Sunday 2 July 2017

রথযাত্রার ইতিহাসের সন্ধানে



রথযাত্রার ইতিহাসের সন্ধানে

আজ রাত্রি পোহালেই কাল উল্টো রথের টান, সপ্তাহভর যে উৎসবের সূচনা হয়েছিলো কাল তার পরিসমাপ্তি, আবার এক বৎসরের প্রতীক্ষা। রথযাত্রা নিয়ে আমরা সবাই আনন্দে, পরম উৎসাহে মেতে উঠি, আসুন আরও একবার জেনে নিই এই রথযাত্রার পিছনে লুকিয়ে থাকা সেইসব পৌরাণিক গল্পগাথা।

দ্বাপর যুগের কথা, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর অনেকদিন কেটে গেছে, যদু বংশও ধ্বংস হয়েছে নিজ দোষে বা বলতে পারেন মা গান্ধারীর অভিশাপে, শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকায়। ভগবান তো অন্তযামী, তিনি জানতেন ধরাধামে তাঁর লীলার পরিসমাপ্তি ঘটানোর সময় আগত। তাঁর ইচ্ছায় একদিন শবর জাতির এক ব্যাধ বাণ মেরে বসলো শ্রীকৃষ্ণের রাঙ্গা চরণে। আর সেই বাণ নির্মিত হয়েছিলো সেই মুষল এর অংশ দিয়ে, অতএব শ্রী কৃষ্ণ ত্যাগ করলেন এই পার্থিব দেহ, যাত্রা করলেন তাঁর আপন বিষ্ণু লোকে। সখা অর্জুন এই দুঃসংবাদ পেয়ে বিলাপ করতে করতে ছুটে এলেন দ্বারকায়, নিজ হাতে সমুদ্র তীরে প্রস্তুত করলেন এক চন্দন কাঠের চিতা, অগ্নি সহযোগ করলেন সেই চিতায়, দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন, গোটা দেহটা পুড়ে ভস্মে রূপান্তরিত হলেও, শ্রীকৃষ্ণের নাভিদেশ তো পুড়ছে না! তখনই হল দৈববাণী, ‘ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই যে ওঁর অনন্তশয়ন।’ অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম জ্যোতি স্বরুপ সেই নাভি। আর তাকে লক্ষ করে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলল অনার্য সেই শবর, তাঁর মনে যে পরম কষ্ট, তাঁর তার বাণেই মৃত্যু হল ভগবানের। এই দুঃখ সে রাখবে কোথায়? দ্বারকা থেকে পুরী পর্যন্ত ছুটে চলল সেই জ্যোতি স্বরুপ সেই নাভি, পিছনে সাঁতরে চলা সেই শবর ব্যাধ, অবশেষে এখানেই ঠাকুরকে স্বপ্ন দেখল সে, ‘কাল ভোরে আমাকে তুলে নে। এখন থেকে তোর বংশধর, শবরদের হাতেই পুজো নেব আমি’। 

তখন থেকে নীলমাধবরূপে তিনি পূজিত হতে থাকলেন শবরদের কাছে, সময়ট তখন দ্বাপর যুগ। এরপর এলো কলি যুগ। কলিঙ্গের রাজা তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব, তিনি ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত। সেই উদ্দেশ্যে তিনি গড়ে তুললেন একটি মন্দির, শ্রীক্ষেত্রে, এখন আমরা যাকে চিনি জগন্নাথধাম বা পুরী রূপে। কিন্তু মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা গেল না কিছুতেই, দুঃখে কাতর রাজা মুহ্যমান হয়ে বসে আছেন রাজসভায়, রাজকার্যে আর তাঁর কোনও আগ্রহ নেই। এমতাবস্থায় রাজসভায় একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারলেন নীলমাধবের কথা - ইনি নাকি বিষ্ণুরই এক রূপ। অমনি চারদিকে ধার্মিক ব্রাহ্মণদের প্রেরন করলেন রাজা।

বাকিরা খালি হাতে ফিরে এলেও, ফিরলেন না একজন – বিদ্যাপতি। তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন সুন্দরী শবররাজ কন্যা ললিতা, নিয়ে এলেন তাদের বাড়ি। ললিতা শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা। প্রভু জগন্নাথের লীলায় ললিতার প্রেমে পড়লেন বিদ্যাপতি, বিয়ে হল দুজনের। বিয়ের পর বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন রোজ সকালেই শ্বশুর শবররাজ কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও উধাও হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। কোথায় যান শবররাজ বিশ্ববসু! কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করতে বিদ্যাপতি জানতে পারলেন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীলমাধবের পূজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু। আনন্দে নেচে উঠলো বিদ্যাপতির মন, রাজকার্য সমাধা করার দিন তাহলে আগত? নীলমাধবের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, তখন তো আর ছাড়ার নয়। অমনি বিদ্যাপতি বায়না ধরলেন, তিনিও দর্শন করবেন নীলমাধবকে।

শবররাজ বিশ্ববসু প্রথমে রাজি না হলেও, অবশেষে মত দিলেন, তবে শর্তসাপেক্ষে। বিগ্রহ পর্যন্ত চোখ বেঁধে যেতে হবে বিদ্যাপতিকে। জামাতা হলেও বিদ্যাপতিকে কোনভাবে নীলমাধবের সন্ধান দিতে রাজি ছিলেন না বিশ্ববসু। বিদ্যাপতিও ছাড়ার পাত্র নন, চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় তিনি গোটা পথটায় সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। যথাস্থানে পৌঁছে যখন তিনি দর্শন পেলেন নীলমাধবের, তখন তাঁর প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল। বনের মধ্যে পূজোর ফুল কুড়িয়ে এনে শবররাজ বিশ্ববসু যখন পূজোয় বসলেন, তখন দৈববাণী হল, ‘এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহাউপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই। তুমি সেই ব্যাবস্থাই কর শবররাজ।’ ভীষণ রেগে গেলেন শবররাজ। ইষ্টদেবতাকে হারাবার দুঃখে বন্দী করলেন বিদ্যাপতিকে। কিন্তু কন্যা ললিতার বারবার কাকুতি মিনতিতে বাধ্য হলেন জামাতাকে মুক্ত করতে।

চতুর বিদ্যাপতিও সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দিলেন রাজার কাছে। ইন্দ্রদ্যুম্ন মহানন্দে জঙ্গলের মধ্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, উদ্দেশ্য ঠাকুরকে সাড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে আনতে। কিন্তু একি, নীলমাধব কোথায়! কোথাও তো নেই তাঁর বিগ্রহ, অতএব আটক হলেন শবররাজ। তখন আবার দৈববাণী হল - যে সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে কাঠ। সেই থেকেই বানাতে হবে বিগ্রহ। যথা সময়ে ভেসে এল সেই দৈব কাঠ। কিন্তু হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া, সেপাইসাস্ত্রী, লোকলস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই কাঠ। শেষে কাঠের একদিক ধরলেন শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণপুত্র বিদ্যাপতি। অনায়সে উঠে এল সেই কাঠ, আসলে প্রভু জগন্নাথের কাছে ব্রাহ্মণ-শবর কোনও ভেদাভেদ নেই যে!

মহারাজ তাঁর কারিগরদের নির্দেশ দিলেন মূর্তি গড়তে। কিন্তু সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই যায় ভেঙে। তা হলে উপায়! মূর্তি গড়বে কে! মহারাজের আকুলতা দেখে বৃদ্ধের বেশে এবার হাজির হলেন স্বয়ং জগন্নাথ। তিনিই গড়বেন মূর্তি, তবে শর্ত একটাই। একুশদিন পরে তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে।

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মেনে নিলেন তাঁর শর্ত, শুরু হল কাজ। ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণি গুন্ডিচা রোজই রুদ্ধ দুয়ারে কান পেতে শোনেন কাঠ কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ। চোদ্দদিন পর হঠাৎ রাণি শুনতে পেলেন সেই রুদ্ধদ্বার কক্ষ নিস্তব্ধ। একি হল, কী হল! কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে রাণি মহারাজকে জানাতেই চিন্তিত ইন্দ্রদ্যুম্ন খুলে ফেললেন কক্ষের দরজা। ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন বৃদ্ধ কারিগর উধাও, পড়ে আছে তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি, তাঁদের হাত, পা কিছুই গড়া হয় নি। গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন ভেবে দুঃখে ভেঙে পড়লেন রাজা। অন্নজল ত্যাগ করলেন রাজা, ইচ্ছা এইভাবেই প্রাণত্যাগ করবেন তিনি, রাত্রে তাঁকে স্বপ্ন দিয়ে প্রভু জগন্নাথ বললেন - যে এমনটা আগে থেকেই পুনর্নির্ধারিত ছিল, তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই শ্রী জগন্নাথদেবের মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

এবার জেনে নিই আরও কিছু কথা - জগন্নাথের প্রধান উৎসব হল রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেব বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরাম বা বলভদ্রকে নিয়ে রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি যান। সেখান থেকে সাতদিন পরে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। এই যাওয়াটাকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে।

রথের দিন তিনটি রথ পর পর যাত্রা করে মাসির বাড়ি,  প্রথমে যাবেন বলরামের রথ, তারপর সুভদ্রা এবং সবশেষে মহাপ্রভু জগন্নাথের রথ। রথে চড়ে এই গমন ও প্রত্যাগমনকে সোজারথ এবং উল্টোরথ বলে।
জগন্নাথ ধামে, অর্থাৎ পুরীতে তিনজনের রথ তিন রকমের হয়, যথা – শ্রী জগন্নাথের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। উচ্চতা ৪৫ফুট, রথের গায়ে হলুদ এবং সোনালি রং। চলার জন্য এই রথে রয়েছে সাত ফুট ব্যাসের ১৬টি চাকা। রথের সারথির নাম মিতালি। এরপরে লাল ও সবুজ রঙের শ্রী বলরামের রথ নাম ‘তালধ্বজ’। উচ্চতায় শ্রী জগন্নাথের তুলনায় এক ফুট ছোট। রথে ছ’ফুট ব্যাসের চোদ্দটি চাকা থাকে, রথের সারথি সাত্যকি। এর পর আসি দেবী সুভদ্রার রথ প্রসঙ্গে, এনার রথের নাম ‘দর্পদলন’। উচ্চতা প্রায় ৪৩ফুট, রথের রঙ লাল এবং কালো। চাকা বারোটি, প্রত্যেকটির ব্যাস পাঁচ ফুট। এই রথের সারথি স্বয়ং অর্জুন। প্রতিটি রথেই সাতজন করে পার্শ্বদেবী অধিষ্ঠিত,  সেই সঙ্গে দু’জন করে দ্বারপাল, একজন করে সারথি এবং একজন করে ধ্বজাদেবতা।

রথের কথা তো জানা হল এবারে জেনে নিই আমাদের ধর্ম গ্রন্থ, পৌরাণিক মত অনুযায়ী রথযাত্রার অন্তর্নিহিত অর্থ, কঠোপনিষদে বলা হয়েছে- আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু। বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মন: প্রগ্রহমেব চ।। অর্থাৎ - “এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী, আর ঈশ্বর থাকেন অন্তরে।“ 

শ্রী জগন্নাথ, শ্রী বলরাম আর দেবী সুভদ্রার এই রুপ সম্বন্ধে আর একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে টা হল এইরুপ যে - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করেন, তারপর তিনি আর বৃন্দাবনে আসেননি। কিন্তু একবার রথে করে পার্শ্ববর্তী গ্রামে এসেছিলেন বৃন্দাবনবাসীদের সাথে দেখা করতে। বৃন্দাবনবাসিরা শ্রীকৃষ্ণকে প্রাণাধিক ভালবাসত তাই তাঁর বিরহে তাঁদের করুন অবস্থা দেখে কিছুক্ষণের জন্যে কৃষ্ণ বলরাম সুভদ্রা তিন জন নির্বাক হয়ে যান, তখন তাঁদের এই অমূর্ত রুপ ফুটে ওঠে। কথিত আছে এই রূপই বর্তমান শ্রী জগন্নাথ, শ্রী বলরাম আর দেবী সুভদ্রার রূপ।

সময়, স্থান বিশেষে কত জনশ্রুতি, পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে তাঁর খোঁজ রাখা সম্ভব নয়। তবে এই রথযাত্রা এবং সামাজিক ঐক্যকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। আসলে এই রথ যাত্রার দিন কোন ভেদাভেদ থাকে না। ধনী,দরিদ্র, উচু, নিচু, স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য সবাই ভক্তি, শ্রদ্ধা আর ভালবাসার টানে একযোগে রাস্তায় নামে, আর আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভগবান সবার এবং এই মিলন মেলায় সবাইকে একত্রিত হতে।  


আগামী উল্টোরথের শুভেচ্ছা রইলো, আজ এই পর্যন্তই, আবার ফিরে আসবো এরকমই কোনও গল্প সাথে নিয়ে। সাথে থাকুন, সঙ্গে থাকুন। ভাল থাকবেন সবাই, শুভ রথযাত্রা। প্রভু জগন্নাথ দেব সবার মঙ্গল করুন।

তথ্যসূত্র – গুগুল ও বিবিধ পত্র পত্রিকা, ছবিও গুগুল থেকেই নেওয়া। 

No comments:

Post a Comment