সকাল ০৮:০০
হাঁফাঁতে হাঁফাঁতে কোনক্রমে দুজনে
ট্রেনে ওঠার সাথে সাথে ট্রেন টা ছেড়ে দিলো। রুমি মানে আমার অর্ধাঙ্গিনী হেঁসে বলল –
দেখলে তো বলেছিলাম ঠিকই পেয়ে যাবো, তুমিই ফালতু টেনশন করছিলে। আমি বললাম – না পেলে
এক ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মে বসে থাকতে তুমি ই বোর হয়ে যেতে। যাক ছাড় দেখি বসার জায়গা
পাওয়া যায় কিনা? কপাল গুনে ট্রেনও বেশ ফাঁকা আর আমরা দুজনে জানালার ধারে বসার
জায়গা পেয়েও গেলাম। বেশ একটু চোখ বুজে চিন্তা করছিলাম, কনুই এর খোঁচা তে চিন্তার বারোটা
বেজে গেল। রুমি বলল - বেশ তো ভুলিয়ে
ভালিয়ে নিয়ে এলে এবার বলতো আঁটপুরে কি কি
দেখার জিনিস আছে? আমি হেঁসে বললাম - স্বামী বিবেকানন্দ ও
তাঁর গুরুভাইদের স্মৃতিবিজরিত গ্রাম আঁটপুর৷আঁটপুর গ্রামটি আটটি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত৷ আটটি গ্রাম তড়া, বোমনগর,
কোমরবাজার, ধরমপুর, আনারবাটি, রানিরবাজার, বিলাড়া, লোহাগাছি৷ ১৮৮৬
সালের ডিসেম্বর মাসে, নরেন্দ্রনাথের (স্বামীজি তখনও
বিবেকানন্দ নাম গ্রহন করেন নি) গুরুভ্রাতা বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য
সন্ন্যাসীদের আঁটপুর গ্রামে আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করে
আঁটপুরে যান এবং কিছুদিন সেখানে থাকেন। আঁটপুরেই বড়দিনের পূর্বসন্ধ্যায়
নরেন্দ্রনাথ ও আটজন শিষ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন আর নরেন্দ্রনাথ
"স্বামী বিবেকানন্দ" নাম গ্রহণ করেন। এই বাবুরাম ঘোষ এ পরে স্বামী প্রেমানন্দ নামে অধিক পরিচিত হন। ওখানে রামকৃষ্ণ
মঠের দুর্গা পূজা খুবই বিখ্যাত। অতএব বুজতে পারছ ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গীতে আঁটপুর কতটা
গুরুত্বপূর্ণ? যদিও এছাড়াও আঁটপুর তার নিজ গৌরবেও সমুজ্জ্বল। দাঁড়াও বলছি তার আগে
একটু পেট পূজা হয়ে যাক – ট্রেন এ চানাচুর মশলা টা হেভি বানায়, বলেই ডাক মিক্সচার
দাদাকে (দাদাও মিক্সচারই বলছিল যে)- এই যে দাদা দুটো দাও তো ভাল করে মেখে। মিক্সচার
দাদার চানাচুর মশলা খেয়ে মুড ফ্রেশ, তাই ইতিহাসের ঝাঁপি খুলে বসলাম আবার। জান রুমি
- ১৭৮৬
সালে তৈরী মিত্রদের (মানেকৃষ্ণরাম মিত্রদের)
রাধাগোবিন্দের আটচালা শৈলীর মন্দিরটি টেরাকোটার কাজ অতুলনীয়৷বর্ধমান রাজ তিলোকচন্দ্র
বাহাদুরের দেওয়ান কৃষ্ণরাম মিত্র বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থের ঘাট থেকে গঙ্গাজল, গঙ্গামাটি
এনে সেই মাটি পুড়িয়ে তাতে ইট তৈরি করে রাধাগোবিন্দের মন্দির নির্মান করেন৷ টেরাকোটার
কাজের জন্য তিনি সুদুর বিষ্ণুপুর থেকে
মৃৎশিল্পী আনান ৷ মন্দিরটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু৷ মন্দিরের সম্মুখভাগে ও দুইপাশের
দেওয়ালে অজস্র টেরাকোটার প্যানেল আছে৷ সামাজিক দৃশ্য থেকে পৌরাণিক দৃশ্য সবই দেখা
যায় টেরাকোটার এই সব প্যানেল গুলি তে। তবে আর এখন গল্প নয়, ট্রেন মালিয়া ঢুকছে এর পরের স্টেশন এ হরিপাল
অতএব বাকি গল্প বাসে উঠে।
সকাল ০৯:৩০
হরিপাল স্টেশন টা বেশ
ছিমছাম আর সুন্দর, বেশ কিছু লোক নামলো আমাদের সাথেই। তাঁদেরই একজন কে জিজ্ঞেস করে
জানতে পারলাম স্টেশন এর বাইরে থেকেই আঁটপুর যাওয়ার বাস ছাড়ে। একে ওকে জিজ্ঞেস করে
বাস খুঁজে পেলাম যখন তখন বাস এর বেশীরভাগ সীটই ভরে গেছে, তাও কোনমতে রুমি কে একটা
সীটে বসিয়ে, কোলে ক্যামেরার ব্যাগ দিয়ে আমি বেচারা দাড়িয়ে গেলাম। রুমি তাও বলল
তুমি বসে যাও আমি দাঁড়াচ্ছি। আমি বললাম - বস এমনিতে তো বাস এ বমি করে ফেল, তুমিই
বস। বলে ফেলে বুজলাম সিক্রেট টা ফাঁস করে ভালো কাজ করি নি। রুমি চোখ পাকিয়ে নীরব
ধমক দিলো। পাশে একজন বয়স্ক দাদু বসেছিলেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন – কোথায় যাওয়া হবে
দুটি তে? বললাম – যাবো আঁটপুর, রামকৃষ্ণ মিশনে। দাদু বললেন – বেশ বেশ, আমি তোমাদের
ঠিক নামবার আগে বলে দেব। কথায় কথায় আলাপ জমে উঠল। ভদ্রলোক স্কুল টিচার ছিলেন,
বর্তমানে রিটায়ার করেছেন। মেয়ের বাড়ী গিয়েছিলেন, বাড়ী ফিরছেন। বললেন সময় থাকলে
উনিও আমাদের সঙ্গী হতেন, কিন্তু ওনার বাড়ী ফেরার তাড়া আছে। বাস আপন ছন্দে ছুটে
চলেছে, চারিপাশের দৃশ্য খুব সুন্দর। গ্রামীণ জীবন যেমন হয় ঠিক তেমনই, যেন তুলি তে
আঁকা একখানি ছবি। আমরা দেখছি আর নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করছি, কিন্তু কনডাকটর
কাকা বলল আঁটপুর মঠ কে নামবে এগিয়ে আসুন, আর দুটো স্টপেজ আছে। অতএব দাদুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে
এগিয়ে গেলাম বাস এর দরজার দিকে। একটু বাদেই বাস নামিয়ে দিলো একদম মঠের সামনেই।
সকাল ১১:৩০
বাস থেকে নেমে একজন কে জিজ্ঞেস করতে
বলল – ওই তো রাস্তার ওপারেই মন্দির কমপ্লেক্স। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে ওপারে গিয়ে মন
ভরে গেল, অনেক গুলো ছোট ছোট মন্দির। রুমি জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা রাধাগোবিন্দ মন্দির
টা কোথায়? বললাম চল এগিয়ে গিয়ে দেখি, আমিও তো আগে আসিনি তাই একটু ঘুরে দেখতে হবে। টেরাকোটার
অপূর্ব নিদর্শন এই মন্দির গুলি, কয়েকটি শিব মন্দির ও দর্শন করলাম আমরা, পরে জেনে
ছিলাম সেগুলি যথাক্রমে - গঙ্গাধর, ফুলেশ্বর, জলেশ্বর, বাণেশ্বর ও রামেশ্বর৷কিন্তু আমাদের ভাগ্য বিরুপ তাই মুল মন্দির রাধাগোবিন্দ মন্দির দর্শন করা সম্ভব
হল না, কারন ১২টা থেকে ৩টে পর্যন্ত মন্দির বন্ধ থাকে৷ তাই অবশেষে বন্ধ দরজার এপার থেকে ছবি
তুলেই সন্তুষ্ট থাকতে হল আমাদের। মন্দিরের ঠিক সামনেই আছে একটি সুপ্রাচীন বকুল
গাছ, বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই বকুল গাছ টি। শোনা যায় স্বয়ং শ্রী রামকৃষ্ণদেব একবার
এই গাছ টির তলে বসে ছিলেন। রুমি ভক্তি ভরে প্রনাম করল, আর আমিও এই পবিত্র জায়গা স্পর্শ
করে ধন্য হলাম। ঘড়ির দিকে চোখ যাওয়াতে হঠাৎ বেশ খিদে অনুভব হল, রুমি কে জিজ্ঞেস
করাতে বলল আমি হাল্কা কিছু খাব এই ধরো কোন স্নাক্স। আচ্ছা গেরোতে পড়লাম, এখানে
স্নাক্স পাই কোথায়? শেষে একটি স্থানীয় দোকানে ডিম টোস্ট আর গরম চা খেয়ে শান্তি এলো
প্রানে।
রুমি জিজ্ঞেস করল – পেট পুজা
তো হল বাবু এবার কোথায় যাবো? বললাম – চল খড়ের ছাউনির চণ্ডীমণ্ডপ টি দেখে আসি। দেখে মন জুড়িয়ে গেল, অসাধারণ কাঠের কাজের
অন্যতম নিদর্শন। প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো এবং লোকমুখে শুনলাম এর গায়ে কাঠের
অসাধারণ কারুকার্য আছে সেটি নাকি কাঁঠাল কাঠের। কৃষ্ণরাম মিত্রের পিতামহ কন্দর্প মিত্র এই চণ্ডীমণ্ডপে
তাঁর গুরুদেবের সাথে মহামায়ার পূজা করেছিলেন। এছাড়া দোলমঞ্চ,
সারদামন্দির এসব ও দর্শন করলাম। বেশি ভিড় ও নেই, খুব সামান্য লোক জনই এসেছে এসব
দেখতে, কে জানে বাঙ্গালী ইতিহাস বিমুখতাই এর জন্নে দায়ী কিনা? অদূরেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ
ও শ্রীমা সারদাদেবীর যোগ্য শিষ্য, রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্বামী
প্রেমানন্দ অর্থাৎ বাবুরাম ঘোষের দূর্গা বাড়ি৷ এই বাড়িতেই স্বামী বিবেকানন্দ সহ
নয়জন গুরুভাই সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প নেন৷ ওখানে একজন মহারাজের সাথে
কথা বলে জানতে পারলাম যে এই দিনটিতে স্মরণ করে প্রতিবছর এখানে অনুষ্ঠান হয়, আর এখানকার দুর্গা
পুজাও খুব বিখ্যাত, অনেক দূর দুরান্ত থেকে লোক আসে৷ কথায় কথায় মহারাজ জিজ্ঞেস
করলেন যে আমরা অন্নভোগ গ্রহন করেছি কিনা, শুনে একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করাতে
মহারাজ হেসে বললেন এখানে প্রতিদিনই অন্নভোগ পাওয়া যায়। তবে আগে এসে কুপন সংগ্রহ
করতে হয়। বললেন একটু দেরি হয়ে গেছে ভাই তাই আজ তো আর হবে না। আমরা বললাম এর পরের
আবার আরও আগে এসে নিশ্চয়ই অন্নভোগ গ্রহন করব।
এবার ফেরার পালা, মনে অপূর্ণতা থেকেই
গেল - রাধাগোবিন্দ মন্দির দর্শন আর অন্নভোগ দুটি আমাদের ভাগ্যে হয়ে উঠল না। তবু
যতটুকু দেখলাম তাতে মন ভরে গেছে, টেরাকোটা বলতে আমরা বিষ্ণুপুর কেই জানি, কিন্তু
আঁটপুর তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় সমুজ্জ্বল। এখানকার মন্দিরগুলির
গায়ের টেরাকোটাগুলিতে ভারতের ইতিহাস পুরান এবং সর্বধর্ম সমন্বয়কে সার্থকভাবে
তুলে ধরা হয়েছে। তবে রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা ও চণ্ডী, বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, এছাড়াও
যুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্যও স্থান পেয়েছে । যুদ্ধের টেরাকোটা ভাস্কর্যগুলিতে
অশ্বারোহী,
গজারোহী এবং উটারোহী সৈন্যদের দেখা যায, এক কথায় অনবদ্য।
ফেরার বাসের জন্নে দাড়িয়ে থাকতে দেখে
একজন লোক বলল একটু এগিয়ে সামনের মোড়-এ যেতে, ওখানে নাকি বাস বেশি পাবো আর ফাঁকাও থাকবে।
অগত্যা গল্প করতে করতে এগুলাম, মোড়-এ এসে দেখি একটি ছোট মিষ্টির দোকান। আর তাতে
গরম গরম শিঙ্গাড়া ভাজছে, পেটুক মন খাবো খাবো করে উঠল। রুমি কে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল
ওকে চলো খাই। অতএব শিঙ্গাড়া অভিযান শুরু, খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখন দেখা মিলল
বাসের। তাই দোকানীর হিসাব মিটিয়ে বাসে উঠে ফিরে চললাম নিজ নিকেতনে। পিছনে পরে রইল অতীত
বঙ্গের এক সোনার ইতিহাস। বাস বেশ ফাঁকাই
ছিল, তাই বসার সীট পেতে অসুবিধা হয়নি। রুমির দিকে তাকিয়ে দেখি বেচারি বেশ টায়ার্ড,
আসলে বাস জার্নির অভ্যাস নেই যে। রুমি কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বুজে বলল এবার সামনের
দুর্গা পুজায় মাস্ট আসব এখানে, আর অন্নভোগ ও খাবো। আমি বললাম আসব তুমি রেস্ট নাও,
আর আমি ভাবি পুরানো দিনের কথা।
কিভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে সরাসরি আঁটপুর যাবার বাস আছে,
গাড়িতে এলে ৪৮ কিলোমিটার মতো৷ হাওড়া-তারকেশ্বর লোকালে
গিয়ে হরিপাল স্টেশনে নেমে ১০ নং বাসে আঁটপুর আসা যায়, এছাড়া ট্রেকারও আছে ৷ ১২টা থেকে ৩টে পর্যন্ত রাধাগোবিন্দ মন্দির বন্ধ থাকে, রামকৃষ্ণ মঠে অন্নভোগ
পাওয়া যায়, তবে আগে এসে কুপন সংগ্রহ করতে হয়। মঠে যোগাযোগের জন্নে ফোন করুন এই
নম্বরে - 03212- 259250
আঁটপুরের ছবি দেখার জন্নে
অনুরোধ করব নীচের লিঙ্কে visit করতে –
No comments:
Post a Comment