Tuesday 31 January 2017

ছোটবেলার সরস্বতী পূজা, একটু ফিরে দেখা।


ছোটবেলার সরস্বতী পূজা, একটু ফিরে দেখা।

মানুষ মনে হয় সব পারে শুধু পারে না ভুলতে। আচ্ছা ধরুন বৃষ্টির ফোঁটা কে যদি ভুলে থাকতে গিয়ে জানালা বন্ধ করি কিংবা ছাতা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করি তাতে কি ভোলা সম্ভব? টুপ করে হঠাৎ ঝরে পরা বৃষ্টির একটি ফোঁটার স্পর্শই যথেষ্ট। আসলে পেন্সিলের দাগ মোছার জন্যে ইরেজার আছে, পেনের দাগ মোছার জন্যে করেকশন ফ্লুইড আছে, চকের দাগ মোছার জন্যে ডাস্টার। হয়তো চোখের জল মোছার জন্যে সমব্যথী কারো হাত, কারো কাঁধ আছে কিন্তু স্মৃতি মোছার জন্য? না মনে হয় কিচ্ছু নেই।

ছোটবেলা কে কবে দূরে ফেলে চলে এসেছি, কতকিছুই তো ভুলে গেছি, কিন্তু সরস্বতী পূজার কথা মনে হয় ভুলতে পারবো না। আমরা সেবার ক্লাস ইলেভেন, আমাদের ‘এ’ সেকশনই দায়িত্ব পেল পূজার সব আয়োজন করার। ব্যাস কি ব্যাস্ততা আমাদের মধ্যে, সবাই মিলে দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে লেগে পরলাম কাজে। কেউ কাগজ কেটে শিকলি বানাচ্ছে, তো কেউ কুমোরপাড়ায় গিয়ে মূর্তির কতদূর দেখে আসছে। আবার কেউ স্কুল ঘরের একটা দিক পরিস্কার পরিছন্ন করে সাজিয়ে তুলছে অদ্ভুত নিপুণতায়, আঁকা হচ্ছে নক্সা করা আলপনা। এই কাজে আমাদের শিল্পী বন্ধু সুখেন ছিল অগ্রগন্য। আবার কেউ কেউ স্কিম করছে কিভাবে মেয়েদের স্কুলে নিমন্ত্রণ করার দলে ভিড়ে যাওয়া যায়। যাই হোক গুতিকয়েক স্মার্ট ছেলে মেয়েদের স্কুলে নিমন্ত্রণ করার গুরু দায়িত্বটি সেরে ফেললো বাদবাকি ছেলেদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে, পড়ে অবশ্য এই নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিলো আবার মিটেও গেছিলো। আসলে আমাদের সময়টাই ছিল ওইরকম, আমরা অভিমান করতাম বেশি, রাগ করতাম কম, তাও আবার বেশি দিন পুষে রাখতে পারতাম না। যাক সে কথা পুজোর কোথায় ফিরে আসি, পুজোর আগের দিন বিকাল বেলায় ভ্যানে করে ঠাকুর এনে সাজানো হয়ে গেলো। আমাদের মধ্যে ইঁচড়ে পাকা কয়েকজন ছিল তাঁরা বলাবলি করছিলো – যাই বলিস এবারে কিন্তু সরস্বতী ঠাকুর টা দেখে মনে হচ্ছে না ঠাকুর ঠাকুর, ঠিক যেন পাশের বাড়ীর মেয়েটি। কেউ কেউ গভীর প্রেমে চকাস চকাস করে দু চারটে চুমুও খেয়ে ফেললো। কি আর করা যাবে, সত্যিই সরস্বতী মূর্তির দিকে তাকালেই মনে হয়, এই তো সেই কিশোর বয়সের প্রেমিকা, ফুরফুরে ঠোট, চোখে দুষ্টু হাসি। এখনই বুঝি দুষ্টু চোখের ইশারা দিয়ে বেণী ঝুলিয়ে হেটে চলে গেলো বুঝি। এখানেই এই কৈশোরের দেবীর জয় জয়কার, কোন বাঙালি কিশোর/ তরুন কি ভুলতে পারে সেই অমোঘ শব্দ বন্ধ - ‘কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে’। না এখানে পীনোন্নত বক্ষজুগলের কথা কেউ বলেনি, শুদু রয়েছে কিশোরী কন্যার উদ্ভিন্ন যৌবনের আভাসটুকু। সরস্বতী পুজোয় কিশোর প্রেমের অভিজ্ঞতা যার নেই, তার জীবন যে ব্যর্থ সেটা এখন বুঝতে পারি। যা বললাম তা আত্মউপলব্ধি বলতে পারেন বা স্বীকারোক্তি হিসাবেও ভাবতে পারেন, এটা পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম। তবে এটা হলপ করে বলতে পারি - সিগারেট ধরানো, প্রথম প্রেম বা বাঙালি কিশোর কিশোরীর অবদমিত ‘লিবিডো’ মুক্তির স্বাদ পেয়েছে এই বিশেষ দিনটাতেই। তাহলে সরস্বতী পুজো কি শুধু মাত্র বই আর পেন, ভক্তি-গদগদ নৈবেদ্য? তা হলে হয়তো আমার মতন অনেকেরই আক্ষেপ থেকে যেতে বাধ্য। 

শেষে এলো বহু কাঙ্ক্ষিত পুজোর দিন। পুজোর দিন সকাল সকাল উঠে স্নান ছেড়ে নিয়ে দৌড় দিলাম স্কুলের দিকে, না না স্কুলে থাকব বলে নয়, স্কুলে একটু সময় কাটিয়ে, প্রসাদ খেয়ে সোজা স্ট্যান্ডের ধারে আড্ডা দেবার জন্যে। স্কুলে গিয়ে দেখি আমাদের সংস্কৃত স্যার পূজায় বসেছে, সেবারে পূজারি ঠাকুর না পাওয়ায় উনি প্রক্সি দিয়ে দিয়েছিলেন। তবে চমৎকার মন্ত্রপাঠ করতেন, মনের গভীরে ছুঁয়ে যেত। অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে হাসবো না হাসবো না করেও সেই ফিক করে হেঁসে ফেলাম, কারণ সেই - “ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে। বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে“। তবে দেখলাম এবারে স্যার ভুরু কুঁচকে না দেখে উনিও হেঁসে ছেড়ে দিলেন। না প্রসাদ তো খাওয়া হয়ে গেলো, কিন্তু বন্ধুদের দেখা নেই, সব শালা গেলো কোথায়? তখন তো এত মোবাইলের চল ছিল না, তাই এদিক সেদিক কিছুটা সময় কাটিয়ে একা একাই চলে গেলাম স্ট্যান্ডের ধারে। তখন কি ছাই জানতাম আমার জন্যে কি চমক অপেক্ষা করে আছে?

স্ট্যান্ডের ধারে গিয়েও কাউকে খুঁজে না পেয়ে নীচে সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। তখন অবশ্য বেশ সিগারেট খেতে শিখেছি, এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে বসে বসে ভাবতে লাগলাম শালা সব বন্ধু গুলো গেলো কোথায়? নিশ্চয়ই কোনও মেয়ের পিছনে ফিল্ডিং দিচ্ছে, শালা ঠিক জুটিয়ে নিয়ে মৌজ করবে আর আমি এবারেও আঙুল চুষবো। হে মা সরস্বতী আমি তো তোমায় চুমুতুমু খাইনি, তবে কেন আমার উপর এই অবিচার? এবারে স্বপ্নে দেখা সেই রাজকন্যার মতো একপিস জুটিয়ে দাওনা মা, কথা দিচ্ছি মন দিয়ে পড়াশুনা করব, আর এদিকে সেদিকে কোনও নজর দেবো না। কে জানে সেবারে মা মনেহয় ভালো মুডে ছিল, শুনে ফেলেছিল আমার কাতর প্রার্থনা। হঠাৎ সম্বিত ফিরল মেয়েলী কণ্ঠে হাহা হিহি শুনে, পিছনে ফিরে দেখি পাঁচ-ছয়জন মেয়ে নিজেদের মধ্যে খুব হাঁসি ঠাট্টা করছে আর মাঝে মাঝেই একজন কে ধাক্কা দিচ্ছে আমাকে দেখিয়ে। ও হরি ভালো করে তাকিয়ে দেখি সুপর্ণা (আমাদের একজন বন্ধুর বোন, মাঝে মাঝে ওদের বাড়ী যাওয়ার সুবাদে মুখ চেনা আছে) শ্যামলা গায়ের রঙ, খুব একটা আহামরি দেখতে নয় তবে রুপে একটা স্নিগ্ধ মাধুর্য আছে। এমনিতে খুব চুপচাপ, কম কথা বলে আজ দেখছি বন্ধু সঙ্গে বেশ বকবক করছে। আমি দেখছি দেখে ওরা বেশ চুপ করে গেলো, তারপর দেখি ওদের মধ্যে একটা সর্দারনী টাইপের মেয়ে খুব করে সুপর্ণাকে কি সব বোঝাচ্ছে, আর সুপর্ণা মাথা নেড়ে না না বলে যাচ্ছে। তারপর জোর করে ওই মেয়েটা সুপর্ণার হাত ধরে টানতে টানতে আমার সামনে এসে হাজির, আমি তো বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম, মুখচোরা বলে এমনি ভালোভাবে কথা বলতে পারতাম না, আর এত দেখছি পুরো মহিলা ব্রিগেড। ওই মেয়েটা এবারে বলে উঠলো – নে বাবা আমি সামনে এনে দাড় করিয়ে দিয়েছি, এবারে যা বলবার তুই বলে নে। আর শুনুন আমার এই বন্ধুটি আপনাকে কিছু বলতে চায়, একটু শুনবেন প্লীজ? আমি তো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তাও কোনও মতে বললাম – তুমি সুপর্ণা না? দিবাকরের বোন তো? এখানে কি ব্যাপার? সুপর্ণা চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, পরনে নীল শাড়িতে বেশ মানিয়েছিল ওকে। ও আস্তে আস্তে বলল – একটা কথা বলব বাবাই দা? রাগ করবে না তো? আমি বললাম – না বল না কি বলতে চাও? সুপর্ণা মুখ তুলে বলল – তুমি কাউকে ভালোবাস বাবাইদা? আমি অবাক হয়ে গেলাম, হঠাৎ এরকম কথা কেন জিজ্ঞেস করছে ও। বললাম – হঠাৎ এই প্রশ্ন? সুপর্ণা বলল – বোলো না প্লীজ আমার জানা দরকার। 

আমি বললাম – না এখনও কাউকে ভালোবেসে উঠতে পারি নি, কিন্তু তুমি....। সুপর্ণা হাঁসি মুখে বলল – একটা কথা বলছি প্লীজ তুমি কিছু মনে করো না, যদি খারাপ লাগে ভুলে যেও, কিন্তু দাদাকে বোলো না। আমার তোমাকে খুব ভালো লাগে, হয়তো ভালোবাসিও। তুমি আমায় একসেপ্ট করবে? আমি একদম অবাক হয়ে গেছিলাম, মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না যে মেয়েটা বাড়িতে গেলে বেশি কথা বলতো না, খালি দাদাকে ডেকে দিয়েই পালিয়ে যেত সে আমার সামনে আজ এই কথা বলছে? আমি শুদু বললাম – দেখো আমি তোমায় কোনদিনও এইভাবে দেখিনি, আর হঠাৎ করে কি এইভাবে কাউকে ভালোবাসা যায়? সুপর্ণার হাঁসিমুখটা কেমন কালো হয়ে গেলো, ও মুখ নামিয়ে বলল – আই অ্যাম সরি বাবাইদা। আমি তোমাকে আর ডিস্টার্ব করব না। আচ্ছা এরপরে তুমি আমাদের বাড়ী আসবে তো? আর দাদা কে কিছু বোলো না প্লীজ।  আমি বললাম – বলবনা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। সুপর্ণারা এর পর ওইখান থেকে চলে গেলো, যাওয়ার সময়ে সুপর্ণা বারবার ফিরে দেখছিল। আর আমার কেমন যেন একটা লাগছিলো, একবার মনে হচ্ছিলো ওকে ডেকে বলি – তুমি আমায় একটু টাইম দাও, তোমায় বুঝতে চাই আবার মনে হচ্ছিলো ধুসস আমি তো কোনদিন ওর কথা মাথাতেই আনিনি তাহলে আজ কেন উল্টোপাল্টা ভাবছি? সেদিন আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা, মজা করা হয়নি আমার, আমি বাড়ী ফিরে এসেছিলাম। এর পরে কয়েকবার সুপর্ণাদের বাড়ী গেছি, দেখেছি ও মুখ ভার করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারি নি, পরে শুনেছিলাম ওর নাকি অনেক ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে গেছিলো। আমিও পরে প্রেমে আঘাত পেয়ে উপলব্ধি করেছিলাম না চাইতে যারে পাওয়া যায় হয়ত তাঁর প্রেমই খাঁটি। কিন্তু ততদিনে আমার সেই ছোট্টবেলার প্রেম আমার কালো মেম আমার থেকে অনেক দূরে কারো ঘরণী হয়ে সুখে হয়তো ঘর সংসার করছে। আমি আর তাঁর সংসারে দেবদাস হয়ে ঝামেলা বাড়াতে চাইনি, মনে মনে ভেবেছি ‘প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে, আমারই এ দুয়ার প্রান্তে। সে তো হায় মৃদু পায় এসেছিল পারি নি তো জানতে।‘ 

এর পরে সরস্বতী পূজা হয়েছিল প্রতি বছর নিয়ম মেনে, তবে আমার স্মৃতিতে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই। হয়ত ফোঁটার অপেক্ষায় থাকা সেই প্রেমটি সারাজীবন সেভাবে আফোঁটাই থেকে গেলো। কেউ কখনো জানবেও না, শূন্য এই বুকে আজও অপেক্ষায় থাকব, মাঝে থেকে যাবে কিছু স্মৃতি যা কোনদিনও ভোলার নয়। 

কিন্তু যে সময় আমি কাটিয়ে এসেছি বন্ধুদের সাথে, সে সমস্ত দিনের গল্প করার সময় আমার চোখে মুখে নিশ্চয়ই আলো ফুটে উঠে। আমি আজও বিশ্বাস করি আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, কিন্তু কোন শঠতা ছিলনা, চরিত্রে নির্মলতা ছিলো, কোন কলুষতা ছিলোনা, আচরণে স্থিরতা ছিলো, কোন রকম অধৈর্য্যতা বা অস্থিরতা ছিলনা, অভিমান ছিল কিনতু আক্রোশ, প্রতিহিংসা ছিলনা। তখন মোবাইল ফোন ছিলনা আর কম্পিউটারও ছিলনা, এটুকুই যা তফাৎ আজকের সাথে। তাহলে কি প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে মানুষের আচরণ পাল্টে যাচ্ছে, মনে হয় যাচ্ছে, তাই কালির দোয়াতে খাগের কলম ডুবিয়ে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ, তাই তিনি হয়েছিলেন বিশ্বকবি, প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের খাগের কলমের বদলে ‘ফাউন্টেন পেন’, তারপরে এলো ‘বলপেন’, জেল পেন এরও পরে এলো কম্পিউটার, ল্যাপটপ আর ট্যাব, ফ্যাবলেট কত কিছু। এখন তো আর আমাদের পেন না হলেও চলে, আমরা ল্যাপ্টপ, আইপ্যাড, কত সব আধুনিক সব গ্যাজেট ব্যাবহার করি। 

যুগের উন্নতির সাথে সাথে হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে কত কিছু, বাঙালির নিজস্ব ভ্যালেন্টাইন দিন সরস্বতী পুজাও হয়তো একদিন এই ভাবেই হারিয়ে যাবে। সভ্যতার, আধুনিকতার বলি হবে এই মিষ্টি দিনটি, সব ভাললাগা, সম্পর্কও। 

তবে একটা কথার উল্লেখ না করলে নয়, এই সরস্বতী পূজার সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে গ্রাম বাংলার আর একটি সাবেক প্রথা। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, আমি অরন্ধন বা শীতলষষ্ঠীর কথাই বলছি। সরস্বতীপুজোর পরদিন গোটাষষ্ঠী বা শীতল ষষ্ঠী পালন করা হয়। শ্রীপঞ্চমী তিথি থাকতে থাকতেই গোটা সেদ্ধ রেঁধে রাখতে হয়। গোটা মুগডাল (সবুজ মুগকলাই), গোটা শিম, গোটা মটরশুঁটি, গোটা রাঙা আলু, গোটা আলু, গোটা বেগুণ জোড়া সংখ্যায় দিয়ে (আমাদের বাড়িতে ১২টা করে দেওয়া হয়) গোটা সেদ্ধ হয়। সেদ্ধ হয়ে গেলে কাঁচা সরষের তেল আর লঙ্কা, নুন দিয়ে মেখে খাওয়া হয়। সাথে পান্তাভাত আর সজনেফুল দিয়ে কুলের তক, আর পাঁচ রকম ভাজা, যেমন সিম, রাঙ্গালু, বেগুন, আলুভাজা, পালং শাঁক ভাজা। সরস্বতীপুজোর পরদিন আমাদের দুপুরের খাবারে আর অন্য কিছু খাওয়া চলে না, সবকিছু বাসি রান্না খাওয়ার রীতি আজও মেনে চলা হয়।  

কোথাও কোথাও শিলনোড়া হলুদ ছোপানো কাপড় পরিয়ে ঠান্ডা হলুদ জলে রাখা থাকে। শিলের কোলে থাকে তার নোড়াটি আর মাথায় জোড়া শিম ও জোড়া কড়াইশুঁটি। বহুবছর ধরে বাংলার এই রীতি মেনে আসছেন মায়েরা তাদের সন্তানের মঙ্গলার্থে, যা এর পরে আর দেখা যাবে কিনা কে জানে? আজকালকার আধুনিকা মায়েরা তো তাঁদের সন্তানের মঙ্গলার্থে কেএফসি, ডমিনজ, পিজ্জাহাটের রাস্তা চিনবেন কিন্তু হ্যাপা পুড়িয়ে গোটাষষ্ঠী বা শীতল ষষ্ঠী পালন করবেন না নিশ্চয়ই। 

Thursday 26 January 2017

বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ৪


বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ৪

বেশ কয়েক বছর আগে একবার একটি লেখায় পড়েছিলাম যে ১২৮৭ সালে সাহিত্য সম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজ সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ শিরোনামে, তাতে তিনি অনেক আক্ষেপ করে লিখেছিলেন – ‘বাংলার ইতিহাস নাই। নহিলে বাঙালী কখন মানুষ হইবে না। আইস আমরা সকলে মিলিয়া বাংলার ইতিহাস অনুসন্ধান করি। যাহার যত দূর সাধ্য সে তত দূর করুক। ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্মাণ করে। একের কাজ নয়, সকলে মিলিয়া করিতে হইবে’। হয়তো স্থানীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা সেই সময় থেকেই, তবে আমার জ্ঞ্যান, শিক্ষা সর্বোপরি সুযোগ কম হওয়ায় কাজের কাজ কিছুই করে উঠতে পারি নি। তবে আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি আঞ্চলিক ইতিহাস সামাজিক তথা দেশ-ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, একে বাদ দিয়ে সমাজের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। আমার ক্ষুদ্রাটিক্ষুদ্র প্রয়াস “বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির” শীর্ষক লেখায় তারই যথসামান্য চেষ্টা করেছি মাত্র।  

এবারের গন্তব্য শ্যামনগরের ব্রহ্মময়ী কালী মন্দির, এটি মূলাজোড়ের কালীবাড়ী নামেও বিখ্যাত। আবারও সাথী হল সহধর্মিণী আর কন্যা, যদিও তাঁদের ঘোরা জায়গা তবু পিছু ছাড়ল না, অগত্যা একাকী যাওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করতে হল। যাওয়ার পথে রুমি মানে আমার সহধর্মিণীটিকে জিজ্ঞেস করলাম – যাচ্ছ ঠিক আছে কিন্তু শ্যামনগর নামের উৎপত্তি আর ব্রহ্মময়ী কালীমন্দিরের ইতিহাস তোমাকেই কিন্তু শোনাতে হবে। প্রতিবার আমি গল্প শোনাবো না এবারে আমি শুনবো। কন্যা আর গিন্নী সমস্বরে প্রতিবাদ করে বলল – না তুমিই বলবে আর আমরা শুনবো, আমরা বেড়াতে আর গল্প শুনতে যাচ্ছি, তাই দায়িত্ব তোমারই। দু দুটো হোম মিনিস্টারের আদেশ অতএব ব্যাজার মুখে বললাম – আগে চল মন্দির চত্বরে কোথাও বসি তারপর তোমাদের গল্প শোনাবো। ভুটভুটি করে গঙ্গা পার হয়ে পৌঁছানো গেলো ব্রহ্মময়ী কালী মন্দির, একটু খুঁজে পেতে একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে দুদণ্ড জিরাবো বলে ঠিক করেছি, অমনি খচরমচর শুরু হল – কি হল বেশ তো বসার জায়গা পাওয়া গেলো এবারে গল্প বল দেখি। না ভালো জ্বালা দেখছি, কোথায় ভালো করে ঘুরব ছবি তুলবো তা না এখন বক বক করো। বললাম আচ্ছা বলছি শোন – শ্যামনগরের সাথে বর্ধমানের রাজপরিবারের যোগ ছিল কোন এক সময়। শ্যামনগরে এক সময় নদীয়ারাজ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারী ছিল, ঐশী মানে আমার কন্যা হাততালি দিয়ে বলে উঠলো আমি জানি সেই গোপাল ভাঁড় আর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের গল্প আমি শুনেছি। হেঁসে বললাম – হ্যাঁ এই সেই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, কিন্তু তাঁর গল্প এটা নয়, সব বলছি মন দিয়ে শোন। বর্গী হামলার সময়ে বর্ধমানের রাজমাতা কৃষ্ণকুমারী দেবী কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে রামদেব নাগ নামে এক কর্মচারীর নামে শ্যামনগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইজারা নিয়ে বর্তমান কাউগাছির কাছে একটি গড় তৈরি করেন। 

সেখানে মন্দির তৈরি করে নিজেদের কুলদেবতা শ্যামকিশোরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজমাতা কৃষ্ণকুমারী ও রাজকুমার তিলকচাঁদ মহাতাব এই গড়ে থাকতে শুরু করেন। শোনা যায় শামুক আকৃতির গড় ছিল বলেই এই গড়ের নাম শামুকগড় হয়েছিল, পরবর্তীকালে সেই শামুকগড় থেকে ‘সামনে গড়’, পরবর্তীকালে সেখান থেকেই শামনগর বা শ্যামনগরের উৎপত্তি। তবে এও মনে করা হয় যে বর্ধমান রাজপরিবার যেহেতু তাদের পারিবারিক বিগ্রহ শ্যামকিশোরকে নিয়ে এসেছিলেন, আর ফিরে যাওয়ার সময় শ্যামকিশোরকে নিয়ে যান নি পরবর্তী সময়ে এই শ্যামকিশোরের নাম থেকেও এই অঞ্চলের নাম শ্যামনগর হয়ে থাকতে পারে।

তবে পুরাতন কাব্যে এই শ্যামনগরের উল্লেখ আছে, জানো পঞ্চদশ শতকে কবি বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসার ভাসান’কাব্যে গঙ্গার দু’পারের বর্ণনায় কবি লিখেছিলেন, ‘‘মূলাজোড়া গাড়ুলিয়া বাহিল সত্বর/ পশ্চিমে পাইকপাড়া বাহে ভদ্রেশ্বর/ চাঁপদানি ডাইনে বামেতে ইছাপুর/ বাহ বাহ বলি রাজা ডাকিছে প্রচুর। এই ‘মূলাজোড়া’ই পরবর্তী সময়ে মূলাজোড়, যা বর্তমান শ্যামনগরের অন্যতম আদি জনপদ ছিল।  

রুমি বলল – হুম শ্যামনগরের কথা তো শুনলাম এবারে ব্রহ্মময়ী কালীমন্দিরের গল্প শোনাও তো? বললাম – হ্যাঁ বলছি শোন, এই ব্রহ্মময়ী কালীমন্দিরের সাথে জড়িয়ে আছে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাই গোপীমোহন ঠাকুরের নাম। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার বাসিন্দা গোপীমোহন ১৮০৯ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন (মন্দির গাত্রে উল্লেখ আছে ৩১শে বৈশাখ ১২১৯ সনে)। কথিত আছে, তাঁর আট বছরের মেয়ে ব্রহ্মময়ীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তখনকার দিনে অনেক কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো, আর বিশেষ করে আট বছরের মেয়ের বিয়ে দেওয়াকে পুণ্যকাজ বলে গন্য করা হতো, বলা হতো গৌরীদান। যাই হোক বিয়ের দিন পাল্কি করে আহিরীটোলা গঙ্গার ঘাটে গোপীমোহন ঠাকুরের মেয়ে ব্রহ্মময়ীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্নান করে জল ভরে আনার জন্য জলে নেমে হঠাৎ করে তলিয়ে যায় ব্রহ্মময়ী। এই সংবাদে গোপীমোহন কন্যার শোকে পাথর হয়ে যান আর বারবার বিলাপ করতে থাকেন। শোনা যায় এরপরেই স্বপ্নাদিষ্ট হন গোপীমোহন, কন্যা ব্রহ্মময়ীকেই মাকালীর রুপে স্বপ্নে দেখেন তিনি। এবং মূলাজোড় ঘাটে তার দেহ ভেসে উঠেছে স্বপ্নে জানতে পারেন আর কালীরূপী ব্রহ্মময়ী তাঁকে বলেন - আমি তোমার মেয়ে, আমার দেহ যেখানে ভেসে উঠেছে সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা কর। গোপীমোহন মূলাজোড়ে গিয়ে মেয়ের দেহ পান এবং কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে কষ্টিপাথরের একটি কালীমূর্তিও পান। অবশ্য গোপীমোহন ঠাকুর মন্দিরের কাজ শেষ করার আগেই মারা গিয়েছিলেন, মন্দিরটি সম্পূর্ণ করেন তাঁর ছোট ছেলে প্রসন্নকুমার ঠাকুর। ব্যাস আমি যতটুকু জানতাম তা তোমাদের বললাম, চল এবার মন্দির ও মাকে দর্শন করে আসি। রুমি বলল – এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সাথে এত করুণ কাহিনি জড়িয়ে আছে তা আগে জানতাম না, জেনে মন ভারী হয়ে গেলো। আমি বললাম – আমিও জানতাম না পরে জেনেছি, আর দেখ কেউই কিছু আগে জেনে আসে না সবাই ক্রমে ক্রমে জানতে পারে। নাও এবারে চলো, ঐশীও বলল - হ্যাঁ মা চলো মেলাতেও তো ঘুরতে হবে।  

পুজার ডালা কিনে মন্দির চত্বরে এসে ছবি তুলতে গিয়ে বাধা পেলাম একজন সেবায়েত ঠাকুর মশাইয়ের থেকে, তিনি গুরু গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করলেন – মায়ের মন্দির ও রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে থেকে কোন ছবি তোলা যাবে না, আর মায়ের বা রাধাকৃষ্ণের ছবি তো একদমই তোলা যাবে না। দেখুন সামনে নির্দেশাবলী দেওয়া আছে। আপনি ছবি তুলতে চাইলে সাইড থেকে তুলতে পারেন। 

তাকিয়ে দেখলাম বড় বড় করে লেখা আছে নির্দেশাবলী, অগত্যা মায়ের পূজা দিয়ে, দর্শন করে মন ভরে গেলো। পিতলের সিংহাসনে কষ্টিপাথরের মনোরম মূর্তি বিরাজমান, গর্ভগৃহে প্রবেশ নিষেধ। মাতৃমূর্তি এখানে পশ্চিমমুখী, জনশ্রুতি অনুসারে বলা হয় মহাসাধক শ্রী রামপ্রসাদ সেন যখন নৌকাপথে গঙ্গা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর গান শোনার জন্য দেবী পশ্চিম দিকে মুখ ফেরান। তবে ইতিহাস অনুসারে মহাসাধক রামপ্রসাদ সেন মারা যান ১৭৭৫ খ্রীঃ আর মন্দির তৈরি হয় ১৮০৯ এ তাই এই ঘটনা সত্য নয়। আরও জনশ্রুতি আছে যে সাধক বামাক্ষ্যাপা এক সময়ে এই কালীমূর্তি পুজো করতেন। ঐতিহ্যের সাথে কত জনশ্রুতি মিশে থাকে তার তুলনা মেলা ভার। 
   
বিধি বাম তাই নির্দেশ অনুসারে সাইড থেকে ছবি তুলেই খুশী থাকতে হল। ব্রহ্মময়ীর মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির, এরকম মন্দির পশ্চিমবঙ্গে বেশী দেখা যায় নি। মন্দিরের সামনে একটি নবনির্মিত পূজা দালান আছে, ভক্ত বৃন্দ একসাথে বসতেও পারে সেখানে। মন্দিরের দুই পার্শ্বে ছয়টি করে সারিবদ্ধ শিবদেউল। শিব দেউলে সাদা ও কালো দুই ধরনের শিবলিঙ্গ দেখা যায়। শিব মন্দিরগুলো অবশ্য গোপীমোহন পুত্র প্রসন্নকুমার সম্পূর্ণ করেন। মন্দিরের দালানের বাতিগুলি ইউরোপীয় প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, মন্দিরে সোপানের কাছে দুই স্তম্ভের উপর শ্বেত পাথরের দুই সিংহ মূর্তি। আর উথার সময়ে পাশের দুই স্তম্ভের গাত্রে খোদাই করা আছে দুটি বিষ্ণু মূর্তি। অনুমান করা হয় এই মূর্তিদুটো ব্রহ্মময়ী মূর্তির চাইতেও প্রাচীন, শোনা যায় এগুলি বাংলাদেশের রাজশাহীর কোন জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ির সময় পাওয়া যায়।

পরবর্তী কালে মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ে এগুলি এনে স্থাপন করা হয়। পরবর্তী গন্তব্য রাধাকৃষ্ণ মন্দির, সেখানেও বড় বড় করে লেখা আছে ছবি তোলা নিষেধ, অন্যথায় ক্যামেরা জমা নিয়ে নেওয়া হবে। যাক শ্রী জিৎ কুমার ঠাকুরের (সেবায়েত, মূলাজোড় ট্রাষ্ট) আদেশ শিরোধার্য, হৃদয়ের ক্যামেরায় মন ভরে তুলে নিলাম নয়ানভিরাম রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি, এখানেও পিতলের ভব্য সিংহাসনে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি বিরাজমান। দেখে বাইরে এলাম, বাইরে দেখলাম পুরাতন তিনটি শিব মন্দিরের আমুল সংস্কার হচ্ছে, মন্দিরগুলি যদিও সর্বসাধারনের জন্যে এখনও খোলা হয়নি।

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি কালী পুজো উপলক্ষে এই কালীবাড়ির পুজো নামকরা। সেদিন রাতে এখানে বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। কালীপুজার দিন রাত্রে অনেক দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এই মন্দির প্রাঙ্গনে। তার পরের দিন সকলকে বিনামূল্যে মায়ের ভোগ বিতরণ করা হয়। গ্রীষ্মকালে মায়ের মন্দির সকাল ৬:১৫ থেকে বেলা ১২:৩০ এবং বিকেল ৪:০০ থেকে ৮:৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে এবং শীতকালে সকাল ৬:৩০ থেকে বেলা ১২:৩০ ও বিকেল ৩:৩০ থেকে রাত্রি ৭:৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়াও পৌষ মাসে এখানে এক মাস ধরে বিশাল মেলা বসে এবং তখন এখানে জোড়া মুলো দিয়ে পুজা দেওয়ার রীতি প্রচলন আছে। হয়ত এর থেকেই মূলাজোড়ের কালী নামটি এসেছে। 

এর পরে মেলা চত্বর ঘুরে দেখার পালা, কত কিছুর বিকিকিনি হচ্ছে, বাইরে নানা রকম খাওয়ার জিনিসের সম্ভার – জিলাবি, গজা, মালপো, নিমকি আরও কত কিছু। তবে একটা জিনিসের কথা না বললেই নয়, সেটা হল স্টেশনের কাছে বিক্রি হওয়া পরোটা আর লাল করে ডিমের কারী। না খেলে এর মজা বোঝাই যাবে না। একবার এসে দেখুন না হলপ করে বলতে পারি নানা রকমের খাবারে রসনা আর মন দুইয়ের তৃপ্তি হবেই হবে।

ফেরার পথে রুমিকে বললাম – জানো এই শ্যামনগরে বাংলার কয়েকজন কৃতি মানুষের বসবাস ছিল, রুমি বলল – হ্যাঁ জানি কবি ভারত চন্দ্র রায়গুণাকর এখানেই থাকতেন। আমি বললাম – হ্যাঁ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কবিকে যে জমি প্রদান করে ছিলেন সেখানেই আনুমানিক ১৭৪৯ খ্রীঃ নাগাদ এখানে বসতবাটি তৈরি করে বাস করতে থাকেন, আর ১৭৬০ খ্রীঃ এই মূলাজোড়েই কবি মারা যান। কবি ভারতচন্দ্রের কাছে মূলাজোড় ছিল বার্ধক্যের বারানসী এবং তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য “অন্নদামঙ্গল” এই মূলাজোড়েই রচিত হয়। মূলাজোড়ের মানুষের জীবনযাপন স্বাভাবিকভাবেই যে তাঁর কাব্যে প্রভাব ফেলে ছিল তার উদাহরন ওনার বিখ্যাত প্রার্থনা ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’- এর মধ্যে দিয়ে এই অঞ্চলের গরিব সাধারন মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়া আর একজন কৃতি পুরুষ ছিলেন শ্রী রঙ্গলাল। বর্ধমানের মহারাজা তাঁকে “বাক্য রত্নাকর”উপাধি দিয়েছিলেন। শরৎ শশি চিত্ত, চৈতন্য উদয়, বৈ্রাগ্য, বিপিন বিহার কাব্য, হরিদাস সাধু প্রভৃতি গ্রন্থ লিখে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন, তবে তাঁর যুগান্তকারী কাজ ছিল বাংলায় বিশ্বকোষ রচনা যা প্রকাশিত হয়েছিল তারই তত্বাবধানে ও তারই প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানায় যা এই অধুনা শ্যামনগরেই ছিল। তখনকার দিনে এইরুপ গণ্ডগ্রামে বসে এরূপ একটি কাজ রীতিমত বৈপ্লবিক, যা বাঙালীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। খেয়ে দেয়ে মেলা থেকে অনেক কিছু কিনে এবারে ফেরার পালা, পিছনে পরে থাকলো হরিমোহন ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা করা এক অনন্য সুন্দর মন্দির আর তার সাথে জড়িয়ে থাকা এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। মন নিজে থেকেই গুন গুন করে উঠলো একটি গান – ‘মন রে কৃষিকাজ জান না| এমন মানব জনম রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা| কালী নামে দেওরে বেড়া, ফসলে তছরুপ হবে না|’ সত্যিই কি সার কথা, বৃথা কাজে, স্বার্থের ঠোকাঠুকিতেই জীবন গেলো, জীবনের উদ্দেশ্যই আজও বুঝতে পারলাম না।  

লেখা শেষ করি শ্যামা মায়ের আর একটি রুপ বর্ণনা করে, যদি কিছু ভুল ভ্রান্তি থেকে থাকে, নিজ গুনে ক্ষমা করে দেবেন। 

মহাকালী
তন্ত্রসার গ্রন্থমতে, মহাকালী পঞ্চবক্ত্রা ও পঞ্চদশনয়না। তবে শ্রী শ্রী চণ্ডীতে তাঁকে আদ্যাশক্তি, দশবক্ত্রা, দশভূজা, দশপাদা ও ত্রিংশলোচনা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর দশ হাতে রয়েছে যথাক্রমে খড়্গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ, শূল, ভূসুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ।

আজ এই পর্যন্তই, আবার ফিরে আসব বাংলার কোনও কালীমন্দিরের ছবি ও লেখা নিয়ে। সবাই ভালো থাকবেন, সবার মঙ্গল হউক। 

(ছবির জন্যে ফটো আলব্যাম দেখুন)

Tuesday 24 January 2017

বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ৩


বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ৩

“ডুব দেরে মন কালী বলে। হৃদি রন্তাকরের অগাধ জলে”। যে বৃহৎ প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলাম সময়াভাবে কতটুকু তা করতে পেরেছি এই প্রশ্ন মন কে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তাই হয়ত মায়ের আশীর্বাদে সুযোগ পেয়ে গেলাম একটি ঐতিহ্যশালী জায়গায় যাওয়ার। এবারের গন্তব্য সুখারিয়া, সোমরা বাজার, সাথী হল এবারে কন্যা আর সহধর্মিণী।

চুঁচুড়া ষ্টেশনে এসে দেখি অনেকটাই সময় আছে, রুমি মানে আমার সহধর্মিণী বলল – এত তাড়া দিলে অথচও ট্রেন আসতে তো বেশ দেরি। তাহলে বসে সুখারিয়াতে কি কি দেখার আছে সেসব গল্প বল।মেয়েও বলল  - হ্যাঁ বাপি একটু গল্প শোনাও দেখি। অতএব বললাম – দেখ সবটা আমি জানি না যতটুকু জানি বলছি মন দিয়ে শোন। ১৬৫৭ সালে মোহন মিত্র মহাশয় উলা-বীর নগরে এসে বসবাস শুরু করলেন। ১৭০৪ সালে তাঁর সুযোগ্য পুত্র রামেশ্বর মিত্র সম্রাট আউরঙ্গজেবের কাছ থেকে মুস্তাফি উপাধি লাভ করেন। পরবর্তীকালে রামেশ্বর মিত্রের বড় ছেলে রুঘুনন্দন মিত্র শ্রীপুর- বলাগড় অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন, আর অন্য সন্তান অনন্ত রাম ১৭১২ সালে সুখারিয়ায় বসবাস শুরু করেন। ১৮১৩ সালে অনন্তরামের তৃতীয় পুত্র শম্ভুরাম মিত্র মুস্তাফির বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফি মহাশয় এই আনন্দময়ী কালী মন্দির তৈরি করান। ১৮১৪ সালে রামনিধি মিত্র তৈরি করান হরসুন্দরী মন্দির। পরবর্তীকালে কাশীগতি মিত্র মহাশয় নিস্তারিনি কালী মন্দির। এছাড়াও আছে ১৭৮৫ সালে তৈরি ঐতিহ্যমণ্ডিত সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, আর এটাই সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির সুখারিয়ার। তবে আর কথা নয় এবারে ট্রেন ঢুকছে, বাকি কথা ট্রেনে উঠে। কিন্তু বিধিবাম ট্রেন এত ভিড় যে ওঠাই গেলো না, হয়ত একা থাকলে হয়ে যেত কিন্তু কন্যা আর সহধর্মিণীকে নিয়ে সেই চেষ্টা করতে পারলাম না। মন খারাপ হয়ে গেলো তবে কি যাওয়া হবে না, পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম পরবর্তী ট্রেন আছে ব্যান্ডেল থেকে ৯:২৬ এ, অতএব ব্যান্ডেলে গিয়ে কিভাবে ট্রেন ধরলাম সে বিবরণে গিয়ে লাভ নেই। ট্রেন উঠে দেখি চিড়ে চ্যাপ্টা করা ভিড়, যাই হোক কোনোমতে সোমরা বাজার ষ্টেশনে পৌঁছানো গেলো। 

সোমরা বাজার ষ্টেশনটি বেশ সুন্দর, ফাঁকা ফাঁকা, ১নং স্টেশনের সামনে বেশ কিছু টোটো, অটো দাড়িয়ে ছিল, জিজ্ঞাসা করে একটি ফাঁকা টোটো তে উঠে বসলাম, যাত্রা হল শুরু। টোটোচালক কাকুটি বেশ মিশুকে, আমরা সুখারিয়ায় মন্দির দর্শনে এসেছি শুনে খুব খুশি হলেন, নিজের থেকেই মোবাইল নং (নাম– প্রশান্ত রাজবংশি, মোঃ– ৭৬৯৯৩৭৩৭৮৭) দিলেন আর বললেন – তোমাদের মন্দির দেখা হয়ে গেলে আমায় ফোন করে দিয়ো আমি গিয়ে তোমাদের নিয়ে আসবো। নইলে হয়ত তোমরা ঠিক মতো টোটো, অটো নাও পেতে পারো। ক্ষণিকের পরিচয় তাও কত আপন ভাব, মন টা ভরে গেলো মুগ্ধতায়। একটা গানের কলি মনে পড়ে গেলো – “দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা, তারে ধরি ধরি, মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না”।

প্রথম গন্তব্য - আনন্দময়ী কালী মন্দির, মন্দিরের সামনে এসে স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে মন ভরে গেলো। একটি বড় পুকুরের ধারে বিশাল পঞ্চবিংশতি চূড়া বিশিষ্ট ভব্য মন্দির, আর তাঁর লাগোয়া ছয়টি মন্দির। আগেই বলেছি শ্রী বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফি মহাশয় এই আনন্দময়ী কালী মন্দির তৈরি করান, মন্দির চত্বরে পৌঁছে ঐশী (আমার কন্যা) আর রুমির আনন্দ ধরে না। দুজনেই বাচ্চা মেয়ের মতো দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিল, আর আমি লেগে পড়লাম আমার কাজে অর্থাৎ ছবি তোলাতে আর মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্ব কীর্তির রস আস্বাধনে। মন্দিরের প্রথম তলার চারদিকের চারটি কোণে ৩টি করে চূড়া রয়েছে, দ্বিতীয় তলার চারটি কোণে ২টি করে ও তৃতীয় তলায় একটি করে চূড়া রয়েছে, ঠিক মাঝখানে রয়েছে মন্দিরের মূল চূড়া| বিশেষজ্ঞদের মতে মন্দিরের স্থাপত্বশিল্পে এ ধরনের কাজ অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ও সারা পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের ৫টি মন্দির রয়েছে। মন্দির গাত্রে টেরাকোটার সুন্দর কারুকার্য রয়েছে – দশভুজা মা দুর্গার মূর্তি, গনেশের মূর্তি, শিবলিঙ্গের রুপ ইত্যাদি। মন্দির সংস্কারের সময় অপটু হাতে পরে অথবা সময়ের আঘাতে অনেক টেরাকোটার কারুকার্য আজ অবলুপ্ত, তবু যা আছে তা আজও প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়া দুধারে ৬টি করে মন্দির রয়েছে যার মধ্যে ৫টি আটচালা ও একটি করে পঞ্চরত্ন মন্দির। একটি পঞ্ছরত্ন মন্দিরে গনেশ মূর্তি রয়েছে ও বাকি মন্দির গুলিতে ভোলানাথ শিব বিরাজমান। মন্দিরের পুরোহিত শ্রী রাজু মুখারজির (মোবাইল নং – ৭৬০২৮০২৬৬৯) সাথে পরিচয় হল, উনিও বেশ মিশুকে লোক কথায় কথায় জানতে পারলাম মুস্তাফি ফ্যামিলির বর্তমান কর্তা শ্রী সোমনাথ মিত্র মুস্তাফি, উনিই এই ট্রাষ্টের প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে কলকাতায় বসবাস করেন। উনি আরও বললেন আগামী ৩রা ফেব্রুয়ারী বাৎসরিক উৎসব, আমন্ত্রন জানিয়ে রাখলেন। আমরাও বললাম যদি সম্ভব হয় নিশ্চয়ই আসবো। এরপর মায়ের স্নিগ্ধ মূর্তি দর্শনে মন জুড়িয়ে গেলো, প্রণামি দিয়ে ও চরণামৃত গ্রহন করে বাইরে এলাম। মন্দিরের পাশে গিয়ে বিস্তৃত কৃষিজমি দেখে মন জুড়িয়ে গেলো, মন্দিরের আগে, পুকুরের পারেই আছে মুস্তাফি পরিবারের বংশানুক্রমিক প্রাসাদ, রাধাকুঞ্জ যা বর্তমানে ধ্বংশস্তুপে পরিনত হয়েছে, দেখে মন ভারী হয়ে গেলো, ঐতিহ্যের কি করুন পরিনতি?  

পরবর্তী গন্তব্য - হরসুন্দরী মন্দির ও নিস্তারিনী মন্দির| যাবার পথে এক যায়গায় থামতে হল, হাতে চালিত তাঁতের মাকুর খটাখট আওয়াজ শুনে, পরিচয় হল দুইজন কারিগর ও তাঁদের মহাজন বাপিদার সাথে। অবাক হয়ে দেখলাম কি অসাধারন নিপুণটায় শাড়ির নক্সায় ফুটে উঠছে একের পর এক অসামান্য কারুকাজ। বাপিদা ও কারিগর দাদা দের থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। পথে অনেকেই দেখলাম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে, অনেকেই হেঁসে জানতে চাইলেন কোথায় যেতে চাই। সাহায্য করলেন পথ দেখিয়ে দিয়ে। 

কিন্তু হরসুন্দরী মন্দিরের সামনে এসে নিরাশ হতে হল, কারন মন্দির দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে, স্থানীয় লোকে দের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ৯:৩০ থেকে ১০:৩০ অবধি মন্দির খোলা থাকে, পুরোহিত মশাই এসে পূজা করে মন্দির বন্ধ করে চলে যান। অতএব বাইরে থেকেই ক্যামেরায় চেষ্টা করলাম ছবি তুলে রাখতে।

এই নবরত্ন মন্দির তৈরী হয় ১৮১৪ সালে আর গড়ন আনন্দ ভৈরবী মন্দিরের মতই, শুধু ঢোকার পথের দুধারে রয়েছে পাঁচটি আটচালা ও দুটি করে নবরত্ন মন্দির| এই মন্দিরগুলোও দেখলাম অনেকবার সারাই ও মেরামত করা হয়েছে। এর পর পৌঁছে গেলাম নিস্তারিনী মন্দির, কিন্তু অদৃষ্টের করুন পরিহাস, সেখানেও দেখি মন্দির চত্বর তালাবন্দি অতএব এবারেও বাইরে থেকেই ক্যামেরায় চেষ্টা করলাম ছবি তুলে রাখতে। ইতিমধ্যে কন্যা ও অর্ধাঙ্গিনী যথেষ্ট ক্লান্ত, আর পদব্রজে যাত্রা করতে অপারগ। অতএব টোটোকাকু (প্রশান্ত কাকু) কে ফোন করে জানাতেই বললেন – হ্যাঁ হ্যাঁ আসছি তোমরা কোথায় আছো বল আমি এখুনি আসছি। আমরা জানালাম নিস্তারিনী মন্দিরের সামনে আছি। উনি জানালেন আসছি, আমার একটু বসে বিশ্রাম নিতে লাগলাম। ইতিমধ্যে প্রশান্ত কাকু এসে গেলেন। অনাকে যখন বললাম যে আমরা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির যেতে আগ্রহী, তখন বললেন – হ্যাঁ চল, মা সিদ্ধেশ্বরী  কে না দেখলে তোমাদের ভালোই লাগবে না, চলো চলো দেখিয়ে তোমাদের ষ্টেশনে ঠিক সময়ে ছেড়ে দেব। যেতে যেতে কথায় কথায় জানতে পারলাম কাকু এখানকারই বাসিন্দা, কাছেই ওনার বাড়ি। বলে রাখলেন এরপরে কোনোদিন এলে অবশ্যই জানাতে উনি ওনার বাড়ি নিয়ে যাবেন আর আমাদের সবুজ দ্বীপ ঘোরার বাবস্থা করেন দেবেন। কথায় কথায় এসে গেলাম সিদ্ধেশ্বরী মন্দির চত্বরে। মন্দিরের পাশেই বেশ খানিকটা দুরেই গঙ্গা, আসলে চড়া পড়ে আজ গঙ্গা বেশ দূরে তবে বর্ষার সময়ে নাকি মন্দিরের কাছাকাছি জল এসে যায়। মন্দিরের গাত্রে লেখা ফলকে জানতে পারা গেলো – সুদুর অতীতে কোন এক সৌম্য কান্তি সাধক এই বত বৃক্ষের পদতলে মায়ের সাধনায় ব্রতী হন আর সিদ্ধি লাভ করেন। এই পাথরের মাতৃ মূর্তি তারই আনিত, পরবর্তীকালে তদানীন্তন জমিদার অর্থাৎ মুস্তাফি বংশের অর্থানুকূল্যে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজ অত্যন্ত জাগ্রত দেবালয়ে পরিনত হয়েছে, সেই বট গাছ যার পদতলে সাধক সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তা আজ কালের নিয়মে অসংখ্য শাঁখা প্রশাখা বিস্তার করে আজও দাড়িয়ে আছে। দেখে মন ভরে গেলো, মন আপনি গেয়ে উঠলো শ্রী ঠাকুরের প্রিয় একটি গান – “ডুব্‌ডুব্‌ডুব্‌রূপ-সাগরে আমার মন৷ তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবে রে প্রেমরত্নধন৷ খুঁজ খুঁজ খুঁজলে পাবি হৃদয়মাঝে বৃন্দাবন৷” মায়ের মৃন্ময়ী রুপ দর্শন করে মনের প্রার্থনা জানিয়ে এবার ফেরার পালা। পিছনে পড়ে রইলো এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের ইতিকথা, যা ঐতিহ্যে আর ভালোবাসায় মাখা। 

প্রশান্ত কাকু বললেন – তোমাদের তো কিছুই খাওয়া হয়নি বোধ হয়, আসলে এখানে ওই চা, বিস্কুট বা কেক ছাড়া কিছুই পাবে না। চলো তোমাদের ষ্টেশনে নিয়ে যাই, অখানে মিষ্টির দোকানও আছে আবার খাবার হোটেলও পাবে। তবে কি জানো তোমাদের শহরের মতো সাজানো গোছানো বড় হোটেল নেই, তবে খাবার দাবার ভালোই, খেয়ে দেখতে পারো। আমরা বলে উঠলাম – না না কাকু আমরা ঠিক খেয়ে নেব, বরং আজ চেনা ছকের বাইরে যেতেই মন চাইছে। তাই আপনি নিসংকোচে নিয়ে চলুন। ষ্টেশনে পৌঁছে ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করাতে আবার অবাক হওয়ার পালা, প্রশান্ত কাকু বললেন – ওই ত্রিশ টাকাই দিয়ো, আমি এক পইসাও বেশি নেব না, তোমরা আমাদের এখানে একটু ঘুরতে এসেছ আমি না হয় একটু বেশি গেছি তাতে বেশি নেব কেন? কত অনাবিল যুক্তি, আর কি সরল মনোভাব? আমাদের স্বার্থপর শহুরে মানসিকতার গালে চপেটাঘাত যেন। অনেক করে বলায় মাত্র পঞ্চাশ টাকাই নিলেন, তারপর অন্য একদল সওয়ারি নিয়ে চলে গেলেন। যাবার সময়ে আবার মনে করিয়ে দিলেন আসার কথা। স্টেশন লাগোয়া একটি ছোট কিন্তু পরিষ্কার খাবার হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে মিষ্টির দোকানে হানা দিলাম। টাটকা মিষ্টি, নতুন গুড়ের রসগোল্লা কিনে ষ্টেশনে উঠে শুনতে পেলাম ট্রেন আসার ঘোষণা হচ্ছে। ট্রেন এলো, ভারাক্রান্ত মনে ফিরে চললাম বাড়ীর অভিমুখে, পিছনে পড়ে রইলো প্রশান্ত কাকু, রাজু ভাই, আর বাপিদার মতো সরল গ্রাম্য মানুষ গুলি আর ঐতিহ্যে ভরা কিছু প্রাচীন মন্দির। 

লেখা শেষ করি মা কালীর আর একটি রুপ বর্ণনা করে, গুহ্যকালী। প্রচলিত মত ও পুরাণমতে গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি কেবল মাত্র সাধকদের আরাধ্য। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর, যথা গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়, তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা, গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা আর কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র। স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত, মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র, কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার। সদা হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা। বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ, এছাড়া বামে বৎসরূপী মহাদেব। 

আজ এই পর্যন্তই, আবার ফিরে আসব বাংলার কোনও কালীমন্দিরের ছবি ও লেখা নিয়ে। সবাই ভালো থাকবেন, সবার মঙ্গল হউক। 

(ছবির জন্যে ফটো আলব্যাম দেখুন) 

Sunday 22 January 2017

আজ নেতাজীর ১২০তম জন্ম জয়ন্তী আর আমরা সুশীল সমাজ




আজ নেতাজীর ১২০তম জন্ম জয়ন্তী আর আমরা সুশীল সমাজ

‘দূরে, বহুদূরে, ওই নদী, ওই বন, উপবন, ওই পাহাড় পর্বত উপত্যকা ছাড়িয়ে আমাদের দেশ। ওই পুণ্যভূমিতেই আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, আবার ফিরে যাব ওই দেশেই| ওই শোনো, ভারতবর্ষ আমাদের ডাকছে, ডাকছে আমাদের আত্মীয়রা|’ যে মহান বিপ্লবীর আহ্বানে দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের সব কিছু ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাতৃভূমিকে ব্রিটিশের হাত থেকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে, যুদ্ধ শেষে হয়ত তাঁদের অনেকেই ফিরে এলেন এই ভারতভূমিতে, কিন্তু যাঁর আহ্বানে এই মুক্তির যাত্রা, সেই মহা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত ফিরলেন না শুধু তিনিই। অথচও তিনি কথা দিয়েছিলেন, তিনি ফিরে আসবেন| কিন্তু এলেন না, এক চিরবিপ্লবী কি কথা রাখলেন না, নাকি তাঁকে ফিরতেই দেওয়া হল না? কি রহস্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে? কি ঘটেছিলো সেই সময়ে যে তাঁর ফেরা হল না? 

তাঁর না ফেরার পিছনে কত যুক্তি, কত রটনা? কেউ বলেন নেতাজী নাকি অজানা পথে যাত্রা শুরু করেন আর এক নতুন যুদ্ধের সূচনার উদ্দেশ্যে, কারো মতে ভারতবর্ষ কে শৃঙ্খলমুক্ত করার আশায় যে রাষ্ট্রের সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন তাঁরাই এদেশের কিছু রাজনৈতিক নেতার অঙ্গুলিহিলনে তাঁকে বন্দি করে নিক্ষেপ করেছিলেন কারাগারে। কেউ কেউ বলেন না তিনি সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি বৈরাগ্যের পথে যাত্রা করেন, চমৎকার বিশ্লেষণ যে মানুষটার একমাত্র স্বপ্ন ছিল ভারতের মুক্তি, তিনি সেই স্বপ্ন পূরণের আগেই বেছে নিলেন বৈরাগ্য? আর যারা তৎকালীন নেতাদেরদের পদলেহন করতেন, তাঁদের শেখানো রাস্তায় হেঁটে তাঁরা নাকি নেতাজীর দর্শন পেয়েছিলেন কোন এক আশ্রমে শ্বেত শ্মশ্রুমণ্ডিত সন্ন্যাসীর মুখাবয়বে। কত সুন্দর গোয়েবোলসিও প্রচার? আর এই প্রচারের ফাঁকে খদ্দরের টুপী পরিহিত নেতা/নেত্রীর দল দিব্বি কিন্তু তাঁদের আখের গুছিয়ে নিয়েছিলেন। 

খুব ভুল বললাম কি? ইতিহাস সাক্ষী আছে যুদ্ধ শেষে আজাদ হিন্দ বাহিনীর হাজার হাজার সৈনিক বন্দী হয়ে যখন স্বদেশের মাটিতে পা রাখলেন, আপামর দেশবাসী যখন তাঁদের কথা জানল, তাঁদের মুখে শুনল নেতাজি সুভাষের আত্ম ত্যাগের কাহিনী, মুহূর্তে কোটি কোটি মানুষের আক্রোশ গিয়ে পড়ল ব্রিটিশ রাজশক্তির ওপর, লক্ষ লক্ষ মানুষ বিনা আহ্বানে পথে নেমে পড়ল (যার উল্লেখ পরবর্তীকালে নৌ বিদ্রোহ ও রয়্যাল বিমানবাহিনীর বিদ্রোহে দেখতে পাই)। বেগতিক দেখে তৎকালীন নেতারা যারা খদ্দর ছাড়া আর কিছু কখনও পরেননি, রাতারাতি গায়ে কালো কোট চাপিয়ে লালকেল্লায় হাজির হয়ে গেলেন এই ভয়ে যে সময় মত ভোল না পালটালে কী জানি এই স্ততস্ফূর্ত গনবিক্ষোভ কখন দিক পরিবর্তন করে তাঁদের বাড়া ভাতে ছাই না দিয়ে দেয়, তাহলে তো এতদিনকার সাধের ‘স্বাধীনতা’ ‘স্বাধীনতা’ খেলাটাই চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে| গদিতে বসার, ক্ষমতার যে তীব্র লালসা তাঁদের মধ্যে ছিল সেটি তো পূর্ণ হতোনা|

আর নেতাজীকে নিয়ে ধোঁয়াশার খেলা অনেকটা সহজ করে দিয়েছিল তাঁদের বন্ধু ব্রিটিশ ও মার্কিনরা, চতুর ব্রিটিশ সুকৌশলে ১৯৪৫ সালের ২২ অগাস্টের একটি রেডিও ঘোষণা করে যাতে জাপান রেডিওর ভাষ্যকার জানালেন : ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জাপানের নবগঠিত সরকার এই সংবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছে যে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা, আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক শ্রী চন্দ্র বোস গত আঠারোই অগাস্ট দুপুর দুটো পঁয়ত্রিশ মিনিটে তাইহোকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে জাপানের একটি হাসপাতালে আনীত হন, ডাক্তারদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি| ওইদিনই মধ্যরাত্রে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন|’ 

চতুর ব্রিটিশের নেতাজীকে নিয়ে ধোঁয়াশার খেলা অনেকটা সহজ করে দিয়েছিল ১৯৪৫ সালের ২২ অগাস্টের একটি রেডিও ঘোষণা| জাপান রেডিওর ভাষ্যকার জানালেন : ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জাপানের নবগঠিত সরকার এই সংবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছে যে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা, আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক শ্রী চন্দর বোস গত আঠারোই অগাস্ট দুপুর দুটো পঁয়ত্রিশ মিনিটে তাইহোকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে জাপানের একটি হাসপাতালে আনীত হন| ডাক্তারদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি| ওইদিনই মধ্যরাত্রে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন|’ আর পরের দিনই সকালে জাপান সরকার নিয়ন্ত্রিত দোমেই নিউজ এজেন্সি এই একই খবর বিশ্বের প্রতিটি সংবাদপত্রের অফিসে পৌঁছে দিল|

দুরাত্মার কি ছলের অভাব হয়? না  তাই লালকেল্লায় তিন আজাদি সৈনিকের বিচার শুরু হতেই, এক সময় যারা নেতাজীকে, জাপানিদের সঙ্গে নিয়ে দেশে ঢোকার চেষ্টা করলেই তাঁকে তরবারি দিয়ে ঠেকাবেন বলে তলোয়ার খেলা প্রাকটিস করছিলেন, তারাই এবার এগিয়ে এসে সওয়াল জবাব শুরু করেছিলেন আজাদিদের পক্ষে, কি অদ্ভুত ভোল বদল তাই না? দাঁড়ান দাঁড়ানা আরও আছে শুনবেন? একের পর এক জনরোষে ব্রিটিশ সিংহ যখন বিপর্যস্ত তখন ৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী এটলি ঘোষণা করলেন, ‘উনিশশো আটচল্লিশ সালের তিরিশে জুন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে|’ ব্রিটিশ সিংহের প্রতিনিধি সুচতুর মাউন্টব্যাটেন চোখে আঙুল দিয়ে তদানীন্তন আন্দোলন ক্লান্ত(?) নেতাদের দেখিয়ে দিলেন জনমানসে তাঁদের ক্ষুদ্রত্ব| সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন ইম্ফল থেকে প্রলম্বিত দীর্ঘ ছায়াটির গুরুত্ব| একদিন বৈধভাবে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও সভাপতির পদ থেকে যাঁকে বিতারিত করা হয়েছিল, যাঁর স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল জনমানস থেকে, তিনিই আজ অলক্ষ্যে থেকে এক ফুৎকারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চলেছেন সবাইকে| সুতরাং পালটে ফেল ক্ষমতার হস্তান্তরের দিন; ১৯৪৮ সালের ৩০ জুনকে এগিয়ে আনা হল ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্টে| কিসের ভয়? পাছে হঠাৎ একদিন না জীবিত নেতাজী এসে হাজির হন আর জনগন সাদরে বরণ করে নেন তাঁদের প্রানপ্রিয় নেতাজীকে, জনগন অস্বীকার করে ক্ষমতার লোভে করা ভারত ভাগ কে?   

ক্ষমতার কি অসীম মহিমা, যারা রাতারাতি ভোল পাল্টে আজাদি সৈনিকদের হয়ে সওয়াল জবাব করেছিলেন তাঁরাই ক্ষমতা পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, আজাদ হিন্দ বাহিনীর কোনও সৈনিককেই আর সামরিক বাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না| শুধু তাই নয়, লিখিতভাবে প্রতিরক্ষা দফতর থেকে সামরিক বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটে ফরমান গেল, কোনও সামরিক ব্যারাকেই যেন নেতাজির ছবি টাঙাবার অনুমতি দেওয়া না হয়| কীসের ভয় ছিল তাঁদের? তাঁরা তো জনগনের কাছের লোক তাঁদের নেতা, তাহলে? না এই প্রশ্নের জবাব তাঁরা দেননি আর তাঁদের উত্তরসূরি বর্তমান নেতা/ নেত্রীবৃন্দও সযত্নে এড়িয়ে যান এই সব অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ|  

১৮২১ সালে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে আজও গবেষণা চলে| তাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল কিনা সেটা জানার জন্য মৃত্যুর ২০০ বছর পরও তাঁর মাথার চুলের, দাঁতের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়| আর আমরা? না প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার দোহাই দিয়ে মুখ লুকিয়ে ঘুরে বেড়াই? 
এখনও পর্যন্ত কি জানতে পেরেছি আমরা? বিভিন্ন তথ্য সুত্রে এটুকুই জানা গেছে - ১৯৪৯ সালের ৯ ডিসেম্বর, জুরিখ থেকে ডক্টর এল অ্যাবেগ শরৎ বসুকে চিঠি দিয়েছিলেন| এমনকি নেশন পত্রিকায় শরৎ বসুর ওই সাক্ষাত্‍কারের কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন তিনি| একইসঙ্গে ডক্টর অ্যাবেগ বলেছেন, জাপানি সূত্র থেকে ১৯৪৬-এ নেতাজির বেঁচে থাকার খবর পান তিনি|

বিভিন্ন নথিগুলো থেকে জানা যায় যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত নেতাজির পরিবারের ওপর নিয়মিত নজরদারি চলেছিল, নেতাজির দুই ভাইপো অমিয়নাথ বসু এবং শিশিরকুমার বসুর ওপর নজরদারি চালাত রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখা|  উডবার্ন পার্ক এবং এলগিন রোডে বসু পরিবারের দুটি বাড়িতে নজরদারি চালিয়ে পাওয়া তথ্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠানো হতো| কীসের কারনে এই নজরদারি? তা কি কোনদিনও জানতে চেয়েছি আমরা? 

কংগ্রেস আমলে নেতাজি সংক্রান্ত নথি নষ্ট করে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে| তবে কি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রাণপুরুষ নেতাজী কংগ্রেসী নেতাদেরই ষড়যন্ত্রের বলি? আশঙ্কা অমুলক নয় - কংগ্রেস তৈরী হয়েছে ও বেড়ে উঠেছে ব্রিটিশের আনুকূল্যে, কংগ্রেস নেতারা বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশের পক্ষে লড়াই করার আবেদনও রেখেছিলেন। অবশ্য ব্রিটিশ প্রভুরা ভারত ত্যাগের সময়ে এই কংগ্রেসের হাতেই দিয়ে যায় ভারতের কর্তৃত্ব। কংগ্রেস নেতৃত্ব এর প্রতিদান দেন লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন কে ভারতের গভর্নর জেনারেল করে, এই মাউন্টব্যাটেন ২১শে জুন ১৯৪৮ পর্যন্ত গভর্নর জেনারেল হিসেবে ক্ষমতাসীন ছিলেন কাদের স্বার্থ রক্ষায়? একদিকে আপোষ কামী, ক্ষমতা লোভী ভীরু কংগ্রেসি নেতৃত্ব আর অন্যদিকে সদা বিপ্লবী নেতাজী, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। তাই বিদেশের মাটিতে নেতাজীকে গুম খুন করার পেছনে ব্রিটিশ, মার্কিন ও কংগ্রেসীদের যৌথ আঁতাতের আশঙ্কা উঁড়িয়ে দেয়া যায় কি? 

শোনা যায় ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী মারা যাওয়ার ঠিক চল্লিশ মিনিট আগে নাকি রাশিয়া থেকে ভারতে তাঁর বাড়িতে ফোন করেন আর বলেন ‘এমন একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, যা ভারতের কাছে বড় খবর। কে সেই ব্যক্তি, তা পরিষ্কার করে বলেননি। তবে অনেকের অনুমান, সেই ব্যক্তি হতে পারেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই নেতাজিকে খুঁজে বের করার জন্য কমিশন গঠনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। রাশিয়া যাওয়ার আগে নেতাজির ভাইপো অমিয়নাথ বসুকে সেই কথা জানিয়েও ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন যে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কাছে নেতাজীর বিষয়ে হয়ত সুনির্দিষ্ট খবর ছিল। তিনি হয়ত সেটাই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। এছাড়া কে এমন মানুষ হতে পারেন, যাঁর সঙ্গে দেখা হলে গোটা দেশে হইচই পড়ে যাবে? কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য রহস্যজনক মৃত্যু হয় ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর, জানা হয়ে ওঠেনি তিনি কি বলতে চেয়েছিলেন? এমন কি তাঁর মৃতদেহের ময়না তদন্তও হয়নি। তাহলে কি সন্দেহের অবকাশ থাকে না?

আমরা বিরাট কিছু চাই না, শুধু জানতে চাই, সত্যিই কি ভারতমাতার শ্রেষ্ঠ সন্তান নেতাজী কি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন? না ক্ষমতালোভী প্রতিক্রিয়াশীল নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন তিনি? কোনটা সত্যি বন্ধুগন? তাহলে তৎকালীন নথিপত্র কেউ দেখতে চাইলেই দেশের সরকার, নেতৃবৃন্দ কেন বারবার একই ভাঙা রেকর্ড চালিয়ে বলে: ‘এই নথি প্রকাশিত হলে একাধিক বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে’, বাঃ কি চমৎকার বন্ধুকৃত্য? ভারতমায়ের  সবচেয়ে দামাল যে ছেলেটি তথাকথিত বন্ধুদের ষড়যন্ত্রে ঘরে ফিরে এল না, ক্ষমতালোভী নেকড়েদের শিকার হল, এখনও তারা বন্ধু! ধিক রাজনীতির ব্যাবসায়িদের, তোমাদের জয় হো। সাথে জয় হোক সুশীল বুদ্ধিজীবী সমাজের যারা কথায় কথায় অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে উঠেন, মোমবাতি মিছিল করেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে দেন তাঁরা আজ কেন নির্বাক? এই নিয়ে বললে/ লিখলে কি রাজরোষে পরতে হবে না মিডিয়ার লাইম লাইটে আসা যাবে না?      

দেশ আজ বড় দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, চারিদিকে শুদু নেই আর নেই, এই নৈরাজ্যের মাঝে, এত সাম্প্রদায়িক হানাহানির মাঝে, এত বিভেদের মাঝে শুদু একজনের কথাই বারে বারে মনে পড়ে তিনি আমাদের প্রানপ্রিয় নেতাজী (আজকাল তো আবার নেতাজি এই শব্দ তাও উচ্চারণ করতে লজ্জা হয়, স্বাধীন ভারতে নেতাজীর উপাধি পেয়ে বসে আছেন কোন এক যদু কুলোদ্ভব ভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতা)। কোথায় তার গড়ে তোলা আজাদ হিন্দ ফৌজে তো কোন বিভেদ ছিল না হিন্দু- মুসলমানে বা হিন্দু – খ্রিস্টানে? 

সবাই তার ডাকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে তাহলে আজ এই বিভেদ কেন? আসলে নেতাজী পরবর্তী নেতৃত্ব সেই বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রমান করতে পারেনি আপামর ভারতবাসীর কাছে, যার বিষময় ফল এই দেশভাগ আর দেশভাগ পরবর্তী দাঙ্গা। তাই তো হৃদয়মথিত করে একটাই আকুতি নেতাজীর আদর্শ, ভাবনা হৃদয়ে নিয়ে দেশ সেবার কাজে এগিয়ে আসুক আগামী প্রজন্ম, গড়ে উঠুক নেতাজীর আদর্শ ভারত। আর প্রকাশ পাক নেতাজীর সম্বন্ধে সব তথ্য।
   
শেষে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করি বিখ্যাত কথাশিল্পী শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যাইয়ের সেই কালজয়ী কথা দিয়ে - “তুমি দেশের জন্য সমস্ত দিয়াছ, তাই ত দেশের খেয়াতরী তোমাকে বহিতে পারে না, সাঁতার দিয়া তোমাকে পদ্মা পার হইতে হয়; তাই ত দেশের রাজপথ তোমার কাছে রুদ্ধ, দুর্গম পাহাড়–পর্বত তোমাকে ডিঙাইয়া চলিতে হয়;—কোন্ বিস্মৃত অতীতে তোমারই জন্য তো প্রথম শৃঙ্খল রচিত হইয়াছিল, কারাগার ত শুধু তোমাকে মনে করিয়াই প্রথম নির্মিত হইয়াছিল,—সেই ত তোমার গৌরব! তোমাকে অবহেলা করিবে সাধ্য কার! এই যে অগণিত প্রহরী, এই যে বিপুল সৈন্যভার, সে ত কেবল তোমারই জন্য! দুঃখের দুঃসহ গুরুভার বহিতে তুমি পারো বলিয়াই ত ভগবান এত বড় বোঝা তোমারই স্কন্ধে অর্পণ করিয়াছেন! মুক্তিপথের অগ্রদূত! পরাধীন দেশের হে রাজবিদ্রোহী! তোমাকে শতকোটী নমস্কার!”

(এই লেখা কোন দ্বেষ বা বিদ্বেষ থেকে নয় ইতিহাসের সত্যটিকে বর্তমানের আলোয় দেখার প্রচেষ্টা মাত্র, এতে কেউ যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে আন্তরিকভাবেই দুঃখিত)

Saturday 14 January 2017

পৌষ পার্বণের কথা আর আমি



পৌষ পার্বণের কথা আর আমি

ক্রিসমাস ক্যারোল, কেক পেরিয়ে মন যখন শীত খুঁজছে, ঠিক তখনই হিমেল হাওয়ায় ভেসে শীত এলো সবার দুয়ারে। আরে শীতের কথা বলতে গেলে যেমন লেপ, তোশক, চড়ুইভাতির কথা মনে পড়ে যায় তেমনই মনে আসে নলেনগুড়, পাটালী, পিঠেপুলির কথা। আগে ছোটবেলায় মায়ের কাছে লেপের ভিতরে শুয়ে শুনতাম উমনোঝুমনোর গল্প, আর ভাবতাম ব্যাটা বামুন কি পাজী? নিজের মেয়ের সাথে কেউ এরকম করে? অনেক পরে একবার কথাও পড়ে ছিলাম - “পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/ আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।” , কার কবিতা ঠিক মনে নেই কিন্তু আজ বড় প্রাসঙ্গিক মনে হল, তাই জুড়ে দিলাম। 

পৌষ সংক্রান্তির দিন কয়েক আগে থেকেই বাড়িতে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। মা বাবাকে বলে দিতো ভালো চালের গুঁড়ো, নারকেল, নলেন গুড়, পাটালী, ক্ষীর –এইসব জোগাড় করে আনতে। আমি বাধ্য ছেলের মতো বাবার সাথে সাইকেলে চেপে আনতে যেতাম নলেন গুড়ের মাটির কেঁড়ে, বাবা বলতো – ও ভাই আগের বারের মতো ভালো জিনিসটা দিয়েছ তো? দোকানি হেঁসে বলতো – হ্যাঁ দাদা, আপনি তো প্রতিবার নেন, আপনারে ঠকাবো ক্যামনে? ও নিয়া যান, স্বাদ মুখে লেগে থাকবা। আমরাও নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ী ফিরে আসতাম, অবশেষে আসতো সেই বিশেষ দিন। পিঠে পুলির দিন আমি বাড়ী ছাড়া হতাম না, যদিও আমার ভাই বোন কেউ না থাকায় ভাগ কমে যাওয়ার ব্যাপার ছিল না, কিন্তু পিঠে বানানো দেখাটা ছিল আমার কাছে একটা উৎসবের মতন, তাই ওইদিন পড়তে যাওয়া, আড্ডা, খেলা সব ক্যানসেল। দুপুরের পর থেকে মা রান্নাঘরে টুকটুক করে কাজ গোছাতে শুরু করতো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামত। রান্নাঘরের হলুদ রঙা দেওয়ালকে আরো উজ্জ্বল করে তুলত হলুদ বাল্বের আলো। সব জোগাড়যন্ত্র করে মা ডাক পারত বাবাকে। বাবা এলে জনতা স্টোভ জ্বেলে অ্যালমিনিয়ামের গোল হাঁড়িতে জল গরম করতে বসিয়ে, মুখে একটা পরিস্কার সাদা সুতির কাপড় বেঁধে ভাপিয়ে তৈরি হতো পিঠে। আমাদের বাড়িতে মাটির হাঁড়ি, সরায় পিঠে কোনদিন হয়নি, তবে মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, মায়েদের বাড়িতে নাকি কয়লার উনুনে আর মাটির হাঁড়ি, সরায়, ঢেঁকি ছাঁটা চালে পিঠে হতো। তবে সে যাই হোক, আমি, আমার কুকুর লুসি, আর টিয়াপাখি পিকু বসে দেখতাম পিঠে তৈরি। কতরকম পিঠে হতো – বিউলির ডালের পিঠে তাতে আবার কি সুন্দর হিঙ্গের গন্ধ, সাদা নারকেলের পিঠে, মিষ্টি নারকেলের পিঠে, পোস্তর পিঠে আর বীট, গাঁজর, আলুর পুর দেওয়া অমৃত সমান ভেজ পিঠে। রাতে ভাট বা রুটির পাঠ থাকতো না সেইদিন, সেইদিন রাত শুদুই পিঠে ময়। পিঠে হয়ে গেলে মা লাল পাড় শাড়ি পড়ে আগে ঠাকুর ঘরে ধুপ ধুনা দেখিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় খড় বেঁধে, বামুন ব্যাটার জন্যে পিঠে তুলে তবে আমাদের দিতো, বামুন ব্যাটার পিঠে অবশ্য পরের দিন সাদা বেড়ালটা উদরস্ত করতো।। কি ভালো লাগতো খেতে সে বলে বোঝানো যাবে না। আমি, আমার লুসি, মায় পিকু অবধি মজা করে খেতাম। মা পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে দিতে চলে যেত। তখন মফস্বলের পাড়া ঘরে দেওয়া নেওয়া ছিল, আন্তরিকতাও ছিল, এখন ফ্ল্যাট বাড়ীর কালচারে যা ভুলতে বসেছি আমরা। কতদিন হয়ে গেছে তাও পাশের বাড়ীর কাকিমার বানানো পাটিসাপটা, গোকুল পিঠে যেন আজও যেন মুখে লেগে আছে।   

শুদু কি সেইদিন পর পর কয়েকদিন কত কিছু রান্না হতো, একদিন কড়াইশুটির কচুরি, আর নতুন আলুরদম, তো অন্যদিন মায়ের হাতের তৈরি ভাজা পিঠে। রাঙ্গালু সিদ্ধ করে তাতে মিষ্টি নারকেলের পুর দিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজা। শেষ দিনে হতো পাউরুটির চপ – আলু, বীট, গাঁজর, কড়াইশুটির পুর দেওয়া, তাতে আবার শুখনো খোলায় ভেজে নেওয়া বাদাম আর কিশমিশও থাকতো। আর আমি শুদু ভাবতাম রোজরোজ এই মহাভোজ কেন হয়না? 
  
কয়েক বছর হোল বাবাকে হারিয়েছি, অফিসের ব্যাস্ত শিডিউলে ছুটির নাম যখন ভুলে গেছি, তাই মায়ের হাতের পিঠে বানানো এখন আর দেখা হয়ে ওঠে না, ছোটবেলার সাথী - লুসি, পিকুরাও আজ নেই, কিন্তু তবু আজও যখন অফিস থেকে ফিরে, মায়ের কাছে, বাড়ীর সবাই মিলে পিঠে খেতে বসি মন চলে যায় সেই ফেলে আসা কৈশোরে, যেখানে প্রতিটা স্মৃতি বড় মধুর। সেদিনকার পেটমোটা উষ্ণ হলুদ রঙের গোলগাপ্পা বাল্ব আজ জায়গা করে দিয়েছে শীতল সাদা ডায়েট করা সি-এফ-এল ল্যাম্পকে, গতিময় জীবনের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মেনে নিয়েছি অনেক বদল, হয়তো এটাও তার মধ্যে একটা। তবে সে যাই হোক, সময় যতই এগিয়ে যাক, যতই পিত্‌জা-বার্গার বাজার দখল করুক, পিঠে-পুলি আছে সেই পিঠে-পুলিতেই - আদি ও অকৃত্রিম।    

আজও হয়তো শীত আসে জাকিয়ে, তবে খুঁজে পাইনা আগের সেই আবেগ, সেই ভালোবাসা। সে যুগের শীত আজ এ যুগের কঠোরতায়, উদাসীনতায় চাপা পরে যাচ্ছে, মাথা তুলে বের হতে পারে না তাই বোধ হয় স্মৃতির কোঠর থেকে উকি দেয় ক্ষণে ক্ষণে। ভরা শীতেও তাই আমার মতন কাঙ্গাল আফসোস করে, মনে হয়ে যেন, আগের মত ভাল করে বোধহয় আর ঠান্ডা পড়ছে না! মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের শৈশব বড়ই আশীর্বাদের, ভালোবাসার ছিল যা বড় হবার সাথে সাথে ব্যাস্তানুপাতিক হারে সেই আশির্বাদ, ভালোবাসা কমে গেছে। তবুও এই ভেবে আনন্দ পাই যে  আমরা তো তাও অনেকটাই পেয়েছি, অন্তত আমাদের স্মৃতিতে তো রয়েছে কিন্তু আজকালকার জেনারেশন ওয়াই বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা আসবে তাদের কপালে তো কানাকড়িও জুটবে না। তখন কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় গরম স্যুপে ফু দিয়ে কোনও আধুনিকা মা তাঁর শিশুকে গল্প শোনাবে - "এক যে ছিল শীত, তার রূপের জুড়ি মেলা ছিল ভার......."। 

Tuesday 3 January 2017

বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ২



বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ২

হাঁসের প্রিয় গুগলি, পর্তুগিজদের হুগলি। গুণের প্রিয় তানপুরা, ওলন্দাজদের চিনসুরা। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় ইতিহাসের শহর চুঁচুড়া নিয়ে এক সময় লিখেছিলেন এই বিখ্যাত ছড়াটি। পর্তুগিজ, ওলন্দাজদের সময়কার নানা ইতিহাস যেমন এই শহরে রয়েছে তেমনিই রয়েছে ব্রিটিশ শাসনকালের নানা স্মারক। গঙ্গাপাড়ের এই শহরের আনাচে কানাচে আজও ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে, শুদু একটু অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে খুঁজে দেখতে হবে। অবশ্য চুঁচুড়ার থেকে বেশী চুঁচড়ো নামটিই কথ্য ভাষায় চলে। চুঁচুড়া নিয়ে কোন কথা বলতে গেলে হুগলী শহরের কথাও চলে আসে। তাই বোধহয় এই দুটি শহরের পৌরসভাও এক। ইতিহাস অনুসারে হুগলী শহরটি ছিল পর্তুগিজদের অধিকারে এবং চুঁচুড়া ছিল ওলন্দাজদের দখলে। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এই দুই শহর দখল করে এবং পরে ১৮৬৫ সালে এই দুই প্রশাসনিক অঞ্চলকে একত্রিত করা হয়। চুঁচড়া আর হুগলী শহরের ইতিহাসের গল্প অন্য একদিন বলব। আজ শোনাবো এই অঞ্চলের কিছু বিখ্যাত কালী মন্দিরের কথা, যা আজও নিজ গৌরবে সমুজ্বল। 

শীতকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে একদিন সকালে আমার মতন বেরিয়ে পরতে পারেন এই মন্দিরগুলি দর্শনে। আমার প্রথম গন্তব্য ছিল মা দয়াময়ী কালীমন্দির, আসুন শোনাই দয়াময়ী কালীমন্দিরের কথা। এই মন্দিরটি চুঁচুড়া শহরের খড়োবাজার অঞ্চলে নেতাজি সুভাষ রোডের পাশে অবস্থিত। ইতিহাস অনুসারে মুঘল সম্রাট আকবরের রাজস্বসচিব টোডরমল্ল জিতেন রায় নামক এক ব্যক্তিকে চুঁচুড়া অঞ্চলের জায়গীরদার হিসেবে নিযুক্ত করেন, আর উক্ত জিতেন রায় দয়াময়ী কালীমন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের পরে অনেকটা জায়গা জুড়ে মন্দিরপ্রাঙ্গণ। গম্বুজাকৃতি চূড়াবিশিষ্ট নাটমন্দিরবিহীন দেবীমন্দিরের বাইরে একটি ঢাকা বারান্দা অবস্থিত। গর্ভগৃহে প্রায় সাড়ে তিন ফুট উচ্চ কষ্টিপাথরে নির্মিত দেবী মূর্তি, মায়ের পদতলে মহাদেব শিব শায়িত আছেন। এই কালীমন্দির প্রাঙ্গনে চারটি শিবমন্দির অবস্থিত, এছাড়াও মন্দির প্রাঙ্গন সুন্দরভাবে সুসজ্জিত যা দর্শনার্থীদের ভালো লাগবে। মন্দির চত্বরে ছবি তোলায় কোন নিষেধ নেই, তবে হ্যাঁ কেউ পূজারী ঠাকুরের ছবি তোলার দুঃসাহস করিবেন না এতে মা রুষ্ট না হলেও তাঁর সেবকের রুষ্ট হওয়ার যথেষ্টই কারন আছে। মন্দিরের মা কে দর্শনের সময় চোখে পড়ল একজন অবাঙালী পুজারি ঠাকুর মায়ের পায়ে জবা ফুল অর্পণ করছেন এক ভক্তের অনুরোধে, মুহূর্তটি সুন্দর হওয়াতে ভাবলাম যদি ছবি তোলা যায়? ক্যামেরা তুলতেই পূজারি ঠাকুর রেগে গিয়ে হাঁইহাঁই করে বললেন – আরে বেটা তুমাকে হামি ফটো লিতে বারন করেছি? তুমি হামার ফটো কেন লিচ্চ, হামার মালিক জানতে পারলে হামায় নোকরি থেকে হাথিয়ে দিবে। 

সাত সকালে কারোর চাকরি খাবার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র ছিল না, তাই ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে আসছি, ডাক শুনে ফিরে দেখি তিনজন দুঃস্থ মহিলা (ওনারা হয়তো ওই মন্দির প্রাঙ্গনেই থাকেন, ভক্ত/ দর্শনার্থীদের দেওয়া দানে জীবন নির্বাহ করেন) আমায় বলছেন তুমি এত ছবি তুললে আর আমাদের ছবি তুলবে না বাবা? মনে হোল সত্যিই তো ঈশ্বর কি শুধু মন্দির বা মূর্তিতেই আছেন, না তিনি আছেন আমাদের মাঝেই। আমারই ভুল, ভুল স্বীকার করে ওনাদের ছবি তুলে আর অল্প কিছু সাহায্য করে বেরিয়ে আসার সময়ে আবারও মনে পড়ল সেই অমোঘ উক্তি “করিতে ঈশ্বর সেবা সাধ যদি মনে, প্রথমে মানব সেবা করহ যতনে”। এর পরের গন্তব্য করুণাময়ী কালী মন্দির।

করুণাময়ী কালী মন্দির শ্যামবাবুর ঘাটের কাছেই অবস্থিত। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে লেখা আছে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে (বাংলার ১২১৮ বঙ্গাব্দে) এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল, দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মন্দির প্রাঙ্গনে ঢুকে মন ভরে গেলো, সামনেই মন্দির। মন্দিরের সামনে বড় দালান, বাম পাশে একটি দালান, ওখান থেকে মন্দিরের ভোগ বিতরণ করা হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে নয়নাভিরাম কষ্টি পাথরের মাতৃ মূর্তি বিরাজমান, পদতলে সাদা রঙের মহাদেব শায়িত। মন্দিরে আলাপ হল একজন বয়স্কা মাসীমার সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম যে এই মন্দির একজন বয়স্কা সাধিকার হা্তেই প্রতিষ্ঠিত, পরে সময়ের সাথে এই মন্দির তাঁর বর্তমান রুপ পেয়েছে। মন্দির দালানে আগের মন্দিরের ছবির সাথে ওনার ছবিও আছে। আর জানতে পারলাম যে প্রতি অমাবস্যায় মাকে ভোগ নিবেদন করা হয়, আতপ চালের ভোগ সাথে পায়েস। ইচ্ছা রইলো পরে কোনোদিন এই ভোগ গ্রহন করার। আবার বেরিয়ে পরলাম ক্যামেরা কাঁধে, এর পরের গন্তব্য ষণ্ডেশ্বর তলার মন্দির গুলি।

ষণ্ডেশ্বরতলায় এলে প্রথমেই চোখে পড়বে বাবা ষণ্ডেশ্বর মহাদেবের ভব্য মার্বেল পাথরের মন্দিরটি। মন্দির চত্বরে প্রবেশের মুখে একটি সুন্দর তোরণদ্বার আছে যা দেখে মুগ্ধ হতে হবে। মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত শ্রী আশিস ব্যানারজী, ওনার অনুমতি নিয়ে ভিতরে গিয়ে বাবা ষণ্ডেশ্বর মহাদেবের লিঙ্গরুপ দর্শন আর মনভরে ছবি তুলে বাইরে এলাম। মন্দিরের সামনে বাম পাশে বাবা ভৈরব নাথের ছোট্ট একটি মন্দির আছে। আর ঠিক মন্দিরের সামনে আছে মা সিদ্ধেশ্বরি মায়ের মন্দির। মায়ের মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, ডান পাশে কৃষ্ণ রাই মন্দির ওর যোগদ্যা দুর্গা মাতার মন্দির। এই মন্দিরের ইতিহাস মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি ফ্রেমে লেখা আছে, যতটুকু অনুধাবন করতে পারলাম তাঁর মর্মার্থ এই যে – আনুমানিক ১৭৪৬ সাল (ইং) নাগাদ জনৈক শ্যামরাম সোম, মতান্তরে দুর্লভ সোম এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দেখে অবাক হয়ে যেতে হয় তাই না? কি প্রাচীন ঐতিহ্যময় ইতিহাস এই মন্দিরের? ষণ্ডেশ্বরতলায় গঙ্গার ঘাটের দিকে আরও দুইটি মন্দির আছে, হনুমানজির আর রাম, সীতার মন্দির। বর্তমানে গঙ্গার ঘাটের সংস্কার হয়েছে, বসার জায়গা, লাইটের বন্দোবস্ত আছে। দেখলাম অনেকেই বসে আছেন, আমিও একটা গাছের তলায় বসে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। বড় ভালো লাগছিলো, আজকের এই স্বার্থপরতার যুগে, হানাহানির সময়ে যেখানে মানুষ উদভ্রান্ত হয়ে পরে প্রকৃত দিক নির্দেশনার অভাবে সেখানে আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন আছে বইকি।

আমাদের দুর্ভাগ্য চারিদিকে আজ শুদু একটি ধর্মের মানুষের অপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার অভাব, এর থেকে আজ যত হিংসা, হানাহানি। এর থেকে মুক্তির উপায় কোনও রাজনৈতিক নেতা বা ধর্মীয় গুরু/ গুরুমাতারা ভেবেছেন কি? স্বামীজি কিন্তু তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তা থেকে ভবিষ্যৎ ভারতের এই চিত্রটি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি শুধু হলেই হবেনা, সংগে তাদের জানতে হবে ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতির ইতিহাস, তা না হলে সাংস্কৃতিক দিকটির অবক্ষয় ঘটবে। তিনি তাই চেয়েছিলেন ভারতের সাধারণ জনগণ শিক্ষার আলোয় সর্ব চেতনাসম্পন্ন হবার সাথে সাথে ভারতের আধ্যাত্মিক সাধনার ধারাটিকেও জানুক। তাই ডাক দিয়েছিলেন তিনি, 'Deluge the country with spiritual ideas'। সত্য, ন্যায়নিষ্ঠতা, ভালোবাসা, শান্তি ও ঐক্য ভারতীয় সনাতন আদর্শের পরিচায়ক। তিনি বলেছেন - ধর্ম শুধুমাত্র বক্তৃতা বা দর্শনতত্ত্বে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি ধর্মকে আত্ম-উপলব্ধি বলেছেন। তাঁর ভাষায়, "এটি হওয়া বা হতে থাকা, তবে শোনা বা জানা নয়। সমগ্র আত্মার রূপান্তরে বিশ্বাসে রূপান্তরিত হওয়াকেই ধর্ম বলে।" তাঁর মতে সব পূজা যদি পবিত্র হয় ও অপরের হিতের জন্য করা হয়, তবে তার সমষ্টিকেই ধর্ম বলা চলে। স্বামীজি বলেছেন, ধর্ম হল মানুষকে পশু থেকে মানুষে এবং তারপর মানুষ থেকে দেবতায় রূপান্তরিত করার শিক্ষা। আসলে স্বামীজি  ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব শিখেছিলেন, "জীবই শিব"। তাই তিনি "শিবজ্ঞানে জীবসেবা"র উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন - মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর থাকেন। তাই মানুষের সেবা করাই ঈশ্বরের সেবা। স্বামীজি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে যদি কোনো দেশকে পুণ্যভূমি বলতে হয়, যদি কোনো দেশে মানবিকতা, পবিত্রতা, শান্তি সর্বোচ্চ স্থান নেয় এবং সর্বোপরি কোনো দেশ যদি আধ্যাত্মিক ধারণায় পূর্ণ থাকে, তবে সেই দেশটি হল ভারত। অনেক কথা হয়তো বলে ফেললাম, যা বলার উপযুক্ত আমি নই, তাই প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার। আগের পর্বে আমি চেষ্টা করে ছিলাম অষ্টধা মা কালীর এক একটি রুপের বর্ণনার, আজ মা সিদ্ধকালীর কথা বলব -   
সিদ্ধকালী মাকালীর একটি অখ্যাত রূপ। কোনও গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পূজা হয় না, এই মাতৃ রুপ কেবলমাত্র সিদ্ধ সাধকদের ধ্যান আরাধ্যা। কালীতন্ত্রতে তাঁকে দ্বিভূজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। অন্যত্র তিনি ব্রহ্মরূপা ভুবনেশ্বরী। সিদ্ধকালী আদপেই রক্তপান করেন না, তিনি খড়্গ দিযে আঘাত হানেন চাঁদে, সেই চাঁদ থেকে নিঃসৃত অমৃত পানে তুষ্ট হন এই দেবী। মা সিদ্ধকালী সদা সালংকারা। তাঁর বামপদ ভোলানাথ শিবের বুকে ও ডানপদ ভোলানাথের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত।

আজ এই পর্যন্তই, আবার ফিরে আসব বাংলার কোনও কালীমন্দিরের ছবি ও লেখা নিয়ে। সবাই ভালো থাকবেন, সবার মঙ্গল হউক।