Thursday 29 September 2016

তর্পণ কি?





তর্পণ কি?

ভারতকোষ অনুযায়ী “ জলের দ্বারা কৃত পিতৃপুরুষ এবং দেবতাদের তৃপ্তি বিধায়ক একটি অনুষ্ঠান”, একে অনেকে পিতৃযজ্ঞও বলে থাকেন। এই যজ্ঞ অনুষ্ঠানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু,শিব প্রমুখ দেবতা, সনক-সনন্দ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সপ্তর্ষি, চতুর্দশ যম ও দ্বাদশ পূর্বপুরুষ (পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধপ্রমাতামহ, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতামহী, প্রমাতামহী ও বৃদ্ধপ্রমাতামহী) এবং ত্রিভুবনের উদ্দেশ্যে জল দেওয়া হয়। পিতৃপক্ষের সময় তিলতর্পণ অনুষ্ঠিত হয়,  অর্থাৎ তিল-মেশানো জলে তর্পণ হয়। তর্পণ শাস্ত্রমতে নিত্যকর্তব্য, তবে আজকের এই জেট যুগে রোজ বাপ-ঠাকুরদাদের স্মরণ করা সম্ভব হয় না বলে, লোকে পিতৃপক্ষে এবং বিশেষ করে - সর্বপিতৃ অমাবস্যায় (যে দিনটিকে আমরা ‘মহালয়া’ বলে থাকি) তিলতর্পণ করেই পিতৃকৃত্য সেরে থাকে।

এই সম্পর্কে একটি সুন্দর গল্প আছে – মহাভারতের যুদ্ধের সময়ে মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে খাবারের পরিবর্তে তাঁকে শুদুই খেতে দেওয়া হল সোনা, আর অনেকরকমের ধনরত্ন। কর্ণ অবাক হয়ে এর কারন জিজ্ঞেস করেন ইন্দ্রকে (মতান্তরে যমরাজকে)। তখন ইন্দ্র তাঁকে বললেন – দেখ বাপু তুমি তো সারাজীবন শুধু সোনাদানা মানে ধনরত্ন বিলিয়েছ, পিতৃ পুরুষকে জল দাওনি, তাই তোমার জন্যে এই ব্যবস্থা। তখন মহাবীর কর্ণ বললেন – “এতে আমার কি দোষ? আমি তো আমার প্রকৃত পিতৃ পুরুষের কথা জানতে পারলাম এই সেদিন। এর আগে তো অধিরথকেই নিজের পিতা বলে জানতাম। যুদ্ধ শুরুর আগেরদিন রাতে মাতা কুন্তী এসে বললেন আমি নাকি তাঁর ছেলে, শ্রীকৃষ্ণও তাঁহাই বললেন। পরবর্তী কালে যুদ্ধে নিজের ভাইয়ের হাতেই মরতে হল, পিতৃ তর্পণের আর সুযোগ বা সময় পেলাম কই? ইন্দ্র বুজতে পারলেন এতে কর্ণের কোন দোষ নেই। তাই তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্যে মর্ত্যলোকে ফিরে জাবার অনুমতি দিলেন আর বললেন এই এক পক্ষকাল তিনি যেন মর্ত্যলোকে অবস্থান করে পিতৃ পুরুষকে জল দেন, এতেই তাঁর পাপস্খালন হবে। যে পক্ষকাল কর্ণ মর্ত্যে এসে পিতৃপুরুষকে জল দিলেন সেই পক্ষটি পরিচিত হল পিতৃপক্ষ নামে। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষের সূচনা হয়। হিন্দু মতে, এই সময় আমাদের স্বর্গত পিতৃপুরুষগণ স্বর্গলোক ছেড়ে নেমে আসেন মর্ত্যলোকে, এই সময় প্রথম পক্ষেই হিন্দুদের পিতৃতর্পণ করতে হয়। মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা।

আমার মহালয়া


আমার মহালয়া

নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের পাল দেখলেই আমার মনে পরে যেত পুজো এসে গেছে, আর দেরি নেই শারদ উৎসবের। আমার জীবনের সুখের স্মৃতির অন্যতম শারদীয় দিনগুলো, সাত সকালে অফিসে বসে কাঁচের ওপারের শহর দেখতে দেখতে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেলো, ধুসস নিকুচি করেছে কাজের, খালি স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠছে ফেলে আসা সময়ের জলছবি, এমন দিনে কি কাজ ভালো লাগে? তাই ভাবলাম মনের কথা খুলে বলার এই মঞ্চে আমিও অবতীর্ণ হয়ে তুলে ধরি আমার কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা।

পুজোর স্মৃতি মানেই মহালয়ার দিন ভোর ভোর উঠে পরে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ শোনা। পুজোর কাউন্তডাউন শুরু হয়ে যেত মহালয়া থেকেই। বাবাকে দেখতাম মহালয়ার আগের দিন থেকেই রেডিও ঠিক থাক করে, নতুন ব্যাটারি ভরে সব রেডি করে রাখতে, যাতে কোন অসুবিধা না হয়। মহালয়া শুরু হলেই বাবা ডেকে দিতেন – বাবাই উঠে পর, মহালয়া শুনবি না? আমিও ঘুম কাটানোর কঠিন জেদ নিয়ে কোনমতে উঠে ঠাকুর নমস্কার করে আবার ধপাস করে শুয়ে পড়তাম। আধো ঘুম আর জাগার মধ্যে কানে ভেসে আসতো তব অচিন্ত্য রূপ-চরিত-মহিমা, নব শোভা, নব ধ্যান রূপায়িত প্রতিমা। শুনতাম আবার মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়তাম আবার কানে ভেসে আসতো বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো রে ভুবন। মা ঠাকুর ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলতো বাবু শুনছিস না ঘুমাচ্ছিস? আবার জেগে উঠে শুনতাম যখন, তখন রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি শেষ হয়ে  বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই উদাত্ত আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে শেষ গানে শান্তি দিলে ভরি দুখ রজনী। তখন মনে হতো এর চেয়ে সুন্দর ভোরের রুপ যেন আর হতে পারে না। আজ প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো বাবাকে হারিয়েছি, বাবার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে রেডিও তে মহালয়া শোনা। এখন তো মোবাইলে সব সময় ভরা থাকে মহিষাসুরমর্দিনীর এমপিথ্রি, যখন ইচ্ছে শুনলেই হয় কিন্তু সেই টান আর অনুভব করি না। খুব মনে পরে যায় ছোটবেলায় মহালয়ার দিন আমাদের বাড়ীর কাছের বাগানে একটা শিউলি গাছ ছিল, ওখানে শিউলি ফুল কুড়োতে যেতাম আরও বন্ধুদের সাথে, আমার মনে হতো রাতের সব তারা মাটিতে বিছিয়ে আছে। যখন শিউলি ফুল কুড়িয়ে জড়ো করতাম আর সুন্দর মিষ্টি গন্ধে মন ভরে যেত আর মনে হত হ্যাঁ সত্যি এবারে পুজো আর বেশি দেরি নেই। শিউলি ফুল কোড়াতে কয়েকটি মেয়েও আসতো, তাঁর মধ্যে একজন কে দেখলে আমার হার্টবিট বেড়ে যেত, মন ভাল হয়ে যেত। কে জানে শৈশবের সেই প্রথম প্রেম আজ কোথায়?   

ফুল কুড়িয়ে মাথে বসে খুব গল্প হতো এবারে পুজোতে কার কটা জামা, প্যান্ট হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি, কত কথা কথার যেন শেষ ছিল না –

“ভাই মহালয়া শুনলি?”
“হ্যাঁ ভাই, তুই পুরো শুনেছিলি না গুল দিচ্ছিস?”
“না রে ভাই মা দুর্গার দিব্বি পুরোটা শুনেছি”
“আচ্ছা, শোন এবারে তুই কি নতুন বন্দুক কিনলি?”
“হ্যাঁ ভাই, বাবা হেবি একটা বন্দুক এনেছে, আর ক্যাপ জানিসই তো সেই সিংহ মার্কা, যা আওয়াজ হচ্ছে, কি বলবো!”
“রোদে দিয়ে দিস ভাই, বিকালে মাঠে বসে ফাটাবো”
“ঠিক আছে রে ভাই, এখন যাই। মা লুচি ভাজছে, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে জোর বকুনি খাবো।“

আজ বড্ড বেশি করে “পুরানো সেই দিনের কথা” মনে পড়ছে, ছোটবেলার সেই বন্ধুরা সব কে কোথায়? অনেকের সাথেই যোগাযোগ নেই, কেউ বিয়ে করে শহিদ আবার কেউ হারিয়ে গেছে কোন কারণ ছাড়াই। আর একবার যদি ফিরে যেতে পারতাম ছোট বেলায় - “আবার দেখা যদি হল সখা, প্রানের মাঝে আয়”, জানিনা আবার কোনোদিন দেখা হবে কিনা? মহালয়ায় আমার বড় প্রাপ্তি একবার বাবার সাথে গঙ্গার ঘাটে যাওয়া, সেইবার বাবা ঠিক করেছিলেন তর্পণ করবেন তাই খুব ভোর ভোর আবার সাথে সাইকেলে করে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। পুবের আকাশে সবে একটু রঙ লেগেছে, পাখিদের কিচির মিছির একটু একটু করে শোনা যাচ্ছে, রাস্তার লাইট পোস্টের ডুম গুলো তখনও জ্বলছিল। বাবার সাথে বকবক করতে করতে কখন যে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে গেছিলাম মনেই ছিল না। বাবা বলেছিল – তুই এখানে চুপ করে বস, আমি জামা কাপড় ছেড়ে ধুতি পরে নি, আর ঠাকুর মশাই কে দেখি গিয়ে। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বসে দেখেছিলাম কি অপূর্ব শোভা ভোরের গঙ্গার ঘাটের। একটু দূরে বাবা আর কয়েকজন কোমর অবধি জলে দাঁড়িয়ে দু হাত বাড়িয়ে তর্পণ করছে - নমঃ ব্রহ্ম তৃপ্যতাম্ নমঃ বিষ্ণু স্তৃপ্যতাম্ নমঃ রুদ্র স্তৃপ্যতাম্ নমঃ প্রজাপতি স্তৃপ্যতাম্। বিষ্ণুরোম্ কাশ্যপ ... গোত্রঃ পিতঃ ... দেবশর্ম্মা তৃপ্যতামেতৎ সতিল গঙ্গোদকং তস্মৈ স্বধা। ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতা হি পরমন্তপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়তে সর্ব্ব দেবতাঃ। একটু বাদে বাবা উঠে এসে গা হাত মুছে জামা কাপড় পরে নিয়ে বলেছিলেন – নে চল দেরি হয়ে গেলো, তোর বোধহয় খিদে পেয়ে গেছে? আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম না না আমার খিদে পাই নি, জানো খুব সুন্দর লাগছে, গঙ্গার ঘাটটা আজ খুব ভালো লাগছে। আর একটু বসি না বাবা?

বাবা হেঁসে বলেছিলেন – ঠিক আছে কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, মা চিন্তা করবে। তারপর বলেছিলেন – নে তুই দেখে নিলি এবারে আমি মারা গেলে এইভাবেই এসে তর্পণ করিস। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল, গলার কাছে একটা কান্না ডলা পাকিয়ে গেছিলো। বলেছিলাম – ধুসস বাজে কথা বোলো না, তুমি সব সময় আমার কাছেই থাকবে। বাবা মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন – পাগল বাবা মা কি চিরদিন কার থাকে? কোন কথা না বলে বাবা কে জড়িয়ে ধরে ছিলাম। ফিরে আসার সময় কথা বলতে পারিনি। বাবা বোধহয় বুজতে পেরেছিল আমার মনের কষ্টটা, তাই এটা ওটা অনেক কথা বলে মন হালকা করতে চেয়েছিল, শেষে গরম জিলিপির উপহারও দিয়েছিল, কিন্তু মনের কোনে কষ্টটা রয়ে গিয়েছিলো সারা জীবন। আজ যখন বাবা নেই তখন মাঝে মাঝেই কষ্টটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। আজ মহালয়ার দিনে বাবাকে খুব মিস করি। রেডিও তে মহালয়া শোনা, তারপর একসাথে বসে লুচি তরকারি খাওয়া সব কিছুই? সময়ের পাকেচক্রেই হক বা পারিপার্শ্বিক কারনেই হক তর্পণ আমার হয়ে ওঠেনি একবারও, মনের কোনে অনুতাপের আগুন জ্বলে আজও। শারদ উৎসব কেন জানিনা আজ কেমন ফিকে হয়ে গেছে, আনন্দ উৎসব, মজার মাঝে আমি খুঁজে ফিরি আমার ছোটবেলা কে, পুরনো বন্ধুদের, হাত বাড়িয়ে ধরতে চাই বাবার সেই হাতটা কে, ওটা যে বড় ভরসার হাত ছিল আমার। বাবারা বোধহয় সবাই বটগাছ, সন্তানের মাথায় নিশ্চয়তার ছায়া দেয়, হঠাৎ করে সরে গেলে এমনই ফাঁকা লাগে।

আমার কাছে মহালয়া আজও টিকে আছে এই ভাবেই, হয়ত সারাজীবন এইভাবেই রেডিও, আকাশবাণী, আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠস্বরে খুঁজে পাব আমার মহালয়াকে। কখনও বা শারদীয় শুকতারা, আনন্দমেলার মাঝে খুঁজে বেড়াই ছোটবেলার স্মৃতিকে। কারন আজকের এই ইদুর দৌড়ের যুগে, স্মৃতিই হয়তো সব থেকে বেশি আপন আর নিজেকে পাওয়ার আনন্দ দেয়।      

উরি হামলা ও আমার দেশপ্রেম






উরি হামলা ও আমার দেশপ্রেম

কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া উরি হামলাকে কেন্দ্র করে আপামোর ভারতবর্ষ উত্তাল, আর আমরা দেশভক্ত বাঙ্গালীরা তো আরও কয়েক কদম এগিয়ে। সাধে কি মহামতি গোখলে বলেছিলেন – “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow”, তিনি আমাদের একদম ঠিক চিনেছিলেন। এই মুহূর্তে উরি থেকে আমার দূরত্ব প্রায় ২৩৯৫ কিলোমিটার, নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে, ফ্যানের তলায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সোশ্যাল মিডিয়াতে খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতেই পারি আমরা। আর কাশ্মীর, এলওসি নিয়ে কথা বলবার হক আমাদের বাঙ্গালীদের আলবাত আছে, ফি বছর গলায়  ডিএসএলআর ঝুলিয়ে কত্ত কাশ্মীর ঘুরেছি আমরা, ডাল লেকে শিকারার সামনে সেলফি তুলেছি, লেহ লাধাখে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে শরীরের সব রক্ত স্ফুটনাঙ্ক ছাড়িয়ে টগবগ করে যখন ফুটেছিল, তখন যুদ্ধ, আর্মি এসব নিয়ে নরম গরম কথা বলতেই পারি। কারন আমরা নিরাপদ – কোন মর্টারের গোলা, বুলেট নিদেন পক্ষে ছররাও আমায় স্পর্শ করতে পারবে না।

সুতরাং অতঃকিম – সোশ্যাল মিডিয়াতে, গরমাগরম লেখা পোস্ট, হোয়াটসঅ্যাপে প্রোফাইল পিকচারে জলন্ত মোমবাতির ছবি, ট্রেনে বাসে পাকিস্থানের বাপের মুণ্ডপাত করি আমরা। অমুক জায়গার অই ছেলেটা উরিতে শহীদ হয়েছে রে!! কি ভাগ্য বল? দেশের জন্নে দেহত্যাগ, উফফ আমাদের দেশের গববো রে! কিন্তু ভেবে দেখেছি কি? কোনদিন সত্যিই যদি দেশের জন্নে যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার ডাক আসে সেদিন কি বীরদর্পে এগিয়ে যাব? না মনে হয়! নিদেনপক্ষে নিজের পরিবারের লোককেও পাঠাবোনা। এসবের জন্নে অন্য কেউ এগিয়ে আসুক, আরে মরলে পরে তাঁর জন্নে শহীদ বেদী তৈরি করার জন্নে তো আমরা আছি, “ক্ষতিপুরন” দিতে, সকাল বিকেল চোঁয়াচোঁয়া ঢেঁকুর তুলে পাকিস্থানের মা বাপ তুলে খিস্তি মারতে। অথচও আজ যদি সীমান্তে যুদ্ধরত সৈনিকদের জন্নে রক্তের প্রয়োজন হয় পারব কি একটু রক্ত দিতে? তাঁর থেকে শহীদের মিথের বঁটিতে কচুকাটা হক ভারতের সৈন্যরা, আর আমরা তাঁদের কফিন মুড়ে দি জাতীয় পতাকায়, কোন রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় ঢুকে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে বলে আসি – ওগো তোমরা কাঁদছ কেন? তোমাদের ছেলেতো শহীদ হয়েছে, কত বড় ভাগ্য তোমাদের। আমাদের হক্কলের গববো আজ তোমাদের ছেলে, ভাই, বাবা। ইসস কত বীর সন্তানের মা বাবা এনারা। তারপর ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বার করে একটু গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে দাওয়ায় বসে, ক্যামেরার সামনে হাসি হাসি মুখে বাইট দিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবি – হারামির বাচ্চা পাকিস্থানিগুলো কে শায়েস্তা করতে আরও সৈন্য পাঠানো হবে না, সিন্ধু জল চুক্তি বাতিল করে দেবো না মোস্ট ফেভারদ নেশনের তকমাটা কেড়ে নিতে হবে। চলুক কূটকছালি, মরুক দেশের ছেলেপুলে আফটারঅল এটা সব সৈনিকের মহান ডেস্টিনি, কজনের ভাগ্যেই বা জোটে?

দেশ বা আমাদের আর্মি নিয়ে সবার আবেগকে আমি স্বাগত জানাই, সন্মান করি এই আবেগ কে। কিন্তু বিশ্বাস করি না যে সোশ্যাল মিডিয়াতে মেকি কোন পোস্ট কে শেয়ার করা বা প্রোফাইল পিকচারে জলন্ত মোমবাতির ছবি দেওয়াকে, কেউ দ্বিমত পোষণ করতেই পারে, কিন্তু এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। আর কেউ সেটা না করলে তাঁর প্রতি বাঁকা দৃষ্টিতে না তাকিয়ে, তাঁকে দেশদ্রোহী বলে ব্যাঙ্গ না করে একটু ভাবুন না কিভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব?

“দেশপ্রেম”, “জাতীয়তাবোধ” এগুলো আমারও আছে, তবে এত সস্তা নয়। আমিও ভালোবাসি আমার দেশ কে, সীমান্তে কোন সৈন্য মারা গেলে, দেশ বিরোধী খবরে আমার ও অ্যাদ্রিনালিন ক্ষরিত হয়। হয়ত কোন কিছু করে দেখানোর দম নেই আমার বুকে, তাই আমি শুদু লড়তে পারি কী-প্যাডে। তবু কোথাও যেন বাধে আমার নিজেকে সেইসব সাহসীদের দলভুক্ত করতে যারা নিজেরা কিসসু না করে খেয়ে দেয়ে, হেঁচে কেশে, চায়ের দোকানে, বাসে ট্রেনে যুক্তি তর্ক করে, আর সমস্ত দায় সরকার বা রাজনৈতিক নেতাদের উপর চাপিয়ে হেঁচকি তুলে মরে যায়। যাই হোক গালভরা বক্তৃতা দেওয়া আমার কম্ম নয়, তাই মাফ করবেন হুজুর! কিন্তু এটা ভুলবেন না যে এটা আমারও দেশ, আমিও দেশ কে ভালোবাসি।
 

Saturday 17 September 2016

বিশ্বকর্মার কিসসা









বিশ্বকর্মার কিসসা



আরে ভাই বাঁদিকে পেটকাটা অনেকটাই বেড়ে এসেছে, ওটাকে টেনে মার।

দাঁড়া আগে চাঁদিয়াল টা কে তো সামলাই।

হ্যাঁ রে তুই এবারে গনেশের দকান থেকে ঘুড়ি কিনিস নি, আমায় বলছিল গনেশদা।

না রে এবারে উর্দি বাজারে একটা নতুন দোকান পেয়েছি, হেভি স্টক আর দাম ও কম।

আরে শালা আমায় বললি না।

আরে আরে তোর ঘুড়ি সামলা, পেটকাটা তে নীচে দিয়ে টানছে, যা ভো কাট্টা।

ধুসস গেল রে।



ছটফট করতে করতে ঘুম টা ভেঙ্গে গেল, চোখ রগরে দেখি কোথায় পেটকাটা আর কোথায় সেই ছাদের আড্ডা, উল্টে দেওয়াল ঘড়িটা চোখ রাঙাচ্ছে অফিসে না লেট হয়ে যায়?



কোনোমতে স্নান ছেরে, নাকে মুখে কিছু গুঁজে, গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে, ঠিক চোখ পরে গেলো আকাশের পানে – ধুসস ফাঁকা আকাশ, ঘুড়ি কোথায়? রাস্তায় এসে মাইকের আওয়াজ, আর বাবা বিশ্বকর্মার প্যান্ডেল মনে করিয়ে দিল সত্যি আজ বিশ্বকর্মা পুজা। ট্রেনও আজ বেশ ফাঁকা, বসার সিট পেয়ে হারিয়ে গেলাম ছোটবেলায়।



বিশ্বকর্মা পুজোর অন্তত একমাস আগে থাকতে আমাদের চোখে ঘুম আসতো না উত্তেজনায়, এবারে কটা ঘুড়ি কিনব, কি মাঞ্জা দেব এসব ভাবতে আর সব জিনিস টাইমে জোগাড় করতেই দিন কাবার হয়ে যেত। বিশ্বকর্মা পুজোর এক দুদিন আগে মাঞ্জা দিতাম – উফফ সে এক বিশাল কাজ ছিল, ভাঙ্গা টিউবলাইট জোগাড় করে হামান দিস্তায় তাকে মিহি করে গুঁড়ো করোরে, মোটা দানার সাবু, গাব গাছের আঠা, হাল্কা নীল রঙ (যাতে আকাশে সুতোর রঙ না  বোজা যায়), তার পর টিপনি দেওয়ার জুতসই লোক জোগাড় করা, নাওয়া খাওয়া ভুলে একটা বেলা এই নিয়ে কাটাতাম, আর বাড়িতে জুটত বকুনি। সব ম্যানেজ করে বিশ্বকর্মা পুজোর সকালে যখন ছাদে যখন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ঘুড়ি উড়াতে যেতাম, নিজেকে বিশ্বজয়ী মহারাজ মনে হত। একটা করে ঘুড়ি কাটা হত আর সম্মিলিত স্বরে ভো কাট্টা, উফফ রক্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্নে যথেষ্ট। প্রতিপক্ষের ঘুড়ি তো নয় যেন পাকিস্থানের ট্যাঙ্ক, না ওড়ালে শান্তি নেই কিছুতেই। এখন এসব ভাবলে হাসি পায়, কিরকম ছেলেমানুষ ছিলাম আমরা? অন্তত পরের সাতটা দিন আমাদের আলোচনার টপিক থাকতো এই ঘুড়ি ওড়ানো।

প্রত্যেক পাড়াতে একজন ঘুড়ি বিশারদ থাকতো, আমাদের পাড়ায় ছিল হাবুল দা। হাবুল দা যখন চারমিনার ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে ছাড়তে মাথা টা উঁচু করে বলত – শোন প্যাঁচ খেলাতা যে সে লোকের কম্ম নয়, অনেক ক্যালকুলেশন করে খেলতে হয়। কখন ঢিল দিবি, খখন লাট দিবি ঘুড়ি কে এগুলো না জানলে ঘুড়ি তো ভো কাট্টা হবেই। আর সন সব সুতোয় টেনে খেলা উছিত নয়, কালো গান এর সুতো হচ্ছে টেনে খেলার জন্নে বেস্ট। আর ঘুড়ি এমন হটে হবে যে তোর হাথের ইশারায় খেলবে, তোর কথা অনুযায়ী বাঁদিকে/ ডানদিকে লাট নেবে। আমরা সব মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনতাম, হাবুল দা বলছে না পটলডাঙ্গার টেনিদা বলছে এটা বোঝা কঠিন ছিল। আমাদের কয়েকজন তো রীতিমতো হাবুলদার ফাই ফরমাস খেটে তাঁর থেকে প্যাঁচ পয়জার শিখে আমাদের ঘুড়ি কেটে গর্বিত গলায় ঘোষণা করত – এটা হাবুলদার শেখানো প্যাঁচ বাবা, এর থেকে বাঁচবি তুই ছোঃ? আমাদের মুখ গোমড়া করা ছাড়া উপায় থাকতো নয়া। কেউ কেউ বলত হাবুল দা মাঞ্জাতে প্রসাদী মন্ত্রপূত জল দেয় তাই ওর ঘুড়ি কেউ কাটতে পারে না। কেউ আবার বলত নারে আমি শুনেছি হাবুলদা কালো শিয়ালের হাগু মিশিয়ে মাঞ্জা দিয়েছে। গাল গল্পের গরু গাছে উঠে যেত আর কি, এখন এসব ভাবলে হাসি পায়।    

মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় কতবার হাত কেটে ফালা ফালা হয়ে যেত, কোনোমতে হাতে ব্যান্ডএড বা হান্সাপ্লাস্ত লাগিয়ে আবার নতুন উদ্যমে লেগে পরতাম ঘুড়ি উড়াতে। কার হাত লাল তো কার নীল, কার বেগুনি হয়ে থাকতো মাঞ্জার রঙ্গে। সাথে ঘুড়ি লোটা, হাত্তা মারা এগুলোর কথা আজকের প্রজন্ম জানলোই না। আজকের দিনে টেকসাভ্যি বাবা মা রা ছেলে/ মেয়েদের হাতে ধরে পেটকাটা, চাঁদিয়াল, ময়ূরপঙ্খি ঘুড়ি চেনান না বা দরকারে ছেলের সাথে লাতাই ধরা, মাঞ্জা দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। তাই মোবাইল, ল্যাপটপেই গেম খেলে আজকের প্রজন্ম, বিশ্বকর্মা পুজোর নীল আকাশ তাদের কাছে অধরা।

খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে হিন্দমোটরে যেতাম বিশ্বকর্মা পুজা দেখতে, কি রমরমা অবস্থা ছিল তখন হিন্দমোটরের, প্রত্যেকটি ইউনিটে একটা করে পুজো। এত প্রসাদ খেতে দিত যে পেট ভরে যেত, শেষে কাকুরা সব আমার সাধের রুমালে বেঁধে দিতো, বলত পরে খাবে। আরে খাব কোন পেটে, পেট যে ভরে গেছে, কিন্তু কিছুতেই শুনত না কথা জোর করে দিয়ে দিতো। অবশ্য পরের ইউনিটে অই প্রসাদ বাঁধা রুমাল দেখালেও ছাড়ত না জোর করে কিছু না কিছু খাওয়াতই, আসলে তখন ভালবাসার টানটাই ছিল আলাদা। এর পর অডিটোরিয়ামে ফ্যাংশান, খাওয়া দাওয়া, বাবার বন্ধুদের ছেলে মেয়েদের সাথে হইচই, সে একটা দিন যেত বটে। আজ সেইসব অতীত, সেই গরিমা আর নেই, ধুঁকতে থাকা কংকালসার কারখানা আর হতদরিদ্র, দুঃখী শ্রমিকদের শূন্য চোখের দৃষ্টি বলে দেয় সব হারানোর ব্যাথা। রিষড়া, ব্যারাকপুর, উলুবেড়িয়া, হাওড়া সব শিল্পতালুকেই বিশ্বকর্মা আজ পিছু হটে গেছে। তাও মাঝে মাঝে রঙ বেরঙের ঘুড়ির মেলা মনে করিয়ে দেয় জীবন একেবারে সাদা কালো হয়ে যায় নি।