Tuesday 24 January 2017

বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ৩


বঙ্গে কালী পূজা ও কালী মন্দির – পর্ব ৩

“ডুব দেরে মন কালী বলে। হৃদি রন্তাকরের অগাধ জলে”। যে বৃহৎ প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলাম সময়াভাবে কতটুকু তা করতে পেরেছি এই প্রশ্ন মন কে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তাই হয়ত মায়ের আশীর্বাদে সুযোগ পেয়ে গেলাম একটি ঐতিহ্যশালী জায়গায় যাওয়ার। এবারের গন্তব্য সুখারিয়া, সোমরা বাজার, সাথী হল এবারে কন্যা আর সহধর্মিণী।

চুঁচুড়া ষ্টেশনে এসে দেখি অনেকটাই সময় আছে, রুমি মানে আমার সহধর্মিণী বলল – এত তাড়া দিলে অথচও ট্রেন আসতে তো বেশ দেরি। তাহলে বসে সুখারিয়াতে কি কি দেখার আছে সেসব গল্প বল।মেয়েও বলল  - হ্যাঁ বাপি একটু গল্প শোনাও দেখি। অতএব বললাম – দেখ সবটা আমি জানি না যতটুকু জানি বলছি মন দিয়ে শোন। ১৬৫৭ সালে মোহন মিত্র মহাশয় উলা-বীর নগরে এসে বসবাস শুরু করলেন। ১৭০৪ সালে তাঁর সুযোগ্য পুত্র রামেশ্বর মিত্র সম্রাট আউরঙ্গজেবের কাছ থেকে মুস্তাফি উপাধি লাভ করেন। পরবর্তীকালে রামেশ্বর মিত্রের বড় ছেলে রুঘুনন্দন মিত্র শ্রীপুর- বলাগড় অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন, আর অন্য সন্তান অনন্ত রাম ১৭১২ সালে সুখারিয়ায় বসবাস শুরু করেন। ১৮১৩ সালে অনন্তরামের তৃতীয় পুত্র শম্ভুরাম মিত্র মুস্তাফির বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফি মহাশয় এই আনন্দময়ী কালী মন্দির তৈরি করান। ১৮১৪ সালে রামনিধি মিত্র তৈরি করান হরসুন্দরী মন্দির। পরবর্তীকালে কাশীগতি মিত্র মহাশয় নিস্তারিনি কালী মন্দির। এছাড়াও আছে ১৭৮৫ সালে তৈরি ঐতিহ্যমণ্ডিত সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, আর এটাই সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির সুখারিয়ার। তবে আর কথা নয় এবারে ট্রেন ঢুকছে, বাকি কথা ট্রেনে উঠে। কিন্তু বিধিবাম ট্রেন এত ভিড় যে ওঠাই গেলো না, হয়ত একা থাকলে হয়ে যেত কিন্তু কন্যা আর সহধর্মিণীকে নিয়ে সেই চেষ্টা করতে পারলাম না। মন খারাপ হয়ে গেলো তবে কি যাওয়া হবে না, পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম পরবর্তী ট্রেন আছে ব্যান্ডেল থেকে ৯:২৬ এ, অতএব ব্যান্ডেলে গিয়ে কিভাবে ট্রেন ধরলাম সে বিবরণে গিয়ে লাভ নেই। ট্রেন উঠে দেখি চিড়ে চ্যাপ্টা করা ভিড়, যাই হোক কোনোমতে সোমরা বাজার ষ্টেশনে পৌঁছানো গেলো। 

সোমরা বাজার ষ্টেশনটি বেশ সুন্দর, ফাঁকা ফাঁকা, ১নং স্টেশনের সামনে বেশ কিছু টোটো, অটো দাড়িয়ে ছিল, জিজ্ঞাসা করে একটি ফাঁকা টোটো তে উঠে বসলাম, যাত্রা হল শুরু। টোটোচালক কাকুটি বেশ মিশুকে, আমরা সুখারিয়ায় মন্দির দর্শনে এসেছি শুনে খুব খুশি হলেন, নিজের থেকেই মোবাইল নং (নাম– প্রশান্ত রাজবংশি, মোঃ– ৭৬৯৯৩৭৩৭৮৭) দিলেন আর বললেন – তোমাদের মন্দির দেখা হয়ে গেলে আমায় ফোন করে দিয়ো আমি গিয়ে তোমাদের নিয়ে আসবো। নইলে হয়ত তোমরা ঠিক মতো টোটো, অটো নাও পেতে পারো। ক্ষণিকের পরিচয় তাও কত আপন ভাব, মন টা ভরে গেলো মুগ্ধতায়। একটা গানের কলি মনে পড়ে গেলো – “দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা, তারে ধরি ধরি, মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না”।

প্রথম গন্তব্য - আনন্দময়ী কালী মন্দির, মন্দিরের সামনে এসে স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে মন ভরে গেলো। একটি বড় পুকুরের ধারে বিশাল পঞ্চবিংশতি চূড়া বিশিষ্ট ভব্য মন্দির, আর তাঁর লাগোয়া ছয়টি মন্দির। আগেই বলেছি শ্রী বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফি মহাশয় এই আনন্দময়ী কালী মন্দির তৈরি করান, মন্দির চত্বরে পৌঁছে ঐশী (আমার কন্যা) আর রুমির আনন্দ ধরে না। দুজনেই বাচ্চা মেয়ের মতো দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিল, আর আমি লেগে পড়লাম আমার কাজে অর্থাৎ ছবি তোলাতে আর মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্ব কীর্তির রস আস্বাধনে। মন্দিরের প্রথম তলার চারদিকের চারটি কোণে ৩টি করে চূড়া রয়েছে, দ্বিতীয় তলার চারটি কোণে ২টি করে ও তৃতীয় তলায় একটি করে চূড়া রয়েছে, ঠিক মাঝখানে রয়েছে মন্দিরের মূল চূড়া| বিশেষজ্ঞদের মতে মন্দিরের স্থাপত্বশিল্পে এ ধরনের কাজ অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ও সারা পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের ৫টি মন্দির রয়েছে। মন্দির গাত্রে টেরাকোটার সুন্দর কারুকার্য রয়েছে – দশভুজা মা দুর্গার মূর্তি, গনেশের মূর্তি, শিবলিঙ্গের রুপ ইত্যাদি। মন্দির সংস্কারের সময় অপটু হাতে পরে অথবা সময়ের আঘাতে অনেক টেরাকোটার কারুকার্য আজ অবলুপ্ত, তবু যা আছে তা আজও প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়া দুধারে ৬টি করে মন্দির রয়েছে যার মধ্যে ৫টি আটচালা ও একটি করে পঞ্চরত্ন মন্দির। একটি পঞ্ছরত্ন মন্দিরে গনেশ মূর্তি রয়েছে ও বাকি মন্দির গুলিতে ভোলানাথ শিব বিরাজমান। মন্দিরের পুরোহিত শ্রী রাজু মুখারজির (মোবাইল নং – ৭৬০২৮০২৬৬৯) সাথে পরিচয় হল, উনিও বেশ মিশুকে লোক কথায় কথায় জানতে পারলাম মুস্তাফি ফ্যামিলির বর্তমান কর্তা শ্রী সোমনাথ মিত্র মুস্তাফি, উনিই এই ট্রাষ্টের প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে কলকাতায় বসবাস করেন। উনি আরও বললেন আগামী ৩রা ফেব্রুয়ারী বাৎসরিক উৎসব, আমন্ত্রন জানিয়ে রাখলেন। আমরাও বললাম যদি সম্ভব হয় নিশ্চয়ই আসবো। এরপর মায়ের স্নিগ্ধ মূর্তি দর্শনে মন জুড়িয়ে গেলো, প্রণামি দিয়ে ও চরণামৃত গ্রহন করে বাইরে এলাম। মন্দিরের পাশে গিয়ে বিস্তৃত কৃষিজমি দেখে মন জুড়িয়ে গেলো, মন্দিরের আগে, পুকুরের পারেই আছে মুস্তাফি পরিবারের বংশানুক্রমিক প্রাসাদ, রাধাকুঞ্জ যা বর্তমানে ধ্বংশস্তুপে পরিনত হয়েছে, দেখে মন ভারী হয়ে গেলো, ঐতিহ্যের কি করুন পরিনতি?  

পরবর্তী গন্তব্য - হরসুন্দরী মন্দির ও নিস্তারিনী মন্দির| যাবার পথে এক যায়গায় থামতে হল, হাতে চালিত তাঁতের মাকুর খটাখট আওয়াজ শুনে, পরিচয় হল দুইজন কারিগর ও তাঁদের মহাজন বাপিদার সাথে। অবাক হয়ে দেখলাম কি অসাধারন নিপুণটায় শাড়ির নক্সায় ফুটে উঠছে একের পর এক অসামান্য কারুকাজ। বাপিদা ও কারিগর দাদা দের থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। পথে অনেকেই দেখলাম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে, অনেকেই হেঁসে জানতে চাইলেন কোথায় যেতে চাই। সাহায্য করলেন পথ দেখিয়ে দিয়ে। 

কিন্তু হরসুন্দরী মন্দিরের সামনে এসে নিরাশ হতে হল, কারন মন্দির দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে, স্থানীয় লোকে দের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ৯:৩০ থেকে ১০:৩০ অবধি মন্দির খোলা থাকে, পুরোহিত মশাই এসে পূজা করে মন্দির বন্ধ করে চলে যান। অতএব বাইরে থেকেই ক্যামেরায় চেষ্টা করলাম ছবি তুলে রাখতে।

এই নবরত্ন মন্দির তৈরী হয় ১৮১৪ সালে আর গড়ন আনন্দ ভৈরবী মন্দিরের মতই, শুধু ঢোকার পথের দুধারে রয়েছে পাঁচটি আটচালা ও দুটি করে নবরত্ন মন্দির| এই মন্দিরগুলোও দেখলাম অনেকবার সারাই ও মেরামত করা হয়েছে। এর পর পৌঁছে গেলাম নিস্তারিনী মন্দির, কিন্তু অদৃষ্টের করুন পরিহাস, সেখানেও দেখি মন্দির চত্বর তালাবন্দি অতএব এবারেও বাইরে থেকেই ক্যামেরায় চেষ্টা করলাম ছবি তুলে রাখতে। ইতিমধ্যে কন্যা ও অর্ধাঙ্গিনী যথেষ্ট ক্লান্ত, আর পদব্রজে যাত্রা করতে অপারগ। অতএব টোটোকাকু (প্রশান্ত কাকু) কে ফোন করে জানাতেই বললেন – হ্যাঁ হ্যাঁ আসছি তোমরা কোথায় আছো বল আমি এখুনি আসছি। আমরা জানালাম নিস্তারিনী মন্দিরের সামনে আছি। উনি জানালেন আসছি, আমার একটু বসে বিশ্রাম নিতে লাগলাম। ইতিমধ্যে প্রশান্ত কাকু এসে গেলেন। অনাকে যখন বললাম যে আমরা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির যেতে আগ্রহী, তখন বললেন – হ্যাঁ চল, মা সিদ্ধেশ্বরী  কে না দেখলে তোমাদের ভালোই লাগবে না, চলো চলো দেখিয়ে তোমাদের ষ্টেশনে ঠিক সময়ে ছেড়ে দেব। যেতে যেতে কথায় কথায় জানতে পারলাম কাকু এখানকারই বাসিন্দা, কাছেই ওনার বাড়ি। বলে রাখলেন এরপরে কোনোদিন এলে অবশ্যই জানাতে উনি ওনার বাড়ি নিয়ে যাবেন আর আমাদের সবুজ দ্বীপ ঘোরার বাবস্থা করেন দেবেন। কথায় কথায় এসে গেলাম সিদ্ধেশ্বরী মন্দির চত্বরে। মন্দিরের পাশেই বেশ খানিকটা দুরেই গঙ্গা, আসলে চড়া পড়ে আজ গঙ্গা বেশ দূরে তবে বর্ষার সময়ে নাকি মন্দিরের কাছাকাছি জল এসে যায়। মন্দিরের গাত্রে লেখা ফলকে জানতে পারা গেলো – সুদুর অতীতে কোন এক সৌম্য কান্তি সাধক এই বত বৃক্ষের পদতলে মায়ের সাধনায় ব্রতী হন আর সিদ্ধি লাভ করেন। এই পাথরের মাতৃ মূর্তি তারই আনিত, পরবর্তীকালে তদানীন্তন জমিদার অর্থাৎ মুস্তাফি বংশের অর্থানুকূল্যে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজ অত্যন্ত জাগ্রত দেবালয়ে পরিনত হয়েছে, সেই বট গাছ যার পদতলে সাধক সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তা আজ কালের নিয়মে অসংখ্য শাঁখা প্রশাখা বিস্তার করে আজও দাড়িয়ে আছে। দেখে মন ভরে গেলো, মন আপনি গেয়ে উঠলো শ্রী ঠাকুরের প্রিয় একটি গান – “ডুব্‌ডুব্‌ডুব্‌রূপ-সাগরে আমার মন৷ তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবে রে প্রেমরত্নধন৷ খুঁজ খুঁজ খুঁজলে পাবি হৃদয়মাঝে বৃন্দাবন৷” মায়ের মৃন্ময়ী রুপ দর্শন করে মনের প্রার্থনা জানিয়ে এবার ফেরার পালা। পিছনে পড়ে রইলো এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের ইতিকথা, যা ঐতিহ্যে আর ভালোবাসায় মাখা। 

প্রশান্ত কাকু বললেন – তোমাদের তো কিছুই খাওয়া হয়নি বোধ হয়, আসলে এখানে ওই চা, বিস্কুট বা কেক ছাড়া কিছুই পাবে না। চলো তোমাদের ষ্টেশনে নিয়ে যাই, অখানে মিষ্টির দোকানও আছে আবার খাবার হোটেলও পাবে। তবে কি জানো তোমাদের শহরের মতো সাজানো গোছানো বড় হোটেল নেই, তবে খাবার দাবার ভালোই, খেয়ে দেখতে পারো। আমরা বলে উঠলাম – না না কাকু আমরা ঠিক খেয়ে নেব, বরং আজ চেনা ছকের বাইরে যেতেই মন চাইছে। তাই আপনি নিসংকোচে নিয়ে চলুন। ষ্টেশনে পৌঁছে ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করাতে আবার অবাক হওয়ার পালা, প্রশান্ত কাকু বললেন – ওই ত্রিশ টাকাই দিয়ো, আমি এক পইসাও বেশি নেব না, তোমরা আমাদের এখানে একটু ঘুরতে এসেছ আমি না হয় একটু বেশি গেছি তাতে বেশি নেব কেন? কত অনাবিল যুক্তি, আর কি সরল মনোভাব? আমাদের স্বার্থপর শহুরে মানসিকতার গালে চপেটাঘাত যেন। অনেক করে বলায় মাত্র পঞ্চাশ টাকাই নিলেন, তারপর অন্য একদল সওয়ারি নিয়ে চলে গেলেন। যাবার সময়ে আবার মনে করিয়ে দিলেন আসার কথা। স্টেশন লাগোয়া একটি ছোট কিন্তু পরিষ্কার খাবার হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে মিষ্টির দোকানে হানা দিলাম। টাটকা মিষ্টি, নতুন গুড়ের রসগোল্লা কিনে ষ্টেশনে উঠে শুনতে পেলাম ট্রেন আসার ঘোষণা হচ্ছে। ট্রেন এলো, ভারাক্রান্ত মনে ফিরে চললাম বাড়ীর অভিমুখে, পিছনে পড়ে রইলো প্রশান্ত কাকু, রাজু ভাই, আর বাপিদার মতো সরল গ্রাম্য মানুষ গুলি আর ঐতিহ্যে ভরা কিছু প্রাচীন মন্দির। 

লেখা শেষ করি মা কালীর আর একটি রুপ বর্ণনা করে, গুহ্যকালী। প্রচলিত মত ও পুরাণমতে গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি কেবল মাত্র সাধকদের আরাধ্য। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর, যথা গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়, তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা, গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা আর কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র। স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত, মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র, কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার। সদা হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা। বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ, এছাড়া বামে বৎসরূপী মহাদেব। 

আজ এই পর্যন্তই, আবার ফিরে আসব বাংলার কোনও কালীমন্দিরের ছবি ও লেখা নিয়ে। সবাই ভালো থাকবেন, সবার মঙ্গল হউক। 

(ছবির জন্যে ফটো আলব্যাম দেখুন) 

No comments:

Post a Comment