Sunday 13 November 2016

ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন


ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন

গতকাল আমিও ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম কয়েকটি ৫০০, ১০০০ নোট জমা দিতে, লম্বা লাইন দেখে একটু বিরক্তি হলেও পরে নিজেরই ভালো লাগলো শুনে যে আমার আগের বয়স্ক কাকুটিয়ও প্রায় দুই ঘণ্টা আগে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে। এবং তিনি অকুণ্ঠভাবেই সমর্থন জানাচ্ছেন কালো ও জাল টাকার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে। না ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়, অল্প কিছু ডাইনোসর প্রজাতির লোক (অবশ্যই হরিদাস বাঙালী) চিৎকার/ অভিযোগ, সরকারকে গাল পাড়ছিলেন, কিন্তু নিজেরাই হাস্যাস্পদ হচ্ছিলেন বাকি লোকেদের কাছে। বেশ কিছুটা সময় পরে নির্ধারিত ৪০০০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এই পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু টিভিতে অমুক দিদি, অমুক দাদার ক্ষোভ, বিপ্লবের বুলি শুনে  মনে এটাই প্রশ্ন এলো - ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিল করাতে আমাদের দাদা, দিদিদের থুড়ি নেতা/নেত্রীদের চোখে ঘুম নেই? আম আদমির হেঁশেল কিভাবে চলবে, কিভাবে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তাঁদের মুখে উঠবে এই চিন্তায় কেন তেনারা প্রানপ্রাত করে চলেছেন? আজ হঠাৎ কেন আম আদমির জন্যে এত দরদ? কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দল কেই দেখলাম না লাইনে দাঁড়ানো আম আদমির জন্যে পানীয় জল/ চা, বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যে ছায়া/ বসার বাবস্থা, গরীব অশিক্ষিত লোকে দের জমার স্লিপ লিখে দেওয়ার কোনও ক্যাম্প করতে? অবশ্য শুনলাম ব্যাঙ্কের সামনে জায়গায় জায়গায় বুথ খুলে প্রতিবাদ কর্মসূচী হবে। সাধু উদ্যোগ মানতেই হবে – কিন্তু সেই সব দিদি, দাদাদের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই, আশা করি ওনারা জবাব দেবেন নিশ্চয়ই? 

১) আম আদমি লম্বা লাইন দিয়ে সিনেমার টিকিট কাটতে পারে, জিওর সিম নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে পারে, রবিবারে খাসীর দোকানে লাইন দিতে পারে, পুজো, পার্বণে মোডের দোকান, রেস্তোরাঁতে লাইনে দাঁড়াতে পারে, ভোটের লাইনে আপনাদের মতো নেতা/ নেত্রীদের জেতাতে লাইনে দাঁড়াতে পারে আর কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা/ পরিবর্তন করাতে পারবে না? আলবাত পারবে, এই আম আদমিই কিন্তু এর আগেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে রেশন দোকানে ডিজিটাল কার্ড, আধার কার্ড করিয়েছে। তাহলে আজ ঠিক আপত্তিটা কোথায়? এই উদ্যোগ নেওয়ার সৎ সাহস আপনারা দেখাতে পারেননি না ব্যক্তিগত (দলগত) স্বার্থে ঘা পড়েছে তাই?  

২) দেশে কালো টাকা, জাল টাকার বিরুদ্ধে আপনাদের (ব্যক্তিগত/ দলগত) অবস্থান ঠিক কোথায়? এর আগে আপনাদের ঘোষিত কর্মসূচী কি ছিল বা এখনই বা কি আছে? 

৩) যে সকল নেতা/ নেত্রীরা বিদেশের কালো টাকা ফেরাতে এত তৎপর! তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন গত ৭০ বছরে কালো টাকার বিরুদ্ধে তাঁদের জিহাদের নমুনা কি ছিল? তাঁরা কি পদক্ষেপ নিয়েছেন এই উদ্দেশ্যে? যে তথাকথিত কালো টাকা সুইস ব্যাঙ্কে জমা আছে বলে এত হইচই, সেই সম্বন্ধে কি তাঁরা আজ জানলেন? এর আগে আপনারা কি শীতঘুমে ব্যাস্ত ছিলেন?

প্লীজ দোহাই আপনাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত স্বার্থের কারনে সাধারণ আম আদমি কে বলির বকরা করবেন না। যারা স্বেচ্ছায় এই কষ্ট মেনে নিতে প্রস্তুত তাঁদের দলে টানার চেষ্টা না করলেও কিছু সুবিধাবাদী, অসাধু লোকেদের নিজেদের পতাকার তলায় ঠিকই পেয়ে যাবেন। বিপ্লব তাঁদের নিয়ে করতে পারেন।

যদি রাষ্ট্র এই পদক্ষেপ না নিত তাহলে হয়তো আমরা জানতে পারতাম না –

১) কোন সুপুত্র তার অসহায় বৃদ্ধা মা বাবা কে এতদিন দেখে নি, অথচও এখন গিয়ে বলছে – এই নাও টাকা কাল সকাল সকাল ব্যাঙ্কে জমা করে দিও, বাবা কে ভালো ডাক্তার দেখিয়ো, দরকার পরলে আরও কিছু টাকা নাহয় আমি দিয়ে দেবো।

২) সমাজের হোয়াইট কালার উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা যারা এতদিন সমাজের নীচের তলার লোকেদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে এসেছে আজ তাঁদের উপকারের চেষ্টার কোনও খামতি নেই? উদ্দেশ্য একটাই যদি তাঁদের হাত ধরে কিছু কালো টাকা সাদা করে নেওয়া যায়, এরজন্যে উপঢৌকনের ডালিও প্রস্তুত।   

৩) দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কত বেহিসাবি টাকা জমা পড়েছে? আর এই অর্থ বর্ষে কত? যতদূর জানি ৬৭ হাজার কোটি টাকা, তাহলে? 

৪) অসাধু ব্যাবসায়িরা তাঁদের কর্মচারীদের আগামী ৬ এমন কি ১২ মাসের বেতনের টাকাও ক্যাশে অগ্রিম কেন দিয়ে দিচ্ছেন? অথচও পূর্বে এই কর্মচারী/ শ্রমিক ভাইটি পিতা বা মাতার চিকিৎসার জন্যে কিছু টাকা ধার/ অগ্রিম চেয়েও পায়নি।  

৫) যে ধনী আত্মীয়টি আগে অবহেলায় গরীব আত্মীয়ের মুখদর্শন করতো না সেই এখন তাঁকে মাখন লাগাচ্ছে যদি আড়াই লাখ করে কিছু টাকা সাদা করে দেয় সে। তার জন্যে অবশ্য যথাযথ মুল্য দিতে ধনী ব্যক্তিটি প্রস্তুত।

এরকম অনেক উদাহরন আশেপাশে পাওয়া যাবে একটু চেষ্টা করলেই।    

এটা ঠিকই সাধারণ মানুষের অনেক অনেক কষ্ট হচ্ছে, যেটা তাঁরা হয়তো দেশের স্বার্থের খাতিরে মুখ বুজে মেনেও নিচ্ছেন। কিন্তু অনেক বেশি কষ্ট তাঁদের হচ্ছে যারা কালো টাকা, জাল টাকার মধু এতদিন পান করে এসেছেন। এবং তাঁরা এই কথা ভেবেও আতঙ্কিত সঞ্চয় করে রাখা সেই মধুভাণ্ড রক্ষা কিভাবে করবেন? তাই এই প্রবাদ বোধ হয় আজ একদম ঠিক যে - “দেশের মধ্যে যখন চোর, দস্যু, ডাকাত, রাজদ্রোহীরা চিৎকার, চেঁচামিচি করবে, জানবে রাজা সুশাসন করছে -  মহামতি চাণক্য”।

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে/ স্বার্থে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মনের কষ্টের, দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে, তাই কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত। অধমের ধৃষ্টটা মার্জনীয়) 

No comments:

Post a Comment