Wednesday 17 May 2017

স্মরণে চারণকবি মুকুন্দ দাস


স্মরণে চারণকবি মুকুন্দ দাস

“ছল চাতুরী কপটতা মেকী মাল আর চলবে ক’দিন?
হাড়ি মুচির চোখ খুলেছে, দেশের কি আর আছে সেদিন।।
খেতাবধারী হোমরা চোমরা, নেতা বলেই মানতে হবে,
মনুষ্যত্ব থাক কি না থাক, তাঁর হুকুমেই চলবে সবে।
সত্যকে পায়ে দলবি তোরা আসন চাইবি বিশ্বজোড়া ।
হবে না তা নবীন যুগে হোস না তোরা যতই প্রবীণ।“

অথবা “হাসি হাসি পরবো ফাঁসী, দেখবে জগৎ বাসী, বিদায় দে মা ঘুরে আসি” – ব্রিটিশ বিরোধী এরকমই অসংখ্য গণসংগীতের অমর স্রস্টা যিনি, তিনি চারণকবি মুকুন্দ দাস। একদিন তাঁর রচিত গানেই উত্তাল হয়ে উঠেছিলো আসমুদ্র হিমাচল, দেশমায়ের শৃঙ্খল মোচনে পথে নেমেছিল অসংখ্য মানুষ। আজও কি তাঁর গান আমাদের রক্তে জ্বালা ধরায় না, হ্যাঁ আজও তাঁর গান সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক মুক্ত চিন্তার মানুষের কাছে। আজ ১৮ই মে তাঁর প্রয়াণ দিবস (১৯৩৪ সালে ১৮ই মে তাঁর প্রয়াণ দিবস), আসুন ইতিহাসের সরণী বেয়ে জেনে নি তাঁর কথা।

আগেই বলে রাখি তাঁর আসল নাম মুকুন্দ দাস নয়, পিতা গুরুদয়াল দে তাঁর নাম রেখেছিলেন যজ্ঞেশ্বর দে, ডাক নাম যজ্ঞা।বাবা গুরুদয়াল দে সরকারি অফিসের এক সামান্য কর্মচারীর কাজ করার পাশাপাশি একটি মুদিদোকান চালিয়ে সংসার নির্বাহ করতেন কোনোভাবে। ছোট থেকেই পড়ালেখায় মন ছিল না যজ্ঞেশর ওরফে মুকুন্দ দাসের। বাবা তাকে জোর করে দোকানদারিতে বসিয়ে দিয়েছিলেন। এমন সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় বীরেশ্বর গুপ্তের গানের দলের সঙ্গে, যুক্ত হন ওই দলের প্রধান সহায়ক হিসেবে। শুরুতে কেবল কীর্তনে বেশি ঝোঁক থাকায় কীর্তন চর্চায় বেশি মনোযোগী ছিলেন ফলে কীর্তনিয়া হিসাবে নামডাকও ছঢ়িয়ে যায় দ্রুত। এছাড়া কীর্তন গানের পাশাপাশি নিজে গান লিখে গাইতে শুরু করেছিলেন। এভাবেই বেড়ে ওঠা মুকুন্দ দাসের, যদিও তখনো ‘মুকুন্দ’ নাম প্রচারিত হয়নি, সবাই ডাকে ‘যজ্ঞা’ বলেই।

কীর্তনের আসরে ডাক পড়ে যজ্ঞার আবার গানের আসরেও ডাক পড়ে। এর মধ্যেই ১৯০০ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন সুভাষিণী দেবীকে। এর পরপরই রামানন্দ ঠাকুরের কাছে দীক্ষা গ্রহণ। তিনিই তার নাম রাখেন মুকুন্দ দাস। সেই সঙ্গে নিজে ঢংয়ে গান, কবিতা, যাত্রাপালার ভেতরে ঢুকে যান আরও। ১৯০৩ সালে বরিশাল আদর্শ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই, নাম - ‘সাধনসঙ্গীত’। সেটি উৎর্সগ করেন গুরু রামানন্দকে। যোগাযোগ হয় নামীদামি স্বদেশি চেতনার সাহিত্য -সংগীত আসরে। এ সময় থেকে মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গুরু- শিষ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়, স্বাদেশিকতার চর্চাও এখান থেকে শুরু হয় এবং মুকুন্দ দাস ক্রমেই বৈষ্ণব ধারণা থেকে সরে আসতে থাকেন।

১৯০৪ সালের দিকে কালিসাধক সনাতন চক্রবর্তী ওরফে সোনাঠাকুর দ্বারা প্রভাবিত হন মুকুন্দ দাস। ১৯০৫ সালে রচনা করেন প্রথম পালাযাত্রা মাতৃপুজা, যাত্রার মধ্য দিয়ে স্বদেশি আন্দোলনের ধারাকে আরও জাগরিত করেন। ওই যাত্রাপালার পান্ডুলিপি বাজেয়াপ্ত করে তৎকালীন পুলিশ। যাত্রাদল গড়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে থাকেন তিনি। মুকুন্দ দাসের যাত্রাপালা ও গান তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার অভিযোগে  তৎকালীন ইংরেজ সরকার এই পালা রচনা ও প্রচারের জন্য মুকুন্দ দাসকে প্রেপ্তার কর এবং সরকার মাতৃপূজা নাটকটি বাজেয়াপ্ত করে। বিচারে মুকুন্দ দাসের তিন বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়। কিছু দিন বরিশাল জেলে রাখার পর মুকুন্দ দাসকে দিল্লি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। মুকুন্দ দাস কারাবসে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী সুভাষিণী দেবীর মৃত্যু হয়, তিন বছর পর জেল থেকে মুক্তিলাভের পর মুকুন্দ দাস বরিশালে ফিরে আসেন। এ সময় চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় নতুন করে যাত্রার দল গঠনে উদ্যোগী হন এবং পুনরায় পালা রচনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯১৬ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আমন্ত্রণে মুকুন্দ দাস তার যাত্রার দল নিয়ে কলকাতা আসেন, সেবার কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে যাত্রা দলের অভিনয় হয়। মহাত্মা গান্ধীর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস মাতৃপূজা কর্মক্ষেত্র, পল্লীসেবা প্রভৃতি যাত্রাপালা রচনা করেন। এছাড়াও মুকুন্দদাসের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - সমাজ, আদর্শ, পল্লীসেবা, সাথী, কর্মক্ষেত্র, ব্রহ্মচারিণী, পথ ইত্যাদি। মুকুন্দ দাস কলিকাতা থাকাকালে একবার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সঙ্গে দেখা করেন, তখন তিনি তাকে গান গেয়ে শোনান ও তার লেখা কয়েকটি বই উপহার দেন। পরবর্তীকালে তিনি বরিশালের কাশীপুর কালীমন্দিরের জায়গা কেনেন, যা এখন বরিশাল শহরে ঢোকার মুখে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল-সংলগ্ন কালীবাড়িটি চারণকবি মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি বলে পরিচিত।  

ভারত মাতার এই সুযোগ্য সন্তান ১৯৩৪ সালের ১৮ মে কলকাতায় যাত্রা পরিবেশন করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে অবসান হয় বৈপ্লবিক গানের, গণনাট্যের একটি অমুল্য অধ্যায়, তাঁর রচিত একটি গান দিয়েই শেষ করছি লেখাটি - 

“ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে,
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।।
তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।
দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী,
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।।
সাজ রে সন্তান হিন্দু মুসলমান
থাকে থাকিবে প্রাণ না হয় যাইবে প্রাণ।।
লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়ান,
নিতে হয় মুকুন্দে-রে নিও রে সঙ্গে।।“

তবে মুকুন্দ দাসের মতো স্বাধীনতার পূজারির মৃত্যু হয় না, দেশ ও সমাজ যখনই পীড়নের মুখোমুখি হয়েছে, তখনই মুকন্দ দাসেরা এসেছে আর আসবেও, উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠবে - ‘আয়রে বাঙালি/আয় সেজে আয়/ আয় লেগে যাই দেশের কাজে’। ভারত মাতার কাছে এটাই আর্তি মা পাঠাও তোমার অগ্নিযুগের সেই দামাল ছেলেদের যারা আর একবার ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে এই মেকী, ভরংবাজিতে পরিপূর্ণ এই সমাজ, গড়ে তুলবে স্বপ্নের অখণ্ড, ঐক্যবদ্ধ ভারত। জয় ভারতমাতা, বন্দেমাতরম। 

(লেখায় যদি কিছু ভুল ভ্রান্তি থেকে যায় তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত, আশা করি পাঠক নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন)

তথ্য সুত্র – বিভিন্ন্য পত্র পত্রিকা, সর্বোপরি গুগুল।

No comments:

Post a Comment