Monday 28 November 2016

ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন – পর্ব ৩


ঘোলাজলের রাজনীতি ও কিছু প্রশ্ন – পর্ব ৩

কিছু বাঁকা প্রশ্নের তীর উড়ে আসছে, আমি নাকি কোনও একটি নির্দিষ্ট পার্টির হয়ে, তাঁদের সপক্ষে কলম ধরেছি। অভিযোগ গুরুতর সন্দেহ নেই, আত্মপক্ষ সমর্থনে ঢাক পেটানোর অভ্যাস কোনও কালেই ছিল না, তবু সবিনয়ে জানাই – আমি কোনও পার্টির বা ভাবনার দলদাস নই, আমি কোনও একটি ইস্যু, আর তার সপক্ষে নেওয়া কিছু পদক্ষেপের প্রশংসা বা সমর্থন করেছি মাত্র, এই আমার অপরাধ। যাক যার যা ভাবনা নিজের কাছে আমি তো কারও ভাবনার পরিবর্তন ঘটাতে পারব না, সেরকম কোনও প্রচেষ্টাও আমার নেই, অতএব একলা মাঝি বেয়ে চল আপন তরী জীবন মাঝে।
  
স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ভারতের শাসন ক্ষমতায় সব থেকে বেশি সময় কেটেছে বিশেষ একটি পরিবারের, একটি দলের হাত ধরেই, হ্যাঁ আমি নেহেরু- গান্ধী পরিবারের তথা কংগ্রেসের কথাই বলছি। আমরা অনেকেই জানি ব্যাংক ন্যাশালাইজেশন হয়েছিল ১৯৬৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরেই, অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা সেই সময় থেকেই। আর বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ শ্রী মনমোহন সিংহের পথচলাও সেই সময় থেকেই। সংক্ষেপে একটু দেখে নেওয়া যাক - Chief Economic Adviser হিসেবে ১৯৭২ সালে থেকে ১৯৭৬ সাল, এরপরে ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল অবধি Reserve Bank Governor হিসাবে কাজ করা, Planning Commission Chairman হিসাবে ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল অবধি দায়িত্বভার সামলানো, তারপর ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল অবধি Finance Minister হিসাবে কার্যভার গ্রহন, এরপরে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল অবধি Prime Ministers of India হিসাবে দায়িত্বভার সামলানো। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে Finance Minister এর পদ অলঙ্কিত করেছেন শ্রী প্রণব মুখারজি তথা শ্রী পি চিদাম্বরন মহাশয়দের মতো প্রবাদপ্রতিম অর্থনীতির কিংবদন্তীরা। তাহলে আজ এই অভিযোগ উঠছে কেন যে – গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা আজও অমিল? এতদিন কি ওনারা এই বিষয়ে অনভিজ্ঞ্য ছিলেন? দেশ কে সুগঠিত করতে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ছড়িয়ে দেননি কেন? কেনই বা আজ গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা অমিল এই ধুয়ো তুলে নোট বাতিলের বিরোধিতা করা হচ্ছে?

আমরা জানি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুজী কালোবাজারিদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, বাস্তবে একজন কালোবাজারিকেও ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাতে পারেননি তিনি। এরপরেও তো কংগ্রেস শাসনে দীর্ঘদিন ভারতবর্ষ ছিল, কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিলো কালোবাজারি, জাল নোট বন্ধে?

জাল নোট সংক্রান্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে শেষ সাড়ে তিন বছরে দেশজুড়ে এটিএম এবং ব্যাঙ্ক থেকে বের হওয়া জাল নোটের সংখ্যাটা ১৯ লক্ষ। যার মোট মূল্য ১৪৪ কোটি টাকার কাছাকাছি। অর্থাৎ, গত সাড়ে তিন বছর ধরে এই বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাঙ্ক এবং এটিএম মারফৎ বাজারে ঘোরাফেরা করছিল। শুদু এখানেই শেষ নয়, টাকার হিসেবে একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে আরবিআই। সেখানে বলা হয়েছে ওই জাল নোটের মধ্যে বাজারজুড়ে -
১০০ টাকার জাল নোটের সংখ্যা ছিল ৫.৪২ লক্ষ, যার মূল্য ৫৪.২১ কোটি টাকা, ৫০০ টাকার জাল নোটের সংখ্যা ছিল ৮.৫৬ লক্ষ, যার মূল্য ৪২.৮ কোটি টাকা, ১০০০ টাকার জাল নোটের সংখ্যা ছিল ৪.৭ লক্ষ, যার মূল্য ৪৭ কোটি টাকা। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত কি এই জাল নোট এর রমরমা বাজার কে ধাক্কা দেয় নি?

আমরা সবাই জানি সন্ত্রাসবাদ আজ ভয়ংকরতম হয়ে দেখা দিয়েছে, এর জন্য বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু আমরা কি কোন দিন ভেবেছি? এই জঙ্গিরা টাকা কোথা থেকে পায়? আসলে আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ থেকেই জাল নোটের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে থাকে। বেশ কয়েক বছর ধরে এটা হয়ে চলেছে, যেটা কোনও সরকারেরই অজানা নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কিরেন রিজিজুর বিবৃতি অনুযায়ী পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর জাল নোট এদেশে প্রবেশ করানোর যে কারবার চলছিল, তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ পত্রে মালদহের কালিয়াচক, সীমান্ত এলাকায় গাঁজা, আফিম ইত্যাদির যে চোরা চালান চলছিলো তা আজ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। এর কৃতিত্ব কি নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের নয়?

যদি একটু তলিয়ে ভাবা যায় তাহলে দেখা যাবে ৮৫ শতাংশ নোট বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী যে আঘাত হেনেছেন, তাতে কিন্তু সবচেয়ে ঘায়েল হয়েছে যে অংশ তা বিজেপি’রই প্রধান ভোটব্যাংক বলে পরিচিত, এককথায় মারোয়ারি/ অবাঙালী ব্যবসায়ীরা। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ করার কি অবকাশ আছে? প্রভুত অর্থনীতি জ্ঞ্যানের অধিকারী হয়েও দশ বছরে সামান্য সিদ্ধান্ত নিতেও হাত কেঁপেছে পূর্বতন প্রধানমন্ত্রীর সে তুলনায় এই পদক্ষেপ কি সমর্থনযোগ্য নয়? বিরোধী পক্ষ এখন বলছে কালো টাকা উদ্ধার অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করা হয়েছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। তাহলে কি সর্বভারতীয় নিউজ পেপারে বিজ্ঞ্যাপন দিয়ে, নিউজ চ্যানেলে কয়েকদিন আগে থাকতে প্রচার করে নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হত? আগে থাকতে জানানো হলে ঘর গুছিয়ে নিতে সুবিধা হতো কি? লোক খেপানোর সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জনমত নিজেদের দিকে ঘোরানো যাচ্ছে না বলে কি জনমোহিনী, চতকদারি রাজনীতির কারবারিরা এত ভীত? এই জন্যে সামান্য বিতর্ক, সমালোচনা তাঁদের সহ্য হচ্ছে না, প্রতিপক্ষ কে নানা ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলছে, এটা অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে? আমিতো কলা খাইনি’ এই গোত্রের হয়ে যাচ্ছে না?  

প্রধানমন্ত্রীর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপটির পর কত কালো টাকা উদ্ধার হবে বা জাল নোটের কারবারে কতটা টান পড়বে—তা হিসাব কষে হয়তো বলা সম্ভব নয় কিন্তু বড়সড় একটা ধাক্কা যে এই কালো টাকা এবং জাল টাকার কারবারিদের উপর পড়েছে তা তাঁদের পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিবিদদের লম্পঝম্প আর বংশবদ মিডিয়ার অবস্থা দেখলে সহজেই অনুমেয়। উপরন্তু এই পদক্ষেপের ফলে প্রধানমন্ত্রী যদি দেশের অভ্যন্তরে অন্তত ৪০ শতাংশ কালো টাকাও উদ্ধার করতে সক্ষম হন—তাহলেই দেশের অর্থনীতি অন্য মাত্রা পাবে। আমরা আম আদমি সেই দিনের অপেক্ষায় বসে আছি। জয় হিন্দ। বন্দেমাতরম।  

(আমার এই লেখা কারও ভাবাবেগে/ স্বার্থে আঘাত দেওয়ার জন্যে নয়, অপিতু এই লেখা আমার মতন আরও কিছু ব্যক্তির মতামতের সপক্ষে যারা দুর্নীতিমুক্ত, শক্তিশালী ভারতবর্ষ কে দেখতে চাই, তাই এই লেখায় কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত। অধমের ধৃষ্টটা মার্জনীয়, কৃপা করে দেশদ্রোহী/ পার্টি বিরোধী বা ম্যাওবাদির তকমা লাগিয়ে দেবেন না) 

No comments:

Post a Comment