ইতিহাসের আয়নায় বাঁশবেড়িয়া
এই শীতে কদিন ধরেই কোন
চেনা জায়গায় আবার যেতে ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু যাবো টা কোথায়? আজ সকালে বেরোবার
তৃষ্ণা আরও প্রবল হল, কিন্তু সেই যাবো টা কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন বটে, রুমি কে
জিজ্ঞেস করতে বলল ধুসস ঘোরা জায়গায় ঘুরে কি লাভ? তারচেয়ে অন্য কিছু ভাবো। কিন্তু
মনে অন্য ভাবনা এলে তো, এমন সময় মনের কোনে বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের কথা এলো। রুমি কে বলতে বলল – কতবার তো গেছি, বিয়ের আগেও
গেছি, আবার যাবো? হেসে বললাম – আর একবার আমার সাথে চলো, ভালোই লাগবে, এছাড়া আজ
কার্ত্তিক পূজা আর বাঁশবেড়িয়ার কার্ত্তিক তো বিখ্যাত চলো দেখে আসি। অতএব বাড়িতে সব
ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে।
দুপুর ১২:৪০
টিকিট কেটে ৩নং প্ল্যাটফর্মে গিয়ে
ঘড়ি দেখে দেখি ট্রেন আসতে এখন একটু দেরি আছে, রুমি কে বললাম – চলো দেরি আছে একটু
বসে রেস্ট নেওয়া যাক। বসতে যাচ্ছি, রুমি সোয়েটার ধরে টানল, বলল- এই কমলালেবু
বিক্রি হচ্ছে কিনবে? ট্রেনে বসে খেতে খেতে যাওয়া যাবে। সুতরাং কমলালেবু কেনা হল,
এর মধ্যে ট্রেন আসার ঘোষণা হয়ে গেছে, একটু বাদে ট্রেন বাবাজির দেখাও মিলল। ট্রেন এ
উঠে দেখি অল্প ভিড়, কে জানে কার্ত্তিক পূজার ভিড় কিনা?
তাই রুমি বসার জায়গা পেলেও আমি পেলাম না। রুমি কে আশ্বস্ত করে বললাম – আরে তিনটে
স্টেশন ও দাঁড়িয়েই চলে যাওয়া যায়।
দুপুর ০১:৩০
অবশেষে বাঁশবেড়িয়া নামা হল, ভালোই রোদ উঠেছে। আর বেশ
ভিড় অনেকেই কার্ত্তিক পূজা দেখতে এসেছে বোধহয়। আমি রুমি
কে বললাম চলো আগে মন্দিরে যাই, আসা যাওয়ার পথে নিশ্চয়ই কার্ত্তিক ঠাকুর দেখা যাবে।
স্টেশনের বাইরে এসে একটা রিকশা কে দরদাম করে ঠিক হল চল্লিশ টাকা নেবে আর
আমাদের মন্দিরে নামিয়ে দেবে। রিকশা তে উঠে কমলালেবু খেতে খেতে, আর দুপাশে
কার্ত্তিক পুজার প্যান্ডেল দেখতে দেখতে যাত্রা শুরু হল। রুমি বলল – চলে গিয়ে বসে বাঁশবেড়িয়ার ইতিহাস শুনব তোমার
থেকে। আমি বললাম দেখ যতটুকু জানি বলব, কিন্তু এর বেশি জানতে গেলে তোমায় বই পরেই
জানতে হবে।
দুপুর ০২:০০
রিকশা নামিয়ে দিলো মন্দিরের কাছেই, গড়বাটির
ঠিক আগেই। রুমি কে বললাম এটা কি জানো? রুমি বলল – পুরানো বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ বলে মনে
হচ্ছে, কোন জমিদারবাড়ির কি? আমি বললাম – ঠিক ধরেছ, এটা বংশবাটির রাজপরিবার অর্থাৎ
দেব রায় পরিবারের পুরানো কেল্লার ধ্বংসাবশেষ। রুমি বলল – বাঁশবেড়িয়া আগে বংশবাটি নামে পরিচিত ছিল
এটা আমি জানি। চলো গড়বাটির ভিতর টা ঘুরে দেখি, তারপর মুল মন্দিরে যাবো। এখন অবশ্য গড়বাটির
বেশীরভাগটাই কালের নিয়মে ধ্বংসাবশেষ-এ পরিনত হয়েছে, তবু আজও নহবত খানার কিছু অংশ
দেখা যায়। ওখানেও একটা পুজা হয়েছে, তাই ভিতরে মণ্ডপের কারুকাজ আছে। একটু রাগ হল
এরকম একটা হেরিতেজ জায়গা তে পুজার অনুমতি ভারতীয় ‘পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ’ দেয় কিভাবে? চারিদিকে বাঁশ, দড়ি দিয়ে মণ্ডপসজ্জা হয়েছে এতে এই প্রাচীন
বিল্ডিং –এর ক্ষতিও তো হতে পারে। যাইহোক একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বেরিয়ে এলাম গড়বাটি
থেকে, রুমি কেও আমার ক্ষোভের কারন গুলো বললাম, ও বলল – বুঝতে পারছি কিন্তু যারা
দেখার তারা যখন দেখেও দেখছে না, তুমি আমি রাগ করে কি করব? তার থেকে চলো মন্দির এ
বসে আড্ডা দি, আর তোমার থেকে গল্প শুনি।
আমি বললাম – দাঁড়াও আগে কয়েকটা ছবি
তুলে নি, তারপর জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। ছবি তুলে মন্দির প্রাঙ্গনে একটা জায়গায়
বসলাম। রুমি কে বললাম – বল কি শুনতে চাও? রুমি বলল – দেখো বাঁশবেড়িয়া আগে বংশবাটি নামে পরিচিত ছিল এটা আমি জানি, কিন্তু এর ইতিহাস ঠিক জানি না। তুমি
যদি কিছু জানো বল। আমি বললাম – দেখো আমিয় বিশেষ কিছু জানি না তবু যতটুকু জানি তোমায়
বলছি, শোন মন দিয়ে।
১৬৭৩ সালে পাটুলির
জমিদার রামেশ্বর রায় তৎকালীন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে গঙ্গার ধারে বংশবাটি
এলাকায় ৪০০ একরের একটি গ্রাম যৌতুক এবং রাজা উপাধি পান। তিনি সেখানে বসতি স্থাপন
করেন ও সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। প্রায় একশো বছর বাদে তাঁর বংশধর, রাজা
নৃসিংহদেব রায় ১৭৮৮ সালে এই হংসেশ্বরী মন্দির তৈরি করতে
শুরু করেন। কথিত আছে যে রাজা নৃসিংহদেব কাশীতে যোগ সাধনা করতে
গিয়েছিলেন আর সেখানেই তিনি কুণ্ডলিনী
সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেন। পরে সেখান থেকে ফেরার পর তিনি এই মন্দির তৈরি করতে
শুরু করেন। তবে এই মন্দির উনি দেখে যেতে পারেন নি। ওনার মৃত্যুর পর ওনার সুযোগ্য
স্ত্রী রানি শঙ্করী ১৮১৪ সালে এই মন্দির নির্মাণ সম্পন্ন করেন। শোনা
যায়, মন্দিরে তৈরির পাথর আনা হয়েছিল চুনার থেকে, আর
রাজস্থানের জয়পুর কারিগরদের আনা হয়েছিল। মূল মন্দিরটি ২১ মিটার লম্বা এবং এতে ১৩টি মিনার আছে। প্রতিটি
মিনারের মাথা এক একটি পদ্মকুঁড়ির আকারে তৈরি। মন্দিরটি পাঁচতলা। প্রতিটি তলা
তন্ত্রমতের এক একটি মূল স্নায়ুকে রিপ্রেজেন্ট করে – ইড়া,
পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না এবং চিত্রিনী। মূল মিনারের একদম ওপরে আছেন মহাযোগী মহাদেব। মা হংসেশ্বরী দেবীর মূর্তি আছে নীচে (গ্রাউন্ড ফ্লোর-এ), এখানে শায়িত
মহাদেবের নাভি থেকে নির্গত মৃনাল দন্ডে প্রস্ফুটিত সহস্রদল পদ্মের ওপর ললিতাসনে
বসে আছেন নীলবর্না চতুর্ভুজা দেবী। তাঁর বাম হাতে খড়গ, নীচে
নরমুন্ড, আর দুই ডান হাতে অভয়মুদ্রা ও শঙ্খ, মায়ের মূর্তি তৈরি হয়েছে নিম কাঠ দিয়ে। তন্ত্রমতে, প্রাণায়ামের সময়ে শ্বাস ছাড়ার মুহূর্তে “হং …”
বলে একটি নাদ নির্গত হয়। তেমনি শ্বাস নেবার সময়ে “স …” করে একটি আওয়াজ হয়। এই দুয়ের সংযুক্তিতেই
হং-স। মহাদেব এবং
দেবীমূর্তির সংযোজনে এই মুর্তির নাম হংসেশ্বরী, বলা যায় শিব এবং শক্তির দুয়েরই পুজা হচ্ছে এখানে। আর এই
মূর্তির কোন বিসর্জন নেই, সেই রানী শঙ্করীর আমল থেকেই পুজা হয়ে আসছে।
অতএব বুজলে এখানে মায়ের নাম হংসেশ্বরী হলেও হংসবাহিনী মা সরস্বতীর
সাথে কোন সম্পর্ক নেই, বা মায়ের বাহনও হাঁস নয়। রুমি বলল – এটা আমি জানি, এখানে
অধিষ্ঠাত্রী দেবি হচ্ছে মা কালী। আচ্ছা ওই পাশে যে টেরাকোটার মন্দির আছে ওটা তো
অনন্ত বাসুদেব মন্দির? ওটা সম্পর্কে যা জানো বল।
আমি বললাম – দেখো এটা একটি কৃষ্ণ
মন্দির, ১৬৭৯
সালে রাজা রামেশ্বর দত্ত এই মন্দিরটি নির্মাণ করান। মন্দিরটি একরত্ন শৈলীতে
নির্মিত, মন্দিরের চূড়াটি অষ্টভূজাকার। মন্দিরের গায়ে
টেরাকোটায় রামায়ণ,
মহাভারত ও কৃষ্ণলীলার ছবি খোদাই করা আছে। এর টেরাকোটা সম্পর্কে বলতে গেলে এটাই বলা যায় – মাটি পুড়িয়ে হল সোনা, আর তাই
দিয়ে গাঁথা অতীত বঙ্গের সোনার ইতিহাস। চলো দেখে আসি আর কিছু ছবিও তুলে নি। ছবি
তুলে, পুরো মন্দির প্রাঙ্গন ঘুরে শেষে হাঁফিয়ে গিয়ে আবার এসে বসলাম মন্দির
প্রাঙ্গনে। আসে পাশে অনেকেই এসেছেন, নিজেদের মতন করে ঘুরে দেখছেন আর সেলফি নিতে ভুলছেন
না কেউই।
রুমি বলল – এই জানো এখানে তো মায়ের
ভোগ পাওয়া যায়, একবার খেয়েছিলাম তো, চলো যাই জিজ্ঞেস করি পাওয়া যাবে কিনা? গিয়ে
ঠাকুরমশাই কে জিজ্ঞেস করাতে জানা গেলো আর তো ভোগ অবশিষ্ট নেই তাই আর পাওয়া যাবে
না। মন্দির চত্বরে একটি বই- এর স্টল আছে, বাঁশবেড়িয়ার ইতিহাস ও মন্দির সংক্রান্ত, কেউ ইচ্ছা করলে কিনতে পারেন।
অল্প মূল্যে বইগুলি বিক্রয় হচ্ছে।
ইতিমধ্যে বেলা বেশ পরে এসেছে, পড়ন্ত
সূর্যের আলোয় ভেঙ্গে পড়া পুরানো রাজবাড়ী খুব সুন্দর লাগছে, তাই ছবি নিলাম কয়েকটা।
এবার ফেরার পালা, ফেরার সময় মন্দিরের বাইরে পুজার ডালার দোকান থেকে একজন বয়স্ক মহিলা
ডেকে বললেন – ভাই পুজা দেবে না। আমরা বললাম – আজ নয় কাকিমা অন্য যেদিন আসব সেদিন
দেবো। মহিলা বললেন – আবার এসো, আমার
দোকানে পুজার সব জিনিসই পাবে। পাশে দেখছি একজন ফুচকা, ঘুগনি এইসব বিক্রি করছেন,
রুমি কে বলাতে বলল – হ্যাঁ খাবো। দুজনে ফুচকা, ঘুগনি খেয়ে এগিয়ে এলাম রাস্তার
দিকে। একটু দাড়িয়ে থাতেই পেয়ে গেলাম একটি রিকশা কে। উঠে বললাম – ভাই তোমাদের এখানে
ভালো ভালো কার্তিক ঠাকুর দেখিয়ে স্টেশন এ ছেড়ে দেবে, কত নেবে বল? রিকশা ভাই বলল –
১০০ টাকা দেবে দাদা, তাহলেই হবে। বললাম – ঠিক আছে তাই দেবো, এখন চলো। বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক ঠাকুর দেখার
গল্প অন্য আর এক দিন, আজ এখানেই লেখা শেষ করছি।
কিভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়ি তে আসতে
পারেন, এছাড়াও হাওড়া – কাটওয়া শাখার ট্রেন ধরে সরাসরি নামতে পারেন বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে। নেমে পেয়ে যাবেন অনেক রিকশাওলা কেই, একটু দরদাম করে উঠে
পরলেই হবে। রিকশাতে করেই ঘুরে নিতে পারেন হংসেশ্বরী
মন্দির আর অনন্ত বাসুদেব মন্দির।
বাঁশবেড়িয়ার ছবি দেখার জন্নে অনুরোধ করব নীচের লিঙ্কে visit করতে
(আমরা হংসেশ্বরী মন্দির গেছিলাম
বেশ কিছুদিন আগে, লেখাটি পোস্ট করা হয়নি, আজ সুযোগমতো পোস্ট করে দিলাম)
No comments:
Post a Comment