Tuesday 8 November 2016

অন্নদাতা সুখী ভব?


অন্নদাতা সুখী ভব?

কোনোমতে ট্রেনে উঠে ঠেলে থুলে ভিতরে এসে অভ্র দেখলো না তাঁদের গ্রুপের সবাই হাজির। সুরজিত গালাগালি দিয়ে বলল – শালা তাড়াতাড়ি বাড়ী থেকে বেরোতে পারিস না? ওইভাবে দৌড়ে কেউ ট্রেনে ওঠে? খসে যাবি তো বাবা। নে বস একটু জিরিয়ে নে। অভ্র কোনও কথা না বলে একটু হেঁসে বসে পড়ল, আসলে আজ তার মন টা ভালো নেই। অফিসে বেরোনোর আগে মধুমিতা মানে বউয়ের সাথে ঝগড়া করে বেড়িয়েছে সে। মধুমিতার আবদার এবারে তাঁকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতেই হবে, নইলে একটা বড় অ্যান্ডয়েদ ফোন চাই তার। তার সব বন্ধুর আছে, এই কি প্যাড দেওয়া ফোন আর চলছে না। মেয়ের গানের স্কুল থেকে বলে দিয়েছে একটা স্কেলচেঞ্জার হারমোনিয়াম কিনে দিতে, মেয়েটা ভালই গায় অভ্রর। অভ্র হিসেব কষে দেখেছে প্রায় ১৮-২০হাজার টাকার ধাক্কা, সে বেসরকারি ফার্মের অল্প মাইনের চাকুরে, হট করে এত টাকার ব্যাবস্থা করে কিভাবে? এই কথাটাই মধুমিতা কে বোঝাতে গিয়ে ঝগড়ার সৃষ্টি, ফলস্বরূপ লেটে স্টেশনে আসা। চিন্তা সুত্র ছিঁড়ে গেলো বিকাশের খোঁচায়, বিকাশ ফিসফিস করে বলে – এই কি এত ভাবছিস রে? শোন আজও দেবুদা আমাদের সবার কাছে ১০০০ টাকা ধার চেয়েছিল, আমরা কাটিয়ে গেছি। তোর কাছে চাইলে একদম দিস না। মালটা ফেরত দিতে ভোগাবে। বলতে বলতে উল্টোদিকের সিট থেকে দেবুদা মুখ বাড়িয়ে বলল – কি আজ লেটে কেন? শরীর ঠিক আছে তো? অভ্র মনে মনে বলল – ভ্যান্তারা ছেড়ে ঝেড়ে কাশও বাবা, মুখে বলল – না এই লেট হয়ে গেলো, আপনি কেমন আছেন দেবুদা? দেবুদা মুখ টা কাঁচুমাচু করে বলল – ভাই ভালো নেই, একটু টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, টা তোমার কাছে ১০০০ টাকা হবে, এই মাইনে পেয়েই দিয়ে দেবো কিচ্ছু ভেবনা। অভ্র বলল- না দাদা এখন তো হবে না, আপনি অন্য কার কাছে একটু্ দেখে নিন। দেবুদা শুকনো মুখে বসে পড়ল। পাশ থেকে অজয় বলল – শালা আবার পেট্রলের দাম ২৮ পয়সা বাড়ল, না দেখছি বাইকে চাপাই ছেড়ে দিতে হবে, মনে হচ্ছে সাইকেলেই স্টেশনে আসতে হবে এবার। নির্মলদা ফুট কাটল – এত সবে কলির সন্ধে, শুনছি গ্যাসের দাম ও বাড়বে। প্রতাপদা ওপাশ থেকে বলল – অচ্ছে দিন অ্যা গয়ে, বুজলে ভাই সাংসদদের মাইনে বাড়ছে। শুনে অজয় কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলে উঠলো – ওই হোক, আর আমাদের যে গত ৪ বছরেও স্যালারি বাড়েনি সেটার খোঁজ কে রেখেছে? কি বল অভ্র তোমাদের বেড়েছে? অভ্র শুকনো মুখে বলল – আর মাইনে বাড়ানো? চাকরি থাকবে কিনা কে জানে? 

(না নিছক কোনও গল্প লিখতে আমি বসিনি, হয়তো আসা যাওয়ার পথে এধরনের বারোমাস্যা আমরা শুনেই থাকি। মূল্যবৃদ্ধি আজ জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু এই নিয়ে কি কোনও প্রতিবাদ, আন্দোলন হয়? আমরা সীমান্ত সমস্যা, পাকিস্থান, হরেক উৎসব-মেলা নিয়ে মেতে আছি, টিভিতে আইপিএল, সিরিয়াল বিনোদনের কত কি? কিন্তু প্রদীপের নিচের অন্ধকার নিয়ে আমরা ভাবি না। প্রতিবাদের ভাষা আজ আমরা হারিয়ে ফেলেছি, আমাদের সামান্য স্বপ্ন - দুবেলা পেট পুরে অন্ন,  সুস্বাস্থ,  সুরক্ষিত একটা ছাদ,  পরনের বস্ত্র ও শিক্ষা। কিন্ত সেটুকুও চাওয়া বা পাওয়ার আশা রাখা যেন স্বপ্নের অতীত। সাধারণ আম আদমি খবরের কাগজে গ্যাসের দাম, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার খবরে চমকে ওঠে, ভাবে এই স্বল্প আয়ে কিভাবে চালাবে সংসার? ঝাঁ চকচকে ভারতের ভিতরে অনুজ্বল, ম্যাড়ম্যাড়ে একটা ভারত আছে সেটা কজন খোঁজ রাখে? যা চকচকে শপিং মল, মাল্টি প্লেক্স, রেস্তোরাঁ এসব দিয়ে ভারত কে বিছার করতে গেলে আমরাই ঠকে যাব। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের কথা কবে বুজবে জনদরদি নেতা ও নেত্রীবৃন্দ? একটু দেখে নেওয়া যাক জনতার ভোটে জিতে আসা জনতা জনার্দনরা সব কেমন আছেন? ভারতে একজন এমপি সারাবছরে – ৬ লাখ টাকা মাইনে, প্রতিদিন ২০০০ টাকা সংসদে হাজিরার জন্যে, ৫.৪ লাখ টাকা অফিস ও তার কর্মীর খরচ খরচা বাবদ পেয়ে থাকেন। এছাড়া অন্য সুবিধা গুলি হল – বিনা খরচে বাসস্থান, জল, চিকিৎসা ও ফোনের সুবিধা। ৩৪ টি প্লেনে যাতায়াতের সুবিধা, রেলে যাতায়াতের পাস। এছাড়াও এনাদের পরিবারও এই ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকেন। আর খোদা না খাস্তা, যদি পাঁচ বছরের পরে গদি না জুটলেও, পেনশন, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তো আছেই। কেউ একবার বলেছিল রাজনৈতিক নেতারা দেহত্যাগ না করলে গদিত্যাগ করেন না, সুতরাং পাঁচ বছর পরে রিটায়ারমেন্তের গল্প দূর অস্ত। বেস কয়েক বছর আগে একবার শুনেছিলাম তৎকালীন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করে বলেছেন, গ্রামে মাথাপিছু  প্রতিদিন ১৫ টাকা ও শহরে মাথাপিছু প্রতিদিন ২০ টাকা খরচ করতে পারলে পুরোপেট পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায়। চমৎকার স্যার ঠাণ্ডা ঘরে বসে এর থেকে ভালো আইডিয়া আসতে পারে না, জানিনা আজও এই রেটই বহাল আছে কিনা? আর একটি কথা জানলে হয়তো হাসি পাবে – আমাদের দেশে সবথেকে সস্তায় পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায় সংসদ ক্যান্টিনে। হ্যাঁ এটা সত্যিই, কিছুদিন আগেও সাংসদরা যারা এত কম আয় করেন, যে তাঁরা এক প্লেট ‘ফ্রায়েড ফিশ উইথ চিপস’ কিনতেন মাত্র ২৫ টাকায়। মাটন কাটলেট পেতেন আরও কমে, মাত্র ১৮ টাকায়। মশলা দোসা ৬ টাকায়! একবার ওই ক্যান্টিনে মধ্যাহ্নভোজন সেরেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভাত, রুটি, রাজমা, সার্সো কা সাগ, আলুর তরকারি আর দই খেয়ে তাঁকে দিতে হয়েছিল ২৯ টাকা। সংসদের ক্যান্টিনে ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে ১০ কোটি ৪০ লক্ষ, ২০১০-১১-এ ১১ কোটি ৭০ লক্ষ, ২০১২-১৩ সালে ১২ কোটি ৫০ লক্ষ এবং ২০১৩-১৪ সালে ১৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে কেন্দ্র। হিসেব বলছে, ভেজিটেবল স্ট্যু তৈরির উপকরণের বাজারদর প্রায় ৪২ টাকা। আর সেই খাবার মাত্র ৪ টাকায় কিনেছেন সাংসদেরা। অর্থাৎ ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় শতকরা ৯০ শতাংশ। এরপরেও আমাদের নেতৃবৃন্দ গ্যাসের উপর ভর্তুকি ছেড়ে দিতে আবেদন করবেন? সেন্টিমেন্তে সুড়সুড়ি দেওয়া লোভনীয় বিজ্ঞ্যাপনে কেন দেখতে হবে ভর্তুকি ছাড়া কেন উচিত? যেখানে মাছ, মাংস হোক বা ভাত-রুটি-বিরিয়ানি— সংসদের ক্যান্টিনে খাবার পাওয়া যায় সুলভে/ ভর্তুকিতে। জানিনা এখন এই চিত্রের পরিবর্তন এসেছে কিনা? মূল্যবৃদ্ধি রোখার পরিবর্তে এই ধরনের ক্যান্টিন দেশের সব জায়গায় খুলে দিলে আম আদমি চারবেলা পেট পুরে খেতে পারে।
 
মাফ করবেন আমি মাননীয় সাংসদদের অবমাননা করে কিছু বলছি না, ওনারা দেশের পথ প্রদর্শক, উন্নতির, আধুনিক ভারতের রূপকার ওনারা না হয় একটু সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেন তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এই আমরা মিডল ক্লাস মধ্যবিত্ত বা সমাজের নীচের তলার মানুষের কথা যদি একটু ভাবেন তাতে ক্ষতি কি? তাহলে প্রতিদিন তিল তিল করে যে যন্ত্রণা ভোগ করছি আমরা তার কিছু সুরাহা হয়। আজকাল তো নিউজ পেপারের পাতা উল্টালেই দেখা যায় অমুক শিল্পপতি, প্রভাবশালী ব্যাবসায়ি কর ফাঁকি, পিএফের টাকা, গ্রাচুইতির টাকা মেরে দেয়, ব্যাংকের পাওনা টাকা মেরে বিদেশে চলে যায়, চাপে পড়ে সাধারণ মানুষ। যেখানে ন্যায্য মজুরি, মাহিনা মেলে না, সেসব বেসরকারি ক্ষেত্রে একটু দৃষ্টিপাত করলে ভালো হয়। ২০১৬-র মে মাসের সরকারি পাইকারি মূল্য সূচক এবং সরকার প্রকাশিত বছর ভিত্তিক মুদ্রাস্ফীতির হারে দেখা যাচ্ছে, ডালে ৩৫.৫৬ শতাংশ, সবজিতে ২২.৯২ শতাংশ ও চিনিতে ২২.৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এরই সঙ্গে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার ৮ শতাংশেরও বেশি, যদি আমার দেওয়া তথ্যে ভুল থাকে সংশোধন কাম্য। আমাদের রোজকার খাদ্যদ্রব্য ডালের দাম আজ আকাশছোঁয়া। দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, কমছে কর্মসংস্থান। এমতাবস্থায় পরিত্রাণের পথ নিশ্চয়ই আমাদের মাননীয় নেতা ও নেত্রীবৃন্দই দেখাবে? হাজার হোক আপনারাই আমাদের প্রকৃত অন্নদাতা। আশা করব আমাদের এই আর্জি সহমর্মিতার সাথে বিবেচনা করা হবে, দেখবেন রাষ্ট্রদ্রোহী বলে তকমা লাগিয়ে দেবেন না যেন? জয় হোক নতুন ভারতের ও আমাদের নেতৃবৃন্দের - অন্নদাতা সুখী ভব।

No comments:

Post a Comment