Wednesday 2 November 2016

এক বিস্মৃত মহান দেশপ্রেমিকের কথা


এক বিস্মৃত মহান দেশপ্রেমিকের কথা

অনেককাল আগের কথা, বৃত্তাসুর বলে এক অসুর ছিল, সে ব্যাটা শিবঠাকুরের থেকে এক বর আদায় করল যে দেব, দানব, মানবের তৈরি প্রচলিত কোন অস্ত্রে তাঁর মৃত্যু হবে না। আপনভোলা শিব ঠাকুর তো বর দিয়ে খালাস, এদিকে বর পেয়ে বৃত্তাসুর আরও অত্যাচারী হয়ে উঠলো, ক্রমে সে দেবলোক অবধি অধিকার করে নিলো। তখন দেবতারা বিচারের আশায় ভগবান বিষ্ণুর কাছে গেলেন, সব শুনে ভগবান বিষ্ণু বললেন – তোমরা নৈমিষারণ্যে ঋষি দধীচির কাছে যাও, তাঁর অস্থি দিয়ে প্রস্তুত এক নতুন অস্ত্র বজ্র দ্বারাই বৃত্তাসুরের নিধন সম্ভব। দেবরাজ ইন্দ্র খুশীতে ডগমগ হয়ে ঋষি দধীচির কাছে ছুটলেন, দয়ালু ঋষি দধীচি সব শুনে তৎক্ষণাৎ যোগবলে দেহত্যাগ করলেন। এদিকে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা সেই অস্থি দিয়ে বজ্র তৈরি করলেন, যা দিয়ে অধর্মী, অত্যাচারী বৃত্তাসুরের বধ সম্ভব হল, আর দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর স্বর্গের সিংহাসন ফিরে পেলেন।

না ধান ভাঙ্গতে শিবের গীত গাইছি না, এটা উদাহরণ রুপে ভাবতে পারেন সবাই। আসলে আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, চারিপাশে শুদুই লোভী, সংকীর্ণমনা মানুষের ভিড়। তা স্বত্তেও দেশের ভিতরে, বাইরে এমন কিছু বিরল দেশপ্রেমিকের নিদর্শন পাওয়া যায় যাদের দেখলে শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। মন নিজেকেই প্রশ্ন করে বসে এও কি সম্ভব? একজন ভারতবাসী হিসেবে সেইসব দেশপ্রেমিকের ঋণ পরিশোধ অসম্ভব, তেমনই একজন হলেন রবিন্দর কৌশিক। নামটা খুব অচেনা তাই না, হবেই কারন রাষ্ট্র এঁদের ভুলিয়ে দেয় নিজ প্রয়োজনেই।

রাজস্থানের এক অখ্যাত শহর শ্রীগঙ্গানগরে ১৯৫২ সালের ১১ই এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন রবিন্দর কৌশিক, প্রথম জীবনে তিনি একজন সফল থিয়েটার অভিনেতা ছিলেন। সেই সুত্রে মাত্র ২১ বছর বয়সে অংশ নেন লখনউতে আয়োজিত এক জাতীয় নাটক কর্মশালায়, এই কর্মশালা থেকেই অন্যদিকে মোড় নেয় তাঁর জীবন। কারন এই নাট্য সম্মেলনেই তিনি চোখে পড়ে যান রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইঙ্গের (RAW) কিছু পদস্ত্র অফিসারের, তাঁর অভিনয় কুশলতা দেখে ঠিক করা হয় তাঁকে আন্ডারকভার এজেন্ট হিসাবে পাকিস্থানে পাঠানো হবে। এর পর তাঁকে দিল্লীতে পাঠানো হয় দুবছরের জন্যে RAW এর অধীনে কঠোর এবং নানাপ্রকার গোপন প্রশিক্ষণের জন্যে। কেমন ছিল সেইসব প্রশিক্ষণ? শারীরিক, অস্ত্র প্রশিক্ষণ ছাড়াও তাঁকে শিখতে হয় উর্দু, এবং কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষা। সৌভাগ্যক্রমে শ্রীগঙ্গানগরে বড় হয়ে ওঠার সুবাদে কৌশিক কয়েকটি ভাষা জানতেন যা পাকিস্থানের পাঞ্জাব প্রদেশের কথ্য ভাষা। এরপর তাঁকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব তথ্য সম্বন্ধে অবহিত করানো হয়, পড়ানো হয় কোরান। যখন তিনি আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবে পুরোপুরি তৈরি, ১৯৭৫ সালে কোনও এক ঝড়জলের রাতে পাকিস্থানের বর্ডার গার্ডদের চোখে ধুলো দিয়ে শত্রু দেশের মাটিতে পা রাখেন তিনি, নতুন নাম নেন নবি আহমেদ শাকির।

এর পরের অনেকটাই আমাদের অজানা, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সিভিলিয়ান ক্লার্ক হিসেবে যোগদান  করেন পাকিস্থান আর্মিতে, বিশ্বাস যোগ্যটা বাড়াতে বিয়েও করেন ‘আমানত’ নামে একজন মুসলিম মেয়ে কে, যার বাবা পাকিস্থান আর্মির অন্য একটি ইউনিটে দর্জি ছিল।

পরবর্তীকালে তিনি নিজ প্রতিভায় পাকিস্থান আর্মির উচ্চপদে উঠে আসেন, পাশাপাশি অত্যন্ত গোপনে এবং নিঃশব্দে চলতে থাকে একজন আন্ডারকভার এজেন্টের সব কাজ। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে পাক সরকারের ও সেনাবাহিনীর বহু গোপন তথ্য ভারতে পাচার করেন তিনি। বহুবার তাঁর পাঠানো তথ্যের জন্যেই পাক সেনা ও জঙ্গিদের বিভিন্ন হামলা ও পরিকল্পনা বানচাল করতে সমর্থ হয় আমাদের দেশ। এই কাজে তাঁর কোড নেম ছিল ‘ব্ল্যাক টাইগার’। কিন্তু ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে নেমে আসে বিপর্যয়, তাঁকে সাহায্য করার জন্যে পাকিস্থান পাড়ি দেয় আর একজন আন্ডারকভার এজেন্ট, যার কোড নেম ছিল ইনায়ত মসিহা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, কিছু ভুলের জন্যে তথ্য আদানপ্রদানের সময় ইনায়ত মসিহা ধরা পড়ে যায় পাকিস্থানি গোয়েন্দা বিভাগের হাতে। ইনায়ত মসিহা কে জেরা, টর্চার করে ‘ব্ল্যাক টাইগার’ এর আসল পরিচয় জানতে পারে পাকিস্থানের গোয়েন্দা বিভাগ। এরপরেই ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হন কৌশিক, এরপর শুরু হয় অকথ্য অত্যাচারের এক নির্মম কাহিনী। ১৯৮৫ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেই তদানীন্তন পাক সরকার, পরবর্তীকালে পাক সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে যা বদলে যায় যাবজ্জিবন কারাদণ্ডে। কিন্তু কোনভাবেই কোনও তথ্য ফাঁস করেননি এই দেশপ্রেমিক মানুষটি। একটিও কথা, তথ্য না বের করতে না পারার রোষে একবছর, দু বছর নয় টানা ১৬ বছর ধরে পাকিস্থানের বিভিন্ন যেমন শিয়ালকোট, লাখপত, মিলানওয়ালি প্রমুখ জায়গার কারাগারে অকথ্য, নির্মম অত্যাচার চালানো হয় তাঁর উপর। অবশেষে ১৯৯৯ সালের ২৬শে জুলাই মুলতানের নিউ সেন্ট্রাল জেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই অসমসাহসী বীরযোদ্ধা। পাক সরকারী নথিতে কারন হিসাবে অ্যাজমা, যক্ষ্মা, হৃদরোগের কথা উল্লেখ আছে, যার সত্যটা আমরা কোনদিনও জানতে পারব না, শোনা যায় জেলের পিছনেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়।

দেশের এই প্রকৃত বীরকে আমরা ভুলে গেছি, হয়তো সেটাই জাগতিক নিয়ম। নিশ্চয়ই এস্পিয়নেজ বা স্পাই জগতের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্র কোনদিনও এইধরনের এজেন্টদের স্বীকৃতি দেয় না, স্বাভাবিক নিয়ম কিন্তু যখন মেকি নায়কদের, সুবিধাবাদী নেতাদের নিয়ে মাতামাতির অন্ত নেই, চারিদিকে যখন সুবিধাবাদী, স্বার্থপর মানুষের এত ভিড় তখন কি আমরা একবারের জন্যে হলেও স্বরন করতে পারি না এই সব বীর দের? ২০১২ সালে ‘এক থা টাইগার’ সিনেমাটি তাঁর জীবনের অনুকরনেই বানানো। যদিও বাস্তবের কৌশিকদের কথা আমরা কতটুকুই বা জানি?

আজ দেশের পশ্চিমাংশে যখন আমাদের দেশের বীর সেনানীরা প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে পাকিস্থানের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে, তখন প্রণাম জানাই এই বীর শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিককে, সাথে অভিনন্দন জানাই সেই সব অগুনতি বীর সেনানী ভাইদের, গোয়েন্দা ভাইদের যারা আমাদের সুরক্ষায় প্রাণপাত করে লড়াই করে চলেছেন। জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম, ভারত মাতা কি জয়।

No comments:

Post a Comment