Friday 19 May 2017

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্ত জীবন অন্বেষণের শিল্পী



মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্ত জীবন অন্বেষণের শিল্পী
(জন্ম - ১৯ মে, ১৯০৮ ; মৃত্যু - ৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৬)

“লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই যে সব কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলো জানাবার জন্যই আমি লিখি” – এই অমর উক্তি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর। উনি জানানোর জন্যে লিখেছেন আর আমি জানবার জন্যে আজন্মের খিদে নিয়ে পড়েছি। ছোটবেলা থেকেই বই আমার একমাত্র নির্ভরযোগ্য সাথী, যা আমাকে কোনদিনও ছেড়ে যাইনি, আমার সুখে দুঃখে একমাত্র পাশে থেকেছে এই বইই। আমার জগত সংসারকে চেনবার আর এক মাধ্যম এই বই, আর যাঁদের যাঁদের লেখা/ বই আমার জীবনে দাগ কেটে বসে গেছে সেইসব অগ্রণী লেখকের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম।

কি বলিষ্ঠ লেখনী! পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, শহরতলি (প্রথম খণ্ড) শহরতলি (দ্বিতীয় খণ্ড), চতুষ্কোণ, ইত্যাদি উপন্যাস আর ওনার ছোটগল্পগুলি বারংবার মুগ্ধ করেছে আমায়। বাংলার বিস্তীর্ণ নদ-নদীর পটভূমিকায় তৎকালীন সাধারণ মানুষের কথা কত সাবলীলভাবে উঠে এসেছে ওনার লেখায়, যা আজও বিভোর করে দেয়। ওনার সম্বন্ধে নতুন করে বলবার মতো আর কিছুই নেই, বাঙালী পাঠকের মনে তিনি আজও অক্ষয় অমর।

আজ জন্মদিনে আরও একবার স্মরণ ও প্রণাম করি এই অমর কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কে।

গণিতজ্ঞ, কবি, দার্শনিক এবং জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়াম



গণিতজ্ঞ, কবি, দার্শনিক এবং জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়াম 
(জন্মঃ ১৮ মে, ১০৪৮; মৃত্যুঃ - ৪ ডিসেম্বর, ১১৩১)

কাল আমার একজন প্রিয় কবির জন্মদিন ছিল (আমি তাঁকে কবি, দার্শনিকই বলব, কারন গণিত জিনিসটা আমার ঠিক মাথায় ঢোকে না, অবশ্য যার জীবনের অংকই মিলল না তাঁর গণিতে কিবা প্রয়োজন), সময়ের অভাবে লিখতে পারি নি, আজ একটু চেষ্টা করলাম মাত্র।

যদিও ওমর খৈয়াম বাঙালী বা ভারতীয় কবি (বাকি উপমাগুলো দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, গণিতজ্ঞ বাদ দিচ্ছি, ওইরকম বহুমুখী প্রতিভার বিশ্লেষণ করি তেমন সাধ্য কই আমার) নন তবু কাজী নজরুল, কান্তি ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, মুজতবা আলী প্রমুখ সাহিত্যিকগন খৈয়ামকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখে গেছেন। মাফ করবেন খৈয়াম এর রুবাইয়াৎ অনুবাদ করা আমার মত অধমের চিন্তা করাও দু:সাহসের ব্যাপার, ক্ষমতার তো প্রশ্নই নেই। আমি শুদু প্রয়াস করলাম রুবাইয়াৎ থেকে অনুবাদ করা কয়েকটি আমার পছন্দের বাংলা কবিতা তুলে ধরার।

‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম-কাজী নজরুল ইসলাম’ থেকে –
১। “ঘুমিয়ে কেন জীবন কাটাস?  কইল ঋষি স্বপ্নে মোর,
আনন্দ-গুল প্রস্ফুটিত করতে পারে ঘুম কি তোর?
ঘুম মৃত্যুর যমজ-ভ্রাতা তার সাথে ভাব করিসনে,
ঘুম দিতে ঢের পাবি সময় কবরে তোর জনম-ভোর।’’

২। আমরা পথিক ধূলির পথের, ভ্রমি শুধু একটি দিন,
লাভের আঙ্ক হিসাব করে পাই শুধু দুখ, মুখ মলিন।
খুঁজতে গিয়ে এই জীবনের রহস্যেরই কূল বৃথাই
অপূর্ণ সাদ আশা লয়ে হবই মৃত্যুর অঙ্কলীন।

৩। ‘এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর,
প্রিয় সাকী, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবনজুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সার্থ
এই যদি পাই চাইবো না কো তখ্ত আমি শাহানশার’।

কিংবা কান্তি ঘোষের অনুবাদ -

১। সেই নিরালায় পাতায় ঘেরা
বনের ধারে শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু,পেয়ালা হাতে
ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়!
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে
গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর ―
সেই তো সখি স্বপ্ন আমার,
সেই বনানী স্বর্গপুর!

বা সৈয়দ মুজতবা আলীর অনুবাদ 
১। জ্ঞান-বিজ্ঞান ন্যায়-দর্শন সেলাই করিয়া মেলা
খৈয়াম কত না তাম্ব গড়িল; এখন হয়েছে বেলা
নরককুন্ডে জ্বলিবার তরে। বিধি-বিধানের কাঁচি
কেটেছে তাম্বু-ঠোককর খায়, পথ-প্রান্তরে ঢেলা ।

আশ্চর্যের কথা শুদু বাঙালী লেখকরাই নন এমন কি ইউরোপের সাহিত্যিক মহলেও ঢেউ তুলে দিয়েছিলেন ওমর খৈয়াম, সাধে কি আর মার্কিন কবি জেমস রাসেল লোয়েল ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতাগুলোকে "চিন্তা-উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মনিমুক্তা "বলে অভিহিত করেছিলেন। ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চারপংক্তির কবিতাগুলো প্রথমবারের মত ইংরেজিতে অনূদিত হয় খৃষ্টীয় ১৮৫৯ সালে, করেছিলেন এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড, আর এই অনূবাদের সুবাদেই ওমর খৈয়াম বিশ্বব্যাপী কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।

অসাধারণ জ্ঞানী ওমর খৈয়ামের একটি কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি, তাহলেই পাঠক বুঝতে পারবেন ওনার জ্ঞ্যানের ব্যাপ্তি কতদূর ছিল, যেখানে দার্শনিকরা একটি বই লিখেও যে ভাব পুরোপুরি হৃদয়গ্রাহী করতে পারেন না, গভীর অর্থবহ চার-লাইনের একটি কবিতার মধ্য দিয়ে ওমর খৈয়াম তা সহজেই তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন -

“সৃষ্টির রহস্য জানো না তুমি, জানি না আমি
এ এমন এক জটিল বাক্য যা পড়তে পারো না তুমি, না আমি
পর্দার আড়ালে তোমায় ও আমার মাঝে চলছে এ আলাপ
পর্দা যেদিন উঠে যাবে সেদিন থাকবে না তুমি ও আমি।”

ফার্সি কাব্য-জগতে ওমর খৈয়াম এক বিশেষ চিন্তাধারার পথিকৃৎ, তাঁকে নিয়ে তর্ক, বিচার, গবেষণা হচ্ছে আর হবেও, আমরা আম আদমি বরং রস আস্বাধন করি ওনার অমুল্য সৃষ্টি রুবাইয়াৎ গুলির। 

Thursday 18 May 2017

১৯শে মে ভাষা শহীদ স্মরণে


১৯শে মে ভাষা শহীদ স্মরণে

আমাদের বাঙ্গালীদের প্রানের ভাষা এই বাংলা, এই ভাষাতেই গান গাই, কবিতা লিখি, আবার তর্কের তুফান তুলি এই ভাষাতেই, অতএব এই ভাষার প্রতি দরদ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এই ভাষার টানে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা তো বাঙালীর মনে আছে, গর্বের সাথে স্মরণ করি সফিউর, রফিক, জব্বারদের, মনে মনে গেয়ে উঠি - “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”।  কিন্তু সেইভাবে কি মনে আছে, বাহান্নর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের অঙ্গরাজ্য আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন অসমসাহসী বাঙালীকে। কে জানে রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, আহারে-বাহারে, হাজারো উৎসবে মেতে থাকা বাঙালীকে দেখে তো মনে হয় না। মাতৃভাষা যে কোন জাতির আবেগিক পরিচয়ের অন্যতম দিক। মাতৃভাষার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। দুঃখজনকভাবে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা সেই এগারো জন মানুষের কথা আজ বোধয় আমরা বিস্মৃত, আমরা জমি আন্দোলনের ইতিহাস কে পাঠ্য পুস্তকে ঠাই দেবার প্রয়াস করতে পারি অথচও নিজে দেশের ভাষা শহীদদের কথা ইতিহাস বইতে সম্মিলিত করার দাবি তুলতে পারি না।

যাকগে এই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করার মহান দায় আমাদের রাজনৈতিক নেতা/ নেত্রীদের সাথে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী সমাজ তো আছেই, অতএব সংক্ষেপে জেনে নিই এই মহান ভাষা আন্দোলনের কথা। কে জানে আগত সময়ে এরকমই আর এক আন্দোলনের ভাগীদার হতে হবে কিনা?

প্রতিবেশী আসাম রাজ্যর প্রধান ভাষা অহমীয়া হলে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ, কাছাড় এবং শিলচর বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা হিসাবেই আজও পরিচিত। স্বাধীনতা তথা দেশ ভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালী (বর্তমান সিলেট বিভাগ) পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বরাক ভ্যালী থেকে যায় আসামে। ১৯৬১ সালে আসাম সরকার শুধু মাত্র অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষনা দিলে, স্বভাবতই ক্ষোভ দানা বাঁধে  স্থানীয় বাঙালীদের ভেতর, পরবর্তীকালে যা ক্রমশঃ রূপ নেয় আন্দোলনের - প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস আন্দোলন। 

১৯৬১ সালের ১৯ মে, আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে এদিন শিলচরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করা হয়। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ভাষাবিপ্লবীরা যখন স্থানীয় রেলওয়ে ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ পালন করছিল তখন নিরাপত্তারক্ষায় নিয়োজিত আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ান তাদের বাধা দেয়। প্রতিরোধ, পাল্টা প্রতিরোধে, এক সময়ে আসাম রাইফেলস গুলি চালালে ঘটনাস্থনে প্রান হারান ১১ জন ভাষাবিপ্লবী, সাথে আহত হন অর্ধশতাধিক। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষনা করা হয়।

সেদিন মাতৃভাষার জন্য যে ১১ জন বীর শহীদ আত্মবলি দেন তাদের মধ্যে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষাশহীদ সতের বছরের তরুনী কমলা ভট্টাচার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দুজন নারী মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন- একজন শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় জন শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ, যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে শহীদ হন। 

১৯ মের ১১ জন ভাষাশহীদদের তালিকা - 

১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য 
২. শহীদ শচীন্দ্র পাল 
৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর 
৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী 
৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর 
৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব 
৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস 
৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস 
৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ 
১০. শহীদ সুনীল সরকার 
১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ 

আসুন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এই সব অসমসাহসী বীর বাঙ্গালীদের, যাঁদের আত্মত্যাগ গর্বিত করেছে সমগ্র বাঙালীকে।

Wednesday 17 May 2017

স্মরণে চারণকবি মুকুন্দ দাস


স্মরণে চারণকবি মুকুন্দ দাস

“ছল চাতুরী কপটতা মেকী মাল আর চলবে ক’দিন?
হাড়ি মুচির চোখ খুলেছে, দেশের কি আর আছে সেদিন।।
খেতাবধারী হোমরা চোমরা, নেতা বলেই মানতে হবে,
মনুষ্যত্ব থাক কি না থাক, তাঁর হুকুমেই চলবে সবে।
সত্যকে পায়ে দলবি তোরা আসন চাইবি বিশ্বজোড়া ।
হবে না তা নবীন যুগে হোস না তোরা যতই প্রবীণ।“

অথবা “হাসি হাসি পরবো ফাঁসী, দেখবে জগৎ বাসী, বিদায় দে মা ঘুরে আসি” – ব্রিটিশ বিরোধী এরকমই অসংখ্য গণসংগীতের অমর স্রস্টা যিনি, তিনি চারণকবি মুকুন্দ দাস। একদিন তাঁর রচিত গানেই উত্তাল হয়ে উঠেছিলো আসমুদ্র হিমাচল, দেশমায়ের শৃঙ্খল মোচনে পথে নেমেছিল অসংখ্য মানুষ। আজও কি তাঁর গান আমাদের রক্তে জ্বালা ধরায় না, হ্যাঁ আজও তাঁর গান সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক মুক্ত চিন্তার মানুষের কাছে। আজ ১৮ই মে তাঁর প্রয়াণ দিবস (১৯৩৪ সালে ১৮ই মে তাঁর প্রয়াণ দিবস), আসুন ইতিহাসের সরণী বেয়ে জেনে নি তাঁর কথা।

আগেই বলে রাখি তাঁর আসল নাম মুকুন্দ দাস নয়, পিতা গুরুদয়াল দে তাঁর নাম রেখেছিলেন যজ্ঞেশ্বর দে, ডাক নাম যজ্ঞা।বাবা গুরুদয়াল দে সরকারি অফিসের এক সামান্য কর্মচারীর কাজ করার পাশাপাশি একটি মুদিদোকান চালিয়ে সংসার নির্বাহ করতেন কোনোভাবে। ছোট থেকেই পড়ালেখায় মন ছিল না যজ্ঞেশর ওরফে মুকুন্দ দাসের। বাবা তাকে জোর করে দোকানদারিতে বসিয়ে দিয়েছিলেন। এমন সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় বীরেশ্বর গুপ্তের গানের দলের সঙ্গে, যুক্ত হন ওই দলের প্রধান সহায়ক হিসেবে। শুরুতে কেবল কীর্তনে বেশি ঝোঁক থাকায় কীর্তন চর্চায় বেশি মনোযোগী ছিলেন ফলে কীর্তনিয়া হিসাবে নামডাকও ছঢ়িয়ে যায় দ্রুত। এছাড়া কীর্তন গানের পাশাপাশি নিজে গান লিখে গাইতে শুরু করেছিলেন। এভাবেই বেড়ে ওঠা মুকুন্দ দাসের, যদিও তখনো ‘মুকুন্দ’ নাম প্রচারিত হয়নি, সবাই ডাকে ‘যজ্ঞা’ বলেই।

কীর্তনের আসরে ডাক পড়ে যজ্ঞার আবার গানের আসরেও ডাক পড়ে। এর মধ্যেই ১৯০০ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন সুভাষিণী দেবীকে। এর পরপরই রামানন্দ ঠাকুরের কাছে দীক্ষা গ্রহণ। তিনিই তার নাম রাখেন মুকুন্দ দাস। সেই সঙ্গে নিজে ঢংয়ে গান, কবিতা, যাত্রাপালার ভেতরে ঢুকে যান আরও। ১৯০৩ সালে বরিশাল আদর্শ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই, নাম - ‘সাধনসঙ্গীত’। সেটি উৎর্সগ করেন গুরু রামানন্দকে। যোগাযোগ হয় নামীদামি স্বদেশি চেতনার সাহিত্য -সংগীত আসরে। এ সময় থেকে মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গুরু- শিষ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়, স্বাদেশিকতার চর্চাও এখান থেকে শুরু হয় এবং মুকুন্দ দাস ক্রমেই বৈষ্ণব ধারণা থেকে সরে আসতে থাকেন।

১৯০৪ সালের দিকে কালিসাধক সনাতন চক্রবর্তী ওরফে সোনাঠাকুর দ্বারা প্রভাবিত হন মুকুন্দ দাস। ১৯০৫ সালে রচনা করেন প্রথম পালাযাত্রা মাতৃপুজা, যাত্রার মধ্য দিয়ে স্বদেশি আন্দোলনের ধারাকে আরও জাগরিত করেন। ওই যাত্রাপালার পান্ডুলিপি বাজেয়াপ্ত করে তৎকালীন পুলিশ। যাত্রাদল গড়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে থাকেন তিনি। মুকুন্দ দাসের যাত্রাপালা ও গান তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার অভিযোগে  তৎকালীন ইংরেজ সরকার এই পালা রচনা ও প্রচারের জন্য মুকুন্দ দাসকে প্রেপ্তার কর এবং সরকার মাতৃপূজা নাটকটি বাজেয়াপ্ত করে। বিচারে মুকুন্দ দাসের তিন বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়। কিছু দিন বরিশাল জেলে রাখার পর মুকুন্দ দাসকে দিল্লি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। মুকুন্দ দাস কারাবসে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী সুভাষিণী দেবীর মৃত্যু হয়, তিন বছর পর জেল থেকে মুক্তিলাভের পর মুকুন্দ দাস বরিশালে ফিরে আসেন। এ সময় চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় নতুন করে যাত্রার দল গঠনে উদ্যোগী হন এবং পুনরায় পালা রচনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯১৬ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আমন্ত্রণে মুকুন্দ দাস তার যাত্রার দল নিয়ে কলকাতা আসেন, সেবার কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে যাত্রা দলের অভিনয় হয়। মহাত্মা গান্ধীর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস মাতৃপূজা কর্মক্ষেত্র, পল্লীসেবা প্রভৃতি যাত্রাপালা রচনা করেন। এছাড়াও মুকুন্দদাসের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - সমাজ, আদর্শ, পল্লীসেবা, সাথী, কর্মক্ষেত্র, ব্রহ্মচারিণী, পথ ইত্যাদি। মুকুন্দ দাস কলিকাতা থাকাকালে একবার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সঙ্গে দেখা করেন, তখন তিনি তাকে গান গেয়ে শোনান ও তার লেখা কয়েকটি বই উপহার দেন। পরবর্তীকালে তিনি বরিশালের কাশীপুর কালীমন্দিরের জায়গা কেনেন, যা এখন বরিশাল শহরে ঢোকার মুখে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল-সংলগ্ন কালীবাড়িটি চারণকবি মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি বলে পরিচিত।  

ভারত মাতার এই সুযোগ্য সন্তান ১৯৩৪ সালের ১৮ মে কলকাতায় যাত্রা পরিবেশন করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে অবসান হয় বৈপ্লবিক গানের, গণনাট্যের একটি অমুল্য অধ্যায়, তাঁর রচিত একটি গান দিয়েই শেষ করছি লেখাটি - 

“ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে,
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।।
তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।
দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী,
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।।
সাজ রে সন্তান হিন্দু মুসলমান
থাকে থাকিবে প্রাণ না হয় যাইবে প্রাণ।।
লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়ান,
নিতে হয় মুকুন্দে-রে নিও রে সঙ্গে।।“

তবে মুকুন্দ দাসের মতো স্বাধীনতার পূজারির মৃত্যু হয় না, দেশ ও সমাজ যখনই পীড়নের মুখোমুখি হয়েছে, তখনই মুকন্দ দাসেরা এসেছে আর আসবেও, উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠবে - ‘আয়রে বাঙালি/আয় সেজে আয়/ আয় লেগে যাই দেশের কাজে’। ভারত মাতার কাছে এটাই আর্তি মা পাঠাও তোমার অগ্নিযুগের সেই দামাল ছেলেদের যারা আর একবার ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে এই মেকী, ভরংবাজিতে পরিপূর্ণ এই সমাজ, গড়ে তুলবে স্বপ্নের অখণ্ড, ঐক্যবদ্ধ ভারত। জয় ভারতমাতা, বন্দেমাতরম। 

(লেখায় যদি কিছু ভুল ভ্রান্তি থেকে যায় তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত, আশা করি পাঠক নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন)

তথ্য সুত্র – বিভিন্ন্য পত্র পত্রিকা, সর্বোপরি গুগুল।

আমরি বাংলা ভাষা আর একটি ক্ষুদ্র বক্তব্য


আমরি বাংলা ভাষা আর একটি ক্ষুদ্র বক্তব্য

গতকাল একটি বহুল প্রচলিত নিউজ পেপারে পড়লাম - রাজ্যের সব স্কুলে এ বার থেকে বাংলা ভাষা পড়তেই হবে, তা সেই স্কুল যে-বোর্ডেরই হোক। স্কুলের ভাষা-মাধ্যম যা-ই হোক, অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা রাখতেই হবে। 

একি কথা শুনি বন্ধু! যে রাজ্যে স্কুলে বাংলায় কথা বললে অনেক তথাকথিত "হাইফাই" স্কুলে শাস্তি হয় সেখানে শেষে এই! না ভাবা যায় না। কি বলছেন? আমি কোন ভাষা পড়বো সেটা আমাকেই ঠিক করতে দিন (না মানে খাওয়ার ব্যাপারে যখন আপ রুচি খানা তখন ......? এই রে শিক্ষাবিদরা তাহলে এখনই রে রে করে উঠে বলবেন – “তাহলে কেউ যদি ইতিহাস, ভুগোল না পড়তে চায় তাহলে সেটাও কি মানা হবে? এভাবে ভাবলে বা চললে কি দেশকে জানা যাবে না যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে আমাদের সন্তান সম ছাত্র ছাত্রীরা?”

ঠিক আমি একেবারে একমত, যেখানে আমাদের দেশে স্কুল স্তরে একদম বেসিক শিক্ষাই দেওয়া হয় সেখানে আঞ্চলিক ভাষা শিক্ষা আবশ্যক তো বটেই। শুদু বাংলা কেন, এটা কন্নর, মারাঠি, হিন্দি সব ভাষার ব্যাপারেই প্রাসঙ্গিক।

তবে এর থেকেও বেশি জরুরী আঞ্চলিক ভাষা (এখানে বাংলা ভাষা কে পড়ুন) আরো প্রাসঙ্গিক করে তোলা। ইংরাজি ভাষা তো আমরা এমনি শিখি না, না শিখলে কি কর্ম জগতে, কি বৃহত্তর শিক্ষার ক্ষেত্রে পাছা মারা যাবে সেই ভয়ে শিখি। তাই সমাজের সর্ব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা কে আবশ্যিক করা হোক, তবেই এর সার্থকতা। 

আশা করি অদুর ভবিষ্যতে একদিন একদিন বাঙালির ছেলে হয়ে "তুই বেশ ভাল বাংলা লিখিস রে" এটাকে আলাদা করে কমপ্লিমেন্ট হিসেবে নিতে হবে না।


ভালো থাকুন, ভালো রাখুন। জয় হিন্দ।

বাহুবলী ২ দ্য কনক্লুশন আর কিছু কথা


বাহুবলী ২ দ্য কনক্লুশন আর কিছু কথা

ইতিমধ্যে সিনেমার পর্দায় বাহুবলী ২ দ্য কনক্লুশন দেখেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সবাই আমরা এই সিনেমাটিকে উপভোগ করেছি, অনেকে অনেক রকম মতামতও দিয়েছে। কিন্তু কয়েকজন বিজ্ঞ্য সর্বোপরি বোদ্ধা জাতীয় লোকের কাছে যা শুনলাম তাতে মগজে খিল লেগে গেলো। 
এই বোদ্ধা জাতীয় সবজান্তা (অবশ্যই বাঙালী, বাঙালী ছাড়া এই আঁতলামো আর কে করবে বলুন দেখি?) ব্যক্তিদের মতে বাহুবলী আসলে কল্পিত হিন্দুত্বের গৌরবগাঁথা শুনিয়ে বক্স অফিসে হিট করেছে, নেহাত কিছু ভিসুয়াল এফেক্ট আছে তাই ভালো লাগছে আর কি! না কয়েকদিন আগে বহুল প্রচলিত সংবাদপত্রেও এই হিন্দুত্বের গৌরবগাঁথা নিয়ে ভারী ভারী সব কথা পড়লাম। অবশেষে মস্তিস্কের ভার লাঘব হেতু মেমরি হইতে ডিলিট মেরে দিলাম।

হায়রে ভারতবর্ষ, তোমার অতীতের বিজয়নগর সাম্রাজ্য, গুপ্ত ও মৌর্য সাম্রাজ্য সব বৃথা! আজকের সেকুলার, তাত্ত্বিক সমাজে হৃত হিন্দু সাম্রাজ্যের কথা বলাও বারণ!

যাকগে আমি ক্ষুদ্র মানুষ, বাহুবলী দেখার পর নিতান্তই অজানাকে জানার কৌতূহলে গুগুলে মাহিস্মতি লিখে সার্চ করে ছিলাম এবং জানতে পেরেছিলাম সত্যিই ভারতেই রয়েছে মাহিস্মতি। তবে দক্ষিণ ভারতে নয়, মধ্য প্রদেশের নর্মদা নদীর ধারেই রয়েছে মাহিস্মতি। অতীতে অবন্তী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলও মাহিস্মতি। আধুনিক ভারতে আজ এই স্থান মহেশ্বরা নামে পরিচিত, মহেশ্বরা ঘাঁট, মন্দির, দুর্গ, এবং মাহেশ্বরী শাড়ির জন্য বিখ্যাত। ইতিহাস অনুযায়ী অবন্তী সাম্রাজ্যের দুটি শক্তিকেন্দ্র ছিল- উত্তরে উজ্জয়িনী এবং দক্ষিণে মাহিস্মতি। এছাড়া মহাভারতেও মাহিস্মতির কথা রয়েছে। এছাড়াও হরিবংশের ইতিহাস অনুযায়ী শোনা যায় রাজা মাহিশমতীই এই সাম্রাজ্য প্রথম তৈরি করেছিলেন, আর তখন মাহিস্মতি অনুপা রাজ্যের রাজধানী ছিল।

অতএব আর কোনও বাক বিতণ্ডার মধ্যে যাচ্ছি না, জয় ভারতমাতা থুড়ি জয় মাহিস্মতি।

উৎসুক পাঠকগন যারা মাহিস্মতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তাঁরা একবার এই লিঙ্কে গিয়ে দেখতে পারেন - অতীতের মাহিস্মতি


Tuesday 16 May 2017

আজ ১৭ই মে, এক অসাধারণ গণিতবিদ এবং সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের আবিস্কারক ও উচ্চতা নিরূপক শ্রী রাধানাথ শিকদার মহাশয়ের প্রয়ান দিবস


আজ ১৭ই মে, এক অসাধারণ গণিতবিদ এবং সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের আবিস্কারক ও উচ্চতা নিরূপক শ্রী রাধানাথ শিকদার মহাশয়ের প্রয়ান দিবস

মাউন্ত এভারেস্টের নাম আজ সবাই জানে, হিমালয় পর্বতমালায় পৃথিবীর সবথেকে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ, আর একজন অসাধারণ মেধাবী বাঙালী গণিতবিদ পরিমাপ করে বের করেন এর উচ্চতা। আসুন আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে একবার স্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ভারত মায়ের এই সুযোগ্য সন্তানটিকে।

স্বর্গীয় শ্রী রাধানাথ শিকদারের জন্ম ১৮১৩ সালে, কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রী তিতুরাম শিকদার। শৈশবে রাধানাথ “ফিরিঙ্গি” কমল বসুর বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন, পরে ১৮২৪ সালে তিনি ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। এই হিন্দু কলেজেই রাধানাথ শিকদার শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন ইংরেজির শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, গণিতের শিক্ষক ড. জন টাইটলার প্রমুখ প্রথিতযশা বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তিদের। হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায়, বিশেষ করে গণিত বিষয়ে তাঁর অসীম জ্ঞান সবাইকে মুগ্ধ করে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ছাত্র থাকাকালীন তিনি নিজেই জ্যামিতির একটি সম্পাদ্য সমাধানের পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন, যা Gleanings in Science (১৮৩১) পত্রিকায় “To draw a Tangent to two Circles” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিলো।

এবার আসি তাঁর কর্মজীবনের কিছু কথায়, ১৮৩১ সালে ভারতে সার্ভেয়র জেনারেল ছিলেন স্যার জর্জ এভারেস্ট, তিনি একজন দক্ষ, তরুণ গণিতবিদকে খুঁজছিলেন। ওইসময়ে তাঁর বন্ধু ড. জন টাইটলার তাঁর প্রিয় ছাত্র রাধানাথের নাম সুপারিশ করে ছিলেন স্যার এভারেস্টের কাছে। ঐ সময়ে আইজ্যাক নিউটনের প্রিন্সিপিয়া সমগ্র ভারতে প্রথম চর্চা করেছিলেন রাধানাথ শিকদার ও রাজনারায়ণ বসাক, যা সম্ভব হয়েছিলো তাঁদের শিক্ষক ড. টাইটলারের জন্যই। স্যার এভারেস্ট রাধানাথ শিকদার কে চিনতে ভুল করলেন না, চাকরি দিলেন নিজ দপ্তরে। শুরু হল এক বরনময় জীবন, সেই সময়ে শ্রী রাধানাথ শিকদারের বেতন ছিল মাসে ত্রিশ টাকার মতো। পরবর্তীকালে শ্রী রাধানাথ গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্ভেয়র হন। দেরাদুনের সিরোন্‌জ অঞ্চলে জরিপের কাজে যুক্ত হয়ে যান তিনি। এ জরিপের কাজের জন্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানী জর্জ এভারেস্ট বেশ কিছু নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই, রাধানাথ এরকম কিছু পদ্ধতির পরিমার্জন করে দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে একটির শিরোনাম ছিলো A Set of Tables for Facilitating the Computation of Trigonometrical Survey and the Projection of Maps for India।

এরপর স্যার জর্জ এভারেস্ট অবসর নিলেন ১৮৪৩ সালে। তাঁর আগে তিনি The Great Trigonometrical Survey কাজটি সম্পূর্ণ করেন। এটি ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ও ভয়ঙ্কর সমস্যাসঙ্কুল জরিপের কাজ। তাঁর জায়গায় অভিষিক্ত হলেন স্যার অ্যান্ড্রু ওয়াহ, তিনি ১৮৪৫ সালের ৩১ মার্চ তারিখে তিনি ভারতের প্রধান কম্পিউটার (Chief Computer) হিসাবে পদোন্নতি পান। আর  সেই সময় শ্রী রাধানাথ শিকদার দেরাদুনের সার্ভে অফিস থেকে কলকাতার সার্ভে অফিসে বদলি হয়ে আসেন, শুরু হয় আর এক কর্মযজ্ঞ। ১৮৪৭ সালে  স্যার অ্যান্ড্রু ওয়াহ হিমালয় পর্বতমালার পূর্বপ্রান্তে একটি নতুন শৃঙ্গ আবিষ্কার করেন। তিনি ধারণা করেন যে এর উচ্চতা তখন পর্যন্ত জানা পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকে বেশি হতে পারে। এর নাম রাখা হলো “শৃঙ্গ-১৫” (Peak-XV)। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে হিমালয় পর্বতের ৭৯টি শিখরের উচ্চতা নির্ণয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। এগুলোর মধ্যে ৩১টির স্থানীয় নাম ছিলো আর বাকিগুলোকে রোমান অক্ষরের সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো। সে অনুযায়ী ভবিষ্যতের এভারেস্ট শৃঙ্গকে ডাকা হতো শৃঙ্গ-১৫ (Peak-XV) নামে।

সেই সময়ে হিমালয় পর্বতমালার সব শৃঙ্গের উচ্চতার মাপ জমা পড়েছিলো কলকাতার গণনা বিভাগে। রাধানাথ শিকদার মন দিলেন এতে, ফল স্বরূপ ১৮৫২ সালের একদিন তিনি আবিষ্কার করে বসলেন শৃঙ্গ-১৫ (Peak-XV) পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। তাঁর হিসাবে এর উচ্চতা ২৯,০০২ ফুট। দেরাদুনে অ্যান্ড্রু ওয়াহকে বিষয়টা জানান তিনি। এ ছিলো এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ওয়াহ সাহেব কাউকে না জানিয়ে দেরাদুনে “কম্পিউটার” পদে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হেনেসি সাহেব ও তাঁর সহযোগীদের দিয়ে বিষয়টা ক্রসচেক করান। অবশেষে ১৮৫৬ সালে শ্রী রাধানাথের পরিশ্রম স্বীকৃতি পায়। সে বছর রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি পিক ফিফটিনকে ঘোষণা দেয় বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ হিসাবে। জর্জ এভারেস্টের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট। স্যার ওয়াহ কোন প্রচলিত আঞ্চলিক নাম প্রস্তাব করতে পারেননি। এর কারণ হলো সে সময় নেপাল ও তিব্বত বিদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো, যদিও তিব্বতিরা একে কয়েকশো বছর ধরে চোমোলুংমা বলে আসছিলো। এর নাম প্রথমে মন্ট এভারেস্ট রাখলে চাইলেও পরে মাউন্ট এভারেস্ট নামটি চূড়ান্ত হয়।

দুঃখের বিষয় একটাই, ১৮৫২ সালে এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করলেও শ্রী রাধানাথের কৃতিত্ব গোপন করে ইংরেজরা, একজন নেটিভ ভারতীয়ের এতো বুদ্ধি সম্ভবত মেনে নিতে পারেনি সেদিঙ্কার সুসভ্য ইংরেজ সমাজ। যাই হোক সত্য কোনদিন চিরকাল গোপন থাকে না, একদিন না একদিন টা সর্ব সমক্ষে আসেই। 

কালের নিয়মে ১৮৫১ সালে সার্ভে বিভাগের এক ম্যানুয়াল প্রকাশিত হয়। A Manual of Surveying for India ছিলো এর নাম। এর লেখক ছিলেন আর. স্মিথ ও এইচ. এল. থুইলিয়ার। এ ম্যানুয়াল প্রকাশে রাধানাথের সহযোগিতা ও অবদানের কথা তাঁরা উল্লেখ করেন। কিন্তু ১৮৭৫ সালে রাধানাথের নাম রাখা হয় নি বইটির তৃতীয় সংস্করণে। ১৮৭৬ সালে Friend of India নামক সংবাদপত্র এ ঘটনাকে “মৃতের উপর ডাকাতি” বলে উল্লেখ করে। রাধানাথের আবিষ্কারের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ভারতের প্রাক্তন সার্ভেয়ার জেনারেল কর্নেল সিডনি জেরাল্ড বুরার্ড। ১৯০৪ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা নেচারের (Nature) ১০ নভেম্বর সংখ্যায় “Mount Everest:The Story of a Long Controversy” শিরোনামে এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করে। সারা বিশ্ব জানতে পারে রাধানাথ শিকদার নামের এ অসাধারণ গণিতবিদ সম্পর্কে।

আচ্ছা গণিতবিদ শ্রী রাধানাথ শিকদারের সম্পর্কে তো অনেক কিছু জানা হল, এবার আসি ব্যাক্তি  রাধানাথ শিকদারের কথায়। ইংরেজ সাহেবদের অধীনে কাজ করলেও তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, স্বাধীনচেতা ও সাহিত্য অনুরাগী। একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। 

১৮৪৩ সালের ১৫ মে, দেরাদুন শহর। সে সময় সাধারণ মানুষকে উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসাররা জোর করে পয়সা না দিয়ে খা‍‌টি‍‌য়ে নিতো। শ্রী রাধানাথ শিকদার সেসময় দেরাদুনের গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অফিসের কম্পিউটার পদে ছিলেন। ঘটনার দিন রাধানাথের পরিচারককে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এইচ. ভ্যানসিটার্ট সাহেব বিনা পয়সায় তাঁর নিজের মালপত্র বহন করিয়ে নিচ্ছিলেন। এমন কাণ্ড দেখে রাধানাথ সে মালপত্র আটকে রাখেন ও ম্যাজিস্ট্রেটকে সশরীরে তাঁর কাছে আসতে বাধ্য করেন এবং যার ফলস্বরূপ তাঁদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ঘটে। শেষে মালপত্র ফেরত পেলেও ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। মামলায় রাধানাথ হেরে যান আর দুশ টাকা জরিমানা হয়ে যায় তাঁর। সে সময় এটা কিন্তু অনেক বেশি অর্থ, তবু শ্রী রাধানাথ কোনরকম গ্রাহ্য না করে জরিমানা দিয়ে দেন। পরবর্তীকালে তাঁর এহেন প্রতিরোধ/ প্রতিবাদের ফলে এরকম বেগার খা‍টিয়ে নেবার মতো অমানবিক কাজ অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। ১৮৫৪ সালে তাঁর বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্রের সাথে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে মাসিক পত্রিকা নামে পত্রিকা বের করেন। ১৮৬২ সালের ১৫ মার্চ তিনি অবসর গ্রহণ করেন ও তৎকালীন জেনারেল এসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশনে (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৮৬৪ সালে তিনি জার্মানির ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি অফ ব্যাভারিয়ার (Natural History Society of Bavaria) সম্মানজক সদস্যপদ পান।

এই মহান গনিতবিদ সাহিত্য অনুরাগী মানুষটির জীবনাবসান ঘটে ১৮৭০ সালে ১৭ মে চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার গঙ্গার ধারে তাঁর নিজস্ব বাড়িতে। তাঁর মৃত্যুর পর নেচার পত্রিকা লিখলো, “Baboo Radhanauth Sickdar for many years chief computer to the Trigonometrical Survey of India, at one time in charge of Calcutta Observatory, and a mathematician of some attainments, died in May last at Calcutta.” তাঁর উপরওয়ালা স্যার জর্জ একবার তাঁর সুযোগ্য শিস্য শ্রী রাধানাথ শিকদার সম্পর্কে বলেন - “Hardy, energetic young man, ready to undergo any fatigue, and acquire a practical knowledge of all parts of his profession.”

আসুন এই মহান বাঙালী মনীষীর প্রয়াণ দিবসে তাঁকে স্মরণ করি, আর প্রার্থনা করি হে ভারতমাতা আরও একবার ফিরিয়ে দাও সেই স্বর্ণযুগের সন্তানদের, দেশের যে আজ আশু প্রয়োজন তাঁদের।

তথ্য সুত্র – বিভিন্ন্য পত্র পত্রিকা, সর্বোপরি গুগুল।

স্মরণে শ্রী উল্লাসকর দত্ত (আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস)


স্মরণে শ্রী উল্লাসকর দত্ত (আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস)

১৯০৮ সালের ১লা মে, ওয়ার্নি স্টেশন থেকে গ্রেফতার করা হয় ক্ষুদিরাম বসুকে। ভীত ব্রিটিশ প্রশাসন সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেয় ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর সাথে জড়িত সকলকে গ্রেফতার করার জন্য। ২ মে কলকাতার ব্রিটিশ প্রশাসনের পুলিশ আটটি স্থানে খানা-তল্লাশি চালায়। কলকাতার মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত ও নলিনীকান্ত গুপ্তসহ ১৪ জন বিপ্লবীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ৪৮নং গ্রে স্ট্রিট থেকে অরবিন্দ ঘোষ সহ তিনজন বিপ্লবীকে, ১৩৪নং হ্যারিসন রোড থেকে ৫ জন বিপ্লবীকে, রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে হেমচন্দ্র কানুনগোকে (হেম দাশ), গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে কানাইলাল দত্তসহ দুইজন বিপ্লবীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এছাড়া ১৩৪নং হ্যারিসন রোডের বাড়ি থেকে পুলিশ প্রচুর পরিমাণে বোমা তৈরির মাল-মশলা ও সাজসরঞ্জাম উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পুলিশ ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে মাটির তলায় পোঁতা কয়েকটি ট্রাঙ্ক উদ্ধার করে। এই সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বোমা ষড়যন্ত্র ও রাজদ্রোহের অভিযোগে মামলা। এই মামলাটিরই নামকরণ হয়েছিল 'আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা'। আলিপুর জজ আদালতে জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট এর আদালতে 'আলিপুর বোমা মামলা'র সূচনা হয়েছিল ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর। মামলায় অরবিন্দ ঘোষের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় একমাত্র চিত্তরঞ্জন দাশ বিনা টাকায় লড়েন, আসামীদের বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন, দু'শর বেশি সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সওয়াল জওয়াবের সমাপ্তি বক্তব্য দেন ৯ দিন ধরে। আলীপুর মামলার শুনানী শেষ হয় ১৯০৯ সালের ১৩ এপ্রিল এবং মামলার রায় ঘোষণা হয় ৬ মে। মামলার রায়ে ৩৬ জন আসামীর মধ্যে বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ এবং বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় (পরে অবশ্য যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেওয়া হয়)। অন্য ১৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দ্বীপান্তর ও কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

আজ সেই মহান বিপ্লবী শ্রী উল্লাসকর দত্তের প্রয়াণ দিবস, আসুন না কর্মব্যাস্ত জীবনের মাঝে একটু জেনে নিই সেসব অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কথা। না বিপ্লব করতে বলছি না, ম্যাদামরা, পলায়নপর, মেকী বাঙালীর রক্তে সেই তেজ আর কোথায়? তবু স্মরণ করতে, জানতে দোষ কোথায়?

উল্লাসকর দত্ত এর জন্মতারিখ ১৬ই এপ্রিল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ, তিনি জন্মেছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার (বর্তমানে জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ) কালীকচ্ছ গ্রামের বিখ্যাত দত্তরায় বংশের এক ব্রাহ্ম পরিবারে। বাবা স্বনামখ্যাত অধ্যক্ষ দ্বিজদাস দত্ত (১৮৫৪-১৯৩৫) আর মা মুক্তকেশী। মা মুক্তকেশী ছিলেন কালীকচ্ছ গ্রামের আরেক বিখ্যাত নন্দীরায় বংশের মেয়ে। উল্লাসকর ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। দাদা মোহিনীমোহন এর জন্ম ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে। ছোটভাই সুখসাগর এর জন্ম ১৮৯০-এ। সুখসাগর-এর পর লাবণ্যকেশী নামে তাদের একজন বোন ছিলেন।

ছোটবেলায় উল্লাসকর এর ডাকনাম ছিল পালু, তবে তিনি কোনভাবেই অভিরাম নন। অনেকে তার নাম অভিরাম বলে প্রচার করতে চান। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম (১৮৮৯-১৯০৮) এর ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে যে গান রচিত হয় (রচয়িতা বাঁকুড়ার বাউলকবি পীতাম্বর দাস। লোককবি ছন্দ মিলাতে গিয়ে ক্ষুদিরামের সাথে অভিরাম নামটি জুড়ে দেন) তাতে আছে – “হলো অভিরামের দ্বীপচালন মা, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, একবার বিদায় দে মা..”। যেহেতু উল্লাসকরেরও যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর  হয়েছিল তাই অভিরাম এর জায়গায় অনেকেই উল্লাসকরকে বসিয়ে দেন। যাক সে কথা ভ্রমে ভরা, আর কর্তাভজা ইতিহাস আমাদের, নইলে সঠিক ইতিহাস চর্চা হলে বোধহয় আমরা অন্যরকম হতাম। 

যাইহোক বিগত সেই স্বর্ণ যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মপ্রচার সর্বোপরি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অনেক বাঙালী আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখিয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লাসকর অন্যতম। বাঙালিদের মধ্যে এমনকি ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম, যিনি সফল বোমা তৈরি করেন। তার তৈরী বোমাটিই ক্ষুদিরাম-এর হাতে তুলে দেয়া হয় অত্যাচারী ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য। এহেন জাত বিপ্লবী উল্লাসকরের শৈশব সবুজে আর পুকুরে-ঘেরা গ্রাম কালীকচ্ছে কাটলেও পরবর্তীকালে তিনি এন্ট্রান্স পাশ করেন কলকাতা থেকে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে। এরপর বিজ্ঞানবিষয় নিয়ে কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। পিতা দ্বিজদাসও একই কলেজের কৃতীছাত্র ছিলেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ এম.এ পাশ করেন। কিন্তু পুত্র উল্লাসকরের নেশা ছিল রসায়নশাস্ত্রে। যা পরবর্তীকালে বোমা তৈরিতে তার কৃতিত্ব বয়ে আনে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন উল্লাসকর স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। কলকাতার বিভিন্ন হলে বিশিষ্ট বাগ্মী ও স্বদেশী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫২-১৯৩২) ও রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) এর বক্তৃতা শুনেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানে তার মূল প্রেরণা বিপিনচন্দ্র পাল। যিনি তার পিতার বন্ধু এবং মামাত ভাইয়ের শ্বশুর ছিলেন। উল্লাসকর এর মামা মহেন্দ্র নন্দীর ছেলে বীরেন্দ্রচন্দ্র নন্দী বিপিন পালের বড় মেয়ে শোভনাকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক আত্মীয়তাসূত্রে বিপিন পালের কলকাতার বাসায় উল্লাসকরের যাতায়াত ছিল। এই সময় তিনি বৌদি শুভনার ছোটবোন লীলা পালের প্রেমে পড়েন। পিতা দ্বিজদাস দত্ত তখন হাওড়ার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক, সন্তানসন্ততি সহ ওখানকার সরকারি বাসভবনে থাকেন।

বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হলেও পড়ালেখায় মন ছিল না উল্লাসের। তিনি ভাবেন পরাধীন দেশে জজ-ব্যারিস্টার হয়ে কী হবে? প্রায় সমবয়সী প্রেমিকা লীলাও বিজ্ঞানের ছাত্রী। লীলা চান তাঁর উল্লাস লেখাপড়া শিখে বড় চাকুরি করবেন। কিন্তু উল্লাস এফ.এ তে ডাহা ফেল করেন, আসলে মনে মনে সাদা চামড়ার অত্যাচার তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। এর মধ্যে একদিন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক মি. রাসেলকে প্রকাশ্যে জুতো দিয়ে পেটালেন।

ব্যস উল্লাসকরের কলকাতায় লেখাপড়ার পাট চুকল। চিন্তিত পিতা বন্ধু বিপিন পালের পরামর্শে ছেলেকে বোম্বে পাঠিয়ে দিলেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। ওখানকার ভিক্টোরিয়া জুবিলি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এ তাকে ভর্তি করে দেয়া হলো। কিন্তু স্বদেশী মন্ত্রে যে একবার দীক্ষা নিয়েছে তাঁর কি ওইসবে মন টেকে? কলকাতায় তাদের গোপন সশস্ত্র আড্ডার খবর তিনি ঠিকই বন্ধুদের চিঠিপত্র মারফত পেতে লাগলেন। বিপ্লবী ভ্রাতৃদ্বয় অরবিন্দ ও বারীন্দ্র ঘোষ দের বাগানবাড়িতে (মানিকতলা অঞ্চলের ৩২, মুরারিপুকুর রোড) তখন বোমা বানানোর তোড়জোড় চলছে। বোম্বাইয়ের লেখাপড়া আরবসাগরে জলাঞ্জলি দিয়ে উল্লাসকর আবার ভিড়ে গেলেন বিপ্লবী দলে। বিলেতি পোশাক ছেড়ে পরলেন দেশি ন হাতি ধূতি আর চাদর। শুরু করলেন একবেলা আহার আর যোগাভ্যাস, স্বেচ্ছায় বেছে নিলেন বিপ্লবীর কঠোর জীবন।

অপরদিকে পিতার কলেজের লাইব্রেরিতে রসায়ন বিষয়ক পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যবহার করতে থাকলেন কলেজ-ল্যাবরেটরি। লক্ষ্য আর স্বপ্ন একটাই- বোমা বানানো। বহু চেষ্টার পর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে উল্লাসকর ও হেমচন্দ্র দাস বোমা তৈরিতে সফল হন। ১৯০৮ এর ফেব্রুয়ারি মাসে বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ৫ জন বিপ্লবী দেওঘর এর পাহাড়ে যান। পরীক্ষার সময় এত বিকট শব্দে বোমাটি বিস্ফোরিত হয় যে, এতে যিনি বোমাটি ছুঁড়েছিলেন সেই প্রফুল্ল চক্রবর্তী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। গুরুতর আহত হন উল্লাসকর দত্ত, পরে গোপন চিকিৎসায় কলকাতায় তাকে সুস্থ করা হয়। পরের ইতিহাস অনেকেরই জানা। তবুও সংক্ষেপে বলছি - সফল বোমা পরীক্ষার প্রায় তিন মাস পর কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোডকে হত্যার জন্য বিহারের মজঃফরপুরে পাঠানো হয় ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকীকে। তারা উল্লাসকর দত্তের তৈরি করা বোমা সঙ্গে নিয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বোমা কিংসফোর্ডের গাড়ির বদলে অন্য ইংরেজের গাড়িতে পড়ে। পরের দিন ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি ধরা পড়ার আগে নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। ফাঁসি হয়ে যায় ক্ষুদিরামের (১১ই অগাস্ট ১৯০৮)। শুরু হয় ধরপাকড়। মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির কারখানা আবিস্কৃত হয়। অরবিন্দ, বারীন্দ্র, উল্লাসকর সহ ধরা পড়েন প্রায় সবাই। উল্লাসকরের ছোটবেলার দুই বন্ধু ধরণী সেনগুপ্ত ও নগেন সেনগুপ্ত, তারা থাকতেন কলকাতার ১৩৪, হ্যারিসন রোডে, আদি বাড়ি কালীকচ্ছ। ওনারা ওখানে কবিরাজী ব্যবসা করতেন, ধরা পড়লেন তারাও। অপরাধ, তাদের ঘরে বোমা তৈরির সরঞ্জাম রেখেছিলেন উল্লাসকর। আরও ধরা পড়েন উল্লাসকরের চার বছরের ছোট মামাত ভাই (মহেন্দ্র নন্দীর ছেলে) অশোক নন্দী। 

১৯০৮এর ১৯শে অক্টোবর ২৪ পরগণার জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট এর আদালতে যে মামলা উঠে ইতিহাসে তা আলীপুর বোমা মামলা নামে খ্যাত হয়। মজার বিষয় হলো ঐতিহাসিক এই মামলার বিচারক মি. বিচক্রফট ও আসামি অরবিন্দ ঘোষ কেম্ব্রিজে সহপাঠী ছিলেন এবং এক সাথে আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। অরবিন্দ সরকারি চাকুরিতে যোগদান না করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। মামলায় উল্লাসকর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। তবে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয়, নিরপরাধ প্রতিবেশী ধরণী ও নগেনকে বাচাঁনোর জন্য। ঐতিহাসিক আলীপুর বোমা মামলা র রায় বেরোয় ১৯০৯ এর ৬ই মে। ৩৬ জন আসামির মধ্যে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এর ফাঁসির আদেশ হয়। হেমচন্দ্র দাস ও অশোক নন্দীসহ ১৭ জনের বিভিন্ন মেয়াদে দ্বীপান্তর ও কারাদণ্ড হয়। অপরদিকে ১৭ জন বেকসুর খালাস পান (এর মধ্যে কালীকচ্ছের ধরণী ও নগেন ছিলেন)। কারাগারে অসুস্থতা হেতু মৃত্যুবরণ করেন ২১ বছরের টগবগে তরুণ কালীকচ্ছের অশোক নন্দী, তারিখটা ছিল ৬ই অগাস্ট ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ।

ফাঁসির আদেশ শোনার পর যে উল্লাসকর আদালতে দাঁড়িয়ে রবিঠাকুরের গান গেয়েছিলেন – “সার্থক জনম আমার জম্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে”। পরবর্তীকালে উল্লাসকর এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে অস্বীকৃতি জানান, তাঁর যুক্তি ছিল যে ইংরেজের আদালত মানি না সেই আদালতে কোন আপিল নয়। অবশেষে তার প্রিয় ঠাকুর মামা যাকে তিনি সবচে বেশি ভালোবাসতেন সেই মহেন্দ্র নন্দীর (শহীদ অশোক নন্দীর বাবা) অনুরোধে তিনি আপিলের কাগজে সই করেন। উচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসির আদেশ রদ করে উল্লাসকর ও বারীন্দ্রের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরাদেশ দেয়া হয় ১৯০৯ এর ২৩শে অগাস্ট।

শুরু হয় এক অন্যজীবন, আরও কষ্টের জীবন। কলকাতা থেকে প্রায় ছয়শ মাইল দূরে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ওখানকার সেলুলার জেলে পাঠানো হলো উল্লাসসহ দ্বীপান্তরপ্রাপ্ত অন্যদের। দশ ফুট বাই আট ফুট সেলে রাখা হলো একেক জনকে। কারাগারে থাকাকালীন ছিল কয়েদিদের খাটুনির নানা ব্যবস্থা - নারকেলের ছোবড়া থেকে দড়ি পাকানো, ঘানি চালিয়ে তেল নিষ্কাশন, বই বাধাঁই, ঝাড়ু তৈরি ইত্যাদি। একটি কলুর বলদ সারাদিন ঘানি ঘুরিয়ে যেখানে আটসের তেল বের করতে পারে সেখানে বিপ্লবী বন্দিদের বের করতে হতো এক মণ তেল। আবার আস্ত নারকেল ঘানিতে দিয়ে তেল বের করতে হতো, না পারলে কঠিন শাস্তি পেতে হতো। আর খাবার হিসেবে সকালে জুটতো দু হাতা কঞ্জি (কঞ্জি মানে গরম জলে চালগুড়ো সেদ্ধ)। দুপুরে এক বাটি ভাত, দুটো রুটি, অড়হর ডাল আর মাঝেমধ্যে কচুপাতার তরকারি।

প্রতিবাদী উল্লাসকর এহেন অন্যায় মেনে নেন নি, যথারীতি তিনি এর বিরুদ্ধে জেলে আন্দোলন শুরু করলেন এই বলে যে কোন পরিশ্রমের কাজ করবেন না। ফলে শাস্তি- অন্যত্র বদলি। আন্দামানেরই অন্য জেলে, আরও কষ্টের জায়গায়, ফলস্বরূপ তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লো। আলীপুর জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি অলীক স্বপ্ন দেখা বা হ্যালুসিনেশান নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এখানে এসে এই রোগ আরও বাড়ে। খিঁচুনিও দেখা দেয়। তাকে পাঠানো হলো মাদ্রাজের মানসিক স্বাস্থ্য নিবাসে। ওখানে চিকিৎসা চললো প্রায় ছয় বছর। প্রায় ১২ বছর কারাগারে কাটানোর পর মুক্তি মিলল উল্লাসকরের। সালটা ১৯২০। ফিরে এলেন কলকাতায়। হ্যারিসন রোডে একটি ঘি-এর দোকান খুললেন। একাই চালান, লোকসান দিয়ে কিছুদিন পর চলে এলেন জন্মগ্রাম কালীকচ্ছে। এখানে তাকে প্রতি সপ্তাহে একদিন সরাইল থানায় হাজিরা দিতে হয়। যে কারণে কলকাতা বা দূরে কোথাও যেতে পারেন না, বাড়িতেই থাকেন। নিজের তৈরি নৌকোতে ভেসে বেড়ান নদীতে। জন্মশিল্পী উল্লাসকর বাঁশি আর দোতারা বাজান, লোকে তন্ময় হয়ে শুনে। গ্রামের ছেলেরা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন তার কারাজীবনের কাহিনী শুনতে। অনুরোধ আসে কারাজীবনের ঘটনা নিয়ে বই লেখার। লিখে ফেলেন “আমার কারাজীবন” শীর্ষক বই, পরবর্তীকালে তিনিই যার ইংরেজি অনুবাদ করেন ’Twelve years of prison life’। থানায় হাজিরা দেওয়া বাতিল হওয়ায় তিনি আবার কলকাতা গেলেন। জেলে থাকাকালীন লীলার চিঠি পেতেন, অনেকদিন হয়ে গেছে লীলা লন্ডন চলে গেছেন, বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর লীলা লন্ডনে কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়ালেখা করেন। দেশে ফিরে মিরাট, লাহোরে চাকুরি করার পর এখন বোম্বেতে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরি করছেন। ছোটভাই সুখসাগর এর চিঠি থেকে এসব জেনেছেন উল্লাস। আবার ভাই সুখসাগরের চিঠি থেকেই জানলেন, লীলার বিয়ে হয়ে গেছে। স্তব্দ হয়ে গেলেন, মন থেকে তিনি এ বিয়ে কিছুতেই মেনে নিলেন না। 

এরপর বোম্বেতে লীলার সাথে দেখা করতে গেলেন, লীলার সামনে আগুন দিয়ে তার সব চিঠি পুড়িয়ে ধূতির খুঁটে ছাই বেঁধে আবার ফিরলেন কালীকচ্ছে। একাকী নিঃসঙ্গ উল্লাসকর, বাবা-মা কুমিল্লায়। দাদা মোহিনীমোহন কলকাতায়। ছোট ভাই সুখসাগর আর ছোটবোন লাবণ্যকেশী ওরফে পুঁটুরানী তিনি জেলে থাকাকালীন মারা গেছে। উল্লাসের সঙ্গী এখন দোতারা, বাঁশি আর ভিরমি খাওয়া (যে রোগে প্রচন্ড ব্যথায় তিনি অজ্ঞান হয়ে যান এবং মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়)।

আবার একটি চিঠি মনে পড়াল প্রেয়সী লীলাকে, তাঁর লীলা বিধবা হয়েছে। আর কালীকচ্ছে মন টিকল না, আবার এলেন কলকাতা, ইতিমধ্যে দেশভাগ হয়েছে।  অথচও আজন্ম বিপ্লবী তিনি, স্বভাবতই দেশভাগ তথা বাংলাভাগ মেনে নিলেন না, সেই সময়ে পশ্চিমবাংলায় শরণার্থীর স্রোত তাকে ভীষণ কষ্ট দিল। তিনি ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভাতা প্রত্যাখ্যান করলেন।
ইতিমধ্যে উল্লাসকরের জীবনে ঘটে গেছে আর এক বিরাট ঘটনা, পক্ষাঘাতগ্রস্থ বিধবা লীলাকে ব্রাহ্মমতে বিয়ে করলেন তিনি, মর্যাদা দিলেন স্ত্রীর, স্বীকৃতি পেল তাঁদের ভালোবাসা। তখন তাঁদের বয়স ছেষট্টি প্রায়, চালচুলোহীন অসুস্থ দুজনের তখন আর কোলকাতায় থাকার কোন সংস্থান নেই। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের কোন একসমযে তাঁরা পাড়ি জমালেন আসামের শিলচর এ। ওখানে তাঁরা ছিলেন প্রেমাঞ্জন (লীলার বৈমাত্রেয় ভাই) এর মেয়ে কল্যাণীর কাছে, শিলচরে চলে যাবার পর উল্লাসকর জীবিত ছিলেন আরও তের-চৌদ্দ বছর। থেকেছেন শিলচরের বিভিন্ন জায়গায়। প্রথমে পদ্মনগরে। পরে নাজিরপট্টির পপুলার হোটেলে, তারাপুরে, জেল রোডে। তাদের ঐসময়ের জীবনযাপনের কাহিনী আজও আমাদের অজানা, আসলে দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দে তদানীন্তন নেতৃবর্গ ভুলেই গেছেন এহেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের, উল্লাসকর তাঁর অন্যথা হবেন কেন? পরবর্তীকালে সহধর্মিণী লীলা পাল ইহলীলা সংবরণ করেন ১৯৬২তে। শিলচরে থাকাকালীন কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের কোন আর্থিক সাহায্য বা পুনর্বাসন ব্যবস্থা উল্লাসকর বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন - “I don’t want any help from any government”, কাঙিক্ষত স্বাধীনতা না পাওয়ায় বার বার তিনি আক্ষেপ করেছেন, স্বাধীনতার নামে দেশভাগ তার কাম্য ছিল না। দেশভাগের জন্য যারা দায়ী তাদের তিনি দেশদ্রোহী মনে করতেন। শিলচরে ১৭ই মে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ৮০ বছর বয়সে ভারতমাতার এই দামাল ছেলেটির জীবনাবসান হয়। উল্লাসকর দত্তের নামে শিলচরে একটি রাস্তার নাম থাকলেও আমাদের কল্লোলিনী কলকাতায় তাঁর নামে কোনও রাস্তা বা স্মারক নেই। বাঙালী হিসাবে যা সত্যিই আমাদের গর্বের বিষয়? সদা জাগুরুক বাঙালী বুদ্ধিজীবী সমাজ এই বিষয়ে একবার ভেবে দেখবেন কি?


তথ্য সুত্র – বিভিন্ন্য পত্র পত্রিকা, সর্বোপরি গুগুল।

Thursday 11 May 2017

বুরহান ওয়ানির মৃত্যুতে যদি কাশ্মীর উত্তাল হতে পারে, তাহলে উমর ফায়াজে’র মৃত্যুতে নয় কেন?



বুরহান ওয়ানির মৃত্যুতে যদি কাশ্মীর উত্তাল হতে পারে, তাহলে উমর ফায়াজে’র মৃত্যুতে নয় কেন?

এই প্রশ্নটা গত কয়েকদিন ধরে আমার মনকে কুরে কুরে খাচ্ছে, অথচও হিসাবটা মেলাতে পারছিনা। হ্যাঁ আমি জঙ্গিদের গুলিতে নিহত কাশ্মীরের তরুণ সেনা অফিসার উমর ফায়াজ পারি’র (২২) কথাই বলছি। গত ডিসেম্বর মাসেই সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাম জেলার এই যুবক, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর প্রথমবার ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন, আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে। অথচও সেই প্রথম ছুটিই হল তাঁর জীবনের শেষ ছুটি, বিয়ের অনুষ্ঠান পরিণত হল তাঁর শবযাত্রায়।

সংক্ষেপে একটু জেনে নি এই উমর ফায়াজ পারি’র কথা, দপড়াশোনা দক্ষিণ কাশ্মীরের নবোদয় বিদ্যালয়ে, তারপর পুণের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে(এনডিএ)। পড়াশোনায় যথেষ্ট মেধাবী তাঁর সাথে খেলাধুলোতেও দক্ষ ছিলেন উমর। অর্থাৎ একজন গুণী, সফল মানুষের সব গুণই ছিল তাঁর মধ্যে, সেনাবাহিনীতেও তিনি অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বুরহান ওয়ানির মতো কোনও একজন আজাদির সিপাহীর বুলেটে শেষ হয়ে গেলো এই প্রতিভাময় কাশ্মিরির জীবন।

না এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, কারণ, সোপিয়ান, কুলগামের মতো এলাকায় অশিক্ষা, বেকারত্ব’র সংখ্যা অনেক বেশি। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে, ভারত বিরোধী জেহাদে অংশগ্রহণ করছে, পাথর ছুড়ছে। বুরহান ওয়ানি তাদের কাছে ‘হিরো’, আজাদির সিপাহী। আর সেখানে উমর ফায়াজরা ব্যাতিক্রমি হলেও দেশদ্রোহী ছাড়া আর কিছুই নয়। হয়তো সেখানকার প্রত্যেক বাবা-মায়েরাই চান তাদের সন্তান উমরের মতো সফল হোক, কোন বাবা মা আর চাইবেন তাঁদের সন্তান বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করে সেনাবাহিনী বা পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাক, এই ব্যাপারে যতই তাদের মনে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকুক না কেন, আমি নিশ্চিত তাঁরা তাঁদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কোথাই চিন্তা করে থাকবেন। আর এই বিষয়টা তথাকথিত আজাদির সিপাহীরা বেশ ভাল করেই জানত। তাই তারা উমর ফায়াজকে খুন করে ওই এলাকার মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল- ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ফল কি হতে পারে।

হতে পারে সাময়িক জয় এই বিচ্ছিনতাবাদিদের হল, কিন্তু এটা তো ঠিক আজ কাশ্মীরের মানুষ প্রকৃত উন্নয়ন চায়, শিক্ষা চায়, কর্মসংস্থান চায়। এবার সমস্যা হল যারা কাশ্মীরকে অশান্ত করে রাখতে চায় তারা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে এলাকায় কোনও রকমের উন্নয়ন না হয়, প্রতিনিয়ত অশান্তি্‌হিংসার বীজ বপন করে চলেছে, ক্রমাগত সাধারণ মানুষের মনে বিষ ঢেলে চলেছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে যাতে নিরাপত্তা বাহিনী, সরকারি কর্মীদের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ঘৃণা তৈরি হয়, তাঁরা আক্রমণ, আঘাত করে বসেন তাঁদের। আসলে তারা কাশ্মীরীদের মেকি ভাবাবেগের কথা, ঝুটা আজাদির কথা বলে নাপাক পাকিস্থানের মদতে জেহাদের আগুন জ্বালিয়ে চলেছে। দুরভাগ্যের কথা দেশের কিছু আস্তিনের সাপ, মিডিয়া তথা বুদ্ধিজীবী মহল এতে মদত জুগিয়ে চলেছে। 

এখন এটাই এখন দেখার আগামী দিনে ভূস্বর্গ উমর ফায়াজের মৃত্যু নিয়ে সরব হয় কিনা? ঠিক যেমনটা আমরা লক্ষ্য করেছিলাম কাশ্মীরের ‘গ্ল্যামার বয়’ সন্ত্রাসবাদী বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর হয়েছিলো। আজ যদি ভারতীয় সেনার কাছে বুরহান ওয়ানি যদি আত্মসমর্পন করত, তাহলে তার স্বযত্নে নির্মিত ভাবমূর্তি ধাক্কা খেত বা তাকে নিয়ে যে রোমান্টিক জীবনযুদ্ধের কাহিনী তৈরি হয়েছে তার বদলে হয়ত তাকে দু’তরফের দালাল বলে বিতর্ক শুরু হত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেরকম কিছু না হওয়ায় কাশ্মীরের কট্টরপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এবং অল পার্টি হুরিয়ত কনফারেন্সের সহযোদ্ধারা আর একটি সুযোগ পেয়ে গেলো। এই বেশ কিছু দিন ধরে আমরা দেখেছি বুরহান ওয়ানিকে একজন রাজনৈতিক নেতা তথা মহান বিপ্লবীর আদর্শ হিসেবে তুলে ধরার মতলবি প্রচেষ্টা করে চলেছে কিছু বিক্রীত ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। ফলস্বরূপ প্রায় শান্ত হয়ে আসা কাশ্মীর উপত্যকা ফের রূপান্তরিত হল কান্নার উপত্যকায়, পুলিশ, সেনাবাহিনীর পাল্টা প্রতিরোধে, গুলিতে কতজন বিক্ষোভকারী প্রাণ হারালেন? এর দায় কি গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী বিক্রীত এবং বিকৃত সংবাদমাধ্যমের উপর চাপালে খুব অন্যায় হবে? যারা মিথ্যা ‘আজাদি’র ধুয়ো তুলে তলে তলে পাকিস্থানের সাথে যুক্ত হবার স্বপ্ন দেখার জন্যে, নিজেদের ব্যাবসায়িক আখের গোছানর স্বার্থে বলি দিয়েছিল আম কাশ্মীরী জনগণকে। 

এখন এটাই দেখার আগামী দিনে এই মেকি সংবাদমাধ্যম উমর ফায়াজের মৃত্যু নিয়ে কতটা সরব হয়, দেশের সম্মানীয় ‘বুদ্ধিজীবী’ মহল, উমর খালিদ-কানাইয়া কুমারের মতো মহান বিপ্লবীরা কোনও প্রতিবাদ সভা করেন কি না। আর যদি না করেন তাহলে তাঁদের পাকিস্থানের পা চাঁটা কুত্তা বললে কি খুব ভুল হবে?