Sunday 20 November 2016

ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন – পর্ব ২


ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন – পর্ব ২

বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বেঁচে থাকলে তিনি “কমলাকান্তের দপ্তর”- এর সংশোধিত ও পরিমার্জিত সংকলন বের করতেন এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষত ‘মনুষ্য ফল’ সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা হয়েছিলো, বর্তমানে তাহা আরও সমৃদ্ধ হতো। সত্যি বাঙ্গালীর ন্যায় পালটিবাজ, বহুরুপী জাতি দুটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। না এই ধারণা আমার একার নহে, আমার মতো কম বেশি অর্ধশিক্ষিত, আমআদমির তো বটেই, এখন প্রশ্ন হল এই দিব্য উপলব্ধি হল কিভাবে?

গত কয়েকদিন ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে, ট্রেনে বাসে, চায়ের আড্ডায়, সব জায়গায় শিক্ষিত, মহাজ্ঞ্যানি বাঙ্গালীর তর্কালাপ, তদুপরি বিবিধ খবরের কাগজ (কি সব ক্যাচ লাইন তাঁদের – জনশত্রু, ভগবান কেন শয়তানকেও ভয় করে না, পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পরতে হয় ইত্যাদি ইতাদি), সর্ব ভারতীয়, নামি দামী নিউজ চ্যানেলের অমৃত বানী শুনে সব ঘেঁটে ঘ। ধাতস্ত হতে বেশ কিছুটা টাইম লেগে গেলো, তারপরেও এই মোটা বুদ্ধিতে বেশ কিছু প্রশ্ন রয়েই গেলো। 

প্রশ্ন-১) নিউজ পেপার ও চ্যানেলে প্রকাশ দেশীয় ক্যারেন্সির (জাল ও আসল সহ) চোদ্দ আনাই হল বড় নোট, মানে ৫০০ ও ১০০০ টাকার। অথচও যোজনা কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের বেশিরভাগ লোকই দিনে ২০টাকাও খরচ করতে পারে না। তাহলে ৫০০, ১০০০ টাকার নোটের অসাধু ব্যাবহারকারী কারা? নোট বাতিলে কাদের কষ্ট হচ্ছে বেশি?   

প্রশ্ন-২) নোট বাতিলের স্বপক্ষে অর্থ সচিবের যুক্তি – গত পাঁচবছরের দেশের অর্থনীতিতে হাই ভ্যালু নোটের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে অর্থ নীতির বহর বেড়েছে ৩০ শতাংশ। দেশে চালু ৫০০ টাকার নোটের সংখ্যা ৭৬ শতাংশ ও ১০০০ টাকার নোটের সংখ্যা ১০৯ শতাংশ, অথচও রিজার্ভ ব্যাংক বাজারে ছেড়েছে ৫০০ টাকার নোট – ১৬৫০ কোটি এবং ১০০ টাকার নোট – ৬৭০ কোটি। তাহলে এবার দেখে নেওয়া যাক দেশে কত কোটি টাকার বেআইনি ও জাল টাকার সমান্তরাল অর্থনীতি, যা বৈধ অর্থনীতির সাথে সমান ভাবে চালু রয়েছে। ৫০০ টাকার নোটের সংখ্যা ১৬৫০ কোটির মানে বৈধ ৮ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা চালু রয়েছে, ১০০০ টাকার নোটের সংখ্যা ৬৭০ কোটির মানে বৈধ ৬ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা চালু রয়েছে। এবার হাজার টাকার নোটের সংখ্যা ১০৯ শতাংশ বৃদ্ধির মানে হল – বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ১০০০ টাকার ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতিতে ১৪ লক্ষ ৩০০ কোটি টাকা চালু রয়েছে। অর্থাৎ তথ্য থেকে এটা পরিস্কার যে, ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোটের বৈধ অর্থ যেখানে ৯ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকা, সেখানে এই দুই ক্যারেন্সির নোট (বৈধ ও অবৈধ) মিলিয়ে এই অর্থের পরিমান ১৯ লক্ষ কোটি টাকার ও বেশি। এই অবস্থা কি উদ্বেগের নয়? এর বিরুদ্ধে আশু লড়াই কি দরকারি ছিল না? তাহলে যারা নোট বাতিলের বিরোধিতা করছেন তাঁরা কি জেনে বুঝেই জাল টাকার কারবারিদের সুবিধা করে দিচ্ছেন? না কি আরও বৃহৎ স্বার্থে ঘা লেগেছে তাঁদের? 

প্রশ্ন-৩) বর্তমান পরিস্থিতিতে আমআদমি অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম বাঁধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, এই তথ্যটি কি প্রধানমন্ত্রীর অজানা? প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবন কি সুরক্ষিত? না কারন যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, ব্যাংকে, এটিএমে নগদ টাকার যোগান স্বাভাবিক না হবে, ততই আমআদমি প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা করবেন যার ফল আগামী নির্বাচনের ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হবে, তার সাথে যোগ দেবে ভ্রষ্ট বিরোধী নেতানেত্রী, জাল ও কালো টাকার কারবারিরা, যাদের মৌচাকে ঢিল মেরেছেন প্রধানমন্ত্রী। হয়তো এই প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ভাইপো, মেয়ে জামাই, ছেলের বা ভাইদের স্বার্থ রক্ষা করতে হচ্ছে না তাই তিনি এত বেপরোয়া? ৭০ বছরের ব্যাধি ৫০ দিনে নির্মূল করা না গেলেও কিছুটা উপশম হবে এই আশা করা যেতেই পারে। কি বলেন ব্যাস্ত জননেত্রী ও নেতাবৃন্দ তৎসহ প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী মহল?   

প্রশ্ন-৪) দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুজী কালোবাজারিদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, বাস্তবে একজন কালোবাজারিকেও ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাতে পারেননি তিনি। সেই দেশে বর্তমানে কালোবাজারি, জালনোটের কারবারি বা অন্যান্য অসাধু বাবসায়িদের কি হাল? খবরের কাগজ ও নিউজ চ্যানেলে প্রকাশ, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে গরু পাচার, সোনা পাচার সহ যাবতীয় চোরাচালান প্রায় বন্ধ, কারন হিসেবে উঠে আসছে সেই ৫০০, ১০০০ টাকার প্রসঙ্গ। তাহলে কি ধরে নিতে হবে চোরাচালান বন্ধ হওয়াতে এক শ্রেণীর নেতা/ নেত্রী ও তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গ দের অসুবিধা হয়েছে আর সেই জন্যেই এত গেলো গেলো রব? এছাড়া দেশের বিভিন্ন্য জঙ্গি সংগঠন আজ মহা বিপাকে, কারন সেই বাতিল ৫০০, ১০০০ টাকার গল্প, কয়েকদিন আগে আবার একটি সর্ব ভারতীয় নিউজ পেপারে দেখলাম ৫০০, ১০০০ টাকার নোট পুড়িয়ে চা করে খেয়েছে উত্তর পূর্বের কোনও এক জঙ্গি সংগঠন। সেই একই ভাবে তোলাবাজ নেতা নেত্রী, বহু স্বনামধন্য চিকিৎসক, উকিল, অসাধু ব্যাবসায়ি আজ বিপাকে। ইনকাম ট্যাক্সের অতর্কিত হানায় উঠে আসছে কালো টাকার খনি। এছাড়া জাল নোটের কারবারিদের মাথায় হাত কিভাবে পড়েছে সে সম্পর্কে আজ সাধারণ মানুষ অবহিত, এছাড়াও কাশ্মীরে যেভাবে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর পাথর ছোড়া, আক্রমণের ঘটনঅ্যা হ্রাস পেয়েছে তার সম্ভাব্য কারন হিসেবে উঠে আসছে সেই বাতিল ৫০০, ১০০০ টাকার প্রসঙ্গ। তাহলে এত হট্টগোল, এত প্রতিবাদ কর্মসূচী এই শ্রেণীর লোকেদের স্বার্থরক্ষার জন্যে নয়তো? আজ অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জেগেছে তার প্রতিফলন আড্ডায়, মজলিশে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। 

প্রশ্ন-৫) সাধারণ মানুষ যথেষ্ট বিপাকে এই বিষয়ে দ্বিমত নেই, কিন্তু লাইনে দাঁড়ানো ১০০ জনের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু জনের ব্যক্তিগত সমস্যাকে ইচ্ছা করে ফোকাস কেন করা হচ্ছে? কেন বেশিরভাগ মানুষ যারা এই নোট বাতিলের স্বপক্ষে তাঁদের কথা তুলে ধরা হচ্ছে না কেন? ইচ্ছাকৃত ভাবেই কি তৈরি করা হচ্ছে অসন্তোষ/ মতামত যা আম আদমির বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এতে স্বার্থ কোন শ্রেণীর সেটাও খুঁজে বের করা দরকার।

প্রশ্ন-৬) যেসব দিদিমনি, দাদাভাইরা আজ আমআদমির দুঃখে, কষ্টে সমব্যাথি তাঁদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, চিটফ্যান্দে সর্বশ্রান্ত গরীব জনগণের জন্যেও কি একইভাবে তাঁদের প্রান কাঁদে? কিংবা তোলাবাজী, জাল নোট, চোরাচালান এসব কাজের বিরুদ্ধেও সমভাবে গর্জে ওঠেন? আজ দেশের অসংগঠিত ও সংগঠিত উভয় ক্ষেত্রের শ্রমিক, কর্মচারীদের দুরাবস্থা অনেকেরই জানা, কিভাবে তাঁরা সিস্টেমের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত, শোষিত হচ্ছে তাও অজানা নয় জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু এই নিয়ে ব্যাপক অর্থে কার্যকরী আন্দোলন কতটা হয়েছে বা হচ্ছে? কে জানে অতীতের ঘটনাবলী তো সেই সাক্ষ্য দেয় না, তাহলে কি তথাকথিত জনদরদি নেতা/নেতৃবৃন্দ শুদুমাত্র বিরোধী আসনে বসার মহান দায় পালন করে চলেছেন?   

ভারতবাসী হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা জাতীয় স্বার্থেও একজোট হতে পারি না। তাই বোধহয় সারজিক্যাল স্ট্রাইকের পরে কোনও জননেতা প্রমানের ভিডিও প্রকাশের দাবি তোলেন, অতীতে ১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক দল প্রচার করেছিলো যে চীন নয় ভারতই চীন কে আক্রমণ করেছে, এরকম আরও কত কি শোনা যায়? চিটফ্যান্দ থেকে জাল নোট, চোরাচালান সব কিছু থেকেই হাত ধুয়ে ফেলেতে উদ্যোগী রাজনৈতিক দলগুলি, সবাই অপরের উপর দোষ চাপাতে ব্যাস্ত – এইসব অনৈতিক কাজকর্ম আমাদের পার্টি অনুমোদন করে না, তাহলে কি পার্টির বিনা অনুমোদনে, ছত্রছায়ায় চলে এই সব কাজকর্ম? কি অদ্ভুত দেশ আমাদের তাই না? আস্তিনের সাপেদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল বোধহয় আমাদের এই ভারতবর্ষ। অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে আরে আগে দেশের বাইরে চলে যাওয়া কালো টাকা উদ্ধার হোক পরে দেশের ভিতরে জমে থাকা কালো টাকা উদ্ধার করুক সরকার। দেশের বাইরে কালো টাকা উদ্ধারে নিশ্চয়ই আরও সক্রিয় হতে হবে রাষ্ট্রকে, কিন্তু সেই আওয়াজ/ দাবি কি বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে যে শক্তিশালী ভারতের প্রয়োজন সেটা কি আমরা বুঝতে পারছি? ভিক্ষার আবেদনে বা অনুনয়ে কালো টাকা হয়তো আসবে না তার জন্যে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী, প্রভাবশালী দেশ হয়ে উঠতে হবে আর তার জন্যে দেশের ভিতরে চলে আসা ৭০ বছরের ক্যান্সার আগে সারান দরকার। এটা ভুলে গেলে চলবে না বিদেশের মাটিতে বা আকাশে কালো টাকা জন্মায় নি, এই বিপুল পরিমান কালো টাকা সৃষ্টি হয়েছে দেশের অভ্যন্তরেই, আর সেটাই বিদেশের মাটিতে পাচার করা হয়েছে। আজ যদি কালো টাকার উৎসে আঘাত হানা যায় তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো কালো টাকা বিদেশে পাচার করার প্রবণতা হ্রাস পাবে।  আজ ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সুবাদে আমরা জানতে পারছি এলাকার স্বনামধন্য চিকিৎসক, উকিল, ব্যাবসায়িদের প্রকৃত চেহারা, আয়কর ফাঁকি দিয়ে তাঁরা কোন নতুন ভারতবর্ষ গড়ে তুলছেন? আর তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় কারা আজ বেশি তৎপর দেশবাসী সেটা বুঝতে পারছে।

আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কত রকম কথা বলি, কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি এই জঙ্গিরা টাকা কোথা থেকে পায়? আসলে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকেই জাল নোটের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে থাকে, এবং বিগত কয়েক দশক ধরে এটা হয়ে চলেছে, যারা নোট বাতিলের স্বপক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন তাঁরা কি এর আগে এই ইস্যুতেও এইভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন? গত ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতির উদ্দেশে ভাষণে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন -  শুধু কি কালোবাজারি, দুর্নীতিগ্রস্ত, কালো টাকার আড়তদার? মাথায় সেদিন আকাশ ভেঙেছিল সন্ত্রাসের নেপথ্যে থাকা মদতদারদেরও। তাই সন্ত্রাসবাদের পাশাপাশি ভারতের অর্থনীতিকে দুর্বল করার জন্যে যারা জাল নোটের কারবারি তাঁদের ও ভালো রকম ধাক্কা দিয়েছে এই নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত, যার কমবেশি খবর নিউজ পেপারে ও নিউজ চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে। তাই যেসব ভারতীয় নাগরিকরা আইনমাফিক আয়কর দেন, সমস্ত রকম দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন, সন্ত্রাসবাদ, জাল নোট প্রভৃতি বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার তাঁরা যদি কিছু কষ্ট সহ্য করে কালো টাকা, জাল নোটের আতঙ্কমুক্ত এক সমাজের ছবি দেখতে চায় তাঁতে বিরোধী পক্ষের উষ্মার কোনও কারন আছে কি? তাই সবিনয় নিবেদন মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ব্যক্তিগত অসুবিধা, মতামত কে সবার মতামত বলে চালিয়ে দেবেন না।

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে/ স্বার্থে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মতন আরও কিছু ব্যক্তির মতামতের সপক্ষে যারা দুর্নীতিমুক্ত ভারতবর্ষ কে দেখতে চাই, তাই এই লেখায় কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত। অধমের ধৃষ্টটা মার্জনীয়, কৃপা করে দেশদ্রোহী/ পার্টি বিরোধী বা ম্যাওবাদির তকমা লাগিয়ে দেবেন না) 

No comments:

Post a Comment