Thursday 29 September 2016

আমার মহালয়া


আমার মহালয়া

নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের পাল দেখলেই আমার মনে পরে যেত পুজো এসে গেছে, আর দেরি নেই শারদ উৎসবের। আমার জীবনের সুখের স্মৃতির অন্যতম শারদীয় দিনগুলো, সাত সকালে অফিসে বসে কাঁচের ওপারের শহর দেখতে দেখতে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেলো, ধুসস নিকুচি করেছে কাজের, খালি স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠছে ফেলে আসা সময়ের জলছবি, এমন দিনে কি কাজ ভালো লাগে? তাই ভাবলাম মনের কথা খুলে বলার এই মঞ্চে আমিও অবতীর্ণ হয়ে তুলে ধরি আমার কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা।

পুজোর স্মৃতি মানেই মহালয়ার দিন ভোর ভোর উঠে পরে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ শোনা। পুজোর কাউন্তডাউন শুরু হয়ে যেত মহালয়া থেকেই। বাবাকে দেখতাম মহালয়ার আগের দিন থেকেই রেডিও ঠিক থাক করে, নতুন ব্যাটারি ভরে সব রেডি করে রাখতে, যাতে কোন অসুবিধা না হয়। মহালয়া শুরু হলেই বাবা ডেকে দিতেন – বাবাই উঠে পর, মহালয়া শুনবি না? আমিও ঘুম কাটানোর কঠিন জেদ নিয়ে কোনমতে উঠে ঠাকুর নমস্কার করে আবার ধপাস করে শুয়ে পড়তাম। আধো ঘুম আর জাগার মধ্যে কানে ভেসে আসতো তব অচিন্ত্য রূপ-চরিত-মহিমা, নব শোভা, নব ধ্যান রূপায়িত প্রতিমা। শুনতাম আবার মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়তাম আবার কানে ভেসে আসতো বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো রে ভুবন। মা ঠাকুর ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলতো বাবু শুনছিস না ঘুমাচ্ছিস? আবার জেগে উঠে শুনতাম যখন, তখন রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি শেষ হয়ে  বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই উদাত্ত আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে শেষ গানে শান্তি দিলে ভরি দুখ রজনী। তখন মনে হতো এর চেয়ে সুন্দর ভোরের রুপ যেন আর হতে পারে না। আজ প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো বাবাকে হারিয়েছি, বাবার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে রেডিও তে মহালয়া শোনা। এখন তো মোবাইলে সব সময় ভরা থাকে মহিষাসুরমর্দিনীর এমপিথ্রি, যখন ইচ্ছে শুনলেই হয় কিন্তু সেই টান আর অনুভব করি না। খুব মনে পরে যায় ছোটবেলায় মহালয়ার দিন আমাদের বাড়ীর কাছের বাগানে একটা শিউলি গাছ ছিল, ওখানে শিউলি ফুল কুড়োতে যেতাম আরও বন্ধুদের সাথে, আমার মনে হতো রাতের সব তারা মাটিতে বিছিয়ে আছে। যখন শিউলি ফুল কুড়িয়ে জড়ো করতাম আর সুন্দর মিষ্টি গন্ধে মন ভরে যেত আর মনে হত হ্যাঁ সত্যি এবারে পুজো আর বেশি দেরি নেই। শিউলি ফুল কোড়াতে কয়েকটি মেয়েও আসতো, তাঁর মধ্যে একজন কে দেখলে আমার হার্টবিট বেড়ে যেত, মন ভাল হয়ে যেত। কে জানে শৈশবের সেই প্রথম প্রেম আজ কোথায়?   

ফুল কুড়িয়ে মাথে বসে খুব গল্প হতো এবারে পুজোতে কার কটা জামা, প্যান্ট হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি, কত কথা কথার যেন শেষ ছিল না –

“ভাই মহালয়া শুনলি?”
“হ্যাঁ ভাই, তুই পুরো শুনেছিলি না গুল দিচ্ছিস?”
“না রে ভাই মা দুর্গার দিব্বি পুরোটা শুনেছি”
“আচ্ছা, শোন এবারে তুই কি নতুন বন্দুক কিনলি?”
“হ্যাঁ ভাই, বাবা হেবি একটা বন্দুক এনেছে, আর ক্যাপ জানিসই তো সেই সিংহ মার্কা, যা আওয়াজ হচ্ছে, কি বলবো!”
“রোদে দিয়ে দিস ভাই, বিকালে মাঠে বসে ফাটাবো”
“ঠিক আছে রে ভাই, এখন যাই। মা লুচি ভাজছে, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে জোর বকুনি খাবো।“

আজ বড্ড বেশি করে “পুরানো সেই দিনের কথা” মনে পড়ছে, ছোটবেলার সেই বন্ধুরা সব কে কোথায়? অনেকের সাথেই যোগাযোগ নেই, কেউ বিয়ে করে শহিদ আবার কেউ হারিয়ে গেছে কোন কারণ ছাড়াই। আর একবার যদি ফিরে যেতে পারতাম ছোট বেলায় - “আবার দেখা যদি হল সখা, প্রানের মাঝে আয়”, জানিনা আবার কোনোদিন দেখা হবে কিনা? মহালয়ায় আমার বড় প্রাপ্তি একবার বাবার সাথে গঙ্গার ঘাটে যাওয়া, সেইবার বাবা ঠিক করেছিলেন তর্পণ করবেন তাই খুব ভোর ভোর আবার সাথে সাইকেলে করে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। পুবের আকাশে সবে একটু রঙ লেগেছে, পাখিদের কিচির মিছির একটু একটু করে শোনা যাচ্ছে, রাস্তার লাইট পোস্টের ডুম গুলো তখনও জ্বলছিল। বাবার সাথে বকবক করতে করতে কখন যে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে গেছিলাম মনেই ছিল না। বাবা বলেছিল – তুই এখানে চুপ করে বস, আমি জামা কাপড় ছেড়ে ধুতি পরে নি, আর ঠাকুর মশাই কে দেখি গিয়ে। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বসে দেখেছিলাম কি অপূর্ব শোভা ভোরের গঙ্গার ঘাটের। একটু দূরে বাবা আর কয়েকজন কোমর অবধি জলে দাঁড়িয়ে দু হাত বাড়িয়ে তর্পণ করছে - নমঃ ব্রহ্ম তৃপ্যতাম্ নমঃ বিষ্ণু স্তৃপ্যতাম্ নমঃ রুদ্র স্তৃপ্যতাম্ নমঃ প্রজাপতি স্তৃপ্যতাম্। বিষ্ণুরোম্ কাশ্যপ ... গোত্রঃ পিতঃ ... দেবশর্ম্মা তৃপ্যতামেতৎ সতিল গঙ্গোদকং তস্মৈ স্বধা। ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতা হি পরমন্তপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়তে সর্ব্ব দেবতাঃ। একটু বাদে বাবা উঠে এসে গা হাত মুছে জামা কাপড় পরে নিয়ে বলেছিলেন – নে চল দেরি হয়ে গেলো, তোর বোধহয় খিদে পেয়ে গেছে? আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম না না আমার খিদে পাই নি, জানো খুব সুন্দর লাগছে, গঙ্গার ঘাটটা আজ খুব ভালো লাগছে। আর একটু বসি না বাবা?

বাবা হেঁসে বলেছিলেন – ঠিক আছে কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, মা চিন্তা করবে। তারপর বলেছিলেন – নে তুই দেখে নিলি এবারে আমি মারা গেলে এইভাবেই এসে তর্পণ করিস। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল, গলার কাছে একটা কান্না ডলা পাকিয়ে গেছিলো। বলেছিলাম – ধুসস বাজে কথা বোলো না, তুমি সব সময় আমার কাছেই থাকবে। বাবা মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন – পাগল বাবা মা কি চিরদিন কার থাকে? কোন কথা না বলে বাবা কে জড়িয়ে ধরে ছিলাম। ফিরে আসার সময় কথা বলতে পারিনি। বাবা বোধহয় বুজতে পেরেছিল আমার মনের কষ্টটা, তাই এটা ওটা অনেক কথা বলে মন হালকা করতে চেয়েছিল, শেষে গরম জিলিপির উপহারও দিয়েছিল, কিন্তু মনের কোনে কষ্টটা রয়ে গিয়েছিলো সারা জীবন। আজ যখন বাবা নেই তখন মাঝে মাঝেই কষ্টটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। আজ মহালয়ার দিনে বাবাকে খুব মিস করি। রেডিও তে মহালয়া শোনা, তারপর একসাথে বসে লুচি তরকারি খাওয়া সব কিছুই? সময়ের পাকেচক্রেই হক বা পারিপার্শ্বিক কারনেই হক তর্পণ আমার হয়ে ওঠেনি একবারও, মনের কোনে অনুতাপের আগুন জ্বলে আজও। শারদ উৎসব কেন জানিনা আজ কেমন ফিকে হয়ে গেছে, আনন্দ উৎসব, মজার মাঝে আমি খুঁজে ফিরি আমার ছোটবেলা কে, পুরনো বন্ধুদের, হাত বাড়িয়ে ধরতে চাই বাবার সেই হাতটা কে, ওটা যে বড় ভরসার হাত ছিল আমার। বাবারা বোধহয় সবাই বটগাছ, সন্তানের মাথায় নিশ্চয়তার ছায়া দেয়, হঠাৎ করে সরে গেলে এমনই ফাঁকা লাগে।

আমার কাছে মহালয়া আজও টিকে আছে এই ভাবেই, হয়ত সারাজীবন এইভাবেই রেডিও, আকাশবাণী, আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠস্বরে খুঁজে পাব আমার মহালয়াকে। কখনও বা শারদীয় শুকতারা, আনন্দমেলার মাঝে খুঁজে বেড়াই ছোটবেলার স্মৃতিকে। কারন আজকের এই ইদুর দৌড়ের যুগে, স্মৃতিই হয়তো সব থেকে বেশি আপন আর নিজেকে পাওয়ার আনন্দ দেয়।      

No comments:

Post a Comment