Thursday 3 November 2016

ভাবের বাঙালি অথবা লোভী কাঙালির চুপকথা – পর্ব ১



ভাবের বাঙালি অথবা লোভী কাঙালির চুপকথা – পর্ব ১

এখন বাঙালী সুযোগ পেলেই ভাব ধরে তাও আবার দিন ও রাতের, ঋতুর পরিবর্তনে এমন কি বোধ হয় জোয়ার ভাটার সাথে পরিবর্তিত/ বিবর্তিত হয়। যদি এর কারন অনুসন্ধান করা যায় তাহলে দেখা যাবে স্বার্থ লাভের আশা কিংবা স্বার্থহানীর শঙ্কায় প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে/ বিবর্তিত হচ্ছে বাঙালী। ভালো ভালো ডারউইন সাহেব তো বলেই গিয়েছেন সময়ের সাথে বিবর্তিত না হলে মুছে যেতে হয় (যেমন ডাইনোসোরাসের ক্ষেত্রে হয়েছে) তাই রূপান্তর স্বাগত। বাঙ্গালীর আর একটি গুণ চোখে পরার মতো, বাঙালী নিজে অপরের দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারঙ্গদ, কিন্তু তাঁর মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বার্থের খোঁজ যাতে কেউ না পায়, সেই বিষয়ে যাতে কেউ মুখ খুলতে না পারে সেজন্যে তাঁর চেষ্টা তদ্বিরের কোনও ঘাটতি থাকে না।

"ধান ভানতে শীবের গীত" টাইপ গল্প হয়ে যাচ্ছে! যে কারনে এই গল্পের অবতারনা তা হলো, যেকোন ভন্ডামির মতো ভন্ড সেকুলারিজম বা মানবতাবাদও বিপদজনক। সম্প্রতি নিউজ পেপারের পাতা উল্টালে হোক বা সোশ্যাল মিডিয়াতে চোখ বোলালেই হোক দেখা যায় – রাষ্ট্রের দমন/ পীড়নের প্রতি একশ্রেণীর শিক্ষিত, উদারমনস্ক মানুষ গর্জে উঠেছেন বীরদর্পে, কোথাও তথাকথিত সেকুলারিজমের পক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন কেউ। আমি আগেও বলেছি আমি কখনই রাষ্ট্রকে একশো শতাংশ ক্লিনচিত দিতে পারি না, যখন রাষ্ট্রের মেকানিজমে আমার আপনার মতো আম আদমি বর্তমান তখন ভুল ত্রুটি হতেই পারে। কিন্তু কোথাও কোনও সংঘর্ষে সন্ত্রাসবাদীরা মারা গেলে গেলো গেলো রব না তুললেই কি নয়? সব সংঘর্ষই কি ভুয়ো? নাকি বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদী সাজার চেষ্টায় হিতাহিত জ্ঞ্যানশূন্য হয়ে পরেছি আমরা? আচ্ছা একটু দেখা যাক এই ধরনের সংঘর্ষে কারা মারা যাচ্ছে? কোনও প্রান্তিক চাষি, উপজাতির লোক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া আম আদমি? নাকি কোনও দাগী অপরাধী, যাদের অতীতে অপরাধের প্রমান/ যোগ আছে, জেল ভেঙ্গে, কর্তব্যরত নিরীহ রক্ষীকে হত্যা করে আরও বড় কোনও অপরাধ কে সংগঠিত করার উদ্দেশে পালিয়ে যাওয়া অপরাধী তাঁরা? যত মানবতাবাদ, নীতিকথা তাঁদের জন্যে যারা অতীতে অপরাধমূলক কাজে জড়িত, সাধারণ আ্ম আদমি্র হত্যার চক্রান্ত করে, সেই চক্রান্তের বাস্তব রুপ দেয় তাঁদের জন্যে? ইদানীং বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদীদের রোল মডেল কারা? বিক্ষোভের নামে কাশ্মীরে নিরাপত্তাবাহিনীর উদ্দেশে পাথর, গ্রেনেড, ধারাল অস্ত্র নিয়ে হামলাকারীরা? আর যেসব নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানরা মারা যাচ্ছেন কয় তাঁদের জন্যে তো বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদীদের কুম্ভীরাশ্রু বইতে দেখি না? বুরওয়ান ওয়ানি, ইয়াকুব মেনন, আফজল গুরু মারা গেলে এঁদের রাত্রে ঘুম চলে যায়? অথচও গঙ্গাধর দলুই, বিশ্বজিৎ ঘোরুই, তুকারাম আম্বলেদের কথা কতবার স্বরন করেছেন এনারা? অথচও কে এই বুরওয়ান ওয়ানি, ইয়াকুব মেনন, আফজল গুরু প্রমুখ সন্ত্রাসবাদীরা? কোনও মহাপুরুষ না দেশপ্রেমিক? তাহলে এই মেকি কান্না কেন?ফেসবুকে এই ধরনের পোস্টে বেশি লাইক পাওয়া যাবে, না নিজেকে উদারমনস্ক, সংখ্যালঘুপ্রেমী হিসেবে তুলে ধরা যাবে?

যারা দেশের বিচার বাবস্থার ভিত টলে যাওয়ার আশঙ্কায় সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করে দিচ্ছেন, তাঁদের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জোশ কি তাঁদের সব সময় এরকমই থাকে? প্রতিনিয়ত আমাদের চারিপাশে কতশত অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, মানবাধিকার কেন মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হচ্ছে, তারবেলায় এঁরা চুপ কেন? পাছে নিজের নিরাপত্তা, পরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়? নাকি দেশ, রাষ্ট্র বাবস্থা হচ্ছে সফট টার্গেট, এর বিরুদ্ধে মুখ খুললে নিজের ক্ষতি হবে না সেই জন্যে? যারা সাম্যবাদ ধার করে আনেন প্রতিবেশী চীন থেকে, ভোগবাদ আমদানি করেন পশ্চিমের উন্নত রাষ্ট্রগুলি থেকে, তাঁরাই অবহেলায় বলতে পারেন ভারত রাষ্ট্রে তাঁরা নিরাপদ নন, এখানে পদে পদে মানবাধিকার, সংখ্যালঘুশ্রেণীর উপর নির্মম অত্যাচার হয়ে চলেছে। সত্যিই তো কেএফসির বার্গার, ম্যাগনামের আইসক্রিম চুষতে চুষতে আরও উন্নত ভারতের স্বপ্ন দেখা কত সহজ? হয়তো ভারত রাষ্ট্রে বসবাস করি বলি এই স্পর্ধা, নইলে তথাকথিত উন্নত, গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রের সমালোচনা করলে কি হতে পারে সেটা বহুল প্রচলিত নিউজপেপারে চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়। আমরা দেশের দোষ ত্রুটি ধরার আগে নিজে দেশকে কি দিতে পেরেছি সেই হিসেব করেছি কোনদিন?

আমি কখনই অস্বীকার করতে পারি না রাষ্ট্রের ভুল হয় না, এমন অনেক ঘটনা থাকে যাতে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থের শিকার হয় সাধারণ মানুষ। সেই ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত, মেনে নেওয়া যায় না, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ অবশ্যই কাম্য। রাষ্ট্র ন্যাংটা হলে তাঁকে কাপড় পরানোর দায়িত্ব আমাদের কেই নিতে হবে কারন আমরা এই রাষ্ট্রেরই বাসিন্দা। কিন্তু মানবতাবাদের ধ্বজাধারীরা একবার তো ভেবে দেখবেন মানবতাবাদ তাঁদের জন্যেই যারা মানুষ, যারা মানুষের ভেকধারী হিংস্র পশু, যারা দেশের সংহতির পক্ষে বিপদজনক, আম আদমির রক্তের পিপাসু তাঁদের হত্যা করাই মানবধর্ম, যুগধর্ম। দেশে অতীতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী হামলাগুলি সাক্ষী, তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী, জেহাদিরা জাত ধর্ম জিজ্ঞেস করে হত্যা করেনি।       

খুব জানতে ইচ্ছে করে এইসব মানবতাবাদীদের কোনও নিকট আত্মীয়, ভালোবাসার কেউ যদি তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নির্মমভাবে মারা যেত কিংবা ধর্ষিত হতো, তখনও কি এত বড় বড় বুলি আওড়াতে পারতেন তাঁরা? খুব সম্ভবত নয়। আগুনের থেকে দূরে বসে আগুনের উত্তাপ অনুভব না করে আগুন কিভাবে নেবানো যায় সেই বিষয়ে তত্ত জ্ঞ্যান দেওয়াটা সহজ, ময়দানে নেবে আগুন নেভাতে সাহায্য করাটা অন্য ব্যাপার। 

আমি এমন বুদ্ধিজীবী, মানবদরদী শিক্ষিত ব্যক্তিদের জানি, যাদের খুব সাদামাটা প্রশ্ন করা হয়েছিলো – আপনারা তো বলেন ভারতে সাম্প্রদায়িকটার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে, অথচও প্রতিবেশী দেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, ভারতে নিজ ধর্মের লোক বিপন্ন এই জিগির তুলে অন্য সম্প্রদায়ের লোকের উপর হামলা হচ্ছে কই এই বিষয়ে তো আপনাদের কোনও বক্ত্যব্য শোনা যায় না? এতে ক্ষুব্ধ হয়ে একজন বলেছিলেন এইসব সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলবেন না আমি এই বিষয়ে কোনও কথা বলব না।

আমার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুসলমান, তাঁর মধ্যে একজন বাল্যবন্ধু, আমাদের বাড়িতে যতবার সে এসেছে একসাথে, এক প্লেটে খাবার খেয়েছি আমরা, ওদের বাড়িতে নিঃসঙ্কোচে ইদে খেতে গেছি, (আমাদের বাড়িতে নানান পুজো,অনুষ্ঠানে তারাও এসেছে) কাকিমা এক সাথে কোর্মা, ফিরনী, লাচ্চা খেতে দিয়েছে কই আমাদের মনে আজও তো কোনও ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়নি। আমি ও আমাদের মুসলমান বন্ধুরা খোলা মনে কখনও জঙ্গি ইস্যুতে পাকিস্থানের মুণ্ডপাত করেছি, আবার সেই দেশের গজলের, রান্নার সুখ্যাতিও করেছি, দেশ-ধর্ম বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। আসলে আমরা সাদা কে সাদা, কালো কে কালো বলেছি নিঃসঙ্কোচে, আমাদের সেকুলারবাদি, মানবতাবাদী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি। আজমল কাসাভ, আফজল গুরু, সালাউদ্দিন, মাসুদ আজাহার এরা সন্ত্রাসবাদী আগে, এদের ধর্ম পরে। আমি মনে করি না, কোনও ধর্ম অপর ধর্মের লোককে আঘাত করতে শেখায়, কোরান, গীতা নিয়ে যেসব লোকেরা বিবাদে জড়ায় তাঁরা কয়জন কোরান, গীতা পড়ে দেখেছে সন্দেহ আছে। 

অথচও বাঙালি বুদ্ধিজীবী, মানবদরদীরা ভোগের সময় যতটা না উল্লাস প্রকাশ করে, তার চেয়েও বেশি মাত্রায় করে ত্যাগের ক্ষেত্রে। তাদের আনন্দ প্রকাশের উল্লাসের তুলনায় শোক প্রকাশের কোলাহল অনেক তীব্র। তারা স্মরণে রাখার চেয়ে ভুলে যাওয়ার মধ্যে নিজেদের সার্থকতা প্রমাণের চেষ্টা করে। খোটা দেওয়ার অভ্যাস এবং ক্ষতস্থানে নুন ছিটিয়ে আনন্দ করাটাই তাঁদের অভ্যাস। তাই বোধ হয় প্যালেস্তাইনের মুসলমান উদ্বাস্তু বা লিবিয়ার যুদ্ধে জমিহারা মুসলিমদের জন্য, কাশ্মীরী মুসলমানদের উপর অত্যাচার করছে ভারতীয় সেনা এই ইস্যুতে রাস্তায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে মোমবাতি মিছিল করে, স্লোগান দেয় কিন্তু প্রতিবেশী দেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার কেন কমে আসছে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের দাবিতে, অন্যান্য ইস্যুতে সোচ্চার হতে পারে না। ধর্মের নামে ভনিতা বাঙালী বুদ্ধিজীবী, মানবদরদীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তাই তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াতে সেকুলারবাদি হয়ে উঠতে গিয়ে আদতে দেশের, সমগ্র দেশবাসীর ক্ষতি করে ফেলছেন এই উপলব্ধি কবে হবে কে জানে? অবশ্যই রাষ্ট্র স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে স্বাধীনতার জানালা বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু মেকি সেকুলার বা মানবতাবাদী হয়ে উঠতে গিয়ে আমরা আদতে রাষ্ট্রের, দেশবাসীর ক্ষতি করে ফেলছি নাতো? তসলিমা নাসরিনের কথায় বলতে পারি - আমার এখন লজ্জা নয় ভয় হয়।

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মনের কষ্টের, দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে, তাই কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত)

No comments:

Post a Comment