নীলকণ্ঠের করচা – স্বামী বিবেকানন্দের ১৫3তম জন্ম উৎসব হল সাঙ্গ আর অগ্নি যুগের এক অমর শহিদের বলিদান দিবস – অতঃকিম্
বাঙ্গালীর আরও এক উৎসবের হল সমাপন,
ভাঙা বাঁশ আর ব্যবহৃত ফ্লেক্সগুলি চারিদিকে ছড়ানো। সংস্কৃতিমনস্ক বাঙ্গালীর মুখে চোখে ফুটে উঠেছে অপরিসীম
তৃপ্তি। কেন জানিনা চোখ বুজলে এখনও চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে সেই মূর্তি৷, লাঠি হাতে
পরিব্রাজক বেশী সেই যুবক যেন
বলে ওঠেন! আমি অমূর্ত বাণ আমার বন্দনা
কি আমি চেয়েছি? চেয়েছি কি ফুলের মালা আর চালের নৈবেদ্য? চেয়েছি কি আলোর
রোশনাই, উৎসবের
ঘনঘটা? আর গথে
বাধা বুলির কপচানি চাইনি
আমি৷ সত্যি তাই, ভগিনী নিবেদিতা সহ বিদেশি শিষ্যর প্রশ ছিল - ‘স্বামিজী কি করলে
আপনি কি করলে আপনি বেশী খুশি হন?’
উত্তর এসেছিল, ‘ভারতবর্ষকে
ভালবাস৷’শিষ্যদের
প্রতি তাঁর আশীর্বাদ ছিল তোরা খাটতে খাটতে মরে যা,
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি৷’ তিনি
চাননি তার ভাব আন্দোলন মেকি বন্দনাতে পরিনত হোক, এতো কেবল আরাধনা নয়,
এ হল এক অবিরাম চলার পথ, তার দৃপ্ত দৃঢ় কন্ঠে শোনা গিয়েছিল সেই
চলার পথের আদর্শ,
‘Blessed are they whose bodies get destroyed in the service of others.’ অন্যের
কল্যানের জন্য জীবনপাত কর,
তথাগত বুদ্ধের বাণী তাই নিজ কন্ঠে তুলে নিয়েছিলেন, ‘বহুজন হিতায়
বহুজন সুখায়’ জীবনপাত করাই
মানব জীবনের শেষ লক্ষ্য৷ তার মাধ্যমেই হবে আত্মার উন্নতি৷
তবে কি তাঁর জন্মতিথির পুণ্য লগ্ন
পালিত হবে না! সেই বিশেষ লগ্নে কি আমরা স্মরণ করব না
তাঁকে? – নিশ্চয়ই
করব! কিন্তু তার দেখানো পথে চলব কবে? আমার ভালো মনে আছে আমাদের
রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসি মহারাজরা বিবেকানন্দের অনুরাগী কোন যুবক যুবতী দেখলে
বলতেন, ‘স্বামীজীর
লেখা পড়ো , তার বানী আগে পড়ো,
সেখান থেকেই প্রেরণা
আসবে৷’এখন
ফেসবুক, ট্যুইটারের
যুগ৷এখন বই পড়ার সময় কই? কিন্তু ব্যক্তিত্বকে চিনতে গেলে, তার দেখানো পথে চলতে
গেলে তো পড়তেই হবে৷ নচেৎ নিছক ভান করে কি লাভ? সকালের প্রভাত ফেরী আর কাউকে
বিবেকানন্দ সাজিয়ে পথ পরিক্রমা এতো লোকদেখানো, ভাঁড়ামো হয়ে যাবে। বড়জোর পরের দিন
অফিসে গিয়ে বলতে পারব একটু Social Work করে এলাম বুজলি? আর দেশ কিভাবে
কাদের জন্নে গোল্লায় যাচ্ছে সেই তর্ক বিতর্কে Participate করে
ভাবব আহা আমার মতো Intellectual আর কে আছে?
মনের ক্যানভাসে আর একজনের কথা খুব
মনে পড়ছে, তিনি অগ্নিযুগের অন্যতম মহান বিপ্লবী প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্য, তার
মৃত্যুদিন ১২ জানুয়ারি ১৯৩৩। কি অদ্ভুত না একজনের জন্মদিন পালন অন্যজনের মৃত্যুদিন কে স্বরন।
১৯৩২ সালের ৩০ এপ্রিল মেদিনীপুরের
দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট ডগলাস নিহত হন। তিনি
তখন জেলা বোর্ডের এক মিটিঙয়ে সভাপতিত্ব করছিলেন। পুলিস প্রহরী মোতায়েন
ছিলো। এমন সময় প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য এবং প্রভাংশুশেখর পাল ডগলাসকে আক্রমণ
করে হত্যা করেন। ভাগ্য বিরুপ তাই প্রদ্যোৎ ধরা পড়ে যান রাজভক্ত কুকুরদের হাতে।
পকেট থেকে পাওয়া গেল দু’টুকরো
কাগজ। একটিতে লেখা: ‘A
fitting reply to premeditated and prearranged barbarous & cowardly attempt
on the patriotic sons of Bengal— Bengal revolutionaries.’ অন্যটিতে: ‘হিজলী
হত্যার ক্ষীণ প্রতিবাদে—
ইহাদের মরণেতে ব্রিটেন জানুক। আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক— বন্দেমাতরম।’
হাজার
জেরা, শত অত্যাচারেও বীর
বিপ্লবীর মুখ থেকে একটা কথাও বেরোয়নি। বেরোয়নি সঙ্গী প্রভাংশু বা অন্য কারও নাম। স্বীকারোক্তি
আদায়ের চেষ্টায় যখন ভূপেন দারোগা
ব্যঙ্গ করে প্রশ্ন করেন, ‘ছিঃ
প্রদ্যোৎ, তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলে এমন ভুল করল? শেষে কিনা তুমি এমন একটা রিভলভার নিয়ে গেলে, যা কাজের বেলায় একেবারেই সাড়া দিল না!’ শিকল-বাঁধা দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রদ্যোৎ বলেছিলেন: ‘Irony of fate, Bhupen-babu, had my revolver spoken out, I would
not have been here and in this condition, the story would have been otherwise.’
অবশেষে
এল শেষের সে দিন, ১২ জানুয়ারি ১৯৩৩। জেলের ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। ঢং ঢং শব্দে
জেগে উঠল জেল চত্বর।সেদিন ও বোধহয় ছিল এমন এ কনকনে ঠাণ্ডা
রা কুয়াশা, স্নান সারা হয়ে গেছে ভারত মায়ের দামাল ছেলেটির, সাথে গীতাপাঠও। ছ’টা
বাজতে তিন মিনিটে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে। জেলের বিভিন্ন সেল
থেকে গর্জন, ‘প্রদ্যোৎ কুমার কি জয়।’ মঞ্চের ওপরে দাঁড়ালেন। নিহত ডগলাসের
পরবর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্জ জিজ্ঞেস করলেন,‘Are you ready?’ শান্ত ভাবে প্রদ্যোৎ বললেন,
‘One minute please Mr. Burge, I have something to say.’ বার্জ অনুমতি দিলেন। এ বারে প্রদ্যোৎ
হাসতে হাসতে বললেন, ‘We are determined, Mr. Burge, not to allow
any European to remain at Midnapore. Yours is the next turn. Get yourself
ready.’ (এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি
হয়েছিল। মাস সাতেক বাদেই বার্জকে হত্যা করেন বিপ্লবীরা।) একটু থেমে আবার বললেন, ‘I am not afraid of death. Each drop of my blood will
give birth to hundreds of Prodyots in all houses of Bengal. Do your work
please.’
কালো
কাপড়ে মুখ ঢাকা পড়ল। ফাঁসির দড়ি পরানো হল। শেষ বারের মতো উচ্চারণ করলেন, ‘বন্দে মাতরম’।স্বাধীনতা সংগ্রামের আর এক প্রদীপ
নিভে গেল, রয়ে গেল ত্যাগ, বলিদানের এক অদ্ভুত গাথা যা ভারতবাসী চিরকাল মনে রাখবে।
জানিনা
বিপ্লবের সেই আগুন আবার জ্বলবে কবে? এক পকেটে গীতা আর অন্য পকেটে স্বামিজির বানী
এই নিয়ে কবে আসবে সেই সব দামাল ছেলেরা ফিরে? কবে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে এই মেকি সভ্যতার
ভরংবাজি। কবে অত্যাচারির অত্যাচার শেষ হবে, কবে ভারতবর্ষ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন
হবে। আমি মাতাল, জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া সাধারন মানুষ মাত্র, রঙিন জলের সুবাধেই
হোক আর কল্পনা বিলাসেই হোক স্বপ্নে আমার নিত্য পায়চারি। কিন্তু ঘোলাটে হয়ে আসা এই
চোখে আজও স্বপ্ন দেখি – ভাবি এইবার হবে সেই মরন সংগ্রাম, সব অন্ধকার ঘুচে গিয়ে
নতুন ভোর উঠবেই। কে জানে কবে আসবে সেই নতুন ভোর, কেউ কি জানেন সে কথা?
No comments:
Post a Comment