Tuesday 12 January 2016

একটি শেষ চিঠি আর কিছু কথা



একটি শেষ চিঠি আর কিছু কথা 

আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তসাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই ত সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকেও স্মরণ করার এই ত সময়।

কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমার ভাইবোনেরা, তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিএ্যহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙ্গে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহুর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহুর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করছিল। জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত সেই স্বপ্নের পিছনে আমি ছুটেছি। জানিনা কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষে পৌছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মত তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধু্রা- এগিয়ে চল। এগিয়ে চল- কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুন। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশির্বাদ করুন।

১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোন দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।
আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে- এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভিতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশির্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
বন্দে মাতরম্‌।

না এটা কোন সাহিত্যের পাতা থেকে তুলে আনা চিঠি নয়, এটা এক মহান বিপ্লবীর শেষ বানী। হ্যাঁ, এই চিঠি যুগনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের। সংস্কৃতিমনস্ক বাঙ্গালী  আমরা নিশ্চয়ই ভুলে গেছি এই মহান বিপ্লবী কে? ঠিকই তো ভুলে যাওয়া তাই আজ আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, তাইত দেশ আজ এতো দুর্নীতি, সমস্যায় ভরা। নইলে রত্নগর্ভা ভারত মা আমাদের, আমাদের তো দিক প্রদর্শনের যোগ্য মনিষীর অভাব নেই, তাহলে কিসের অভাব আমাদের? থাক আর প্রশ্নে কাজ নেই, প্রশ্নের কশাঘাতে বিবেক জাগে কি?

মাস্টারদার জীবন নিয়ে বলতে বসলে সময়ের সীমায় তাঁকে বাধা অসম্বভ।  তবু আমার মতো বেকুবের এই ধৃষ্টতা নিজ গুনে ক্ষমা করে দেবেন।  খুব মনে পড়ে যাচ্ছে বলিউড পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকরের বানান ছবি খেলে হাম জি জান সে এর কথা, চোখের সামনে যেন সব কিছু ঘটে চলেছে, যদি কেউ পারেন দেখে নিতে পারেন ছবি টি, খুব খারাপ লাগবে না।যাক ফিরে আসি যেটা বলতে চাইছি সেই প্রসঙ্গে।

ভারতের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় একটি দিন ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। প্রায় পৌনে ২০০ বছর আগে পলাশির প্রান্তরে যে-সূর্য ডুবে গিয়েছিল, কিছু তরুণের শৌর্যে-বীর্যে-বীরত্বে ও তাজা রক্তে স্নাত হয়ে তা আবার উদিত হয়েছিলো  চট্টগ্রামে। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও পুলিশের অস্ত্রাগারসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতর দখল করে নিয়েছিল তার পর সকলে সমবেত হয় পুলিশ অস্ত্রাগারের সামনের মাঠে। সেখানে উত্তোলন করা হয় জাতীয় পতাকা। চট্টগ্রাম বিদ্রোহ নামে খ্যাত ব্রিটিশশাসকের কলজেকাঁপানো এই কর্মযজ্ঞের সর্বাধিনায়ক ছিলেন স্কুলশিক্ষক সূর্য সেন। উত্তোলিত পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে ৩৬ বয়সী এই যুবক দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে চট্টগ্রাম এ মুহূর্তে স্বাধীন। এই ঐতিহাসিক ঘোষণার পরপরই স্বাধীন বিপ্লবী সরকারের প্রধান হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে সূর্য সেনের নাম ঘোষণা করা হলো। এর পরের ঘটনা আশা করি সবার এ জানা।

১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী রাতে সেখানে এক বৈঠকে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। রাত প্রায় ১০টার দিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনী ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে গুলি বিনিময় করে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত আর সুশীল দাসগুপ্ত পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। এরপর ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর করা হয়। অথচ মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি। ফাঁসীর পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়। ন্যায়প্রিয়, সুসভ্য ব্রিটিশ জাতির কি সুন্দর বিচার?  

শতবর্ষের পরাধীনতার অন্ধকার বিদীর্ণ করে সূর্যের মতোই উদিত হয়েছিলেন তিনি ভারতের পূর্বদিগন্তে। তাঁর তীব্র তেজে ক্ষণিকের জন্যে হলেও শুধু যে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকের দম্ভ চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তাই নয়, ভেঙে গিয়েছিল পরাধীন ভারতবাসীর প্রায় দু শ বছরের কুম্ভকর্ণের নিদ্রাও।আজ দেশের দুর্দিনে শুদু আকুতি এই যে - ফিরে এসো মাস্টারদা, তোমার স্বপ্ন, কাজ দুই অসমাপ্ত। তুমি ছাড়া কে করবে এই কাজ? তাই তুমি ফিরে এসো আবার।
 

1 comment:

  1. মুক্তির মন্দির সোপানতলে
    কত প্রাণ হলো বলিদান
    লেখা আছে অশ্রুজলে....

    ReplyDelete