Tuesday 19 January 2016

কলকাতার ইহুদী সিনগাগ আর কিছু টুকরো কথা



বণিকের মানদণ্ড যখন ধীরে ধীরে রাজদণ্ডে পরিবর্তিত হচ্ছিল, তখন ইংরেজদের সাথে সাথে আরও অনেকেই এসেছিলেন এই বঙ্গে। আর্মেনিয়ান, ইহুদী, ডাচ, ফরাসী আরও অনেকেই, তাঁদের সংস্কৃতির, শিল্পকলার ছাপ আজ দৃশ্যমান। কলকাতার বেশ কয়েকটি রাস্তা যেমন - বেলিলিওস স্ট্রিট, এজরা স্ট্রিট এবং সিনগাগ স্ট্রিট, স্বভাবতই এটা দৃশ্যত কলকাতায় ইহুদিদের বেশ বাড়বাড়ন্ত ছিল। কলকাতার শ্রেণি বিভক্ত সমাজে তখন এই ইহুদিদের বলা হতো বাগদাদি ইহুদিনামে। এর অবশ্য কারণও ছিল, ১৮ শতকের শেষের দিকে বেশির ভাগ ইহুদিই কলকাতায় এসেছিল বর্তমান ইরাক ও সিরিয়া থেকে। সেইসময় কলকাতায় ইহুদিদের অনেক বসতি থাকলেও, দেশভাগের পর, স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর ইহুদীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমতে থাকে। আজ যে কজন ইহুদী এই শহরে রয়েছেন তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে।

পুরানো কলকাতাকে চেনার চেষ্টায় শুরু করেছিলাম এই লেখা আর ছবি তোলা।ঐতিহাসিক বা উইকিহাসিক অনুসন্ধান আমার কর্ম নয় বরং চেনা জানা তথ্য আর স্মৃতি মিশিয়ে চেষ্টা করলাম টুকরো ছবি তুলে ধরার। বড়দিনে আমরা অনেকেই নাহমের কেক এর খোঁজ করি, এই নাহম রা কিন্তু ইহুদী, এনারা ১৯০২ সালে তাঁদের বেকারি বাবসা চালু করেন, আর নিউ মার্কেটের বর্তমান স্থানে বাবসা স্তানান্তরিত করেন ১৯১৬ সালে। কলকাতার রেকর্ড অনুযায়ী প্রথম ইহুদী অধিবাসী হলেন Shalon Cohen, ইনি সুদুর আল্লেপো তে জন্মগ্রহণ করেন যা বর্তমানে সিরিয়া নামেই বেশি পরিছিত। ১৭৯২ সালে ইনি সুরাটে এসেছিলেন আর কলকাতায় আসেন ১৭৯৮ সালে। আজ আমরা Chowringhee Mansions, Esplanade Mansions এর স্তাপত্ত্যশিল্প দেখে অবাক হয়ে যাই, অনেকেই বোধহয় জানি না এর স্তপতিকার ছিলেন দুজন ইহুদী - David Joseph Ezra and Elias David Ezra। কলকাতায় ইহুদীদের পাঁচটি সিনগাগ (গির্জা) আছে। প্রথম সিনগাগটি নির্মিত হয় ১৮২৫ সালে, আর এটি তৈরি করেন Shalome David Cohen।এর পরেই ১৮২৫ সালে Ezekiel Judah Jacob তৈরি করান Neveh Shalom Synagogue, এটি অবশ্য ১৯১১ পুনঃ নির্মিত হয়েছিলো। আর ১৮৫৬ সালে David Joseph Ezra এবং Ezekiel Judah তৈরি করান বেথ এল সিনগাগটি (Beth El Synagogue situated in Pollock Street)।আর ১৮৮৪ সালে কানিং স্ট্রিট এ Elias David Joseph Ezra তার বাবা অর্থাৎ David Joseph Ezra এর সৃতিতে তৈরি করান Magen David Synagogue। কলকাতার ইহুদী সিনগাগ গুলি নিয়ে আমার জানার দৌড় এই অবধি সীমিত।

যাইহোক পুরানো কলকাতাকে জানার তাগিদেই হোক বা ছবি তোলার প্রেরনাতেই হোক ঠিক করেছিলাম সুযোগ পেলেই এই ইহুদী সিনগাগ গুলির ছবি তুলব। সুযোগ মিলে গেল ২৫এ ডিসেম্বরে, সকাল সকাল ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য Neveh Shalom Synagogue, বাস ধরে কানিং স্ট্রিট এ নেমে Neveh Shalom Synagogue খুঁজে নিতে অসুবিধা হল না। ওখানে যে বেথ এল এর কর্মচারী রা ছিলেন বেশ আন্তরিক ওরা। ওদের দুজনের সাথেই ঘুরে দেখলাম সিনগাগ টি, Neveh Shalom Synagogue টি বেশ ছিমছাম, খুব বেশি কারুকার্যের আড়ম্বর এখানে নেই। যা আছে তা হচ্ছে এক অদ্ভুত পবিত্রতা যা এই নিঃসঙ্গ, নীরব সিনগাগ টি তে এলে অনুভব করা যায়। নীচে পুরুষদের বসার বাবস্থা আর উপরের ব্যালকনি তে মহিলা দের বসার বাবস্থা। মাঝে প্লাটফর্ম টি ইহুদীদের পুরোহিতের জন্নে,যাকে ওনারা Rabbi বলে থাকেন। সামনে Old Testament এর বানী মুদ্রিত আছে, এটা কে ওনারা Apse বলেন।



এর পরের গন্তব্য Magen David Synagogue, এই সিনগাগটি Neveh Shalom Synagogue এর ঠিক পাশেই। ওখানে আলাপ হল আরও দুজনের সাথে – প্রতাপ সিনহা আর শিবু পাত্র। এনারা দুজনেই archaeological survey of india-র কর্মচারী, সিনগাগের দ্বায়িত্তে রয়েছেন। আর দুজনেই খুব ভালমানুষ তাই আবার আড্ডা উঠল জমে, নিজেরাই যত্ন করে চা খাওয়ালেন আমায়। কিছুতেই চা-এর দাম দিতে দিলেন না আমায়।আর আলাপ হল আনোয়ার খান আর সেখ গুফরানের সাথে, এই দুজন বেথ এল এর কর্মচারী। দুজনেই সদালাপী আর মিশুকে তাই ভাব জমতে দেরি হল না। ঘুরে ঘুরে দেখালেন এই বিশাল সিনগাগ টির প্রতিটি জায়গা। ছবি তুলতে তুলতে বারবার হারিয়ে যাচ্ছিল মন, পুরানো কলকাতার ছবি যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছিল চোখের সামনে। সম্বিত ফিরে এল প্রতাপ দার ডাকে – এদিকে এই সিনগাগের প্রতিষ্ঠা ফলক গুলো দেখুন হিব্রু আর ইংলিশে তারিখ সাল সব লেখা আছে। Magen David Synagogue টি ইতালীয় ভাস্কর্যের সংমিশ্রনে তৈরি, এর লাল ইটের উপর কারুকাজ সত্যি দৃষ্টিনন্দনকারী। ভিতরে গেলে চোখ জুড়িয়ে যাবে এমনই সুন্দর সাজানো। লম্বা লম্বা রড থেকে সুন্দর ঝাড়বাতি ঝুলছে, দেওয়ালে হাল্কা ক্রিম রঙের, আর চারিদিকে বড় বড় রংবেরঙ্গি বেলজিয়াম কাঁচের জানালা। সূর্যের আলো পড়ে অদ্ভুত মায়াজাল সৃষ্টি করছে। সুন্দর কালো পালিশ করা চেয়ার, আলো যেন ঠিকরে পড়ছে গা থেকে।এখানেও নীচে পুরুষদের বসার বাবস্থা আর উপরের ব্যালকনি তে মহিলা দের বসার বাবস্থা। মাঝে প্লাটফর্ম টি ইহুদীদের পুরোহিতের জন্নে,যাকে ওনারা Rabbi বলে থাকেন। সামনে Old Testament এর বানী মুদ্রিত আছে, এটা কে ওনারা Apse বলেন।দেওয়ালে ইহুদী প্রতিষ্ঠাতা দের ছবি, সেই সময় সিনগাগটিকে কিরকম দেখতে ছিল তারও ছবি আছে দেওয়ালে। এছাড়া আছে হিব্রু ক্যালেন্ডার। সিনগাগটি ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে সত্যি মন ভরে এলো।

আনোয়ার আর প্রতাপ দা বললেন চলুন উপর থেকে ঘুরিয়ে আনি আপনাকে।দুই পাশে দরজার পাশেই সিঁড়ি আছে, সুন্দর মজবুত কাঠের সিঁড়ি, আর সিঁড়ি তে ওঠার সময় চোখে পড়ল বেশ কিছু পেইন্তিং – সব এ ইহুদী প্রতিষ্ঠাতা বা কর্মকর্তার। উপর থেকে নীচে দেখলে খুব সুন্দর লাগছে, পিছনে বেলজিয়াম গ্লাসের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করেছে। আনোয়ার ভাই বলল চলুন আপনাকে ছাদ থেকে ঘুরিয়ে আনি, ওখানে ক্লক টাওয়ার আছে, আর ছাদে গেলে উপর থেকে Neveh Shalom Synagogue এর ছবিও আপনি তুলতে পারবেন। আমিতো এক পায়ে খাড়া, অতএব আমরা তিনজন – আমি, আনোয়ার ভাই আর প্রতাপ দা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম। একটু উঠেই দেখি সেই জাহাজের ডেকে উঠবার যেরকম বাবস্থা অনেকটা সেরকম – খাঁড়াই কাঠের সিঁড়ি। এর দরজা আবার উপর দিকে খোলে। যাইহোক উঠে দেখি একটা উঁচু প্লাটফর্ম তাতে নানা রকমের মেশিন পত্র। প্রতাপ দা বললেন এটাই ক্লক সিস্টেম যা এখন খারাপ হয়ে পড়ে আছে, লোক ডাকা হয়েছে সারানোর জন্নে। ছাদে গিয়ে ক্লক টাওয়ার আর Neveh Shalom Synagogue এর ছবি তুলে ফেরার পালা। উফফ আবার সেই খাঁড়াই সিঁড়ি, কোনমতে নীচে নেমে তবে হাফ ছাড়ল।

এর পরে তো বেথ এল সিনগাগে যাওয়ার পালা, প্রতাপ দা কে বলতে সদা হাসি খুশি মানুষ টি হেসে বললেন – নিশ্চয়ই যাবেন চলুন আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। এই তো কাছেই চলুন ঘুরে আসি, তবে ওই সিনগাগ টি এখনও ASI অধিগ্রহন করেনি। তবে অসুবিধা হবে না, ওখানেও চেনা জানা লোক আছে। অতএব আবার যাত্রা হল শুরু। Magen David Synagogue ছেড়ে বাদিকে একটি গলির ভিতর Beth El Synagogue। হাল্কা হলুদ রঙের বিল্ডিং, পরিচয় দিয়ে প্রবেশের ছাড়পত্র মিলল। ওখানেও আলাপ হল নির্মল গলুইয়ের সাথে, প্রতাপদার মতো নির্মল ও খুব হাসি খুশি ছেলে। আর আলাপ হল সিরাজ দার সাথে, একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ সিরাজ দা। তবে আলাপ জমতে দেরি হল না। নির্মল আর সিরাজ দা মিলে দরজা খুলে ঘুরে দেখালেন সিনগাগটি।

Beth El Synagogue টিও হাল্কা ক্রিম রঙের, সাথে আকাশী রঙের কাজ করা। মোটামুটি একই রকমের বাবস্থা - নীচে পুরুষদের বসার বাবস্থা আর উপরের ব্যালকনি তে মহিলা দের বসার বাবস্থা। মাঝে প্লাটফর্ম টি ইহুদীদের পুরোহিতের জন্নে,যাকে ওনারা Rabbi বলে থাকেন। সামনে Old Testament এর বানী মুদ্রিত আছে, এটা কে ওনারা Apse বলেন। নির্মল বললেন চলুন উপরে ঘুরে আসি, উপরে ১তা মিউজিয়াম মতো আসে, মনে হয় আপনার ভালোই লাগবে। উপরে এসে মন খুশি হয়ে গেল – বিভিন্ন স্বনামধন্য ইহুদী ব্যাক্তিত্যের নানান ছবির কোলাজে সাজানো। সবে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে যাবো আর সিরাজ দা হাঁ হাঁ করে উঠলেন – বললেন ছবি নাকি তোলা মানা। এমনিতেই ভদ্রলোক বার বার ই বলছিলেন বেশি ছবি তুলবেন না – কে জানে দুটি ছবি এক্সট্রা তুললে ট্যাক্স লাগে কিনা, মানব চরিত্র বেজায় জটিল তাই কথা না বাড়িয়ে শুদু দেখেই খুশি থাকতে হল। যতদূর মনে পড়ছে ভারত পাকিস্থান (বাংলাদেশ) যুদ্ধের প্রধান কারিগর Lieutenant General J.F.R Jacob – এর ছবিও আছে। যাইহোক সব দেখে নামার সময় দেখি নির্মল এর মুখ গম্ভীর, কারন জিজ্ঞেস করাই বলল ওর নাকি সিরাজ দার ওইভাবে বাধা দেওয়া টা ভালো লাগেনি।আমি হেসে বললাম – আরে ভাই আমি কিছু মনে করি নি,জাস্ট ভুলে যাও ব্যাপারটা। বাইরে এসে দেখি প্রতাপ দা দাড়িয়ে আছেন আমায় ওনাদের গির্জা তে আর একবার নিয়ে যাওয়ার জন্নে। হুম ঘড়ি দেখে মনে হল আরও কিছু আড্ডা দেওয়া যেতেই পারে, তাই যাবো বলে দিলাম। নির্মল এর মধ্যেই সামনের চায়ের দোকানে চা অর্ডার করে দিয়েছে, আবার এক প্রস্থ চা খেয়ে প্রতাপ দা-র সাথে কথা বলতে বলতে ফিরে এলাম Magen David Synagogue। 

ফিরে এসে  দেখি শিবুদা, আনোয়ার ভাই, গুফরান ভাই বসে আছে, অতএব জমাটি আড্ডা শুরু হল। কথায় কথায় জানতে পারলাম আনোয়ার ভাই, গুফরান ভাইরা বংশপরম্পরায় এই সিনগাগের দেখভালের দায়িত্তে আছেন, অথচও আজও তাঁদের নুন্যতম পারিশ্রমিক জোটে না।সত্যি কলকাতা একটি ব্যতিক্রমী জায়গা, যে ইহুদী আর মুসলিম রা পরস্পরের শত্রু তারাও এখানে শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করছেন – সবচেয়ে বড় কথা ইহুদী কত্রীপক্ষ্য তাঁদের সিনগাগ গুলির দায়িত্ত দিয়ে নিশ্চিন্তে আছেন, তাহলে এই বৈষম্য কেন? ওনারা কি পারেন না অন্তত নুন্যতম পারিশ্রমিক দিতে? কে জানে কবে তাঁদের ঘুম ভাঙবে? আমি যতদূর জানি জিউশ গার্লস স্কুল এই ইহুদী কত্রীপক্ষেরই পরিচালনায়, আর সেই স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রীই মুসলিম, এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদাহরন বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই আমার। ঈশ্বরের কাছে এটাই চাই এই শান্তি চিরস্তায়ি হোক। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পরতে দেখি ওরে বাবা অনেক বেজে গেছে, এবার তো বিদায় নেওয়ার পালা। সবার সাথে করমর্দন করে বেরিয়ে এলাম, সদালাপী প্রতাপ দা একদম গেট অবধি এসে ছেড়ে দিয়ে গেলেন।

ফিরে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল এটাই জীবন, কত মানুষের সাথে আজ পরিচয় হল, কত অজানা তথ্য জানলাম, আর জানলাম কিছু মানুষ কে। যাদের সুখ দুঃখের কথা আমার বেড়ানোর ঝাঁপি কে আরও পরিপূর্ণ করে তুলবে। বিদায় সিনগাগ বিদায় কলকাতা।

কলকাতার সিনগাগ গুলির ছবি দেখার জন্নে অনুরোধ করব নীচের লিঙ্কে visit করতে।


 





 



No comments:

Post a Comment