Saturday 14 January 2017

পৌষ পার্বণের কথা আর আমি



পৌষ পার্বণের কথা আর আমি

ক্রিসমাস ক্যারোল, কেক পেরিয়ে মন যখন শীত খুঁজছে, ঠিক তখনই হিমেল হাওয়ায় ভেসে শীত এলো সবার দুয়ারে। আরে শীতের কথা বলতে গেলে যেমন লেপ, তোশক, চড়ুইভাতির কথা মনে পড়ে যায় তেমনই মনে আসে নলেনগুড়, পাটালী, পিঠেপুলির কথা। আগে ছোটবেলায় মায়ের কাছে লেপের ভিতরে শুয়ে শুনতাম উমনোঝুমনোর গল্প, আর ভাবতাম ব্যাটা বামুন কি পাজী? নিজের মেয়ের সাথে কেউ এরকম করে? অনেক পরে একবার কথাও পড়ে ছিলাম - “পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/ আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।” , কার কবিতা ঠিক মনে নেই কিন্তু আজ বড় প্রাসঙ্গিক মনে হল, তাই জুড়ে দিলাম। 

পৌষ সংক্রান্তির দিন কয়েক আগে থেকেই বাড়িতে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। মা বাবাকে বলে দিতো ভালো চালের গুঁড়ো, নারকেল, নলেন গুড়, পাটালী, ক্ষীর –এইসব জোগাড় করে আনতে। আমি বাধ্য ছেলের মতো বাবার সাথে সাইকেলে চেপে আনতে যেতাম নলেন গুড়ের মাটির কেঁড়ে, বাবা বলতো – ও ভাই আগের বারের মতো ভালো জিনিসটা দিয়েছ তো? দোকানি হেঁসে বলতো – হ্যাঁ দাদা, আপনি তো প্রতিবার নেন, আপনারে ঠকাবো ক্যামনে? ও নিয়া যান, স্বাদ মুখে লেগে থাকবা। আমরাও নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ী ফিরে আসতাম, অবশেষে আসতো সেই বিশেষ দিন। পিঠে পুলির দিন আমি বাড়ী ছাড়া হতাম না, যদিও আমার ভাই বোন কেউ না থাকায় ভাগ কমে যাওয়ার ব্যাপার ছিল না, কিন্তু পিঠে বানানো দেখাটা ছিল আমার কাছে একটা উৎসবের মতন, তাই ওইদিন পড়তে যাওয়া, আড্ডা, খেলা সব ক্যানসেল। দুপুরের পর থেকে মা রান্নাঘরে টুকটুক করে কাজ গোছাতে শুরু করতো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামত। রান্নাঘরের হলুদ রঙা দেওয়ালকে আরো উজ্জ্বল করে তুলত হলুদ বাল্বের আলো। সব জোগাড়যন্ত্র করে মা ডাক পারত বাবাকে। বাবা এলে জনতা স্টোভ জ্বেলে অ্যালমিনিয়ামের গোল হাঁড়িতে জল গরম করতে বসিয়ে, মুখে একটা পরিস্কার সাদা সুতির কাপড় বেঁধে ভাপিয়ে তৈরি হতো পিঠে। আমাদের বাড়িতে মাটির হাঁড়ি, সরায় পিঠে কোনদিন হয়নি, তবে মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, মায়েদের বাড়িতে নাকি কয়লার উনুনে আর মাটির হাঁড়ি, সরায়, ঢেঁকি ছাঁটা চালে পিঠে হতো। তবে সে যাই হোক, আমি, আমার কুকুর লুসি, আর টিয়াপাখি পিকু বসে দেখতাম পিঠে তৈরি। কতরকম পিঠে হতো – বিউলির ডালের পিঠে তাতে আবার কি সুন্দর হিঙ্গের গন্ধ, সাদা নারকেলের পিঠে, মিষ্টি নারকেলের পিঠে, পোস্তর পিঠে আর বীট, গাঁজর, আলুর পুর দেওয়া অমৃত সমান ভেজ পিঠে। রাতে ভাট বা রুটির পাঠ থাকতো না সেইদিন, সেইদিন রাত শুদুই পিঠে ময়। পিঠে হয়ে গেলে মা লাল পাড় শাড়ি পড়ে আগে ঠাকুর ঘরে ধুপ ধুনা দেখিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় খড় বেঁধে, বামুন ব্যাটার জন্যে পিঠে তুলে তবে আমাদের দিতো, বামুন ব্যাটার পিঠে অবশ্য পরের দিন সাদা বেড়ালটা উদরস্ত করতো।। কি ভালো লাগতো খেতে সে বলে বোঝানো যাবে না। আমি, আমার লুসি, মায় পিকু অবধি মজা করে খেতাম। মা পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে দিতে চলে যেত। তখন মফস্বলের পাড়া ঘরে দেওয়া নেওয়া ছিল, আন্তরিকতাও ছিল, এখন ফ্ল্যাট বাড়ীর কালচারে যা ভুলতে বসেছি আমরা। কতদিন হয়ে গেছে তাও পাশের বাড়ীর কাকিমার বানানো পাটিসাপটা, গোকুল পিঠে যেন আজও যেন মুখে লেগে আছে।   

শুদু কি সেইদিন পর পর কয়েকদিন কত কিছু রান্না হতো, একদিন কড়াইশুটির কচুরি, আর নতুন আলুরদম, তো অন্যদিন মায়ের হাতের তৈরি ভাজা পিঠে। রাঙ্গালু সিদ্ধ করে তাতে মিষ্টি নারকেলের পুর দিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজা। শেষ দিনে হতো পাউরুটির চপ – আলু, বীট, গাঁজর, কড়াইশুটির পুর দেওয়া, তাতে আবার শুখনো খোলায় ভেজে নেওয়া বাদাম আর কিশমিশও থাকতো। আর আমি শুদু ভাবতাম রোজরোজ এই মহাভোজ কেন হয়না? 
  
কয়েক বছর হোল বাবাকে হারিয়েছি, অফিসের ব্যাস্ত শিডিউলে ছুটির নাম যখন ভুলে গেছি, তাই মায়ের হাতের পিঠে বানানো এখন আর দেখা হয়ে ওঠে না, ছোটবেলার সাথী - লুসি, পিকুরাও আজ নেই, কিন্তু তবু আজও যখন অফিস থেকে ফিরে, মায়ের কাছে, বাড়ীর সবাই মিলে পিঠে খেতে বসি মন চলে যায় সেই ফেলে আসা কৈশোরে, যেখানে প্রতিটা স্মৃতি বড় মধুর। সেদিনকার পেটমোটা উষ্ণ হলুদ রঙের গোলগাপ্পা বাল্ব আজ জায়গা করে দিয়েছে শীতল সাদা ডায়েট করা সি-এফ-এল ল্যাম্পকে, গতিময় জীবনের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মেনে নিয়েছি অনেক বদল, হয়তো এটাও তার মধ্যে একটা। তবে সে যাই হোক, সময় যতই এগিয়ে যাক, যতই পিত্‌জা-বার্গার বাজার দখল করুক, পিঠে-পুলি আছে সেই পিঠে-পুলিতেই - আদি ও অকৃত্রিম।    

আজও হয়তো শীত আসে জাকিয়ে, তবে খুঁজে পাইনা আগের সেই আবেগ, সেই ভালোবাসা। সে যুগের শীত আজ এ যুগের কঠোরতায়, উদাসীনতায় চাপা পরে যাচ্ছে, মাথা তুলে বের হতে পারে না তাই বোধ হয় স্মৃতির কোঠর থেকে উকি দেয় ক্ষণে ক্ষণে। ভরা শীতেও তাই আমার মতন কাঙ্গাল আফসোস করে, মনে হয়ে যেন, আগের মত ভাল করে বোধহয় আর ঠান্ডা পড়ছে না! মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের শৈশব বড়ই আশীর্বাদের, ভালোবাসার ছিল যা বড় হবার সাথে সাথে ব্যাস্তানুপাতিক হারে সেই আশির্বাদ, ভালোবাসা কমে গেছে। তবুও এই ভেবে আনন্দ পাই যে  আমরা তো তাও অনেকটাই পেয়েছি, অন্তত আমাদের স্মৃতিতে তো রয়েছে কিন্তু আজকালকার জেনারেশন ওয়াই বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা আসবে তাদের কপালে তো কানাকড়িও জুটবে না। তখন কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় গরম স্যুপে ফু দিয়ে কোনও আধুনিকা মা তাঁর শিশুকে গল্প শোনাবে - "এক যে ছিল শীত, তার রূপের জুড়ি মেলা ছিল ভার......."। 

No comments:

Post a Comment