Friday 11 November 2016

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সুন্দরবন - এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন আমরা


রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সুন্দরবন - এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন আমরা

“পৃথিবী খারাপ মানুষের কাজের জন্য ধ্বংস হবে না, ধ্বংস হবে তাদের জন্য যারা খারাপ মানুষের কাজ দেখে কিন্তু কিছু করে না” – আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের এই উক্তি তথাকথিত প্রতিবাদি, পরিবেশপ্রেমী, বুদ্ধিজীবী মানুষের জন্যে অবশ্যই প্রযোজ্য। 

বন্যপ্রাণ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের অনন্য এক মিলনস্থল আমাদের সুন্দরবন। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় গড়ে ওঠা এই ম্যানগ্রোভ অরন্যে যেমন পাওয়া যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার, স্বাদু/ মিষ্টি জলের ডলফিন, নোনাজলের কুমির, দুরন্ত হরিণ আরও কতশত জীবজন্তু, তেমনই সুন্দরী, গেওয়া, গরান প্রমুখ ম্যানগ্রোভ গাছ। ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা এই সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে আর বাকীটা আমাদের দেশে। অথচ এই সুন্দরবনেরই একেবারে নিকটে হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (BPDB), ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মিত হবে সুন্দরবনের থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে পশুর নদীর তীর ঘেঁষে এই প্রকল্পে ১৮৩৪ একর জমির সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে।

আমরা জানি উন্নয়নের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে বিদ্যুৎ, বাংলাদেশের উন্নতির লক্ষে বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকারি, আর প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ভারত যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা সাধুবাদের যোগ্য। কিন্তু এটা আমরা জানি যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জ্বালানী হচ্ছে কয়লা, এতে যে বিপুল পরিমাণে দূষণ ছড়াবে তার প্রতিকার হবে কিভাবে? রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে প্রয়োজন হবে আনুমানিক ৪৭ লক্ষ টন কয়লা – যা জাহাজযোগে নিয়ে আসা হবে ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। সুন্দরবনের বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলা পশুর নদীর উপর দিয়ে এই কয়লা বোঝাই জাহাজগুলো চলাচল করবে। এতে পরিবহনকালে কয়লার ভাঙ্গা টুকরা, তেল, ময়লা আবর্জনা সুন্দরবন সংলগ্ন জলে মিশবে। জাহাজ যাতায়াতের ফলে এর থেকে সৃষ্ট ঢেউয়ে পাড় ভাঙবে, উন্মুক্ত চলাচলের সুযোগে সুন্দরবনে চোরাশিকারী বাড়বে। এই বিপুল পরিমান কয়লা পোড়ানোয় তৈরী হবে বিষাক্ত ধোঁয়া, যাতে মিশে থাকবে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড। এছাড়া আর্সেনিক, পারদ, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, রেডিয়াম এগুলোর মারাত্মক দূষণ তো রয়েছেই।

অথচও দুই দেশেই মানুষের/ উন্নতির আগ্রাসনে সুন্দরবন ক্রমাগত সংকুচিত হলেও এখনও এই অঞ্চলকে, এখানকার মানুষ ও প্রাণী সমুহকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মায়ের মতো রক্ষা করছে এই সুন্দরবনই। এটা বোধহয় বেশ কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আয়লা আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। এটা আমাদের দুই দেশেরই দুর্ভাগ্য যে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা প্রদানকারী সুন্দরবনের অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত অবদানের মূল্য ঠিকমতো নির্ধারণ করতে পারি নি, নইলে সুন্দরবন না থাকলে এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে কত ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতো সেটা দুই দেশের কর্পোরেট বিজনেস মহল ও রাজনৈতিক কারবারিরা হয় করেনি নইলে নিজ স্বার্থের কারনে বিশ্লেষণ করতে দিতে চায় না।

কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের বিদ্যুতের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে ওইখানে ছোট ছোট টাইডাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করা যেতে পারে, প্রসঙ্গত ওই এলাকাটি একটি টাইডাল জোনের মধ্যে পড়ে। আমি পরিবেশ বিজ্ঞ্যানী নই, এই বিষয়ে আরও সুস্পষ্ট, সাইন্টিফিক যুক্তি/ দিশা পরিবেশ বিজ্ঞ্যানীরা দিতে পারবেন। কিন্তু আজ যখন বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মরোক্কোর মারাকেশ শহরে বৈঠকে বসেছেন পরিবেশবিদরা, আমরা আশা রাখতেই পারি এই বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ তাঁরা নিশ্চয়ই নেবেন? 

No comments:

Post a Comment