Thursday 29 September 2016

উরি হামলা ও আমার দেশপ্রেম






উরি হামলা ও আমার দেশপ্রেম

কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া উরি হামলাকে কেন্দ্র করে আপামোর ভারতবর্ষ উত্তাল, আর আমরা দেশভক্ত বাঙ্গালীরা তো আরও কয়েক কদম এগিয়ে। সাধে কি মহামতি গোখলে বলেছিলেন – “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow”, তিনি আমাদের একদম ঠিক চিনেছিলেন। এই মুহূর্তে উরি থেকে আমার দূরত্ব প্রায় ২৩৯৫ কিলোমিটার, নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে, ফ্যানের তলায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সোশ্যাল মিডিয়াতে খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতেই পারি আমরা। আর কাশ্মীর, এলওসি নিয়ে কথা বলবার হক আমাদের বাঙ্গালীদের আলবাত আছে, ফি বছর গলায়  ডিএসএলআর ঝুলিয়ে কত্ত কাশ্মীর ঘুরেছি আমরা, ডাল লেকে শিকারার সামনে সেলফি তুলেছি, লেহ লাধাখে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে শরীরের সব রক্ত স্ফুটনাঙ্ক ছাড়িয়ে টগবগ করে যখন ফুটেছিল, তখন যুদ্ধ, আর্মি এসব নিয়ে নরম গরম কথা বলতেই পারি। কারন আমরা নিরাপদ – কোন মর্টারের গোলা, বুলেট নিদেন পক্ষে ছররাও আমায় স্পর্শ করতে পারবে না।

সুতরাং অতঃকিম – সোশ্যাল মিডিয়াতে, গরমাগরম লেখা পোস্ট, হোয়াটসঅ্যাপে প্রোফাইল পিকচারে জলন্ত মোমবাতির ছবি, ট্রেনে বাসে পাকিস্থানের বাপের মুণ্ডপাত করি আমরা। অমুক জায়গার অই ছেলেটা উরিতে শহীদ হয়েছে রে!! কি ভাগ্য বল? দেশের জন্নে দেহত্যাগ, উফফ আমাদের দেশের গববো রে! কিন্তু ভেবে দেখেছি কি? কোনদিন সত্যিই যদি দেশের জন্নে যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার ডাক আসে সেদিন কি বীরদর্পে এগিয়ে যাব? না মনে হয়! নিদেনপক্ষে নিজের পরিবারের লোককেও পাঠাবোনা। এসবের জন্নে অন্য কেউ এগিয়ে আসুক, আরে মরলে পরে তাঁর জন্নে শহীদ বেদী তৈরি করার জন্নে তো আমরা আছি, “ক্ষতিপুরন” দিতে, সকাল বিকেল চোঁয়াচোঁয়া ঢেঁকুর তুলে পাকিস্থানের মা বাপ তুলে খিস্তি মারতে। অথচও আজ যদি সীমান্তে যুদ্ধরত সৈনিকদের জন্নে রক্তের প্রয়োজন হয় পারব কি একটু রক্ত দিতে? তাঁর থেকে শহীদের মিথের বঁটিতে কচুকাটা হক ভারতের সৈন্যরা, আর আমরা তাঁদের কফিন মুড়ে দি জাতীয় পতাকায়, কোন রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় ঢুকে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে বলে আসি – ওগো তোমরা কাঁদছ কেন? তোমাদের ছেলেতো শহীদ হয়েছে, কত বড় ভাগ্য তোমাদের। আমাদের হক্কলের গববো আজ তোমাদের ছেলে, ভাই, বাবা। ইসস কত বীর সন্তানের মা বাবা এনারা। তারপর ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বার করে একটু গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে দাওয়ায় বসে, ক্যামেরার সামনে হাসি হাসি মুখে বাইট দিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবি – হারামির বাচ্চা পাকিস্থানিগুলো কে শায়েস্তা করতে আরও সৈন্য পাঠানো হবে না, সিন্ধু জল চুক্তি বাতিল করে দেবো না মোস্ট ফেভারদ নেশনের তকমাটা কেড়ে নিতে হবে। চলুক কূটকছালি, মরুক দেশের ছেলেপুলে আফটারঅল এটা সব সৈনিকের মহান ডেস্টিনি, কজনের ভাগ্যেই বা জোটে?

দেশ বা আমাদের আর্মি নিয়ে সবার আবেগকে আমি স্বাগত জানাই, সন্মান করি এই আবেগ কে। কিন্তু বিশ্বাস করি না যে সোশ্যাল মিডিয়াতে মেকি কোন পোস্ট কে শেয়ার করা বা প্রোফাইল পিকচারে জলন্ত মোমবাতির ছবি দেওয়াকে, কেউ দ্বিমত পোষণ করতেই পারে, কিন্তু এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। আর কেউ সেটা না করলে তাঁর প্রতি বাঁকা দৃষ্টিতে না তাকিয়ে, তাঁকে দেশদ্রোহী বলে ব্যাঙ্গ না করে একটু ভাবুন না কিভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব?

“দেশপ্রেম”, “জাতীয়তাবোধ” এগুলো আমারও আছে, তবে এত সস্তা নয়। আমিও ভালোবাসি আমার দেশ কে, সীমান্তে কোন সৈন্য মারা গেলে, দেশ বিরোধী খবরে আমার ও অ্যাদ্রিনালিন ক্ষরিত হয়। হয়ত কোন কিছু করে দেখানোর দম নেই আমার বুকে, তাই আমি শুদু লড়তে পারি কী-প্যাডে। তবু কোথাও যেন বাধে আমার নিজেকে সেইসব সাহসীদের দলভুক্ত করতে যারা নিজেরা কিসসু না করে খেয়ে দেয়ে, হেঁচে কেশে, চায়ের দোকানে, বাসে ট্রেনে যুক্তি তর্ক করে, আর সমস্ত দায় সরকার বা রাজনৈতিক নেতাদের উপর চাপিয়ে হেঁচকি তুলে মরে যায়। যাই হোক গালভরা বক্তৃতা দেওয়া আমার কম্ম নয়, তাই মাফ করবেন হুজুর! কিন্তু এটা ভুলবেন না যে এটা আমারও দেশ, আমিও দেশ কে ভালোবাসি।
 

No comments:

Post a Comment