग्लानिर्भवति भारत। अभ्युत्थानमधर्मस्य तदात्मानं सृजाम्यहम्॥ परित्राणाय साधूनां विनाशाय च दुष्कृताम्। धर्मसंस्थापनार्थाय सम्भवामि युगे युगे “॥ জয় হোক এই ভারতের, এই ভারতের সকল অধিবাসীগণের। শান্তি, সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক তাঁদের জীবন। উত্তরসূরিদের জন্যে থাকুক এক শক্তিশালী, সঙ্ঘবদ্ধ ভারত।  


(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে/ স্বার্থে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মনোকষ্টের বহিঃপ্রকাশ মাত্র, তবু যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তা অনিচ্ছাকৃত ও এই ত্রুটি মার্জনীয়) 



Wednesday 8 March 2017

আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রসঙ্গে


আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রসঙ্গে

আজ ৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সকালবেলা পেপার খুলেই দেখি সরকার (পড়ুন রাজনৈতিক দল) কের দেওয়া পাতা জুড়ে কি বড় বিজ্ঞ্যাপন? তাঁর সাথে ঝুড়ি ঝুড়ি হিসাব নারী স্বার্থে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাধু সাধু কি মহৎ প্রচেষ্টা সরকার তথা রাজনৈতিক দলগুলির, অথচও এই দলগুলিই কিভাবে নির্বাচনে নারী নিগ্রহকারী মহান ব্যাক্তিদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার টিকিট প্রদান করে বুঝতে পারি না! ঠিক সেইভাবেই বুঝে উঠতে পারি না ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষ (লোকসভা, রাজ্যসভা)তে মহিলাদের যোগদান এত কম কেন? বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা গুলির দিকে তাকালেও একই প্রমান পাওয়া যায়। তবে কি সবই মুখের কথা, লোক দেখানো আর মনভুলানো কথা মাত্র?

মানুষ হিসেবে একজন নারী তাঁর পরিপূর্ণ অধিকারের দাবিতে সুদীর্ঘকাল যে আন্দোলন চালিয়ে আসছে, সেই লড়াইয়ের সম্মানস্বরূপ পালিত হচ্ছে নাকি নারী দিবস। যাতে অন্তত একটা দিন আমরা সবাই, গোটা বিশ্ব আলাদা করে মনে করতে পারি নারীরাই এই জগতের শক্তির উত্‍স আর প্রেরণা। যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ধারায় নারী কোনও অংশেই পুরুষের পিছনে ছিল না। ফ্রান্সের প্যারি কমিউন, ফরাসি বিপ্লব, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনসহ ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে পুরুষের পাশেই নারীকে দেখা গেছে। কিন্তু, কাঙ্ক্ষিত দাবি/ সন্মান নারী্রা অর্জন করতে পারেনি।

আজও দেখা যায় বেশ কিছু কর্মক্ষেত্রে নারীর মজুরি পুরুষের চেয়ে কম (উদাহরণ স্বরপ দেখতে পারি অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিভিন্ন কলকারখানা, ব্যাবসা ক্ষেত্র বা কৃষি ক্ষেত্র)। আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের ২০০৯ এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে পুরুষের চেয়ে নারী ১৬ ভাগ পারিশ্রমিক কম পায়। অপর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে নারীরা কাজ করছে শতকরা ৬৫ ভাগ, অথচও তার আয় মাত্র শতকরা দশ ভাগ। পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সংখ্যানুপাত প্রায় সমান। অথচ, দুনিয়ার মোট সম্পদের একশ ভাগের মাত্র এক অংশের মালিক মেয়েরা। এবারে নারীদের অবস্থার কথায় আসি – তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলি সহ বহু উন্নত দেশে আজ নারীরা কখনও শ্লীলতাহানি, কখনও যৌন নির্যাতন, কখনও মেয়ে হিসাবে জন্মানোর জন্য চূড়ান্ত নিপীড়ন, আবার কখনও ধর্ষনের বা পারিবারিক হিংসার শিকার। তাহলে এই ঘটা করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের কি প্রয়োজন? দেশের তাবর তাবর নেতা/ নেত্রীরা, মায় বুদ্ধিজীবী সমাজ কত ভালো ভালো কথা বলে থাকেন এই দিনে। বলা হয়ে থাকে এসব দিবস নাকি নারীকে সম্মানিত করেছে! এখান থেকেই নারীকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান করা হয়! তাঁদের জাগতে আহ্বান করা হয়! আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো লাগে।

আচ্ছা আমরা কি নারীকে দুর্বল, অবলা মনে করছি তাই এই ভাঁওতাবাজি? সন্মানের নামে লিঙ্গ বৈষম্যের সুক্ষ ভেদাভেদের পাঁচিল তুলে কি লাভ? আমরা কি ভুলে গেছি ভারতবর্ষে নারীরা সেই প্রাচীন বৈদিক কাল থেকে জীবনের সব দিক থেকে পুরুষের সমান মর্যাদা লাভ করতেন, যার উদাহরণ আমরা বিভিন্ন লেখায় পাই। এছাড়াও ঋকবেদ অনুযায়ী প্রাচীন ভারতে নারীদের উপযুক্ত বয়সে বিয়ে হত এবং গান্ধর্ববিবাহে বা স্বয়ংবরে তারা পতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন। গার্গী, মৈত্রেয়ী, অপলা, লোপামুদ্রা, খনা (প্রকৃত নাম বোধহয় লীলাবতী) ইত্যাদি অনেক  বিদুষী নারীর উল্লেখ পাওয়া যায় আর আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম দিশারী রানি দূর্গাবতী, ঝাসির রানি লক্ষীবাই, সরোজিনি নাইডু, ভিকাজি কামা, ডাঃ অ্যানি বেসান্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বিজয়লক্ষী পণ্ডিত, রাজকুমারী অমৃত কৌর, অরুণা আসফ আলী, সুচেতা কৃপালিনী, নেতাজির ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির ঝাঁসি রেজিমেন্ট যা সম্পূর্ণ নারী বাহিনী দ্বারা পরিচালিত ছিল, ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল, এনাদের কথা আজ আমরা ভুলে গেছি। আর শুদু আমাদের দেশে নয় এরকম অগ্নিকন্যা ভারতের বাইরে অন্যান্য দেশেও ছিল ও থাকবে। এরকমই একজন ফরাসি নাট্যকার ও বিপ্লবী ওলিম্পে দ্যা গগ্স। ১৭৯১ সালে বিপ্লবী ওলিম্পে দ্যা গগ্স (Olympe de Gouges) 'নারী অধিকার এবং মহিলা নাগরিকদের ঘোষণা' প্রকাশ করেন। এতে তিনি বলেন, 'নারী জেগে উঠো - গোটা বিশ্বে যুক্তির সঙ্কেত ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। তোমার অধিকারকে আবিষ্কার করো। প্রকৃতির শক্তিশালী সাম্রাজ্য এবং পক্ষপাত, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও মিথ্যা দিয়ে অবরুদ্ধ নয়। সত্যের শিখা পাপ ও অন্যায় দখলের মেঘকে দূর করে দিয়েছে।' ১৭৯৩ সালে এনাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। মৃত্যু পূর্বে অসীম সাহসিকতা নিয়ে তিনি বলেন, 'নারীর যদি ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে, তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন?'

তাহলে প্রশ্ন এটাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যদি নারী ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে পারে, নারী যদি নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষ শাসিত সমাজের সাথে লড়াই করতে পারে, তাহলে সে নারীর জন্য আলাদা করে নারী দিবসের সত্যিই কি কোন দরকার আছে? 

ইদানীংকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি এক একটা বিশেষ দিনে মেসেজের/ পোস্টের ছড়াছড়ি, কত ভালো ভালো পোস্ট, দেখলে/ পড়লে মনে হয় সত্যিই দেশ উন্নতির পথে চলছে। কত বড় বড় নারীবাদী সমাজকর্মীরা, সমাজের মান্য গন্য ব্যাক্তিরা কত ভালো ভালো লেকচার দিচ্ছেন। অথচও আজকের যুগে, বলা যেতে পারে বিজ্ঞ্যাপনের যুগে নারীরা যে পন্যে পরিনত হচ্ছে, সেবিষয়ে তাঁরা চুপ কেন? জীবন দিয়ে সতীত্ব রক্ষা করার মত উদাহরণ আমাদের দেশে কম নেই, অথচ সেই সতীত্ব যখন টাকায় বিক্রি হয় এবং প্রগতিশীল সমাজ হাততালি দিতে থাকে এই বলে যে, নারী সাহসী হচ্ছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে! বাহরে সমাজ বাহ!

আজকাল তো টিভি খুললেই চোখে পড়ে হরেক কিসিমের বিজ্ঞ্যাপন, একবার একটি ডিও-র অ্যাড এ দেখেছিলাম, একটি বাড়ীতে পুজা হচ্ছে, ঢাক বাজছে, সবাই নিজের কাজে ব্যাস্ত, এমন সময় একটি ছেলে ডিও দিয়ে বারান্দা দিয়ে আসার সময় একজন তরুণী বধূর সাথে ধাক্কা খায়, আর বধূটির ফ্যান্টাসিতে ভেসে ওঠে শরীরী খেলার এক টুকরো দৃশ্য। আচ্ছা এখানে পন্য কে? ডিও না ওই সুন্দরী বধূটি? এছাড়া কনডমের, নামিদামি কোম্পানির পারফিউমের বা পাউডারের বিজ্ঞ্যাপনে পন্য ঠিক কি তা বুঝে ওঠা যায় না। ঠিক যেমনই আইপিএল ক্রিকেট খেলায় চিয়ার লিডার নামি মেয়েদের নাচন কোদনের বাধ্যবাধকতা বোঝা যায় না। আমরা টিভি খুললেই দেখতে পাই কালো মেয়েদের ফর্সা করবার হরেক কিসিমের ক্রিম এর মনোহারী সব বিজ্ঞ্যাপন, এগুলি কি নারী সন্মান কে বাড়িয়ে দিচ্ছে? কখনও দেখানো হচ্ছে কোনও মেয়ে তাঁর কালো রঙের জন্যেই পিছিয়ে পরেছিল, কিন্তু বিশেষ কোম্পানির ক্রিম ব্যাবহারের ফলে ফর্সা হয়ে সবাই কে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, সত্যিই নারীর সন্মানের কি অপরুপ পরাকাষ্ঠা? আর এই বিজ্ঞ্যাপনগুলিতে কোনও না কোনও মেয়ে অভিনয় করছে! ঠিক এইভাবে সিনেমায় ‘সাহসী দৃশ্য’ নামে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে তাকে কেউ কেউ নারীর এগিয়ে যাওয়ার নিদর্শন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন, এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে  নারী পিছিয়ে ছিল কারণ নারী তখন অনেক পোশাক পরতো, এখন নারী পোশাক খুলছে তাই তারা এগিয়ে যাচ্ছে! আর এটাই প্রগতিশীলতা, আচ্ছা শুধু ভেঙে ফেলার নামই কি প্রগতিশীলতা? না ভাঙার পড়ে নতুন উন্নত কিছু সৃষ্টি করার নাম প্রগতিশীলতা ঠিক কোনটা? 

তথাকথিত নারীবাদীরা কি বুঝতে পারছেন, নারীর সম্মান সবচেয়ে বেশি কেড়ে নিচ্ছে তার পণ্য হওয়া? কনডমের, নামিদামি কোম্পানির পারফিউমের বা পাউডারের বিজ্ঞ্যাপনে যে মেয়েটা শরীর দেখাচ্ছে সে যে নিজেকেও ‘বিপণন যোগ্য পণ্য’ করে তুলছে, সেটা কি এই নারীবাদীরা ভাবছে? আমার শরীর আমার নিশ্চয়ই, কিন্তু ‘আমার শরীর’ ‘ইচ্ছে হলে ঢাকবো, নয় খুলবো’ এটা কি ঠিক? 

অনেকে বলবেন যাই হয় এই পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের জন্যে হয়, সব দোষ পুরুষদের, তাঁরাই বাধ্য করে নারীকে পন্য হতে। কিন্তু সত্যি কি এটাই? পতিতা পল্লিতে যারা নিজের শরীরের ব্যবসা করে তারা পুরুষদের বলে কাস্টমার, আর তারা নিজেরা হয় ‘পন্য’, কিন্তু পতিতারা না হয় পেটের দায়ে দেহ বিক্রি করে। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন পেশার শিক্ষিত নারীরা যখন সব জেনে বুঝে পণ্য হয় তারা কি পেটের দায়ে পণ্য হয়? নাকি শরীরের চাহিদার জন্য পণ্য হয়? নাকি একটা বাড়ি বা ফ্লাট, ব্যাংক ব্যাল্যান্স, বিলাসবহুল জীবনের জন্য পণ্য সাজে?

আমি নারীবিদ্বেষী নই, নারীদের দোষ দেখতে পুরুষদের দোষ খাটো করে দেখাতে লিখতে বসি নি। আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের দায়িত্ব আরও অনেক বেশি। নইলে সোশ্যাল মিডিয়ায় বড়বড় লেকচার ঝেড়ে আর সুযোগ বুঝে ভিড় বাসে, ট্রেনে নারী শরীর ছুঁয়ে যাবার অদম্য ইচ্ছেতাকে চাপতে না পেরে সুযোগের সদব্যাবহার করে আর যাই হোক নিজের দায়িত্ব পালন করা যায় না। যদি আমরা দৈহিক ভিন্নতাকে অস্বীকার না করে দেহকে প্রাধান্য না দিয়ে একটু ভাবি তাহলে নারীরাও একজন পরিপূর্ণ মানুষ, তাঁরও নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, চেতনা, সৃষ্টিশীলতা, ব্যাক্তিত্ব, বিবেক-বুদ্ধি-সম্মান রয়েছে, স্বাধীনতা রয়েছে, তাতে অযথা হস্তক্ষেপ না করে তাঁকে জীবনের পথে চলার অঙ্গ/সাথী বলে যদি ভাবতে পারি হয়তো শ্লীলতাহানি, যৌন নির্যাতন, মেয়ে হিসাবে জন্মানোর জন্য নিপীড়ন, ধর্ষনের বা পারিবারিক হিংসার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারি। 

রবি ঠাকুরের একটি কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করলাম – 

“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী 
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি 
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ 
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন। 
সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা 
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা। 
কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না, 
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা, 
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার, 
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার। 
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ, 
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন। 
পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা 
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।“

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে/ স্বার্থে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ, শিক্ষা-দীক্ষা, বুদ্ধিও অনেক কম, নিরেট মাথায় যতটুকু বুঝেছি লিখেছি মাত্র তাই দোষ ত্রুটি ও অধমের ধৃষ্টটা মার্জনীয়)